বলশেভিকবাদের সেরা দুশমন ট্রটস্কি (চতুর্থ তথা শেষ পর্ব) - বোধায়ন রায়





(এই প্রবন্ধটি “Towards A New Dawn…the other voice of the people magazine”-এ ২০১২ সালের জানুয়ারি – ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটিকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন চারুদত্ত নীহারিকা রজত)


(চতুর্থ তথা শেষ পর্ব)


সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কৃত হবার পর প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ডঃ

বহিষ্কারের পর, ট্রটস্কির, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রোলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্রের প্রতি বিরোধিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। একদিকে, বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমের মাধ্যমে, যেটির দ্বারা তিনি বেশ ভালোমতন উপার্জন করেছিলেন এবং অপরদিকে, অক্টোবর বিপ্লবের প্রতি বিশ্বস্ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের খুন করবার জন্য ষড়যন্ত্রের দ্বারা তিনি, পুঁজিবাদী প্রতিক্রিয়ার তরফে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করেন।

১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে, ওয়াল স্ট্রিটের পতনের আরম্ভের মধ্যে, যেটিকে এখন আমরা মহামন্দা বলে জানি, পুঁজিবাদ তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংকটকে প্রত্যক্ষ করে। এটি আমেরিকা থেকে শুরু হয়ে প্রত্যেক পুঁজিবাদী দেশ এবং প্রত্যেক উপনিবেশকে প্রভাবিত করে এবং এটি ১৯৪০ সালের গোড়া পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যদিও, আমেরিকার মতন কিছু অর্থনীতি ১৯৩৪ সালের আশপাশ নাগদ এটিকে কিছুটা সামলাতে সক্ষম হয় কিন্তু, কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯৩৭-৩৮ সালে তারা আবার একটি মন্দার সম্মুখীন হয়। ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে আমেরিকায়  উৎপাদন কমে যায় ৪৬%, অপরদিকে বেকারি বৃদ্ধি পায় ৬০৭%। আমেরিকা এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির উপনিবেশ ছিল, যেখান থেকে তারা আরও বেশি লুঠ করে মন্দার প্রভাব কে কম করতে পারতো। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, নীতিগতভাবে কোনও উপনিবেশের উপর নির্ভর করতো না এবং তৎসত্ত্বেও, তারা মন্দার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ১৯২৯-১৯৩২-এ তাদের শিল্প উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছিল এবং সেটি ধারাবাহিক ভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে, ট্রটস্কি লিখলেন, “আংশিক সংকট ধীরে ধীরে একটি সাধারণ সংকটে পরিণত হচ্ছে এবং তা ক্রমে বেড়েই চলেছে। এটি নিজেকে প্রকাশ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যে, জনগণের শক্তির বিপুল ব্যয় ও মহানতম প্রযুক্তিগত সাফল্য সত্ত্বেও, তারা অর্থনৈতিক সাফল্য পিছিয়ে থাকছে এবং জনগণের একটি বিপুল অংশ দারিদ্র-সঙ্কুল অবস্থার মধ্যে পড়ে থাকছে।“ এইটিই হল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির, বিশেষত আমেরিকার, সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচার করা মিথ্যা। ১৯৩২ সালে তিনি তার “The Soviet Economy in Danger”-এ লিখেছিলেন, “একদিকে অর্থনীতির সাধারণ বৃদ্ধি এবং অপরদিকে নতুন নতুন চাহিদার এবং অসাম্যের বৃদ্ধি, নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব অর্থনীতির সাথে যুক্ত হবার প্রয়োজনীয়তাকে বৃদ্ধি করে। “স্বাধীনতার” কর্মসূচী, অর্থাৎ সোভিয়েত অর্থনীতির স্বনির্ভর চরিত্র, আরও বেশি বেশি করে এর প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে উন্মোচিত করছে। স্বেচ্ছাচারিতা হিটলারের বিশিষ্টতা, মার্কস বা লেনিনের নয়।“ আসুন, এই বিবৃতির সার্বিক যৌক্তিকতাকে পরীক্ষা করে দেখা যাক। প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়নে “অসাম্য” ধীরে ধীরে কমছিল। প্রকৃতপক্ষে, নির্দিষ্ট ভাবে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটছিল কারণ, সোভিয়েত জনগণের জীবনমানের উন্নতি ঘটেছিল। দ্বিতীয়ত, যদি একটি শিল্পে বিকাশমান সমাজতান্ত্রিক দেশে চাহিদা বৃদ্ধি পায়, তাহলে কেন তাকে, নিজের সম্পদের বিকাশ ঘটিয়ে আত্মনির্ভর হবার বদলে বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সংযোগ সাধনের দিকে নজর দিতে হবে? আগেই যেরকম বলা হয়েছে, লেনিন, একটি দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তুলবার শর্তগুলি নির্দিষ্ট ভাবে বর্ণনা করে গেছেন। অপরদিকে, হিটলারের স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে পড়ে দাস বানানো এবং ইহুদীদের, “অনার্যদের”, নিকেশ করা। এইভাবেই ট্রটস্কি, স্তালিনকে হিটলারের সাথে তুলনা করেন এবং এর দ্বারা, সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজমকে নাৎসিবাদের সাথে তুলনা করে পুঁজিবাদী পরিকল্পনার সাথে সহযোগিতা করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি তার “Revolution Betrayed”-এ দাবি করলেন যে, কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে “সোভিয়েত আমলাতন্ত্র”, অন্যান্য আমলাতন্ত্র, বিশেষত ফ্যাসিবাদী আমলাতন্ত্রের মতনই। এটিই হল কারণ, যে কেন সেই সমস্ত বইয়ের দোকানে ট্রটস্কির বই পাওয়া যায় যেখানে, মার্কস এমনকি লেনিন বা স্তালিনেরও বই পাওয়া যায় না; কারণ ট্রটস্কি একজন সচেতন বুর্জোয়া প্রচারক হয়ে উঠেছিলেন।  

ট্রটস্কি তার গুলিয়ে দেওয়া এবং ভ্রান্ত তত্ত্বের প্রচার চালিয়ে যেতে থাকলেন। ১৯২৭ সালে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জাতীয়তাবাদী কুয়োমিংতানিরা বিশ্বাসঘাতকতা করে। এরই ফলশ্রুতিতে, শহরে হাজারে হাজারে কমিউনিস্ট নিধন যজ্ঞ সংঘটিত হয়। এই ঘটনার পিছনে ছিল, তৎকালীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীদের, সাধারণ সম্পাদক চেন তু শিউ এবং তার অনুগামীদের, ভুল লাইন। চেন তু শিউ-কে পদচ্যুত করা হয় তার ভুল লাইনের জন্য। কিন্তু, এরপর তিনি যখন পার্টি শৃঙ্খলা ভেঙে, প্রকাশ্যে পার্টির সমালোচনা শুরু করেন, যেরকমটি ট্রটস্কি কয়েকবছর আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নে করেছিলেন, তাকে ১৯২৯ সালে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর চেন একজন ট্রটস্কিপন্থী হয়ে যান। কুয়োমিংতানিরা তাকে গ্রেপ্তার করে এবং জেলে পুরে দেয়। ১৯৪২ সালে মৃত্যুর আগে, তিনি প্রকাশ্যেই একজন মার্কসবাদ বিরোধী হয়ে ওঠেন এবং বুর্জোয়া ও প্রোলেতারিয় গণতন্ত্রের মধ্যে, কোনও প্রকার গুণগত প্রভেদকে স্বীকার  করতে অস্বীকার করেন। ১৯২৭ সালের ম্যাসাকারের সময়কার চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও তার কেন্দ্রীয় কমিটির গঠন সম্পর্কে ট্রটস্কি সম্পূর্ণরূপে অবগত ছিলেন। কিন্তু তবু তিনি “স্তালিনবাদী” গোষ্ঠীর উপর দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের দায় চাপালেন। তিনি আবারও কৃষকদের প্রতি অবজ্ঞার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এলেন। ১৯৩৯ সালে তিনি তার “Peasant War In China And The Proletariat”-এ লিখলেন, “ধরা যাক চীনের, বিরোধী বামপন্থীরা (Left opposition) অদূর ভবিষ্যতে শিল্প-প্রোলেতারিয়েতদের মধ্যে সফল ভাবে এবং ব্যপক ভাবে কাজ করতে সক্ষম হলেন এবং, তাদের অধিকাংশের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলেন। ইতিমধ্যে, সরকারি পার্টি, তাদের সমস্ত শক্তিকে “লাল ফৌজের” উপর নিবদ্ধ করলো এবং সেটি করলো কৃষক প্রধান অঞ্চলে। আসল ঘটনাটি ঘটবে তখনই, যখনই, কৃষক  বাহিনী, শিল্প কেন্দ্রগুলিকে দখল করে নেবে এবং শ্রমিকদের সাথে তারা মুখোমুখি হবে। এইরকম অবস্থাকে চীনা স্তালিনবাদীরা কি ভাবে সামলাবে? এটা বোঝা খুব একটা কঠিন নয় যে, তারা কৃষক বাহিনীকে “ট্রটস্কিপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল”-দের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক ভাবে খাড়া করে দেবে। অন্যভাবে বললে, তারা সশস্ত্র কৃষকদেরকে, এগিয়ে থাকা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করবে।“ এ কথা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, ট্রটস্কির চিরস্থায়ী বিপ্লবের পচা তত্ত্বের বর্ণনার জন্য, যা প্রোলেতারিয়েত এবং কৃষকদের মধ্যেকার যুদ্ধের উদ্ভট কল্পনা করেছিল, চীনা ট্রটস্কিপন্থীরা কোনোদিনই  শ্রমিক শ্রেণিকে, সেই পর্যায় পর্যন্ত সংগঠিত করতে এগিয়ে আসে নি। শ্রমিক শ্রেণি এবং কৃষকরা কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে লড়েছিল এবং চীনা “স্তালিনবাদীদের” নেতৃত্বে একটি সফল বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলো।

১৯৩৪ সালের জুন মাসে, ট্রটস্কি প্রস্তাব করলেন, ফরাসী ট্রটস্কিপন্থীরা French Section of the Workers’ International (SFIO)-এ যুক্ত হবার জন্য, নিজেদের কমিউনিস্ট লিগ এবং যুব বিভাগকে ভেঙে দিক। সেই থেকে, ট্রটস্কিপন্থীদের মধ্যে এই লাইন খুবই জনপ্রিয়। লেনিনবাদ, সংশোধনবাদী বা বুর্জোয়া সংগঠনে যুক্ত হওয়া অনুমোদন করে তাদেরকে একটা মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করে বিপ্লবের কর্মসূচীকে ছড়িয়ে দেবার স্বার্থে, কিন্তু সেটা কখনওই কমিউনিস্টদের নিজেদের সংগঠনকে, যেটা শ্রমিক শ্রেণিকে প্রস্তুত করবার প্রধান যন্ত্র, তাকে বজায় না রেখে নয়। যদি কোনও আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচী, নিজেদের সংগঠনের বিলোপ ঘটিয়ে, বুর্জোয়া সংগঠনে প্রবেশ করা হয় তাহলে, সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের কাউকেই কোনও জায়গায়, কারোর কাছে দায়বদ্ধ করা যায় না; তারা, বুর্জোয়া সংগঠনে মিশে যাবার অঙ্গ হিসাবে অবশ্যম্ভাবীরূপে বুর্জোয়া উপাদানে অধঃপতিত হবে এবং বুর্জোয়াদের দোষগুলিকে নিজেদের মধ্যে প্রবেশ করাবে। এর ফলে, ঐ সংগঠনগুলিতে বিপ্লবী কাজকর্ম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত সেই কাজের কোনও উল্লেখও কেউ করবে না। ট্রটস্কি ধারার এই প্রকার অনুপ্রবেশের তত্ত্ব, বিলোপবাদের একটি তাত্ত্বিক অজুহাতে পরিণত হয়েছে।

নিশ্চিতভাবেই, স্তালিন এবং C.P.S.U.-র নির্দিষ্ট কিছু ভুল রয়েছে, যেগুলিকে ট্রটস্কি নিজের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, স্তালিন, সমাজতন্ত্রে, শ্রেণি সংগ্রামের চলমানতাকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে, শ্রেণি সংগ্রামের সমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। বহিঃশত্রুকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান শত্রু হিসাবে দেখা হয়েছিল। এতেকোরে, সোভিয়েত নেতৃত্ব চেয়েছিল, আন্তর্জাতিকভাবে সমস্ত সম্ভাবনাময় শক্তি, ফ্যাসিবাদ তাদের প্রধান শত্রু, এই ঘোষণা করুক। ভারতের জনগণের জন্য এটি ছিল একটি ভুল চিন্তাধারা, কারণ তাদের প্রধান শত্রু আসলে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। অবশ্য, সোভিয়েত নেতৃত্ব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে, তাদের ধারণাকে গ্রহণ করবার জন্য কোনও প্রকার জোর করে নি। এই ধারণা, ভারতের সংশোধনবাদী নেতৃত্বের দ্বারা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে গৃহীত হয়েছিল, যারা চাইলে, নিজেদের অভিজ্ঞতার নিরিখে, একটি সঠিক লাইন তৈরি করতে পারতেন। এই সুযোগ ট্রটস্কি গ্রহণ করেন এবং ১৯৩৯ সালে তিনি লেখেন, “An Open Letter to the Workers of India” এবং স্তালিনকে সমালোচনার আহ্ববান জানান। এ কথা না বললেও চলে যে, এই চিঠি ভারতীয় শ্রমিকদের বিশাল অংশের কাছে কোনওদিনও পৌঁছায় নি, যদিও কিছু ভারতীয় ট্রটস্কিপন্থী এটিকে ছাপিয়েছিলেন। ভারতের ট্রটস্কিপন্থী পার্টিগুলি চিরকালই খুবই ছোট এবং তারা তাদের কাজকর্মকে বিপ্লবী বুলি ঝাড়বার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে এসেছে। তাদের এমন কোনও কর্মকাণ্ড নেই যা, তাদেরকে বিপ্লবী হিসাবে সনাক্ত করতে পারে। অপরদিকে, আজ পর্যন্ত, ভারতের সমস্ত কমিউনিস্ট আন্দোলন, কঠোরভাবে স্তালিনকে সমর্থন করে এসেছে।

তত্ত্ব এবং মিথ্যা প্রচারের দ্বারা বলশেভিকদের মোকাবিলা করতে না পেরে, ট্রটস্কি এবার ঝুঁকলেন সন্ত্রাসবাদের দিকে। ১৯৩৪ সালের  পয়লা ডিসেম্বর, C.P.S.U.(B)-র পলিটব্যুরোর সদস্য, সেরগেই   কিরভ খুন হলেন। খুনি হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় এবং  জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায়, যে তিনি ট্রটস্কি ও সোভিয়েত নেতা কামেনেভ এবং জিনোভিয়েভের মতন কয়েকজনের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি সন্ত্রাসবাদী চক্রের সাথে যুক্ত। এই সন্ত্রাসবাদী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের বিচার হয় এবং ১৯৩৮ সালের মধ্যে তাদের প্রাণদণ্ড বা জেল হয়। এই ঘটনাপরম্পরাকে আমরা জানি মস্কো মামলা নামে। অধিকাংশ বিচার-ই সংঘটিত হয়েছিল প্রকাশ্যে। অভিযুক্তরা তাদের অপরাধ স্বীকার করে নেয়। ট্রটস্কিপন্থীরা এবং পুঁজিবাদী প্রকাশ্য-প্রতিক্রিয়াশীলরা, বিদেশ থেকে এই বিচারের নিন্দা করে এবং একে একটি লোকদেখানো বিচার বলে অভিহিত করে ও সোভিয়েত সরকারকে অত্যাচারের অভিযোগে  অভিযুক্ত করে, কিন্তু অভিযুক্তদের চেহারায় কোনও অত্যাচারের চিহ্ন দেখা যায় নি। সারা দুনিয়া জুড়ে বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম এই বিচারকে মানতে অস্বীকার করে এবং অভিযুক্তদের “মহান বিপ্লবী” বলে তুলে ধরে; যদিও তারা একথা উল্লেখ কখনও করে নি যে, তাদের স্বীকারোক্তিগুলিকে, প্রচুর প্রমান ব্যতিত অন্য কিছুর ভিত্তিতে যাচাই করা হয়েছে; হলে হয়তো কোনও অভিযুক্ত, আচমকাই বিশাল “স্তালিনীয় ষড়যন্ত্র”-এর বিষয়ে কিছু বলতেন। বিদেশে ট্রটস্কিপন্থীরা বললেন, যে স্তালিন “পোড় খাওয়া বলশেভিক সেনাদের খুন করেছে” কিন্তু বাস্তবে, অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে, তখনকার অধিকাংশ নেতৃত্বস্থানীয় বলশেভিক, পার্টিতে রয়েছেন কমপক্ষে তিরিশ বছর যাবৎ। যদিও তারা ১৯১৭ সালে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন না, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ অক্টোবর বিপ্লব এবং গৃহযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ট্রটস্কিপন্থী সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় এবং বিচারের পদ্ধতির জবাবে, অন্যান্য সোভিয়েত বিরোধীদের সাথে আমেরিকার ট্রটস্কিপন্থীরা একটি ছদ্ম বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়া চালু করে, ট্রটস্কির নিরপরাধ ভাবমূর্তিকে কায়দা করে তুলে ধরবার জন্য। এর নাম ছিল, “American Committee for the Defence of Leon Trotsky”. এই কমিটি কিছু লিবারাল বুদ্ধিজীবীদেরকে এর মধ্যে যুক্ত করেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পদত্যাগও করেন। এই পদত্যাগিদের মধ্যে একজন হলেন মরিৎস হলগ্রিন যিনি প্রকাশ্যে তার পদত্যাগের কারণ হিসাবে বলেন, “তার জন্য ন্যায়ের দাবিতে বর্তমানের লিবারাল আন্দোলন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি ট্রটস্কিপন্থী পরিকল্পনা ব্যতিত আর কিছুই নয় …… American Committee for the Defence of Leon Trotsky সম্ভবত তাদের অজ্ঞাতসারেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের একটি ট্রটস্কিপন্থী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।“

কমিটির অনুসন্ধান কমিটি, যা ডু ই কমিশন নামে পরিচিত, একটা বড় নাটক সাজালো, যাতে ট্রটস্কিকে নিরপরাধ হিসাবে চিত্রিত  করা যায়। ডু ই কমিশন, প্রকাশ্য ভাবে লেনিনবাদ বিরোধী জন ডু ই এবং অটো রুলেকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই কমিশনের শুনানির সময় ট্রটস্কি, প্যাটাকভ এবং রাদেক-এর বিচার সম্পর্কিত তার নিজের সই করা একটি বিবৃতি, আমেরিকার কুখ্যাত হারস্ট প্রেসকে দেবার কথা অস্বীকার করেন। সেখানে লেখা হয়েছিল,”কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে স্তালিন নিজেকে সমস্ত সমালোচনা এবং রাষ্ট্রের উপরে স্থাপন করেছেন …… তাকে খুন করা ছাড়া স্থানচ্যুত করা সম্ভব নয়। ট্রটস্কি, হারস্ট প্রেসকে, তার একাধিক প্রবন্ধ চুরি করবার দায়ে অভিযুক্ত করেন; যার মধ্যে বেশ কিছু প্রবন্ধ তিনি বুর্জোয়া প্রেসকে বিক্রি করেছিলেন। সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে ট্রটস্কিপন্থীদের পুরানো অভিযোগ ছিল যে, তারা “অভিযুক্তদের” সাথে কপটতা করছে। কিন্তু তারা এটার কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারে নি যে, কেন সমস্ত অভিযুক্তরা বিচারের প্রতিটি পর্যায়ে এই ধরণের প্রতারণার ফাঁদে পা দেবে,  যখন তারা দেখতে পাচ্ছেন যে তাদের পূর্বসূরিদের মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে বা শাস্তি হচ্ছে? অথবা বহু দশকের বিপ্লবী কাজের অভিজ্ঞতার পর এই ধরণের বিশাল এবং অবমাননাকর অভিযোগককেই বা তারা কেন মেনে নেবেন? এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ট্রটস্কি উত্তর দিয়েছিলেন,  “আমি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে বাধ্য নই।“ ঐ কমিশনের একজন সদস্য, কার্লটেন বিল, কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন যখন তাকে ট্রটস্কিকে ঠিক ভাবে জেরা করা থেকে বিরত করা হয়। ট্রটস্কিদের এই দুর্বল নাটক, আসলে প্রকৃত কমিউনিস্টদের সামনে ট্রটস্কিপন্থীদের আরও বেশি করে বেনাকাব করে দেয়। এরপর, ট্রটস্কি, তার ক্রোধকে প্রকাশ করবার জন্য, স্তালিনের উপর আরও অপবাদপূর্ণ আক্রমণ নামিয়ে আনেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ভবিষ্যৎবাণী করেন। ১৯৩৯ সালে, তিনি তার বই, “Revolution Betrayed”-এ লিখলেন, “আমরা এমন কি এই প্রত্যাশাও করতে পারি, যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আগামী মহাযুদ্ধ থেকে পরাজয় ব্যতিত, আর কোনোভাবে পরিত্রাণ পেতে পারে? এই খোলামেলা প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলিঃ যদি যুদ্ধটা শুধু যুদ্ধ-ই থাকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। প্রাযুক্তিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক জায়গা থেকে, সাম্রাজ্যবাদ তুলনামূলক ভাবে অসম্ভব শক্তিশালী। যদি এই শক্তি, পশ্চিমের বিপ্লবের দ্বারা অতি দুর্বল না হয়, তাহলে তা এই সাম্রাজ্যকে, যে সাম্রাজ্য অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জেগে উঠেছিল, তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।“ আমরা সবাই জানি, পরবর্তী বছরগুলিতে, ইতিহাস, ট্রটস্কির লাইন অনুযায়ী প্রবাহিত হতে একেবারেই রাজি হয় নি।

১৯৪০ সালের ২৪-শে অক্টোবর, ট্রটস্কি, তার মেক্সিকোর দুর্গে, র‍্যামোন মিরকাডের-এর দ্বারা খুন হন। র‍্যামোন মিরকাডের বেশ কিছু মাস যাবৎ ট্রটকির ঘনিস্ট সহযোগী ছিলেন। আততায়ী, ছদ্ম নামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন এবং অভিযোগ যে তিনি N.K.V.D.-র একজন এজেন্ট ছিলেন। অবশ্য, র‍্যামোন মিরকাডের এই হিংস্র প্রত্যাঘাতের জন্য, তার ব্যক্তিগত জীবনে ট্রটস্কির নাকগলানোকে দায়ি করে। ট্রটস্কির মৃত্যুর সাথে সাথে, ট্রটস্কিবাদী আন্দোলন, সারা দুনিয়া জুড়ে অনেক টুকরে ভেঙে যায়। প্রায়শই তারা পরস্পরের প্রতি মারাত্মক বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন এবং পরস্পর পরস্পরকে “স্তালিনবাদী” বলে অভিযুক্ত করেন। কিন্তু একটি বিষয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ; আর সেটি হল, সমস্ত চলমান শ্রেণি সংগ্রামের বিরোধিতা। ট্রটস্কিবাদীরা “স্তালিনবাদ”-কে আমলাতান্ত্রিক বলে সমালোচনা করে, কিন্তু তারা নিজেরা বুর্জোয়া দেশের সরকারে যোগ দিয়েছে, এবং এমন সরকারেও যোগ দিয়েছে যারা প্রত্যক্ষভাবে উপনিবেশবাদের নীতি নিয়ে চলেছে বা, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সামরিক অত্যাচার নামিয়ে আনছে; উদাহরণ যথাক্রমে, গ্রেট ব্রিটেন এবং শ্রীলঙ্কা। ট্রটস্কিপন্থীদের তত্ত্বের বহুপ্রকার শাখাপ্রশাখা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ কেউ উপনিবেশে সামন্তবাদের উপস্থিতিকে স্বীকার করে নেয়, যখন অপরপক্ষ সারা পৃথিবী জুড়ে পুঁজিবাদী  ব্যবস্থার বর্তমান থাকার দাবি করে। লেনিনবাদের প্রতি তাদের ঘৃণা এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যে, তারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য গ্রহান্তরের জীবদের সাথে যোগাযোগের পরিকল্পনা  করছে। ট্রটস্কিপন্থী জুয়ান পোসাডাস তার অনুগামীদের কাছে আবেদন করেনঃ “যখন তারা হস্তক্ষেপের জন্য আসবে, তখন আমরা, গ্রহান্তরের জীবদের কাছে আবেদন জানাবো পৃথিবীর অধিবাসীদের সাথে সহযোগিতা করতে, যাতে তারা, তাদের দুর্দশা  থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। আমরা তাদের কাছে আহ্ববান  জানাবো, যাতে তারা আমাদের সাহায্য করবার জন্য, তাদের সাধনগুলিকে ব্যবহার করে।“ এটা অবশ্য সত্যি, যে যদি ট্রটস্কিপন্থীরা প্রোলেতারিয়েতের অগ্রবাহিনী হয়, তাহলে একমাত্র গ্রহান্তরের জীবরাই সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে! ট্রটস্কিবাদের বিপদ এমনকি সেই সব সংগঠনেও বর্তমান, যারা মুখে তার বিরোধিতা করে। খ্রুশ্চেভের তীব্র ভাবে স্তালিনকে বাতিল করা, আসলে ট্রটস্কির চিন্তাধারা থেকেই ধার করা, তারই অভিযোগে পূর্ণ – স্বাধীনতা খর্ব করা, মস্কো মামলায় অত্যাচার করা। হোজার, মাও সেতুং-এর বিরোধিতা প্রতিধ্বনিত করে ট্রটস্কির কৃষকদের গুরুত্ব না দেওয়া। নেপালে বিপ্লবের তুঙ্গ অবস্থায়, বাবুরাম ভট্টরাই মন্তব্য করেন, “প্রোলেতারিয়েতের লক্ষে অগ্রসর হবার প্রশ্নে, ট্রটস্কিবাদ, স্তালিনবাদের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।“ এরপর বাবুরাম ভট্টরাই অগ্রসর হয়ে বিপ্লবী পার্টি, লাল ফৌজ এবং বিপ্লবী ক্ষমতার যন্ত্রগুলির বিলোপ ঘটাতে উদ্যোগী হন। ট্রটস্কিবাদের বিপদকে শুধুমাত্র, তার প্রকাশ্য অনুসরণকারীদের অস্বীকার করবার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না; তার তাত্ত্বিক দিকগুলিকে অধ্যায়ন ও মোকাবিলা কোরে এবং যখনই, সেগুলির কোনও বিপ্লবী সংগঠনের মধ্যে আবির্ভাব ঘটবে, তা সে যে আকারেই আসুক না  কেন, তাকে চিহ্নিত করবার মধ্যে দিয়েই তাকে প্রতিরোধ ও পরাস্ত করা সম্ভব হবে। 

@@@সমাপ্ত @@@

বোধায়ন রায়ের সাথে bodhayan.roy@gmail.com এ যোগাযোগ করা যেতে পারে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>

সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম - অনুবাদে রুমা নিয়োগী(প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)

ইস্ক্রার সম্পাদকীয় বোর্ডের ঘোষণা