বলশেভিকবাদের সেরা দুশমন ট্রটস্কি (দ্বিতীয় পর্ব) - বোধায়ন রায়








(এই প্রবন্ধটি “Towards A New Dawn…the other voice of the people magazine”-এ ২০১২ সালের জানুয়ারি – ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটিকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন চারুদত্ত নীহারিকা রজত)


(দ্বিতীয় পর্ব)


লেনিনবাদ বলে যে, পুঁজিবাদের ফলে সৃষ্টি হয় অসম রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিকাশ এবং যার ফলে প্রথমে একটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৫ সালে লেনিন লিখলেন, “পুঁজিবাদের একটি চরম নিয়ম হল অসম অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিকাশ। এই কারণে, এক বা একাধিক পুঁজিবাদী দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় সম্ভব হয়। পুঁজিপতিদের ক্ষমতাচ্যুত ও নিজেদের সমাজতান্ত্রিক উৎপাদনকে সংগঠিত কোরে, সেই দেশের বিজয়ী প্রোলেতারিয়েত  বিশ্বের অবশিষ্ট পুঁজিবাদী দেশগুলির বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায় এবং অন্যান্য দেশের নিপীড়িত শ্রেণীগুলিকে আকর্ষিত করে ও সেই সব দেশে, পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানকে জাগ্রত করে এবং প্রয়োজনে, সশস্ত্র বাহিনীকে সেই দেশের নিপীড়ক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।“

যদি একটি দেশের প্রোলেতারিয়েত তার দেশের বুর্জোয়াদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে সফল হয়, যখন অন্যান্য দেশগুলিতে সেই ধরণের বিপ্লবী শক্তি বিকশিত হয় নি বা, বুর্জোয়ারা বিপ্লবকে দমন করতে সফল হয়েছে তখন, ট্রটস্কির তত্ত্ব আন্তর্জাতিক প্রোলেতারিয়েতের বিজয়ী অংশের জন্য শুধুই পরাজয়ের পূর্বাভাস দিতে পারে এবং প্রোলেতারিয়েতকে হতদ্যম ও বিপথু করে। এই পরিস্থিতিতে লেনিনবাদ আমাদের সঠিক সমাধানটি দেয়; যদি বিকশিত দেশে বিপ্লব ব্যর্থ হয় তখন প্রোলেতারিয়েত, কৃষকদের সাথে তার জোটকে মজবুত করবে এবং একটি দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। ১৯২১ সালে R.C.P.(B)-র দশম সম্মেলনে লেনিনের একটি দলিলে বলা হচ্ছে, “ এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, একটি দেশ, যেখানে জনগণের একটি বিপুল অংশ ক্ষুদ্র কৃষি উৎপাদক, সেখানে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একমাত্র এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে একটি সর্বাত্মক ও বিশেষ উদ্বর্তনকালীন পদক্ষেপ গ্রহণ করবার মধ্যে দিয়ে, যেটি আবার চূড়ান্ত ভাবে বিকশিত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে, যেখানে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই শিল্পের বা কৃষির মজুরী-শ্রমিক, সেখানে অবান্তর হিসাবে বিবেচিত হবে। পূর্ণ বিকশিত পুঁজিবাদী দেশগুলির একটি বহু দশক ধরে বিকশিত কৃষি-শ্রমিক রয়েছে। একমাত্র এই শ্রেণীই সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভাবে সমাজতন্ত্রে উদ্বর্তনকে সহায়তা করতে পারে। একমাত্র সেই দেশগুলি, যেখানে এই শ্রেণীটি যথেষ্ট ভাবে বিকশিত হয়েছে, সেখানেই, দেশ ভেদে উদ্বর্তন-প্রক্রিয়া ব্যতিতই, পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে, সরাসরি ভাবে যাওয়া সম্ভব। আমরা অজস্র লেখাপত্রে, জনসভায় এবং আমাদের সংবাদপত্রে দেওয়া সমস্ত বিবৃতিতে একথা জোর দিয়ে বলেছি যে, রাশিয়াতে এই পরিস্থিতি নেই। এখানে শিল্প-শ্রমিকরা সংখ্যালঘু এবং ছোট কৃষকই হল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এইরকম একটি দেশে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিজয়ী হতে পারে একমাত্র দুটি শর্তের যেকোনো একটির পূরণের দ্বারা। প্রথমত, যদি এক বা একাধিক উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশ একে যথাসময়ে সমর্থন দেয়। আপনারা একথা জানেন, আমরা অতীতের তুলনায় এই শর্ত পূরণ করবার অনেক বেশি চেষ্টা করেছি কিন্তু, তাকে বাস্তবায়িত করবার কাছাকাছিও যেতে পারি নি। দ্বিতীয় শর্তটি হল, একনায়কতন্ত্র প্রয়োগ করছে যে প্রোলেতারিয়েত শ্রেণী অর্থাৎ, রাষ্ট্র ক্ষমতা যে ধারণ করছে তার সাথে, কৃষিজীবী জনতার অধিকাংশের একটি জোট।“ লেনিন আরও বললেন, “আমরা জানি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য দেশে বিপ্লব সংঘটিত না হচ্ছে, কৃষকদের সাথে এই মৈত্রী-ই রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে রক্ষা করতে পারে।“ এটি আরও উল্লেখ করে, বিকশিত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি ব্যতিত, বিশেষ উদ্বর্তনকালীন পদক্ষেপের, যা ট্রটস্কির এক লাফে সমাজতন্ত্রের যে কল্পনা, তাকে বাতিল করে।


ট্রটস্কির রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশই স্পষ্ট সুবিধাবাদ এবং ইতিহাসের বিকৃতির দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে। এগুলির বিরুদ্ধেও ১৯১১ সালে লেনিন আঘাত করেন। ১৯১১ সালে লেনিন লিখলেন, “প্লেনারি সভার দ্বারা নিযুক্ত স্কুল কমিশনের নির্দিষ্ট নির্দেশ, কোনও পার্টি-বক্তা স্ফিরদ ফ্যাকশনাল গোষ্ঠীতে যাবে না – এর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচারন করে বিশ্বাসঘাতক ট্রটস্কি সেখানে যায় এবং তাদের সাথে একটি সম্মেলনের পরিকল্পনার ব্যাপারে আলোচনা করে। এই পরিকল্পনাটি বর্তমানে স্ফিরদ-গ্রুপ একটি লিফলেটের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছে। এবং এই হলো সেই বিশ্বাসঘাতক, যে নিজের বুক বাজিয়ে গর্বের সাথে, পার্টির প্রতি তার আনুগত্যকে প্রকাশ করে দাবি করছে যে, তিনি স্ফিরদ এবং বিলোপকারীদের সামনে নত হন নি। এটাই হলো বিশ্বাসঘাতকের নির্লজ্জতা।“ এবং “এই ঘটনাকে ট্রটস্কির মতন লোকেদের কাজকম্মের সাথে তুলনা করুন, যে “সহমত” এবং বিলোপকারিদের বিরুদ্ধে তাদের বৈরিতা নিয়ে চিৎকার করে। আমরা এইসব কাজকম্মগুলোকে ভালো মতনই চিনি; এই লোকগুলো সপ্তম সুরে চিৎকার করে বলে যে তারা “বলশেভিকও না, মেনশেভিকও না”, তারা আসলে সমাজ-গণতন্ত্রী”; তারা হিংসুটের মতন শপথ করে ও দিব্যি কেটে বলে, যে তারা বিলোপবাদের শত্রু এবং বেআইনি R.S.D.L.P.-র সমর্থক; তারা, পোত্রোসভরা, গলাবাজি করে অপদস্ত করে তাদের, যারা বিলোপবাদীদের মুখোশ খুলে দেয়; তারা বলে যে, বিলোপবাদ-বিরোধীরা বিষয়টিকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে; কিন্তু পোত্রোসভ, মারতভ, লেভিটস্কি, দন লারিন প্রভৃতি নির্দিষ্ট বিলোপবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও ট্যাঁ-ফোঁ করে না।“ এবং “অতএব এটি স্পষ্ট, যে ট্রটস্কি এবং তার মতন “ট্রটস্কিবাদী ও মীমাংসাকারী”-রা যেকোনো বিলোপবাদীদের চেয়ে বেশি অনিষ্টকারী; গোঁড়া বিলোপবাদীরা তাদের মতামত সরল ভাবে রাখে এবং শ্রমিকদের পক্ষে, তারা ভুল কিনা, সেটা নির্ধারণ করা সহজ হয়। অপরদিকে, ট্রটস্কিরা শ্রমিকদের ধোঁকা দেয়, শয়তানিটাকে লুকিয়ে রাখে এবং ফলে, তাদের বদমায়েশিটাকে প্রকাশ করা ও তার উপশম করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যিনিই ট্রটস্কির ছোট্ট গ্রুপকে সমর্থন করেন, তাঁরা আসলে সমর্থন করেন শ্রমিকদের প্রতারনার এবং বিলপবাদীদের আড়াল করবার পলিসিকে। রাশিয়াতে পোত্রোসভ এবং কোম্পানির পূর্ণ স্বাধীনতা এবং তাদের কাজকর্মকে বিদেশ থেকে বিপ্লবী বুকনিবাজি দিয়ে আড়াল করা – এটিই হল ট্রটস্কিবাদের সারৎসার।“ 

পরবর্তীতে, ট্রটস্কি এটা দাবি করবার চেষ্টা করেন যে, “ট্রটস্কিবাদ” হল একটি নিন্দাজনক-তকমা যেটা “স্তালিনবাদীরা” আবিষ্কার করেছেন এটা দেখাতে যে, ট্রটস্কির চিন্তাধারা লেনিনের থেকে আলাদা। তাই তার অনুগামীরা নিজেদের বলশেভিক-লেনিনবাদী বলতেন, যদিও মজার ব্যাপার হলো, এই দুটির কোনটাই তারা নন। কিন্তু “ট্রটস্কিপন্থী” - এই আপাত অসম্মানজনক তকমাটি লেনিন, তার ট্রটস্কির বিরুদ্ধে সংগ্রামের গোড়াতেই ব্যবহার করেছিলেন, যেটা আমরা আগেই দেখেছি। ১৯১৪ সালে লেনিন লিখেছিলেন, “কিন্তু পরিহাস বাদ দিয়ে (যদিও ট্রটস্কির অসহ্য কোটেশন-বাজির হালকা অথচ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর করবার একমাত্র পথ হল পরিহাস করা)” “ট্রটস্কিবাদ”-এর সামনে “আত্মহত্যা”-ও একটি ফাঁকা বুলি।   

১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে, ট্রটস্কি, জর্জিয় মেনশেভিক নিকলাই চিইয়াইতজ-কে একটি চিঠিতে বলেন, “বর্তমান সময়ে লেনিনবাদের সম্পূর্ণ ধাঁচাটি-ই গড়ে উঠেছে মিথ্যা এবং ভ্রান্ত্রির উপর এবং সেটি নিজের মধ্যেই নিজের ধ্বংসের বিষাক্ত উপাদানাগুলিকে লালন করে চলেছে”। তিনি আরও লেখেন, “লেনিনের পরিকল্পিত ভাবে উস্কে দেওয়া শোচনীয় কলতলার ঝগড়া, যেটা আদপে একটা পুরানো মাতব্বরি, যে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের যা কিছু পিছিয়ে পড়া তার এক পেশাদার শোষক, এটাকে একটা বুদ্ধিহীন আবেশ বলে মনে হয়।“ এটি স্পষ্ট ভাবে দেখায় যে, ট্রটস্কি তার প্রতিপক্ষকে সবচেয়ে অবমাননাকর শব্দে আক্রমণ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাই, স্তালিনের উপর তার পরবর্তী আক্রমণগুলিতে অবাক হবার কিছুই নেই এই কারণে যে, ট্রটস্কি এমনকি মহান লেনিনকেও,  তার স্বভাবসিদ্ধ কুৎসা হতে নিস্তার দেন নি। চিইয়াইতজ-কে লেখা চিঠিটি, ১৯২১ সালে রাশিয়ার পুলিশের মহাফেজখানাতে পাওয়া যায়। পার্টির ইতিহাসের কমিশনের সভাপতি ওলমিনস্কি যখন তাকে, এটি প্রকাশ করা হবে কিনা জানতে চান, তখন “The Stalin School of Falsification”-এর ভবিষ্যৎ লেখক এবং নারাজ ব্যক্তিটি উত্তর দেন, “আজকের পাঠকেরা এটি বুঝতে পারবেন না, ইতিহাসের জরুরী সংশোধনকে প্রয়োগ করতে পারবেন না এবং খামোখা গুলিয়ে ফেলবেন”। পরবর্তীতে, তিনি তার আত্মজীবনীতে এর একটি বিস্তারিত অজুহাত দেনঃ “এই সময়ে লেনিনের বিরুদ্ধে, আমার চিইয়াইতজ-কে লেখা চিঠিটি প্রকাশিত হয়। এই ঘটনা ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসের। তখন সেন্ট পিটারসবার্গ থেকে প্রকাশিত বলশেভিকদের সরকারি সংবাদপত্র, আমার ভিয়েনা থেকে প্রকাশিত Pravda – a Labor Paper নামটা দখল করে নেয়। এর থেকেই একটা তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়, যেটা প্রবাসী জীবনের খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। চিইয়াইতজ-কে লেখা একটি চিঠিতে, যিনি সেই সময় বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মাঝে অবস্থান করছিলেন, আমি বলশেভিক কেন্দ্র এবং লেনিনের উপর আমার রাগ উজাড় করে দেই।।“ কিন্তু, যদি ট্রটস্কির এই অজুহাতকে সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়, অর্থাৎ, কেউ যদি এরকম ধরে নেয় যে ট্রটস্কি শুধুমাত্র তার রাগ দেখাচ্ছিলেন লেনিন এবং লেনিনবাদের উপর, যে কেউ এটাও ধরে নিতে পারেন যে, স্তালিন এবং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অনুশীলনের প্রতি ট্রটস্কি তার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন কারণ, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতে পারেন নি।

১৯১৭ সাল পর্যন্ত ট্রটস্কি একবার এই গ্রুপ, আরেকবার ঐ গ্রুপে ঘুরে বেড়িয়েছেন; নিজের রাজনীতিতে তিনি কখনই সুস্থিত ছিলেন না। বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে তার এই দোদুল্যমানতা লেনিন একসাথে করে বলেছেন, “রাশিয়ার মার্কসবাদী আন্দোলনের পুরনো কর্মীরা ট্রটস্কিকে ভালো ভাবেই চেনেন এবং তাদের উপকারের জন্য তাকে নিয়ে আলোচনা নিরর্থক। কিন্তু শ্রমিকদের নবীন প্রজন্ম তাকে চেনে না এবং অতএব, তাকে আলোচনায় আনাটা জরুরী কারণ প্রবাসী পাঁচটি গ্রুপের মধ্যে বিশিষ্ট, যেগুলি বাস্তবে বিলোপবাদী এবং পার্টির মধ্যে দোদুল্যমান……এই “আয়ারাম-গয়ারাম”-রা একটি দাবিই করতে পারে যে, তারা সমস্ত গ্রুপের বাইরে কারণ, তারা আজ এক গ্রুপ থেকে তাদের চিন্তাধারা ধার করে তো, কাল আরেক গ্রুপের থেকে ধার করে।" ট্রটস্কি ১৯০১-১৯০৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন একজন গোঁড়া ইস্ক্রাপন্থী এবং র‍্যাজানভ ১৯০৩ সালে তার ভূমিকা সম্পর্কে বলেছিলেন “লেনিনের মুগুর”। ১৯০৩ সালের শেষে ট্রটস্কি হয়ে গেলেন একজন গোঁড়া মেনশেভিক, অর্থাৎ তিনি ইস্ক্রাপন্থীদের ত্যাগ করে অর্থনীতিবাদী হয়ে গেলেন। তিনি বলেছিলেন, “পুরানো এবং নতুন ইস্ক্রার মধ্যে আছে সাগরের ব্যবধান”। ১৯০৪-১৯০৫ সালে তিনি মেনশেভিকদের ত্যাগ করেন এবং একটি দোদুল্যমান অবস্থান নেন; সেই সময় তিনি মারতিয়নভ (অর্থনীতিবাদি)-এর সাথে সহযোগিতা করেন এবং তার আজগুবি  “চিরস্থায়ী বিপ্লব”-এর তত্ত্বের ঘোষণা করেন। ১৯০৬-১৯০৭ সালে তিনি বলশেভিকদের কাছে আসেন এবং ১৯০৭ সালের বসন্তকালে তিনি দাবি করেন যে, তিনি রোজা লুক্সেমবামর্গের সাথে ঐক্যমত্য হয়েছেন। এই ভাঙনের সময়, দীর্ঘ “অ-গোষ্ঠীবাজি” দোদুল্যমানতার সময়ে, তিনি আবার দক্ষিণ দিকে হেলে যান এবং ১৯১২ সালের অগাস্ট মাসে বিলোপবাদীদের সাথে একটি ব্লক গঠন করেন। বর্তমানে তিনি সেটিও ত্যাগ করেছেন, যদিও তিনি এখনও ভিতর থেকে সেই পচা দাবিগুলিই আউড়ে যাচ্ছেন।“                         

অক্টোবর বিপ্লব এবং গৃহযুদ্ধে ভূমিকাঃ

সন্দেহাতীত ভাবে, ট্রটস্কি ছিলেন একজন বাগ্মী এবং অক্টোবর বিপ্লবের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তবে, গুরুত্বের দিক থেকে তাকে লেনিনের ঠিক পরেই রাখাটা, যেটা ট্রটস্কিপন্থীরা প্রায়শই করে থাকে, সেটা ভুল।  ট্রটস্কিকে দেখা যেত জনগণের মধ্যে,  শ্রমিকদের বিরাট জমায়েতে উত্তেজক ভাষণ দিচ্ছেন তার অসাধারণ বাগ্মীতা নিয়ে এবং প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলির মোকাবিলা করছেন। কিন্তু তিনি তখন সবেমাত্র বলশেভিকদের সাথে যোগ দিয়েছেন এবং ফলে, তিনি প্রোলেতারিয় শৃঙ্খলা এবং পার্টি সংগঠনকে চালানোর পদ্ধতি সম্পর্কে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন। অভিজ্ঞ কমিউনিস্টদের যেমন স্তালিনের উপর দায়িত্ব ছিল সাংগঠনিক যোগাযোগ রক্ষার এবং তারা, সারা রাশিয়া জুড়ে সেই কাজ, বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই নিরলস ভাবে করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু উপরে উল্লিখিত কারণের জন্য, ট্রটস্কিকে সেইসময় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে মনে হত তাদের কাছে, যারা ছিলের পার্টির বাইরের দরদী এবং পার্টির কাজকর্মের বিষয়ে সম্যক ভাবে অনবহিত। নির্দিষ্ট করে বললে, এই কারণেই “দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন”-এ জন রীড বারবার ট্রটস্কির নাম উল্লেখ করেছেন এবং যাতে করে এরকম মনে হয়েছে যে, বলশেভিকদের পদাধিকারের ক্ষেত্রে ট্রটস্কি হলেন দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাস্তবে লেনিন ১৯১৭ সালের গোড়াতেও ট্রটস্কিকে একজন নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিস্ট বলে মনে করতেন না। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে, লেনিন, আলেকজান্দ্রা কোলোনতাইকে লেখা চিঠিতে ট্রটস্কিকে একজন “শুয়োর” এবং “দলবদলু” বলে উল্লেখ করেছেন।

১৯১৭ সালের এপ্রিলে ফিরে এসে, লেনিন পেশ করলেন তার বিখ্যাত এপ্রিল থিসিস, যা বলশেভিকদের ইতিকর্তব্য সম্পর্কে একটি স্পষ্ট রূপরেখা দিল। এটি আরও প্রস্তাব করলো যে, পার্টির নাম কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে পরিবর্তিত করতে হবে কারণ, সংশোধনবাদীরা নিজেদের সমাজ-গণতন্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিচ্ছে এবং বুর্জোয়াদের সাথে সাথ দিয়ে এই নামকে কালিমালিপ্ত করেছে। লেনিনের রূপরেখা অনুযায়ী পার্টি তার কাজকর্মে গতি আনলো এবং জনগণের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলো। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর তারা সরকারি ভাবে আইনি সংগঠনের স্বীকৃতি পেলেও, এখন তাদেরকে আবার, তাদের সম্মেলনকে গোপনে সংঘটিত করতে হবে। লেনিন এরপর ফিনল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।


......ক্রমশঃ 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>

সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম - অনুবাদে রুমা নিয়োগী(প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)

ইস্ক্রার সম্পাদকীয় বোর্ডের ঘোষণা