বর্তমান ভারতীয় কৃষি-ব্যাবস্থা'র চরিত্র আধা-সামন্ততান্ত্রিক না পুঁজিবাদী? একটি পর্যালোচনা - রচনা: চন্দন দত্ত



১৯৬৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী'র উদ্যোগে 'সবুজ বিপ্লব'-এর ঢক্কানিনাদ-এর  পর ধেকেই গুঞ্জন উঠতে শুরু করেছিল যে ভারতের কৃষি-ব্যবস্থায় নাকি একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়ে গেছে। এরপর ১৯৯১ সালে আর এক প্রধানমন্ত্রী শ্রী পি ভি নরসিংহ রাও মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী শ্রী মনমোহন সিং দ্বারা 'আর্থিক-উদারীকরণ' নীতি প্রণয়নের স্বল্পকাল পর থেকেই ভারতের রাজনৈতিক মহলে কলরব শুরু হয়ে গেছে যে, ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থা এবার পুঁজিবাদী চরিত্র অর্জন করে ফেলেছে। সম্প্রতি কিছু কিছু বাম মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠনের তরফ থেকেও জোরালো ভাবে এই দাবি পেশ করা হচ্ছে। তাহলে কি ভারতের কৃষি-ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন হয়ে ব্রিটিশ জমানার আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যবস্থা বর্তমানে পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে?

এই পরিবর্তনের পক্ষে যাঁরা গলা মেলাচ্ছেন, তাঁরা এর কারণ স্বরূপ সবুজ বিপ্লব, জমিদারি নির্মুলন আইনের প্রনয়ণ, জমির উর্ধসীমার পুনর্নির্ধারণ, কৃষিতে পুঁজি নিবেশের পথ সুগম করতে ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য সরকারী ঋণের সুবিধা প্রদান প্রভৃতি সংষ্কারমূলক সরকারী পদক্ষেপ, আমদানীকৃত উন্নত মানের বীজ ও সারের উপযোগ, চাষের কাজে হাল-বলদের পরিবর্তে ট্র্যাক্টরের ব্যবহার, জলসেচের পুরনো পন্থার পরিবর্তে বিদ্যুৎ চালিত পাম্প ও অন্যান্য কৃষি-যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রভৃতিকে তুলে ধরছেন এবং সর্বোপরি এর ফলে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত ফসল ব্যাপক ভাবে কৃষি-বাজারে বিক্রয় হওয়ার কথা বলছেন। একইসাথে, সরকারের উপরোক্ত নানান সংষ্কারমূলক যুগান্তকারী (?) পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া 'সবুজ বিপ্লবের' মধ্য দিয়েই নাকি ভারতের কৃষি ব্যবস্থার এই আমূল পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, এমনই দাবি করছেন।

কিন্তু ব্রিটিশদের ছেড়ে যাওয়া আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যবস্থার পুঁজিবাদে রূপান্তর মানে তো কৃষি-ব্যবস্থার গুণগত বা মৌলিক পরিবর্তন। বৈপ্লবিক কোনো উথালপাথাল ছাড়া এই গুণগত পরিবর্তন সম্ভবপর হল কী ভাবে ? নাকি ভারতের বৃহৎ জমিদার ও বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের পার্টি 'জাতীয় কংগ্রেস' সরকার নিঃশব্দে এই বৈপ্লবিক কাজ সম্পন্ন করেছে ? বিষয়টি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর ও গোলমেলে এবং মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিস্তারিত বিশ্লষণ মারফত একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো নেহাৎ জরুরি হয়ে পড়েছে। সুতরাং সেই পথে অগ্রসর হওয়া যাক ।

ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থায় সত্যিই এরকম কোনো মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে কী না, মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার মীমাংসা করতে হলে, নিম্নোক্ত কয়েকটি প্রশ্নের যথার্থ বিশ্লষণ সহ সদুত্তর খুঁজে নেওয়া একান্ত আবশ্যক বলে মনে করি। প্রশ্নগুলি যথাক্রমে :

১) কৃষি-ব্যবস্থার গুণগত বা মৌলিক পরিবর্তন বলতে ঠিক কী বোঝায় ?

২) ১৯৪৭ সালের পূর্বে ভারতীয় কৃষি'র চরিত্র কী ছিল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে কৃষির উন্নতিকল্পে ভারত সরকার দ্বারা যে সমস্ত সংষ্কালমৃলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার কতটা সুফল পাওয়া গেছে ?

৩) ভারতে সবুজ বিপ্লবের প্রকৃত স্বরূপ কী ?

৪) ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থার পুঁজিবাদীকরণ হয়ে থাকলে এর ফলে কৃষি-উৎপাদনের উপকরণ সমূহের মালিকানা এবং উৎপাদন-সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন এসেছে ?

(৫) কৃষিক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ভূমিকা কী ?

এবার একে একে এই পাঁচটি প্রশ্নকে ভিত্তি করে এই সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লষণের মধ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক।

বিশ্লেষণ (১) :

কৃষি-ব্যবস্থার গুণগত বা মৌলীক পরিবর্তন বলতে ঠিক কী বোঝায়?

কৃষি-ব্যবস্থার অর্থাৎ কৃষি-চরিত্রের মৌলীক বা গুণগত পরিবর্তন বলতে বোঝায়, কৃষির পুরাতন অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ নূতন এক অবস্থায় উত্তরণ। যার মানে হচ্ছে, পুরাতন উৎপাদিকা শক্তির (এক্ষেত্রে সম্মিলিত ভাবে কৃষি-জমি, চাষের হাল-বলদ বা ট্র্যাক্টর ও অন্যান্য কৃষি-যন্ত্রপাতি, জল-সেচ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি) মালিকানার কোনোরকম হাতবদল বা স্বামিত্বের পরিবর্তন হয়েছে কী না ও পুরাতন উৎপাদন সম্পর্কের, (অর্থাৎ উৎপাদনের উপকরণের মালিক ও ভাগ-চাষী বা বর্গাদার বা কৃষি-শ্রমিকের মধ্যেকার যে সম্পর্ক) তার কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়ে নূতন চরিত্রের এক কৃষি-ব্যাবস্থা জন্ম নিয়েছে কিনা।

এক্ষেত্রে আমাদের করনীয় হচ্ছে, ১৯৪৭ সালের পূর্বেকার কৃষির অবস্থা এবং পরবর্তী কালে দেশের কৃষি-ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া যাবতীয় পরিবর্তনের সামগ্রিক পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন সম্পর্কিত যা কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে তার বাস্তব ভিত্তিক বিশ্লষণ দ্বারা প্রকৃত সত্যের অন্বেষণ করা।

বিশ্লেষণ (২) :

১৯৪৭ সালের পূর্বে ভারতীয় কৃষি'র চরিত্র কী ছিল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে কৃষির উন্নতিকল্পে ভারত সরকার দ্বারা যে সমস্ত সংষ্কালমৃলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার কতটা সুফল পাওয়া গেছে?

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একশ' বছরের কৃষক বিদ্রোহ, ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী দলিত সংগঠনগুলির সংগ্রাম, অসংখ্য কৃষক আন্দোলন,  বাংলা-বিহার-পাঞ্জাব-মহারাষ্ট্র জুড়ে অজস্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ও দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের মিলিত ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা যখন ভারত ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়, তখন ভারতে কৃষি-ব্যবস্থা ছিল আধা সামন্ততান্ত্রিক। এই আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বৃটিশদের দ্বারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতীয় কৃষকদের ওপর তীব্র শোষণ এবং অবর্ণনীয় অত্যাচারও চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এই শোষণ-অত্যাচার যে শুধু আর্থিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল তাই নয়, বরং জাতপাতের নামে আদিবাসী-হরিজনের ওপর অকথ্য অত্যাচার ও অন্যান্য সামাজিক শোষণ চলেছে জমিদারদের মাধ্যমে, যেগুলি প্রকৃতপক্ষে ছিল আধা-সামন্ততান্ত্রিক শোষণেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এমতাবস্থায় ভারতের বৃহৎ দালাল বুর্জোয়া শ্রেণী ও জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী পার্টি, জাতীয় কংগ্রেস, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর দেশের বিভিন্ন কৃষকসভাগুলির সম্মিলিত আওয়াজ - 'কৃষকের হাতে জমি চাই' বা 'জনগণের হাতে সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করো' প্রভৃতি দাবিসমূহকে কোনো গুরুত্বই না দিয়ে তথা ভারতের আধা সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কোনো চেষ্টাই না করে, বরং তথাকথিত ভূমি সংস্কারের নামে বড় বড় জমিদার ও ধনী চাষিদের হাতে আরও চাষযোগ্য জমি অর্পণ করে ইংরেজদের ফেলে যাওয়া আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই যথাবৎ কায়েম রেখেছে। এমনকি এই সময়ে বাংলায় তেভাগা আন্দোলন ও হায়দ্রাবাদে তেলেঙ্গানার যে কৃষক আন্দোলন চলছিল, তা স্বাধীন দেশের এই কংগ্রেস সরকার নির্মম ভাবে দমন করতেও পিছপা হয়নি। এতটাই জনদরদী (?) ছিল এই সরকার।

১৯৪৭ পরবর্তী কালে কংগ্রেস সরকার ভূমি সংস্কারের জন্য বেশ কিছু আইন পাশ ক'রে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেসব কিছুই বাস্তবায়িত করা হয়নি। যেমন ১৯৫০ সালে বিভিন্ন রাজ্যে 'জমিদারি উচ্ছেদ আইন' (Zamindari Abolition Act) এবং Tenancy Act পাশ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫০ সালে বর্গাদার আইন পাশ হয়। এই আইন কয়েকবার সংশোধিত হবার পর তা পশ্চিমবঙ্গ ভূমি-সংস্কার আইনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৩ সালে গৃহীত হয় জমিদারি উচ্ছেদ আইন (Estate Acquisition Act)। যারা আগে জমিদারদের খাজনা দিত কিন্তু 'রায়ত' হিসাবে স্বীকৃত ছিল, তাদের এই আইনে জমির মালিকানা দিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে গৃহীত হয় পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন (Land reform Act, 1954)। এই আইনে সব রায়তকেই ২৫ একর পর্যন্ত কৃষিজমি এবং ১৫ একর পর্যন্ত অ-কৃষিজমি রাখতে দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে ওই আইনের সংশোধন করে কৃষিজমির সর্বোচ্চ সীমা --- সেচ এলাকায় ১২.৫ একর এবং অ-সেচ এলাকায় ১৭.৫ একর করা হয় এবং ওই সংশোধনীতেই বলা হয় যে ভাগচাষিরা উৎপন্ন ফসলের ৭৫ শতাংশ পাবেন। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একটি মাত্র সংশোধনী হয়েছে ১৯৮০ সালে, যাতে কৃষি-অকৃষি সব জমিকেই ১৭.৫ এবং ১২.৫ একর উর্ধসীমার মধ্যে আনা হয়।

এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল বড় জমির মালিকদের কাছ থেকে জমি নেওয়া এবং তা ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলি করা। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবত এই আইন কার্যকর করা হয়নি, কারণ কংগ্রেসের মধ্যেকার বড়-জমিদারদের লবি এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরই মধ্যে সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাড়ি সহ অন্যান্য কৃষক আন্দোলন এবং ১৯৭৭ সালে কৃষক-সভাগুলির বিভিন্ন  আন্দোলনের জোয়ারে পশ্চিমবঙ্গে কিছু জমি খাস হয়েছে এবং কিছু বর্গাদারের নাম রেকর্ডভূক্ত হয়েছে। তাহলেও পশ্চিমবঙ্গে বিলি হওয়া জমির পরিমাণ ছিল মোট কৃষিজমির মাত্র ৮ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ করা যায় প্রায় ১৫ লক্ষ বর্গাদারের নাম রেকর্ডভূক্তি। এক্ষেত্রে তাঁরা জমির ওপর যে বর্গা অধিকার পেয়েছেন তা মোট জমির ৭ শতাংশ মাত্র ছিল। এক কথায় বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কারের ফলে প্রায় ১৫ শতাংশ জমির ওপর কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই বেশি। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে ভূমির হস্তান্তর হয়েছে নাম মাত্র। সারা ভারতে এই বন্টিত জমির পরিমাণ ছিল মোট জমির মাত্র ২ শতাংশ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কৃষি-ব্যবস্থায় উৎপাদিকা শক্তির মূল উপাদান, চাষযোগ্য জমির মালিকানার ক্ষেত্রে নামমাত্র, অল্পকিছু পরিমানগত পরিবর্তন করা হয়েছে, মূলগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু, ভাগচাষী ও বর্গাদারদের নতুন করে সামান্য কিছু জমি বন্টন করা হয়েছে। এই সমস্ত পদক্ষেপ জনকল্যাণমূলক এবং প্রশংসনীয়  হলেও, এটা পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থা' প্রবর্তনের লক্ষণ নয় মোটেই, কারণ এর মধ্য দিয়ে কৃষি-জমির কেন্দ্রীভবনের পরিবর্তে তা আরও টুকরো টুকরো করে গ্রামীণ কৃষি-বুর্জোয়া গড়ে ওঠার ও তারই সঙ্গে গ্রামীন সর্বহারার সংখ্যা বৃদ্ধির পুঁজিবাদী প্রক্রিয়াকে বাধা দিয়ে প্রচলিত আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই আরো মজবুত করা হয়েছে। এটাকে বরং প্রচলিত ব্যবস্থারই উন্নয়নমূলক কিছু কাজ বলা যেতে পারে।

উত্তর ও পশ্চিম ভারত এবং কৃষ্ণা-গোদাবরী উপত্যকায় কিছু অঞ্চলে জমিদার ও ধনী কৃষকরা পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বীজ, সার, মেশিনারি ও প্রযুক্তির জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা থাকায় উদ্বৃত্তের বড় অংশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে চলে যায়। এখন ওই সব এলাকায় ঢাক ঢোল পেটানো 'সবুজ বিপ্লব' মুখ থুবড়ে পড়েছে। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার দেশের পূর্বাঞ্চলে 'দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের' পরিকল্পনা নিয়েছেন, যার মূল কথা হলো হাইব্রিড বীজের মাধ্যমে ধান এবং অন্যান্য ফসলের চাষ বৃদ্ধি। হাইব্রিড বীজ কৃষককে প্রতি বছরই কিনতে হবে 'মনসান্টো'র মতো বহুজাতিক সংস্থার কাছ থেকে। এই বীজ ব্যাপক ভাবে চালু হলে কৃষি পুরোপুরি 'মনসান্টো'র মত বহুজাতিক কোম্পানিগুলি মারফত সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। অর্থাৎ যান্ত্রিক ভাবে কৃষিতে সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর এক পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যাবস্থা চালু করার আয়োজন চলছে। কিন্তু ভারতের মতো একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-উপনিবেশিক দেশে, যেখানে জমিদার-সামন্তপ্রভুদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, বড় বড় পুঁজিপতিরা পর্যন্ত স্বাধীন নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, যেখানে দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা তলানিতে, সেই দেশে কৃষি-ব্যাবস্থায় পুঁজিবাদ প্রবর্তন করার চেষ্টা, প্রকারান্তরে কাকের ময়ূর পুচ্ছ ধারণের সামিল। বাস্তবে এই পরিকল্পনা সাম্রাজ্যবাদের সেবা করার একটি প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিশ্লেষণ (৩) :

ভারতে সবুজ বিপ্লবের প্রকৃত স্বরূপ কী ?

১৯৬৫ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, পাঞ্জাব প্রদেশে। পরে এই উদ্যোগ হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশের কিছু অঞ্চলেও প্রসারিত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা হাই-ব্রিড শস্যবীজের চাষ করে গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা। প্রাথমিক  ভাবে উন্নত মানের শস্যবীজ চাষের ফলস্বরূপ গম উৎপাদনের পরিমাণে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে বিরাট হৈচৈ শোনা গেলেও সামগ্রিক ভাবে এই উদ্যোগ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, এককথায় 'ফ্লপ' করে গেছে বলা যেতে পারে। এবং তখনকার মতো এই পরিকল্পনা স্থগিত করে দেওয়া হয়। এই ব্যর্থতার কারণ স্বরূপ যে বিষয়গুলি উঠে এসেছে সেগুলি যথাক্রমে : * আমদানি করা শস্য বীজের আকাশ ছোঁয়া দাম, * একসাথে বিশাল বড় আকারের জমিতে এই চাষ না করলে খরচ তুলে লাভের অঙ্ক খুব একটা বেশি হয় না, * এই শস্য বীজের ফলনে যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়, তাতে জমির স্বাভাবিক উৎকৃষ্টতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনও শোনা গিয়েছে, * আনুষঙ্গিক খরচ-খরচা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি, * চাষীর লাভের চেয়ে হাই-ব্রিড শস্য বীজের নির্যাতকারীর (Exporter) লাভ বেশি হয়, অর্থাৎ লাভের গুড় পিঁপড়ে খায়,* সার্বিক ভাবে বিশাল অঙ্কের পুঁজি নিবেশের প্রয়োজন হয়, যা সহজলভ্য ছিল না, * বীজ আমদানী ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনার নানান ঝামেলার কারণে কৃষকরা নিরূৎসাহ হয়ে পড়েন।

বিশ্লেষণ (৪) :

ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থার পুঁজিবাদীকরন হয়ে থাকলে এর ফলে কৃষি-উৎপাদনের উপকরণ-এর মালিকানা এবং উৎপাদন-সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন এসেছে ?

প্রথমে কৃষি-ব্যবস্থার পুঁজিবাদীকরণ বলতে কী বোঝায় এবং, বস্তুত তারও আগে  আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কেই বা সঠিক ধারণাটি কী, সেটা একটু বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার।

আমরা জানি ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে বাংলা-বিহারের ক্ষমতা দখল করেছিল এবং পরবর্তীতে ইংরেজরা ভারতের অসংখ্য পরস্পর-বিচ্ছিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজগুলিকে ধ্বংস ক'রে ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের ভূমিব্যবস্থার অনুকরণে 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ও বিহারের সর্বত্র এবং মাদ্রাজ ও যুক্ত-প্রদেশের কতিপয় অঞ্চলে 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' প্রবর্তন ক'রে জমিদারদের জমির চিরস্থায়ী মালিকরূপে মেনে নিয়ে, তাদের মারফত কৃষক-জনসাধারণের কাছ থেকে অস্বাভাবিক বেশি হারে খাজনা আদায় ও আরও নানান শোষণমূলক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল যাবত প্রচলিত মোগল বাদশাহ-নবাবদের

'সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যাবস্থা', যে ব্যাবস্থায় জনসাধারণকে নবাব-বাদশাহদের খাজনা দিতে হতো সরাসরি এবং তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট কম হারে, তথা জমিদাররূপী মধ্যবর্তী কোনো অশুভ শক্তির অস্তিত্ব ছিল না, সেই ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করেছিল। পরবর্তী কালে ইংরেজরা এই ব্যবস্থা সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কায়েম করেছিল। মোগল জমানায় সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে সামান্য কর আদায়ের যে ব্যাবস্থা ছিল, তাকে নস্যাৎ করে ইংরেজরা অসংখ্য জমিদারদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে দ্বিগুণ, তিন গুণ বা এমনকি চারগুণ পর্যন্ত কর আদায়ের মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত শোষণ-পীড়নের এই যে নতুন এক কৃষি-ব্যাবস্থার জন্ম দিয়েছিল, সেটিই হচ্ছে আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থা, যা পুরোপুরি বাদশাহ-নবাবদের সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যবস্থাও নয় আবার পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থাও নয়। এই ব্যবস্থায় সমগ্র কৃষিজমির একটা বৃহৎ অংশ বড়-ছোট জমিদার-জোতদারদের ও ধনী কৃষকদের মালিকানাধীন করে অবশিষ্ট সামান্য পরিমাণ জমি, মাঝারি চাষী ও গরিব চাষিদের স্বত্বাধীন করে দেওয়া হয়েছিল।

অর্থাৎ ভারতের মোট কৃষি-জমি তথা বাস্তু-জমি, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এবং নিতান্তই অবিন্যস্ত অবস্থায় বিরাজমান ছিল। সমাজের অসংখ্য শ্রেণীবিভাগের একেবারে মাথায় ছিল জমিদার, তালুকদার, জোতদার, মালগুজার ও ধনী-কৃষক প্রভৃতি, জমির ওপর যাদের ছিল সর্বাধিক মালিকানা এবং যাদের সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অকল্পনীয়, কারণ ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সর্বাধিক সংরক্ষণ প্রদান করা হতো। তাঁরা নিজেরা চাষ করতো না, তার পরিবর্তে ভাগচাষি, বর্গাদার বা অল্প কিছু ক্ষেত্রে ক্ষেত-মজুরদের দিয়ে সেই চাষের দায়িত্ব পালন করাতো। বৃটিশ সরকারকে জমিদারদের নির্ধারিত বিরাট অঙ্কের বাৎসরিক খাজনা দিতে হতো, যার দ্বিগুণ বা তিনগুণ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে চারগুণ পর্যন্ত খাজনা জমিদাররা তাঁদের অধীন সমস্ত স্তরের প্রজাদের কাছ থেকে জোর-জুলুম করে আদায় করত। এরপর ছিল ধনী চাষী যাঁরা নিজেরা চাষ করতো না কিন্তু চাষের দেখাশোনা ও তদারকির কাজ করত। এর নীচে ছিল মাঝারি চাষী ও গরিব চাষী, যাঁরা নিজেরাই নিজেদের জমি চাষ করে কোনোমতে পরিবারের ভরণপোষণ করতেন। সমাজের একেবারে নিম্নস্তরে অবস্থান করতো ভূমিহীন ক্ষেতমজুররা। এঁরা ছিল প্রধানত দলিত, আদিবাসী বা অন্য কোনো নিম্ন-সম্প্রদায়ভুক্ত। এঁরাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি শোষণ, অত্যাচার ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার। বর্তমান যুগে এঁদের একটা বিরাট অংশ (সংখ্যায় প্রায় নয়-দশ কোটি) গ্রামে কৃষি-মজুরির পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কোনায় কোনায়, বড় বড় শহরগুলিতে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রে (Informal sector) মজুরি-শ্রম মারফত কোনোমতে দিন গুজরান করছেন।

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, তৎকালীন সমাজের উৎপাদিকা শক্তি ছিল প্রধানত জমিদার-জোতদার শ্রেণীর হাতে এবং কিছু পরিমাণ ধনী-চাষীদের হাতে। অবশিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেনী ছিল শোষিত, অত্যাচারিত ও অবহেলিত। এবং সেই যুগে কৃষি-ব্যবস্থায় ব্রিটিশদের দালাল শ্রেণী হিসেবে বিত্তবান জমিদার-মহাজনদের সাথে ভাগচাষি, বর্গাদার, ক্ষেতমজুর ও বিত্তহীন জনসাধারণের দ্বন্দ্ব ছিল প্রধান দ্বন্দ্ব।

এই ছিল তৎকালীন সমাজের উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক এবং এই কৃষি-ব্যবস্থাই ছিল তৎকালীন ভারতের আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যবস্থা।

এখানে জানিয়ে রাখা দরকার যে ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষের কৃষি-ভূমি সংক্রান্ত কোনো তথ্য-পরিসংখ্যানই পাওয়া দুষ্কর। ভূমি সংক্রান্ত যা কিছু পরিসংখ্যান উপলব্ধ আছে সে সবই ভারত সরকার দ্বারা প্রস্তুত যথাক্রমে  ১৯৬১ সালের ' Tenancy and land concentration as wel as Census data', ১৯৬৪-৬৫ সালের 'The Rural Labour Enquiry',  ১৯৭১ সালের 'All-India Debt and Investment Survey', 'Census of 1978' প্রভৃতি। এছাড়া Center for Monitoring the Indian Economy, (CMIE)'র 1979-এ প্রস্তুত করা কিছু তালিকা (Table) উপলব্ধ আছে, কিন্তু এই সমস্ত পরিসংখ্যানই এমন ভাবে প্রস্তুত করা, যে এর থেকে সরাসরি কোনো সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। তবুও এইসব পরিসংখ্যান থেকে যেটুকু উপযোগী তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, তা নিম্নরূপ :

বড় জমিদার ও ধনী কৃষক পরিবার দ্বারা অধিকৃত জমির পরিমাণ : ---

সর্বোচ্চ ৪%-এর অধিকারে আছে ৩১% জমি (তার মধ্যে ২.২%-এর অধিকারে আছে ২৩% জমি)। ১৯৭১-৭২ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাত্র ৫%-এর অধিকারে আছে ৪৭.২১% জমি, এবং এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১%-এর অধিকারে আছে ২২.৯৬% জমি। এর একটা মোটামুটি হিসাব ধরলে দেখা যাচ্ছে যে সর্বোচ্চ ৫% জমিদার, জোতদার ও ধনী কৃষকের  অধিকারে রয়েছে প্রায় ৫০% জমি।

মাঝারি ও গরীব চাষী পরিবার দ্বারা অধিকৃত জমির পরিমাণ : ---

সম্ভবত ২০% থেকে ৩০% চাষযোগ্য জমি রয়েছে ৮৫% পরিবারের হাতে, যারা নিজে চাষ করেন। এই ৮৫% পরিবারের মধ্যে মধ্যবিত্ত থেকে গরিব চাষী ও এমনকি ভূমিহীন অতি দরিদ্র অন্যান্য পেশায় নিযুক্তরাও পড়েন। মাঝারি চাষীদের মধ্যে যাঁদের ২.৫ একরের উপরে জমি আছে কেবল এমন পরিবারগুলিই জমির ওপর ভিত্তি করে জীবন ধারণ করতে সক্ষম আর এর নীচে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের গ্রামে অথবা শহরে অন্যান্য জীবিকার মাধ্যমে উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হয়।

গ্রামীণ সর্বহারাঃ---

৬৫% গ্রামীণ পরিবার যাঁরা সামগ্রিক ভাবে দেশের ৯% অথবা তার কম জমির অধিকারী, তাঁদেরকে গ্রামীণ সর্বহারা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জীবনধারণের জন্য তাঁদের কৃষি-মজুরি অথবা অন্যান্য জীবিকা খুঁজে নিতে হয়। NSS/AIDIS এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই কৃষি-মজুরদের অনুপাত ১৯৫৩-৫৪ সালের ২২% থেকে কমে ১৯৭১-৭২ সালে হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৬%, বিভিন্ন সরকারী টেনান্সি এক্ট, ল্যান্ড সিলিং এক্ট প্রভৃতির কল্যাণে। তবে একই সময়ে গ্রামীন ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যাও সমান অনুপাতে বেড়ে ১১% থেকে ২৭.৪% এ পৌঁছেছে। সামগ্রিক ভাবে AIDIS-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৭১-৭২ সালে ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের অনুপাত ছিল ১৪.৬%, ভূমিহীন হস্ত-শিল্প কারিগর ছিল ২.৪% এবং  অন্যান্য অ-কৃষি শ্রমিক ছিল ১০.৪%, অর্থাৎ সর্বমোট ২৭.৪%।

অনুমান করা যায় যে, ২০০০ সালে এসে এই গ্রামীণ সর্বহারাদের সর্বমোট অনুপাত বেড়ে, খুব কম করে হলেও ৩০%-এর কম হবে না। আর এদের মধ্যেকার একটা বিরাট অংশই পরবর্তী কালে পরিযায়ী-শ্রমীক-এ রূপান্তরিত হয়েছেন।

এবার দেখে নেওয়া যাক কৃষিব্যবস্থার পুঁজিবাদীকরণ বলতে কী বোঝায় এবং ভারতে এই পুঁজিবাদীকরণ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে।

পুঁজিবাদী-কৃষি নিঃসন্দেহে একটি উন্নততর কৃষি-ব্যবস্থা, যে ব্যাবস্থায় কেন্দ্রীভূত বিরাট বিরাট ক্ষেত-খামারে আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও উন্নত মানের বীজ, সার ও কীটনাশক প্রভৃতির উপযোগ তথা উন্নত কলা কৌশলের প্রয়োগ দ্বারা বিপুল পরিমাণে বিকশিত গুণমান সম্পন্ন কৃষি-পণ্যের উৎপাদন করা হয়। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, - প্রথমত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ছোট-বড় কৃষি জমিকে কেন্দ্রীভূত করে বড় বড় ক্ষেত-খামারে রূপান্তরিত করা হয়। দ্বিতীয়ত কৃষি-যন্ত্রপাতি ইত্যাদির ব্যাপক প্রয়োগ তথা উন্নত মানের বীজ, সার, কীটনাশক প্রভৃতির উপযোগ ও উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ সুনিশ্চিত করা হয়। তৃতীয়ত জমির মালিক ও উৎপাদনকারী হিসেবে কৃষি-মজুর ছাড়া ভাগচাষি, বর্গাদার, ফোঁড়ে, দালাল প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগী উদ্বৃত্ত- আহরণকারীদের অবলুপ্তি ঘটে।

ভারতের পুরনো আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যবস্থার পুঁজিবাদীকরন হয়েছে কী না, সেটা বিচার করতে হলে পুঁজিবাদী ব্যাবস্থায় উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে যে কতকগুলি পূর্বশর্ত থাকে, সেগুলির পূরণ হওয়া  অত্যাবশ্যকীয়। সেই পূর্বশর্তগুলি নিম্নরূপ:

ক) কৃষি-জমির কেন্দ্রীভবন ---

বেশির ভাগ কৃষি-জমি কেন্দ্রীভূত অবস্থায় থাকতে হবে প্রধানত সীমিত সংখ্যক কিছু বিত্তবান মানুষের মালিকানায়, যারা বিশাল আকারের কৃষি-পণ্য উৎপাদনের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় পুঁজি নিবেশ করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে ব্যঙ্ক পুঁজি বা অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি পুঁজির যোগান আবশ্যক হতে পারে।

খ) উন্নততর উৎপাদন সম্পর্ক --- কৃষিকাজে ভাগচাষি, বর্গাদার, প্রভৃতি অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগীদের পরিবর্তে সরাসরি কৃষি-মজুরদের যথার্থ সংখ্যক নিযুক্তি পরিলক্ষ্যিত হতে হবে। কারণ এই ব্যবস্থায় জমির মালিক ও কৃষি-মজুর ছাড়া ভাগচাষি, বর্গাদার প্রভৃতি অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর অস্তিত্ব লোপ পায়।

গ) আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার --

চাষাবাদের জন্য পুরাতন হাল-বলদ, পুরানো জলসেচ ব্যবস্থা, ধান কাটা, ঝাড়াই-মাড়াই এবং পণ্য পরিবহন প্রভৃতি ম্যানুয়াল কাজের পরিবর্তে আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতি, যেমন ট্রাক্টর, ডাম্পার, পাম্পসেট ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতির বহুল ব্যবহার হতে হবে।

আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও উন্নত মানের বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার আবশ্যিক ভাবে হতে হবে।

ঘ) কৃষি-পণ্যের বিক্রয় ---

উৎপন্ন সামগ্রিক কৃষি-পণ্যের অন্তত ৯০ শতাংশ সরাসরি কৃষি-বাজারে বিক্রয় পরিলক্ষ্যিত হতে হবে, কারণ এই ব্যবস্থায় ভাগচাষি, বর্গাদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ব না থাকায় উৎপন্ন ফসলের ভাগাভাগি হয়না এবং জমির মালিক থাকে সীমিত সংখ্যক, যার ফলে বিক্রয়যোগ্য ফসলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। একই সাথে ফসল বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ফোঁড়ে, দালালদের মত মধ্যস্বত্বভোগীদের অবলুপ্তির ফলস্বরূপ বিশাল অঙ্কের একটা খরচ কমে গিয়ে লাভের হার উপযুক্ত মাত্রায় বৃদ্ধি পায়।

ঙ) GDP তে কৃষির অবদান : 

কৃষি-পণ্যের বিক্রয়ের পরিমাণ বিপুল মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় এবং সেই কারণে কৃষিক্ষেত্র থেকে সরকারের বর্ধিত হারে শুল্ক প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে দেশের GDP তে কৃষি-পণ্যের অবদান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়, যার প্রতিফলন দেশের বাৎসরিক কৃষি বাবদ আয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে পরিলক্ষ্যিত হওয়া উচিত।

চ) উন্নততর শ্রেণী-চেতনার বিকাশ ---

পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থায় আধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ও উন্নততর উৎপাদন-সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার দরুন সমাজে অবশ্যই তার ফলপ্রসূ প্রভাব পড়ে এবং সেই কারণে আমাদের দেশের বহু পুরাতন ঘৃণ্য-জাতিভেদ প্রথার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে তার জায়গায় উন্নততর শ্রেণী-চেতনা সম্পন্ন সংস্কৃতির বিস্তার লাভ করা বাঞ্ছনীয়, যার প্রতিফলন সমাজে দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত।

উপরোল্লিখিত ছয়টি শর্তকে এবার আমরা একে একে NSS, AIDIS এবং CMIE থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন পরিসংখ্যানের নিরিখে পর্যালোচনা করে দেখবো যে, ভারতে, তথাকথিত পুঁজিবাদী-কৃষি, পুঁজিবাদের এইসব পৃর্বশর্তগুলি মোটামুটি কত শতাংশ পূরণ করতে পারছে এবং সেই অনুযায়ী স্থির হবে যে আমাদের দেশে কথিত এই পরিবর্তন কতখানি কার্যকর হয়েছে।

পর্যালোচনা - (ক)

কৃষি জমির কেন্দ্রীভবন :

ইতিপূর্বেই প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে মোটামুটিভাবে আমরা দেখেছি যে, ভারতের সমগ্র কৃষি-জমির মোটামুটি ৫০% কেন্দ্রীভূত রয়েছে ৫% জমিদার ও ধনী চাষীদের মালিকানায়। অবশিষ্ট ৩০% জমি রয়েছে মাঝারি ও গরিব চাষিদের হাতে।

এখন মনে হতে পারে যে, এই যে ৫০% জমির মালিকানা ৫% জমিদার ও ধনী কৃষকের হাতে রয়েছে, যাঁদের পক্ষে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট পুঁজির যোগান দিতে পারাও মোটেই কষ্টকর নয়, তাঁদের দ্বারা এই পুঁজিবাদী-ব্যবস্থায় চাষাবাদ করা তো সহজেই সম্ভব। কিন্তু সেক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে, এই ৫০% জমি তো ৫% ভিন্ন ভিন্ন মালিকদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে, ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো ছেটানো অবস্থায় বিরাজ করছে, অর্থাৎ কেন্দ্রীভূত জমি নয়। সুতরাং বিশাল বিশাল কেন্দ্রীভূত জমিতে পুঁজিবাদী চাষের যে পূর্বশর্ত, সেটা পুরণ হবে কী করে ? তা সত্বেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অল্প-বৃহৎ আকারের কিছু জমিতে যে এই পুঁজিবাদী কৃষিকাজ হতে পারে না, তা নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে তার প্রভাব স্বরূপ সর্ব-ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি-উৎপাদনের পরিমাণগত কিছু বৃদ্ধি হতে পারে মাত্র, গুণগত কোনো বিরাট পরিবর্তন মোটেই আশা করা যায় না। সুতরাং পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থায় পূর্বশর্ত পূরণের বিষয়টি এক্ষেত্রে ৩০% থেকে ৩৫% পালিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, তার বেশি কিছু নয়।

পর্যালোচনা - (খ)

উন্নততর উৎপাদন সম্পর্ক :

আমরা এর আগে AIDIS-এর পরিসংখ্যান থেকে দেখেছি যে, ১৯৭১-৭২ সালে ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের শতকরা অনুপাত ছিল ১৪.৬%। পরবর্তী কালে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হিসেব ধরলে  ২০০০ সালে গ্রামীন সর্বহারাদের অনুপাত খুব বেশি হলে ধরা যেতে পারে মোটামুটি দ্বিগুণ হয়ে ৩০% এ পৌঁছেছে, যার মধ্যে অন্তত ১০% পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে অন্যান্য শহরে নিযুক্ত। কিন্তু সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী পুঁজিবাদী কৃষি সংঘটিত হয়ে থাকলে, সেক্ষেত্রে অবশিষ্ট ২০% কৃষিমজুর দিয়ে সেই কাজ কী করা সম্ভব ? যেখানে আমরা জানি যে ভারতে অন্তত ৬০% কৃষক সরাসরি কৃষিকাজের সাথে যুক্ত, তাহলে বাকি ৪০% কৃষক কারা ? এঁরা ভাগচাষি আর বর্গাদার ও অন্যান্য মধ্যস্বত্বাভোগী  ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। সুতরাং বোঝা যায় যে, ভাগচাষ ও বর্গাচাষের অস্তিত্ব পুরোমাত্রায় বহাল রয়েছে। আর সেই কারণে এক্ষেত্রেও কৃষি-মজুর সম্পর্কিত পুঁজিবাদী-কৃষির পূর্বশর্তটি পূরণ হয় না।

পর্যালোচনা - (গ)

আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার :

CMIE প্রদত্ত ১৯৬৯ সালের Agricultural Input-এর Table 1 অনুযায়ী প্রতি হেক্টর ফসল ফলানো জমিতে সব ধরনের সারের ব্যবহার হয়েছে ১৯৬৫-৬৬ সালে ৫.১ কেজি, ১৯৭৫-৭৬ সালে ১৭.৪ কেজি, ১৯৭৮-৭৯ সালে ২৯.৪ কেজি। প্রতি এক লাখ হেক্টর ফসল ফলানো জমিতে ট্র্যাক্টরের উপযোগ হয়েছে ১৯৬৫-৬৬ সালে ৩৪ টি, ১৯৭৫-৭৬ সালে ১৬৬ টি এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে ২৩৪ টি। জলসেচের জন্য প্রতি এক লাখ হেক্টর জমিতে বিদ্যুত চালিত টিউবওয়েল ও পাম্পসেট-এর ব্যবহার হয়েছে ১৯৬৫-৬৬ সালে ৩৬২ টি, ১৯৭৫-৭৬ সালে ১৭১৭ টি এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে ২,৩০৮টি। সারা ভারত জুড়ে  পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থার  পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত এই পরিসংখ্যান কী হাস্যকর রকমের অপর্যাপ্ত নয় ? Google সার্চ করে পাওয়া গেল যে ভারতে চাষযোগ্য আবাদি জমির সর্বমোট পরিমান ১৫৯.৭ মিলিয়ন হেক্টর অর্থাৎ ১৫৯৭,০০,০০০ হেক্টর। এই ১৫৯৭ লক্ষ হেক্টর জমির চাষ করতে ১৯৭৮-৭৯ সালে ট্র্যাক্টরের ব্যবহার হয়েছে মাত্র ২৩৪ টি ? বর্তমানে এই সংখ্যাটা দশগুণ বেড়ে যদি ২৩৪০ টিও হয়, তবে সেক্ষেত্রে মাত্র ৬৮,২৪৮ একর জমি চাষ করা যাবে। যদি একটি ট্র্যাক্টরকে একদিনে দশটি জমিতেও ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে মোট কর্ষিত জমির পরিমাণ (আমার হিসেবে) দাঁড়াবে ৬,৮২,৪৭৯ হেক্টর, যা ভারতের সর্বমোট কৃষি জমির মাত্র ০.৪৩ %। সারের ব্যবহার ও জলসেচের উপরোক্ত হিসাব ধরলে সমগ্র দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর অনুপাত আরও নগণ্য হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে ভারতের মত এত বৃহৎ একটি দেশের সামগ্রিক কৃষি-কর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অনুপাতে এইসব সংখ্যা নেহাৎই অকিঞ্চিৎকর এবং রীতিমত হাস্যকর নয় কী ? সুতরাং এক্ষেত্রেও পুঁজিবাদী-কৃষির পূরবশর্ত কোনোভাবেই পূরন হচ্ছে না।

পর্যালোচনা - (ঘ)

কৃষি-পণ্যের বিক্রয় :

প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে কৃষি-পণ্যের বিক্রয় সংক্রান্ত কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান কোথাও উপলব্ধ নয়। কাজেই এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তথ্য-সুত্রের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যক্তিগত অনুসন্ধান থেকে জানা যায় যে, সাধারণত গ্রামের মাঝারি চাষীরা সারা বছরে উৎপন্ন ফসলের এক চতুর্থাংশ নিজেদের ভোগের জন্য সংগৃহীত রেখে তিন চতুর্থাংশ ফসল আড়তদারের গুদামে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। গরিব চাষীরা হয়ত তিন চতুর্থাংশ নিজেদের জন্য রেখে এক চতুর্থাংশ আড়তদারকে বেচে আসেন বা পুরোটাই হয়ত তাঁদের নিজেদের জন্য যথেষ্ট নয়। ধনী চাষী ও জোতদার-জমিদাররাও বোধকরি এই একই উপায় অবলম্বন করেন। এবং সবশেষে আড়তদারেরা এই সব সংগৃহীত ফসল কৃষি-বাজারে বা এজেন্ট মারফত সরকারের কাছে থোক দামে বিক্রয় করেন। তাহলে কৃষি-পণ্যের বিক্রয় সরাসরি কৃষি বাজারে বা সরকারের কাছে গেল কোথায় ? তার পরিবর্তে মধ্যস্বত্বভোগীরা সেই কাজের মারফত একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্ত আত্মস্থ করে প্রকৃত উৎপাদনকারী ও সরকারের লাভের অংশে ভাগ বসিয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রেও পুঁজিবাদী কৃষির পূর্বশর্ত পূরণ হচ্ছে না।

পর্যালোচনা -(ঙ)

GDP তে কৃষির অবদান :

GDP তে কৃষিজাত-পণ্যের অবদানের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভাবেই পরিসংখ্যান নির্ভর, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে এই সংক্রান্ত পরিষ্কার কোনো তথ্য NSS, AIDIS বা CMIE দেয়নি। Google ঘেঁটে যেটুকু পরিসংখ্যান সংগ্রহ করতে পেরেছি সেটুকুই এখানে ব্যক্ত করছি এবং আমার মনে হয় যে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সেটাই যথেষ্ট।

স্বাধীনতার পর মোট জাতীয় আয়ের অর্ধেকের বেশি আসত কৃষি থেকে। ২০০৩-০৪ সালে মোট জাতীয় আয়ের ২১.৭ শতাংশ এসেছিল কৃষি থেকে, ২০০৭-০৮ সালে এটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭.৮ শতাংশে। ২০০৮-০৯ সালে ভারতের মোট জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি ৭ শতাংশের কাছাকাছি হলেও এক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদনের অবদান ছিল মাত্র ১.৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে  গুরুত্বপূর্ণ যে, খাদ্যশস্যের উৎপাদন ০.৮ শতাংশ এবং ডালের উৎপাদন ৮.৫ শতাংশ কমে যায়। সবমিলিয়ে দেশের GDP তে কৃষির অবদান রীতিমত সংকটজনক। নয়া উদারনীতি চালু হওয়ার পরবর্তী দশ বছরে কৃষির পরিকাঠামো নির্মাণে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে গুরুতর ভাবে। অন্যদিকে কৃষির উদ্বৃত্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি গিলে খেয়েছে। এই সামগ্রিক পরিসংখ্যান কৃষির গভীর সংকটকেই সূচিত করছে। সুতরাং এক্ষেত্রে যেটুকু তথ্য  সংগ্রহ করা গেছে, তা থেকে GDP তে কৃষিজাত পণ্যের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, একথা কোনো মতেই প্রতিষ্ঠিত হয় না। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও কৃষি-উৎপাদনের পুঁজিবাদী চরিত্র অর্জনের শর্তটি মোটেই ধোপে টিকছে না।

পর্যালোচনা - (চ)

উন্নত শ্রেণী-চেতনার বিকাশ:

পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থায় ঘৃণ্য সামন্ততান্ত্রিক জাতিভেদ প্রথার অবসান সংক্রান্ত অত্যাবশ্যক যে শর্তটি এখন আমরা আলোচনা করতে চলেছি, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণই শুধু নয়, এটি বিস্তারিত ও যথার্থ বিবেচনার দাবি রাখে, কারণ জাতীয় সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে সমাজ-জীবনের আয়না, যার মধ্যে যে কোনো সমাজ-ব্যবস্থার একেবারে সঠিক চিত্রটি প্রতিফলিত হয়।

ভারতের অতি প্রাচীন চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা, যে বর্ণ-ব্যবস্থার দ্বারা সামাজিক শ্রম-বিভাজন নির্ধারিত করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণ পঠন-পাঠন ও পূজার্চনা ইত্যাদি করবে, ক্ষত্রিয় যুদ্ধ-বিদ্যা ও প্রশাসনে অংশ নেবে, বৈশ্য ব্যবসা-বানিজ্য করবে আর শূদ্র, দৈহিক শ্রমের কাজ করবে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রগুলি এই শ্রম-বিভাজনকে কঠোর ভাবে মেনে চলার কথা বলেছে। ব্রাহ্মণ যদি লাঙল ধরে তাহলে সে জাতিচ্যুত হবে। আবার শূদ্র যদি পড়াশোনা করার চেষ্টা করে তাহলে তার মৃত্যুদন্ড হবে। এহেন বিধান আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বৃটিশ-ভারতে যেমন এই ব্যবস্থার বিশেষ হেরফের হয়নি, স্বাধীন ভারতীয় সমাজেও তা পূর্ণ মাত্রায় বহাল থেকেছে। আমরা দেখেছি এমনকি আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চিরাচরিত শ্রম-বিভাজনকে কতখানি গুরুত্ব দিতেন, যার নিদর্শন গান্ধী এবং আমবেদকরের মধ্যে বিতর্কের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে। "হোয়াট হ্যাজ দ্য কংগ্রেস অ্যান্ড মিঃ গান্ধী ডান ফর দ্য আনটাচেবলস" বইয়ে আম্বেদকর,গান্ধীর লেখা উদ্ধৃত করেছেন। গান্ধী লিখেছেন, "নিম্ন-বর্ণের মানুষদের সব ধরনের পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তারা চিরাচরিত পেশা পরিত্যাগ করে অন্য পেশা গ্রহণ করবে। লোকেরা যদি পুরুষানুক্রমে অনুসৃত পেশা ত্যাগ করে তাহলে সমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।" সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, ভারতে বর্ণ অনুযায়ী পেশার বিষয়টি সমস্ত যুগেই অনুসৃত হয়ে এসেছে, আধুনিক ভারতও এক্ষেত্রে আলাদা কিছু নয়। এখানে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, প্রাচীনকাল থেকে ব্রিটিশ আসার আগে পর্যন্ত জমির মালিকানা ব্যক্তিগত থাকেনি। উদ্বৃত্ত আহরিত হতো রাষ্ট্রের দ্বারা এবং বর্ণ-ব্যবস্থায় উচ্চ-নীচ অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সেই উদ্বৃত্ত বন্টিত হত। স্বভাবতই আমরা এ কথা বলতে পারি যে, বর্ণ-ব্যবস্থা ছিল এক বিশেষ ধরনের উৎপাদন-সম্পর্ক, কারণ এটি ছিল এক মানুষের সঙ্গে আর এক মানুষের এমন এক সম্পর্ক, যে সম্পর্কের মধ্যে লোকেরা উৎপাদনে অংশগ্রহণ করছিলেন এবং সে সম্পর্কের দ্বারা সামাজিক উৎপন্নের বন্টন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। এইভাবে দু'হাজার ধরে নতুন নতুন জাতির সৃষ্টি হয়েছে।

আজকের যুগে এসেও আমরা দেখতে পাই যে, জাতি-ধর্মের নামে সমাজে কত রকমের অবিচার-অত্যাচার এবং এমনকি হত্যালীলা পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে। আদিবাসী ও দলিতরা এখনও শুধুমাত্র কঠিন কায়িক শ্রমের জন্য বিশেষভাবে নিযুক্ত হন ক্ষেত-খামার ও গভীর খনি-গর্ভের ভিতরে সব ধরনের কষ্টকর কাজের জন্য। বর্ণভেদ ও অস্পৃশ্যতা গ্রামে-গঞ্জে আমাদের সমাজকে রীতিমত পঙ্গু করে রেখেছে। এর পরও কী আমরা পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার দাবি করতে পারি ? কোনো মতেই তা পারিনা। সুতরাং এই নিরিখেও পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থা প্রবর্তনের পূর্বশর্ত কোনো মতেই পালিত হচ্ছে না।

তাই, উপরোক্ত সমস্ত তথ্য-পরিসংখ্যানই যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, কৃষি-ব্যবস্থার পুঁজিবাদীকরনের কোনো শর্তেরই পরিপূরণ হচ্ছে না, বিশেষ করে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের যখন কোনো রদবদলই হয়নি, তখন এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, চাষের পদ্ধতির ক্ষেত্রে সামান্য কিছু অদলবদল সত্বেত ভারতের আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থা বহাল তবিয়তে বিরাজমান রয়েছে। 

বিশ্লেষণ - (৫)

কৃষিক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজির ভূমিকা কী ?

আমাদের পর্যালোচনায় ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কৃষি-ব্যবস্থায় উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে নানান পদক্ষেপ নেওয়া সত্বেও কৃষি-উৎপাদনের পরিমাণগত কিছু বৃদ্ধি ছাড়া কৃষি-ব্যবস্থার চরিত্র পরিবর্তিত হওয়ার কোনো লক্ষণই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে কি এটাকে সরকারের ব্যর্থতা বলা যায় নাকি এর পিছনে অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে রয়েছে ? 

না, ব্যর্থতা নয় মোটেই। এ হচ্ছে পরিবর্তনের নাম করে কৃষি-ব্যবস্থার একটা সংষ্কার সাধনের চেষ্টা মাত্র। ভারতের শাসকশ্রেনী কখনোই চাননি কৃষি-ব্যবস্থার পুঁজিবাদীকরন করতে, কারণ এই পদক্ষেপের জন্য যে বৈপ্লবিক সদিচ্ছা শাসকশ্রেনীর মধ্যে থাকা দরকার, সেটা তাদের মধ্যে আদৌ ছিল না, এবং থাকার কথাও নয়। কারণ এই সরকার ছিল বৃহৎ মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতি তথা সামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের সম্মিলিত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী একটা সরকার, যা চরিত্রগতভাবে ছিল সাম্রাজ্যবাদের বশম্বদ-দালাল প্রকৃতির। এই সরকারের দ্বারা দেশের সমস্ত ক্ষেত্রেই পরিমিত কিছু বিকাশ সাধন সবসময়ই সাম্রাজ্যবাদের অনুমোদনযোগ্য ছিল কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপের অনুমোদন --- নৈব নৈব চ। আর তাই, কৃষি এবং শিল্পোদ্যোগ, দুটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি, ভারত সরকারের বিকাশ কার্যক্রম একটা সীমিত পর্যায় পর্যন্তই এগিয়ে নিয়ে গিয়ে হাত গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার পর থেকে নেহেরু সরকারের তরফে দেশের উন্নতিকল্পে পাঞ্জাবের ভাকরা-নাঙ্গাল জলবাঁধ থেকে শুরু করে সারা দেশব্যাপী শ'য়ে শ'য়ে জলাধার, জলবাঁধ, মাইলের পর মাইল রাস্তাঘাট, জন বসতি, বিদ্যুত যোগাযোগ ব্যবস্থা, রেল-যোগাযোগের বিস্তার, পাঁচ-পাঁচটা বিরাট বিরাট ইস্পাত কারখানার নির্মাণ, নবরত্ন সংস্থার গঠন তথা আরও কত রকমের ঔদ্যোগিক বিকাশ কার্যক্রম প্রভৃতির মাধ্যমে দেশকে প্রগতির পথে খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে হাজার রকমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কৃষি ও শিল্প বিকাশের প্রভূত উন্নতির পর অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই মাঝপথে থেমে যাওয়া হয়েছে। আর এই থেমে যাওয়াটা নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই কেন বিশেষ ভাবে কার্যকরী হল ? এই প্রশ্নেই এসে পড়ে সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকার কথা। ১৯৪৭ এর পর থেকে ভারত সরকার দেশ গঠনের লক্ষ্যে যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ক্রমাগত ভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, সেটা এই কারণে সম্ভবপর হয়েছে যে, তখন পৃথিবী ছিল দুই মেরুতে বিভক্ত, --- মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ। আর এই দুই সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যে তীব্র রেষারেষি, প্রতিযোগিতা, উত্তেজনা, সবই বিদ্যমান ছিল। এবং সেই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ভারত, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের পক্ষে থেকে দেশের অগ্রগতির কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। সোভিয়েতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেই যুগে, ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই তারিখে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৪ টি বৃহৎ ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য কয়েকটি ক্ষেত্রকে জাতীয়করণ ক'রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়াও, শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে ঔদ্যোগিক ক্ষেত্র, রেল সেবা, বিমান সেবা, বিদ্যুত যোগাযোগ, টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেলিভিশন-এর প্রসার প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রভূত উন্নতি সাধন হয়। এমনকি সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ মারফত সামরিক ক্ষেত্রেও দেশের এক বিরাট অগ্রগতির সূচনা করেন। সেই সময় ভারত এমনকি একটি বৃহৎশক্তি হয়ে ওঠারও স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু এরপর আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। ১৯৮০'র দশক আসতে আসতে সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে যথেষ্ট দূর্বল হয়ে পড়ে। সেই অবস্থায় তাঁরা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার তাগিদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আপস মূলক কিছু সামরিক চুক্তির প্রস্তাব পেশ করে। এরপর ৮ ই ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই দুই দেশের মধ্যে পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকারান্তরে এইসব চুক্তি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্বলতার সাক্ষ্য বহনকারী এবং একপ্রকার আত্মসমর্পণের সামিল,যা সারা বিশ্ব বুঝে উঠতে দেরি করেনি। ভারতও এই পরিবর্তিত অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শিবির বদল করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। এরপর ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং রাশিয়ায় পুনরায় ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার  ঘোষণা করা হয়। আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে বিশ্ব হয়ে পড়ে একমেরুবিশ্ব। দোর্দন্ডপ্রতাপ হয়ে ওঠে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর সারা বিশ্বব্যাপী নিজের প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে, বিশ্বায়ন ও লগ্নি পুঁজির বিশ্বময় কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে। ইতিমধ্যে ভারতের কংগ্রেস সরকারও ভোল পাল্টে ধীরে ধীরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয় এবং ১৯৯১ সালেই প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও-এর কংগ্রেস মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী শ্রী মনমোহন সিং দ্বারা অর্থনৈতিক উদারীকরণের নীতি প্রণয়ন করে ভারতকে নতুন বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের এক অনুগত সভ্য হিসেবে জাহির করে। কিন্তু কী ছিল এই অর্থনৈতিক উদারীকরণ ? আসুন সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক বিষয়টিকে।

প্রকৃতপক্ষে আর্থিক উদারীকরণ নীতি ছিল ভারতের অর্থনীতিকে উদার চরিত্র অর্পণ করে মার্কেট এবং সার্ভিস সহায়ক করে তোলা এবং প্রাইভেট ও ফরেন ইনভেস্টমেন্ট-এর ভূমিকাকে প্রসারিত করা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, সেটা করা হয়েছিল তৎকালীন অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ও আই এম এফ-এর কাছ থেকে Bail out package হিসেবে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের লোন নেওয়ার শর্ত হিসেবে। বস্তুত পক্ষে আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে যে সমস্ত পরিবর্তন আনা হয়েছিল তার মধ্যে পড়ে, আমদানী শুল্ক কম করা, বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া, আন্তর্জাতিক লগ্নির ক্ষেত্রে ট্যাক্স কম করা এবং বৃহত্তর বৈদেশিক পুঁজি নিবেশের দ্বার উন্মুক্ত করা। এবং এইসবই করা হয়েছিল তৎকালীন সরকার দ্বারা ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিশাল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথ সুগম করার লক্ষ্য নিয়ে। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ দেশের ভিতরে, এই উদারীকরণের সামগ্রিক লক্ষ্য ছিল কৃষি-ক্ষেত্রে ভরতুকি কম করে আনা এবং ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফল হিসেবে অর্জিত নানা অধিকার-সমৃদ্ধ শ্রম-নীতিকে লঘু করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথ সুগম করা। তখন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত পার্টি নির্বিশেষে সমস্ত সরকারই এই নীতিকে বহাল রেখেছে এবং উপরোক্ত জনবিরোধী নীতিসমূহকে কার্যকরী করতে উঠে পড়ে লেগেছে, যা প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদের অনুগত থেকে তার পদ-সেবায় নিয়োজিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

এটাই সাম্রাজ্যবাদের যুগে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সরকার সমূহের সমঝোতাপন্থী পথ। আর আমাদের দেশও সেই পথকেই অবলম্বন করেছে।

এরকম একটি পশ্চাদপদ দেশের কৃষি বিকাশের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা হচ্ছে,  বিকাশ-নিয়ন্ত্রণকারী এক শোষকের ভূমিকা। ভারতের মত দেশগুলোকে শুধু তাঁদের সেবা করে যেতে হবে ---  কিন্তু দেশের কৃষি বা শিল্পের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মত অবস্থায় উন্নীত হওয়া চলবে না। আর মহাশক্তির তকমা নিয়ে তেঁনারা আমাদের কৃষির উন্নতির কথা বলে একদিকে 'মনসান্টো'র মত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো থেকে শস্য-বীজ, সার ইত্যাদি আমদানি করতে চাপ দেবেন, আরেক দিকে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে উৎসাহিক করবেন।

১৯৭০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, ভারতের কৃষি বিকাশকে কেন্দ্র করে ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু ঠিক কত পরিমাণ বাড়িয়েছে এবং সার্বিক ঋণের অঙ্গ ঠিক কত, তার কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়নি। তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি আনুমানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ এর মধ্যে কৃষিতে ডাইরেক্ট ও ইনডাইরেক্ট সব ধরনের প্রতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে ২,৬২১.৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫,৭২২.৩ কোটি টাকা হয়েছিল।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে কৃষির উন্নতির নাম করে কী ভাবে কৃষকদের ঋণের জালে বেঁধে নেওয়া হয়েছে। অথচ কৃষকদের আয় বৃদ্ধি হওয়া তো দূরের কথা, ক্রমশই জীবনধারণের পক্ষে তা রীতিমত অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ছে। আর তার পরিণাম স্বরূপ কৃষকদের ঋণের দায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। ৩ মে, ২০১৭ তারিখে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মাননীয় সুপ্রিম কোর্টকে এক লিখিত বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছে যে, ২০১৩ থেকে প্রতি বৎসর গড়ে ১২,০০০ এর বেশি কৃষকের আত্মহত্যার খবর তাদের কাছে রয়েছে। যদিও একটি অসমর্থিত খবর অনুযায়ী ভারতে বিগত বছরগুলিতে আনুমানিক ১,৫০,০০০ (এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) কৃষক ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন। এই হচ্ছে কৃষকদের ঋণের জালে জড়ানোর পরিণতি আর এই হচ্ছে আমাদের কৃষি-ব্যবস্থা। একেও যদি কেউ বিকশিত পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থা বলে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করে, তবে আর কিছু বলার থাকে না। 

যাইহোক, উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে এটাই পরিস্ফুট হচ্ছে যে ভারত ও অন্যান্য পশ্চাদপদ দেশগুলোর কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ভূমিকা ও উদ্দেশ্য একটাই, --- এই সমস্ত দেশের কৃষি-ব্যবস্থার গুণগত কোনো পরিবর্তনকে নস্যাৎ করে কেবলমাত্র পরিমাণগত উন্নয়নের সুফলের লোভ দেখিয়ে ক্রমাগত ভাবে তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদীদের নানান পণ্যের গ্রাহক করে রাখা এবং ঋণের জালে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর একেকটি কূপমন্ডূক দেশ-এ পরিনত করে রাখা। আর পশ্চাপদ এইসব দেশের সরকারগুলোর ভূমিকা হচ্ছে --- পুরোপুরি সুবোধ বালক স্বরূপ তাদের যাবতীয় আজ্ঞা-পালন করে যাওয়া।

তাই সবশেষে এ কথাই বলা যায় যে, আমাদের মত পশ্চাদপদ দেশগুলো, সংযুক্ত সংগ্রাম মারফত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারলে শুধু আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থা কেন, কোনো রকম ব্যাবস্থারই মৌলিক কোনো পরিবর্তনই করা কোনো ক্রমেই সম্ভব হবে না।


- সমাপ্ত -


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>

সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম - অনুবাদে রুমা নিয়োগী(প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)

ইস্ক্রার সম্পাদকীয় বোর্ডের ঘোষণা