কমিউনিস্ট দ্বন্দ্বতত্ত্বের ইতিহাস (সংকলিত এবং অনুদিত)

 

 



কমিউনিস্ট দ্বন্দ্ব-তত্ত্বের ইতিহাস

 

 

বৈপ্লবিক তত্ত্ব ছাড়া কোন বৈপ্লবিক আন্দোলন হতে পারে না” - কি করতে হবে’ – লেনিন


মার্ক্সবাদের পূর্বে দ্বান্দ্বিক চিন্তাভাবনাঃ

দ্বন্দ্বের (dialectics) কেন্দ্রীয় ধারণা হল, বিপরীতের ঐক্য এবং সংগ্রাম;  অর্থাৎ সম্পর্কিত বিষয়ের (বস্তু বা বস্তুর চেতনার) বিপরীতমুখী ঝোঁকের একসাথে জুড়ে থাকা এবং বস্তুর পরিবর্তন ও বিকাশের কারন। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দর্শন হল কমিউনিজমের বিজ্ঞানের জন্য অপরিহার্য। কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট দর্শনের প্রবর্তক; তবে তাঁরা এই দর্শনকে শূন্য থেকে  সৃষ্টি করেন নি। তারা এমন একটি ধারণাকে বিকশিত করেছিলেন  যার ইতিহাস, ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরানো এবং  যে ধারণা ভারত এবং চীনে স্বাধীন ভাবে বিকশিত হয়েছিল  আমরা এখানে এই ধারণার আদিতম এবং সাম্প্রতিকতম স্তরই শুধু উল্লেখ করবো।

একেবারে প্রথমদিককার উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় দ্বান্দ্বিক চিন্তাবিদ ছিলেন গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস। হেরাক্লিটাস বেঁচেছিলেন আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বর্তমান পশ্চিম-তুর্কি  অঞ্চলে। হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, সংঘর্ষ বা conflict হল সর্বজনীন। এটিই সবকিছুর জনক  এবং এই সংঘর্ষ বা conflict এর কারণেই কেউ হয় দাস, আবার কেউ বা স্বাধীন। হেরাক্লিটাস জোর দিয়ে বলতেন যে, বস্তুর বিপরীত গুণগুলি একই সময়ে অবস্থান করে। যেমন, সমুদ্রের জল একই সাথে প্রচণ্ড বিশুদ্ধ এবং প্রচণ্ড বিস্বাদ; মাছেদের জন্য এই জল পানযোগ্য এবং জীবনদায়ী, কিন্তু মানুষের  জন্য এটি পানের অযোগ্য এবং মারাত্মক। লেখনী একই সাথে ঋজু এবং বাঁকা। তিনি চিহ্নিত করেছিলেন যে, বস্তুর, তার বিপরীতের সাথে একটি যোগসূত্রে বর্তমান যা নিজেতে ফেরত  আসে। যেমন একটি ধনুকের ছিলা বা একটি সুরবাহারের তার।   হেরাক্লিটাস সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, সব কিছুই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এরজন্যই একই নদীতে দুবার নামা যায় না  যেহেতু, বিভিন্ন  জল প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে। তিনি আরও বলেছিলেন বস্তুর মধ্যে, তার বিপরীতে পরিবর্তিত হবার ঝোঁক বর্তমান। যেমন অসুস্থতা পরিবর্তিত হয় সুস্থতায়, ক্লান্তি পরিবর্তিত হয় বিশ্রামে, উষ্ণতা পরিবর্তিত হয় শীতলতায় প্রভৃতি।

 

হেরাক্লিটাসের ধারণাকে অধিকাংশ গ্রীক দার্শনিকই ভালো ভাবে গ্রহণ করেন নি। তারা প্রাকৃতিক জগৎ-এ এবং সামাজিক জীবনে স্থায়িত্ব (stability) দেখতে চাইতেন। তারা চাইতেন দাস সমাজের মধ্যে, যে  শ্রেণীর তারা প্রতিনিধিত্ব করতেন, তা যেন অনন্তকাল   বজায় থাকে। হেরাক্লিটাসের বিরোধীদের করা সমালোচনা তার চিন্তাকে  ছড়িয়ে দিয়েছিল যা, পরবর্তী প্রজন্মকে, প্রভাবিত করেছিল।

হেগেলের অবদানঃ

মার্ক্সবাদের আসার আগে, দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে শেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন জার্মান দার্শনিক জি।এফ।ডাব্লিউ।হেগেল। হেগেল মারা যান ১৮৩১ সালে। হেগেল বুঝেছিলেন যে, তিনি হেরাক্লিটাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। তিনি  লিখেছিলেন, “হেরাক্লিটাসের এমন কোনও প্রস্তাব  (Proposition) নেই যা আমি আমার যুক্তিতে গ্রহণ করি নি হেগেল  ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং প্রুসিয়ার  সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জনগণের সাথে, নিবিড় সম্পর্কে কাজ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে, অসংগতি এবং দ্বন্দ্ব সর্বত্র বর্তমান এবং বস্তু ও প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হতে পারে কারণ তাদের মধ্যে অসংগতি রয়েছে। যদিও কোন কিছুর মধ্যেকার অসংগতি একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে টিকে থাকতে পারে কিন্তু তারা (অর্থাৎ অসংগতিগুলি) তাদের নিজেদের বিলোপের দিকে এগোতে থাকে। হেগেল যুক্তি দিলেন যে, অসংগতির নিষ্পত্তি জন্ম দেয় নতুন পরিস্থিতির যার মধ্যে থাকে নতুন ধরণের অসংগতি যার আবার নিস্পত্তির প্রয়োজন হয়ে পরে। হেগেল এই অসংগতি বা দ্বন্দ্বের উপর এবং দ্বন্দ্বের অন্যান্য বিষয়ের উপর গভীর এবং বিস্তারিত অধ্যয়ন করেন এবং এই ধারণাকে প্রকৃতি এবং সমাজের উপর প্রয়োগ করেন। এই কারণেই মার্ক্স, হেগেলকে একজন শক্তিশালী চিন্তাবিদ বলেছিলেন এবং নিজেকে হেগেলের ছাত্র (Pupil) বলে মনে করতেন।

দ্বন্দ্বতত্ত্বে হেগেলের অবদান সত্ত্বেও মার্ক্স এবং এঙ্গেলস, হেগেলের দর্শনে দুটি সিরিয়াস প্রমাদ খুঁজে পানঃ

প্রথমত হেগেল বস্তুবাদী ছিলেন না। বস্তুবাদ বলে যে, বস্তুগত উপাদান এবং বস্তুর গঠন, তাদের সম্পর্কে আমাদের চিন্তনের ভিত্তি; সেই চিন্তন যা বস্তুকে মোটামুটি সঠিক ভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা মুলগতভাবে আসে বস্তুর সাথে আমাদের পারস্পরিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

হেগেল বস্তুকে চিন্তনের ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করেন নি। তিনি চিন্তনকে, বস্তুর ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, চিন্তন হলো বস্তুর অবশ্যিক প্রকৃতি” (essential nature) এবং সেই চিন্তন নিজ হতে প্রবাহিত হয়” (goes out of itself) ও সেই যুক্তিযুক্ত হেতু” (logical reason) বস্তুর গুণাবলিকে রক্ষা করে এবং যার দ্বারা গঠিত হয় সেই বস্তুর গুণের একতা।

মার্ক্স, হেগেলের এই ভাববাদী মতামতকে বাতিল করেন কারণ তা ছিল বিপ্রতীপ সত্য (inverse truth) মার্ক্স বললেন, হেগেলের দর্শন মাথার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে এবং একে বস্তুগত বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে, সোজা ভাবে পায়ের উপর দাঁড় করানো প্রয়োজন।

হেগেলের দ্বিতীয় বড় প্রমাদ ছিল সরাসরি দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রমাদ। হেগেল নিশ্চিত ছিলেন যে, বিরোধের নিষ্পত্তি হয় একটি উচ্চতর স্তরে” (higher unity), বিরোধাত্মক দিকগুলির সংশ্লেষণের (synthesis) মধ্য   দিয়ে যেখানে গিয়ে বিরোধাত্মক দিকগুলি আর বিরোধাত্মক থাকে না।   

মার্ক্স তর্ক দিয়ে দেখালেন যে, এটি সমাজ এবং প্রকৃতির বস্তুজগতের  বিরোধের ক্ষেত্রে আপাদমস্তক ভুল। এই বিরোধাত্মক দিকগুলির নিরসন  ঘটে সিদ্ধান্তের জন্য সংগ্রাম”-এর মধ্য দিয়ে যেখানে একটি দিক অপর দিকটিকে পরাস্ত করে।

আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে দেখবো যে, এই ধারনাই হল কমিউনিস্ট দ্বন্দ্বতত্ত্বের মুল নির্যাস এবং যার অন্তর্নিহিত প্রয়োগ হল কমিউনিজমের জন্য সংগ্রাম।


প্রাচীন চীনের দ্বান্দ্বিক চিন্তার প্রাচীনতম জানা বইটি হল ‘ইকিং’ যেটি   ১১৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংকলিত হয়েছিল। ‘ইকিং’ এর অর্থ হল   পরিবর্তনের  পুস্তক। এটি লেখেন ফো-হি। এই পুস্তকে আমরা পাই, দ্বন্দ্বের মুল বিষয়  অর্থাৎ সবকিছুই পরিবর্তিত হয় এবং বিপরীতগুলি সর্বদাই অন্তরসম্পর্কযুক্ত। উদাহরণ হিসাবে এখানে আমরা পাই, ইন এবং ইয়ান (পজিটিভ ও নেগেটিভ), স্বর্গমর্ত, নরনারী, আলোঅন্ধকার, শক্তিশালীদুর্বল, পিতামাতা প্রভৃতি। স্বর্গ এবং মর্তের পরিবর্তনগুলিকে,  এই মেরু-প্রভেদ সম্পন্ন গুণাবলীর ব্যাখ্যা, এখানে বিকাশের মাধ্যমে  করা হয়েছে।

দার্শনিক লাও-শে বা লাও-শি লিখেছিলেন, “পৃথিবীর সকলে যখন বলে ওঠে সুন্দর, তখনই স্বীকার করে নেওয়া হয় অসুন্দরকে। যখন পৃথিবীর সকলে সাধুতার মধ্যে সুন্দরকে চিনতে পারে, তখনই অসুন্দরকে মেনে নেওয়া হয়। হওয়া এবং না হওয়া একে অপরকে উৎপন্ন করে। ভারি এবং হালকা একে অন্যকে সম্পূর্ণ করে। লম্বা এবং খাটো একে অপরকে রচনা করে। উচ্চ এবং নীচ একে অপরকে বিপ্রতীপক্রমে প্রতিষ্ঠা করে। কণ্ঠস্বর এবং স্বর একে অপরকে আন্তরিক সহযোগিতা করে। পূর্বে এবং পরে একে অপরকে অনুসরণ করে। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মো-তি বা মো-শি নামের একজন ছুতর ও আবিস্কারক, চীনা দ্বন্দ্বতত্ত্বের মধ্যে বস্তুবাদকে নিয়ে আসেন। তিনি লিখলেন, “আমার মতে হওয়া এবং না হওয়া বিষয়টি নির্ভর করে মানুষ তার চোখ বা কানের সাহায্যে,  অর্থাৎ দেখা ও শোনার মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা লাভ করছে তার দ্বারা সে কোনটাকে বাস্তব, আর কোনটাকে অবাস্তব হিসাবে গ্রহণ করছে, তার উপর। মো-শি শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক অবস্থান নিয়েছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জনগণ তার অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট হবে এবং তারা তাদের জীবনকে নিজেরাই পরিচালিত করবে।    

ইতিহাস থেকে দ্বন্দ্ব শেখাঃ

সবকিছুর মতনই, কমিউনিস্ট দ্বান্দ্বিক দর্শন হটাৎ করে আবির্ভূত হয়  নি। এর বিকাশের পিছনে আছে একটি দীর্ঘ এবং বহু তাত্ত্বিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামগুলি সর্বদাই ছিল প্রায়োগিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক  সমস্যার সাথে সম্পর্কিত। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে দ্বন্দ্বতত্ত্বের একটি বিশদ বোঝাপড়ার জন্য প্রয়োজন সেই পদ্ধতিগুলিকে কিছুটা জানা, যা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ আমাদের যুগপৎ ভাবে, কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিতরে দ্বন্দ্বের বিকাশে যে সকল উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং যে সকল প্রমাদ ঘটেছে, সেগুলিকে অধ্যয়ন করতে হবে। কার্ল মার্ক্স একবার লিখেছিলেন যে, তিনি দ্বন্দ্বতত্ত্বের  উপর তার মতামতের একটি আঁটসাঁট সারাংশ দিতে চান কিন্তু তা তিনি  করে উঠতে পারেন নি। পরিবর্তে তিনি তার বই ক্যাপিটালএবং অন্যান্য রাজনৈতিক লেখাপত্রে তার দ্বান্দ্বিক আবেদনকে প্রয়োগ করেছিলেন এগুলিই হল মার্ক্সের দ্বন্দ্বতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের সুত্র এবং  অবশ্যই খুবই ভালো সুত্র কারণ, এগুলি আমাদের দেখায় যে দ্বন্দ্বতত্ত্বকে কি কাজে লাগানো যায়।  

দ্বান্দ্বিক বিরোধঃ

মার্ক্স লিখেছিলেন যে, দ্বান্দ্বিক বিরোধ সমস্ত প্রকার দ্বন্দ্বের উৎস। তার উদাহরণগুলি দেখায় যে, সমস্ত বিরোধ, দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিপরীতের দ্বারা গঠিত যারা একে অপরের সাথে সংগ্রাম করে এবং হস্তক্ষেপ করে। উদাহরণস্বরূপ, মার্ক্স, পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য এবং  বিনিময় মূল্যের মধ্যেকার বিরোধাত্মক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা  করলেন  “পারস্পরিক শর্তযুক্ত, অবিচ্ছেদ্য গুণযুক্ত যা, একে অপরের  অধীন, কিন্তু যা একই সময়ে চরম বিপরীত এবং যা একে অন্যকে  বাতিল বা বিরোধিতা করে” - এইভাবে

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, আপনি যত ক্ষুধার্ত-ই হোন না কেন (খাদ্যের  ব্যবহারিক মূল্য হল সে ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটায়), আপনার কাছে টাকা না থাকলে আপনি  খেতে পারবেন না (খাদ্যের একটি বিনিময় মূল্য আছে)। এখানে বিরোধের এই দুটি দিককেই বলা হয় অবিচ্ছেদ্য গুণযুক্তএবং এই বিরোধের মধ্যকার সম্পর্কের ধরন হল পারস্পরিক শর্তযুক্ত অর্থাৎ একটি দিক, অপর দিকটিকে স্বতন্ত্র করছে, যেমন পিতামাতা এবং সন্তানের মধ্যেকার সম্পর্কের দুটি দিক (দু প্রান্ত হতে)

তবে সমস্ত বিপরীতসবসময় একে অপরকে বিরোধ করে না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, একজন শ্রমিকের যে পণ্য ও সেবার চলাচলের দরকার তা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে, নগদ এবং ধারের চলাচলের সাথে বিরোধমূলক অবস্থান নেয়; যদিও অনেক সময়ই নগদ এবং ধার পণ্যের চলাচলকে সহজ করে দেয়। যদিও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় মজুরি দেবার ক্ষেত্রে, ধার এবং নগদের চাহিদা পণ্যের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতিকে অচল করে দেয়। আর তখনই এই দুই বিপরীত, অর্থাৎ পণ্য ও সেবা বনাম নগদ ও ধার পরস্পরের সাথে বিরোধাত্মক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এই ভাবে এদের এই বিপরীত সম্পর্ক একটি বিরোধের সম্পর্কের জন্ম দেয়।                                             

পুঁজিবাদের একটি ঝোঁক হল, লাগামছাড়া ভাবে উৎপাদিকা শক্তির ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটানো। এই ঝোঁক বর্তমান থাকে কারণ  পুঁজিবাদীদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতা প্রত্যেক পুঁজিবাদীকে কম খরচে আরও বেশি পণ্য উৎপাদনে বাধ্য করে। পুঁজিবাদে পণ্য তখনই উৎপাদিত হয় যখন  তা লাভজনক ভাবে বিক্রি করা যায় যখন পুঁজিবাদীরা তাদের  উৎপাদিত পণ্যের জন্য ক্রেতার সন্ধান করে তখন একটি বিরোধাত্মক বিপরীতের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। পুঁজিবাদের একটি বিশাল সংখ্যক পণ্য বিক্রয় করা হয় শ্রমিকদের কাছে যাদের আবার  সেই পণ্য কিনবার সামর্থ্য থাকাটা জরুরি। কিন্তু উৎপাদনে লাভ  করতে গিয়ে পুঁজিবাদীদের, শ্রমিকদের বেতন কমাতে বা আটকাতে হয় বা শ্রমিক ছাঁটাই করতে হয়; যার নেগেটিভ ফল দেখা দেয় বাজারের কেনার ক্ষমতায়। ফলে সম্পর্কটি বিরোধাত্মক হয়ে যায়। মার্ক্স এই বিরোধকেই  বলেছেন পুঁজিবাদের মূলগত বিরোধ। এটি হল পুঁজিবাদের সাথে উৎপাদিকা শক্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রনের মূলগত সম্পর্কের সাথে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের বিরোধের একটি সাধারন চিত্রের উদাহরণ।

বিরোধের নিরসনঃ

দ্বন্দ্বের একটি সাধারণ ধারণা হল এই যে, যখন একটি বিরোধ বর্তমান থাকে এবং দুটি বিপরীত দিক সংগ্রামে লিপ্ত থাকে তখন সেই বিরোধ নিস্পত্তির দিকে এগোতে থাকে। বিরোধের এই নিস্পত্তির প্রক্রিয়াকেই বলে দ্বন্দ্বের নিরসন। মার্ক্স লিখলেন যে, শ্রেণী হিসাবে শ্রমিক শ্রেণী এবং পুঁজিবাদী শ্রেণীর মধ্যেকার বিরোধ হল ব্যাক্তিগত সম্পত্তি যা বিরোধের সম্পর্কের বিকাশ ঘটায় এবং এইভাবে একটি সম্পর্ক নিরলসভাবে নিরসনের দিকে এগিয়ে চলে। পুঁজিবাদী সংকটে  অর্থের ব্যবহার এবং পণ্যের চলাচলের মধ্যেকার বিরোধ ঘটনাক্রমে নিরসন হয় কিন্তু তা  শুধুই পরবর্তী সংকটের শুরু হওয়া পর্যন্ত  পুঁজিবাদের মূলগত দ্বন্দ্ব অর্থাৎ উৎপাদনের বিস্তার এবং মজুরির সংকোচনের (মোট দেও  মজুরির দিক থেকে) বিরোধের নিরসন পুঁজিবাদের মধ্যে হওয়া সম্ভব না; তা কেবলমাত্র সম্ভব কমিউনিস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।

বিরোধের নিরসন সম্পর্কে মার্ক্সঃ

আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে, বিরোধ হল দুটি সম্পর্ক যুক্ত প্রক্রিয়া, ঝোঁক বা অবস্থার মধ্যেকার সংগ্রাম। আমরা পুঁজিবাদের বিভিন্ন বিরোধের উদাহরণের মধ্য দিয়ে এটাও দেখেছি যে, বিরোধের নিরসন সম্ভব বা বিরোধের অবসান সম্ভব।

চিন্তন এবং বাস্তবতার বিরোধঃ 

আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরের বিরোধ নিয়ে আলোচনা করেছি, কিন্তু বিরোধ অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, প্রকৃতি এবং চিন্তনের মধ্যেও সংঘটিত হয়। মার্ক্স লিখেছিলেন যে, বাস্তবতার বিরোধ, বিরোধাত্মক চিন্তনের সৃষ্টি করে কিন্তু বিরোধের অবস্থান সর্বদাই  বস্তুর অভ্যন্তরে থাকে এবং তা কখনোই বস্তুর ভাষাগত প্রকাশের মধ্যে থাকে না। চিন্তনের বিরোধ হোক বা ভাষার বিরোধ এবং সমাজ বা বাস্তব প্রকৃতির বিরোধ, যেগুলিকে  বলা হয় বাস্তব বিরোধ, তাদের নিরসন সম্ভব, তবে তা একই ভাবে হতে হবে, এমনটা নাও হতে পারে।

বাস্তব বিরোধের নিরসনঃ

বাস্তব বিরোধের নিরসনের সময়, বিরোধাত্মক দিকগুলির মধ্যেকার সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটতেই হবে। এই প্রক্রিয়াকে, অর্থাৎ যে প্রক্রিয়া এই বিরোধকে নিরসনের দিকে নিয়ে যায়, তাকে মার্ক্স বলেছেন, বিকাশ। বিকাশের ক্ষেত্রে কমপক্ষে চারটি পরিবর্তন থাকবেইঃ এক) বিকাশের পর্যায়ে বিরোধ হবে সরলতর এবং স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত। উদাহরণস্বরূপ, ভূস্বামীর পুঁজিবাদীতে রূপান্তর হল একটি বাস্তবতার  সংগ্রাম যা বিরোধকে (শ্রম এবং পুঁজির  বিরোধ) সরলতর বিরোধীতে পরিণত করবে, তাকে (বিরোধকে) একটি চরমতম পর্যায়ে তুলে আনবে এবং নিরসনের দিকে নিয়ে যাবে। দুই) বিকাশের ক্ষেত্রে বিরোধ অনেকবেশি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।  উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান বিশ্ব বাজারের সংকটে বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থার বিরোধ হয়ে উঠেছে লক্ষণীয়। তিন) বিকাশের পর্যায়ে বিরোধ হয়ে উঠবে আরও তীক্ষ্ণ, আরও তীব্র এবং চূড়ান্ত। উদাহরণস্বরূপ, মার্ক্স বলেছেন, ১৮৪৮ সালে  ইংল্যান্ড ছিল সেই দেশ যেখানে বুর্জোয়া সমাজের বিরোধ, বুর্জোয়া এবং প্রোলেতারিয়েতের মধ্যেকার শ্রেণী সংগ্রাম সম্পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠেছিল এবং তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়েছিল। চার) বিকাশের পর্যায়ে বিরোধ, একপ্রকারের গতির সৃষ্টি করে। মার্ক্স লিখলেন, পণ্যের বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় এমন সম্পর্ক জড়িত থাকে যা, একে অন্যকে বিরোধ করে এবং বাতিল করে। পণ্যের বিকাশ এই বিরোধকে বাতিল করে না, বরঞ্চ এমন একটি গঠন প্রস্তুত করে, যার মধ্য দিয়ে এই বিরোধ এগোতে থাকে সাধারণভাবে, এই প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির মধ্য  দিয়েই বাস্তব বিরোধের নিরসন ঘটে।

একটি বাস্তব বিরোধের বিপরীত দিকগুলির সমন্বয় বা পুনর্মিলন সম্ভব নয়। নিরসন তখনই সম্ভব যখন এই দুই দিকের বিরোধ একটি চুড়ান্ত পর্যায়ে উন্নিত হয় এবং একদিক অপর দিককে পরাস্ত করে। মার্ক্স তীব্র ভাবে সেই সমস্ত মানুষদের আক্রমণ করেন যারা বিকাশকে ব্যাতিরেকে বিরোধের নিরসনের চেষ্টা চালান, অর্থাৎ শ্রমজীবী জনতা এবং মালিকের মধ্যে সমঝোতা চালিয়ে,  দুপক্ষকে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো থেকে বিরত করে।

ধারণা এবং তত্ত্বের বিরোধঃ

বিরোধের নিরসনের বহু ঘটনায়, ধারণা এবং বাস্তব বিরোধের নিরসন  একই প্রকারের। ভুল ধারণা এবং তত্ত্বের বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লড়াইয়ের জন্য মার্ক্স পরিচিত ছিলেন। এই লড়াই তিনি চালিয়েছিলেন মূলত রাজনীতি এবং অর্থনীতি বিষয়ে। এরকম বহু ঘটনা আছে যেখানে বিরোধাত্মক দিকদুটি একই সাথে আংশিক সঠিক হয় এবং এই বিরোধের নিরসন সম্ভব তাদের মধ্যে সঠিক যোগসূত্রের সন্ধানের  মধ্য  দিয়ে। মার্ক্স বলেন, অর্থনৈতিক তত্ত্বেও এরুপ সম্ভব।

মার্ক্স দ্বন্দ্বতত্ত্বকে বিরাট মূল্য দিতেন কারণ এই তত্ত্ব দেখায় যে, সবই পরিবর্তনশীল এবং কিছুই স্থায়ী নয়। মার্ক্স একে দেখতেন সহজাত সমালোচনাময় এবং বৈপ্লবিক হিসাবে। নিশ্চিতভাবেই তিনি সঠিক ছিলেন আমাদের প্রয়োজন দ্বন্দ্বতত্ত্বের উপর জনশিক্ষা পরিচালনা করা এবং একে কমিউনিস্ট বিপ্লবের একটি যন্ত্রে পরিণত করা।  

দ্বন্দ্বের বিকাশে এঙ্গেলসঃ

চার দশক ধরে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, কার্ল মার্ক্সের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায়, কমিউনিস্ট তত্ত্বের বিকাশ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংগঠনের ক্ষেত্রে কাজ করে গেছেন। তাঁরা তাদের লেখালেখির ব্যাপারে একটা শ্রম বিভাগ গঠন করেছিলেন। এঙ্গেলস লিখতেন সামরিক বিষয় এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের উপর, মার্ক্স লিখতেন অর্থনীতির উপর। আবার  দুজনেই লিখতেন রাজনীতি এবং ইতিহাস বিষয়ে। এছাড়াও  দ্বন্দ্বতত্ত্বকে রক্ষা এবং তাকে জনপ্রিয় করবার কাজও এঙ্গেলস করেছেন। একান্তে এঙ্গেলস, মার্ক্সের ক্যাপিটাল গ্রন্থে দ্বান্দ্বিক ধারণার জটিল উপস্থাপনা সম্পর্কে বেশ সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখতেন। এঙ্গেলস এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে, যে পাঠক কোনদিন কলেজে পা রাখেনি সে অবশ্যই নিজের উপর অত্যাচার করে খুশি হবে নাশুধু এটা বুঝতে যে মার্ক্স, পণ্যের ব্যবহার এবং তার বিনিময় মুল্যের মধ্যেকার বিরোধ নিয়ে কি লিখেছেন। [সুত্রঃ Marx on the Dialectics of Elliptical Motion* Thomas S Weston ...] এঙ্গেলস দ্বন্দ্বতত্ত্বকে সরল ভাবে যাতে পাঠক  বুঝতে পারেন, তার জন্য বহু আর্টিকেল এবং বই লিখেছেন। পাশাপাশি দ্বন্দ্ব তত্ত্বে তার রয়েছে মৌলিক অবদান।

দ্বান্দ্বিক চিন্তন বনাম অধিবিদ্যক (metaphysical) চিন্তনঃ

এঙ্গেলস, অধিবিদ্যক টার্ম-টি ব্যবহার করেছিলেন অ-দ্বান্দ্বিক চিন্তনকে  বোঝাতে। যদিও কমিউনিস্ট দর্শনে এই টার্ম-টি অন্য ভাবেও ব্যবহৃত  হয়। অধিবিদ্যা মহাবিশ্বের মূলগত রুপ সংক্রান্ত প্রশ্নের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয় যেখানে ভাববাদ এবং বস্তুবাদ, একটি মূলগত ভাবে পরস্পর বিপরীত বীক্ষা (views) যদিও এঙ্গেলস এই টার্মটি- কে এই ভাবে ব্যবহার করেছেন যেখানে অধিবিদ্যার অর্থ হল এক প্রকারের গোঁড়া চিন্তন যা, বিপরীতের অন্তঃসংযোগকে অস্বীকার করে।  বিপরীত যেমন, শ্রমিক শ্রেণী এবং পুঁজিবাদী শ্রেণীর মধ্যে কোনও  কঠোর বিভাজন রেখা নেই। কিছু পেশার মানুষজন যেমন, চিত্রতারকা বা পেশাগত ভাবে বিদগ্ধ খেলোয়াড় এই দুই ক্যাটাগরির কোনটার মধ্যেই নিখুঁত ভাবে ফিট করে না। কিছু শ্রমিক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে, আবার কিছু পুঁজিপতি দেউলিয়া হয়ে চাকুরীজীবীতে পরিণত হয়। এঙ্গেলস বললেন, এটা হল বৈশিষ্টমূলক বিপরীত (typical opposites) যা নির্দিষ্ট বিভাজনরেখাহীন কিন্তু যা আবার একই সাথে একটি নির্দিষ্ট বিভাজনরেখাকে অতিক্রম করে এবং অন্য প্রান্তে অনুপ্রবেশ করে এবং যাতে করে, সময়ের সাথে সাথে দুই প্রান্তের সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। এই ধরণের সম্পর্ককে বলে বিপরীতের আন্তরব্যাপন (interpenetration of opposites) এই আন্তরব্যাপনকে অস্বীকার করাই হলো অধিবিদ্যক চিন্তন যা, বাস্তবতার উপর যথেচ্ছ বিভাজন চাপিয়ে  দেয়। এঙ্গেলস বললেন, প্রকৃতি হলো দ্বন্দ্বের প্রমান এবং এর স্বপক্ষে প্রকৃতি বিজ্ঞান থেকে অধিবিদ্যক চিন্তন বনাম দ্বান্দ্বিক চিন্তনের উপর বহু উদাহরণ দেন। উদাহরণস্বরূপ, ডারউইন-এর বিবর্তনের তত্ত্ব,  প্রজাতি সম্পর্কিত অধিবিদ্যক চিন্তনকে বাতিল করে কারণ অধিবিদ্যক চিন্তন প্রজাতিকে একটি অপরিবর্তনীয় বিভাগ বলে প্রতিপন্ন করে যা,  প্রতিটি প্রজাতির থেকে আলাদা ভাবে অবস্থান করে। বিজ্ঞানীরা পশুদের শ্রেণীর মধ্যে বহু অন্তর্বর্তীকালীন কেস আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছেন, যেমন, বিশাল ডায়ানোসোর এবং পাখিদের মধ্যে। এঙ্গেলস ডারউইনের তত্ত্বকে সুযোগ (chance) এবং প্রয়োজনীয়তার (necessity) মধ্যেকার দার্শনিক ধারণার উদাহরণ হিসাবে চিহ্নিত করেন। তিনি দেখালেন যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া নির্ভর করে পরিব্যক্তির (mutations) উপর যা কিনা, প্রকৃত প্রস্তাবে সজীব কোষের সুযোগের রূপান্তর (chance variations) অতএব, বিবর্তনের ক্ষেত্রে, সুযোগ এবং প্রয়োজনীয়তা হল সেই বিপরীত যার আন্তরব্যাপন ঘটে এবং যা এ কে অন্যের উপর নির্ভরশীল।

বিপরীতের বিরোধ এবং আন্তরব্যাপন (contradiction and   interpenetration of opposites):

সংঘর্ষ এবং বিরোধ যে পরিবর্তনের কারণ এটা ঘটনা এবং এটিই হলো দ্বন্দ্বের হৃদয় যা কিনা বিপরীতের আন্তরব্যাপনের সাথে  নিবিড়ভাবে যুক্ত। এঙ্গেলস এই ধারণাকে বাতিল করেন যে, দ্বান্দ্বিক বিরোধ মনে একজোড়া শক্তি নিজেদেরকে শুধু বিপরীত দিকে ঠেলছে বা টানছে, যেমনটি ঘটে দড়ি টানাটানি খেলায়। এই সংজ্ঞা এই কারনে ভুল যেহেতু, এটি বিরোধাত্মক দিকগুলির মধ্যেকার সম্পর্ককে  আলোচনার বাইরে রাখে যেখানে, এই প্রত্যেক দিক অন্য দিকটিকে  আংশিক ভাবে নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধের পরিকল্পনাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে অন্যের অস্ত্রসম্ভারের সাথে মানানসই হতে হয়।  শ্রমিক শ্রেণীর একটা অংশ, স্বার্থপরতা, লোভ, জাতিবাদী মানসিকতা  প্রভৃতি পুঁজিবাদী শ্রেণীর চরিত্র গ্রহণ করে। এঙ্গেলস তাই বিপরীতের আন্তরব্যাপনকে, দ্বন্দ্বের নিয়ম হিসাবে বিবেচনা করেছেন।

দ্বন্দ্বের নিয়ম প্রসঙ্গে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসঃ

মার্ক্সের কমরেড এঙ্গেলস-এর, দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান   হল, দ্বান্দ্বিক নিয়মাবলীকে পরিবর্তনের সাধারণ নীতি হিসাবে সুত্রায়িত  করা। তিনি বললেন, আমারা বিশ্বকে একটি তৈরি করা বস্তু হিসাবে না দেখে, একটি প্রাথমিক ভাবে কতকগুলি প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে দেখবো। দ্বন্দ্বের নিয়মাবলী সমস্ত প্রক্রিয়ার কিছু বৈশিষ্টকে ব্যাখ্যা করে। এঙ্গেলস এভাবে বললেন, দ্বন্দ্ব হলো শুধুমাত্র গতির সাধারণ নিয়মাবলীর বিজ্ঞান এবং প্রকৃতি, মানব সমাজ ও চিন্তনের বিকাশের বিজ্ঞান।

এঙ্গেলস দ্বন্দ্বের তিনটি বেসিক নিয়ম কে নির্দিষ্ট করেন। আমরা ইতিমধ্যেই একটি নিয়ম আলোচনা করেছি, যাকে বলে বিপরীতের আন্তরব্যাপন। এই নিয়ম বলে যে, বিপরীত পরস্পরের সাথে এমন  ভাবে যুক্ত থাকে যে, দুটি দিকের কোনও স্পষ্ট বিভাজনরেখা থাকে  না কিন্তু তারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং তারা একে অন্যকে পরিবর্তিত করে।              

আরেকটি নিয়ম হল, “পরিমাণের গুণে পরিবর্তন” (Transformation of quantity into quality) এর অর্থ হলো, যথেষ্ট পরিমাণে কোন কিছুর পরিমাণকে বৃদ্ধি বা হ্রাস করলে একটি গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়। জলের ফোঁটা বা জলের জমে যাওয়ার মতন গুণগত পরিবর্তন ঘটবে  যদি জলের তাপমাত্রার যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটানো হয়। একটি ছোট গোষ্ঠীর ক্ষমতার তুলনায় একটি বিরাট জনসমাবেশ, ক্ষমতার দিক থেকে অনেক বেশি কার্যকরী। এঙ্গেলস লিখলেন, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের সহযোগিতা, বহু শক্তির একটি শক্তিতে একভবন (fusion) একটি নতুন শক্তির জন্ম দেয় যা, ঐ বহু শক্তিগুলির  প্রত্যেকটি যোগফলের চেয়ে কার্যকরী ভাবে আলাদা।

তৃতীয় নিয়মটি হলো নেতিকরণের নেতিকরণ” (negation of the negation) এঙ্গেলস এই নিয়মটিকে বলতেন বিরোধের মাধ্যমে বিকাশ" (development through contradiction) এখানে নেতিকরণ বলতে দ্বান্দ্বিক নেতিকরণ বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ কোন কিছুর মধ্যেকার বিরোধের ফলস্বরূপ তার বিপরীতে রূপান্তর ঘটে যাতে কোরে  একটির ধ্বংসসাধন বা আংশিক সংরক্ষণ ঘটে। যেমন একটি বীজ যখন চারায় পরিণত হয় তখন সেই প্রক্রিয়ায় বীজের ধ্বংসসাধন ঘটে (নেতিকরণ)। এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিক নেতিকরণকে এই ভাবে ব্যাখ্যা করলেন, “ সমস্ত বিকাশের প্রকৃত চালিকা-নীতি বিপরীতে বিভাজন, তাদের সংগ্রাম (struggle) এবং তার ফলাফল।নেতিকরণের নেতিকরণ বলে  যে, যখন দ্বিতীয় দ্বান্দ্বিক নেতিকরণ, প্রথম নেতিকরণকে অনুসরণ করে, তার ফলাফল প্রথম নেতিকরণের পূর্বের অবস্থার চেয়ে কিছু পরিমাণে বা মাত্রায় পৃথক হবে। যে বীজের ধ্বংস সাধনের মধ্য দিয়ে (প্রথম নেতিকরণ) চারা গাছটির জন্ম হয়েছিল, তা কালক্রমে আবার বহু বীজের জন্ম দেবে। সেই বীজের ধ্বংস সাধনের মধ্য দিয়ে (দ্বিতীয় দ্বান্দ্বিক নেতিকরণ) আবার যে চারা গাছ জন্মাবে তা, প্রথম বীজ সৃষ্টিকারী চারাগাছের চেয়ে (প্রথম নেতিকরণের পূর্বের অবস্থা) কিছু পরিমাণ বা মাত্রায় পৃথক হবে। এই নিয়ম (নেতিকরণের নেতিকরণ) বলে যে, ঐতিহাসিক পরিবর্তন রিভারসিবল নয় এবং এই পরিবর্তন বৃত্তাকারে এগোয় না। এঙ্গেলস এক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদের বিকাশের উদাহরণ দিয়েছেন। সেই বিকাশের পর্যায়ে পুঁজিবাদীরা বহু ক্ষুদ্র উৎপাদকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল, যা ছিল একটি দ্বান্দ্বিক নেতিকরণ (প্রথম নেতিকরণ)। যখন শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে, তখন তারা পুঁজিবাদীদের সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্ত করে। একসময় ভাবা হয়েছিল যে শ্রমিক শ্রেণীর এইযে পুঁজিপতিদের সম্পত্তির বাজেয়াপ্তকরণ, তাই হল দ্বিতীয় নেতিকরণ। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ের পর এই ধারণা নাকচ হয়ে গেছে অর্থাৎ এটিকে  নেতিকরণ ভাবা নাকচ হয়েছে (negating the negation)  বোঝা গেছে যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই দ্বিতীয় নেতিকরণ সংঘটিত হয় না; এই পর্যায়ে দ্বিতীয় নেতিকরণের দিকে শর্ত প্রস্তুত হওয়া শুরু হয় মাত্র। কমিউনিস্ট সমাজের প্রতিষ্ঠাই হল দ্বিতীয় নেতিকরণ এবং সেখান থেকে আর পুঁজিবাদের ফিরে আসা অসম্ভব।

এই তিনটি নিয়মকে কেন আমরা বিধি বলবো? এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, এই তিনটি নিয়ম মানব সমাজের ইতিহাস থেকে শুরু করে, চিন্তন, প্রকৃতি বিজ্ঞান প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং এর সত্যতার প্রমান পাওয়া গেছে। এঙ্গেলস এই প্রয়োগের ক্ষেত্রে খুব জোর দিয়েছিলেন রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রকে।

এখন আমাদের বুঝে নেওয়া দরকার যে তিনি বিধি (laws) বলতে কি বুঝিয়েছেন। এঙ্গেলস এবং মার্ক্স বিধি বলতে বোঝাতেন, এমন নিয়ম  যা একটি প্রয়োজনীয় ঝোঁককে ব্যাখ্যা করে, যা সর্বদাই উপস্থিত কিন্তু  যা সর্বদা সম্পূর্ণরূপে নিরুপিত (realized) নয়।

জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা (The Dialectics of Knowledge): 

এঙ্গেলস বুঝেছিলেন যে, সামাজিক অনুশীলনীই হল সমস্ত জ্ঞানের ভিত্তি। অর্থাৎ মানুষের দ্বারা প্রকৃতির পরিবর্তন সাধন, শুধু প্রকৃতি যেমন আছে তেমন ভাবে নয়, এটিই মানুষের চিন্তনের অপরিহার্য এবং আশু ভিত্তি।তত্ত্বের সৃষ্টি এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তার আবার পরীক্ষণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যার ফলে পাওয়া যায় ধারাবাহিক আংশিক  সত্য যাদের মধ্যে কিছু সংশোধিত হয়, বিস্তৃত হয় আবার কিছু বাতিলও হয়। জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক বিকাশের মধ্যে থাকে মোচড় (twists), সম্মুখে উল্লম্ফন (leaps forward), বিপরীতে ফেরা (reverses) এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লব (scientific revolutions) এঙ্গেলস বলেছিলেন যে, যদিও কিছু প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক বিধিকে বিশুদ্ধ রুপে (in pure form) প্রতিষ্ঠিত করা যায়, কিন্তু আমরা সাধারণত আংশিক বা প্রায় সত্যই (partial or approximate truth) প্রাপ্ত হয়ে থাকি। এঙ্গেলস Boyle’s Law এর উদাহরণ দিলেন। Boyle’s Law হল গ্যাসের আয়তন এবং চাপের মধ্যেকার সম্পর্ক। বর্তমানে এই সুত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ Boyle’s Law একটি প্রায় সত্য বা একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক বিকাশকে বুঝতে ব্যর্থ হলে তা এইরুপ অবাস্তব সিদ্ধান্তে আমাদের নিয়ে আসবে যে, যেহেতু Boyle’s Law-কে মডিফাই করা যায় তাই এটি খাঁটি সত্য নয়; অতএব সত্যই নয়। এই ধরণের যুক্তি ভাববাদে প্রচুর পাওয়া যায়। প্রায় সত্য বা অসম্পূর্ণ সত্যকে মোটা দাগে ভুল দেগে দেওয়া একটা ভ্রান্তি কারণ এই প্রায় বা অসম্পূর্ণ সত্যগুলি হল জ্ঞানের বিকাশের স্তর, এমন একটি স্তর যা আমাদের অনুশীলনকে কার্যকরী ভাবে গাইড করতে পারে। জ্ঞানের আরও বিকাশ, অনুশীলনকে আরও কার্যকরী ভাবে গাইড করবে এবং এটি ক্রমাগত চলতে থাকবে।

এঙ্গেলসের দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রভাবঃ

এঙ্গেলসের Anti-Dühring এবং ফায়ারবাখের উপর প্যামফ্লেট বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং উনবিংশ শতাব্দীতে একটি বহু-পঠিত বই ছিল।  সোভিয়েত ইউনিয়নের শুরুর দিনগুলিতে দ্বন্দ্ব তত্ত্ব বিরোধী দর্শনের  বিরুদ্ধে সংগ্রামে তার গভীর প্রভাব ছিল। এঙ্গেলসের অসম্পূর্ণ বই Dialectics of Nature সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯২৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। যারা দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে বাতিল বা বিকৃত করতে চাইতো বা দাবি করতো যে, দ্বন্দ্ব তত্ত্ব ভ্রান্ত অথবা এটি শুধুমাত্র মানব সমাজে ই প্রযোজ্য, প্রকৃতির ক্ষেত্রে নয়, তাদের বিরুদ্ধে এই বইটি ছিল জবাব  

 কেন দর্শনশাস্ত্র প্রয়োজনীয়ঃ সংস্কার নয়, বিপ্লবঃ

দর্শন সর্বদাই রাজনীতির সাথে যুক্ত, কিন্তু দ্বন্দ্বের সাথে বিপ্লবের সম্পর্ক আরও নিবিড়। এটিকে সহজেই লক্ষ্য করা যায় সংশোধনবাদের বিকাশের মধ্যে; অর্থাৎ সংশোধনবাদ এবং বিপ্লবকে নাকচ করার মধ্যে, আর যা শুরু হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে। সেই সময় কমিউনিস্ট আন্দোলন পরিচিত ছিল সমাজ গণতন্ত্র” (social democracy) নামে। সমাজ গণতন্ত্রীরা (social democrats) কমিউনিজমের জন্য সংগঠিত হয়েছিলেন সমাজতন্ত্র নামক ছাতার তলায়; আর আজকে আমরা জানি যে, সে কৌশল ছিল ভয়ংকর রকমের ভুল। বিপ্লবী এবং সংশোধনবাদীদের মধ্যেকার বিরোধ যখন  বিকশিত হয়ে উঠলো এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টি হলো, তখন থেকে সমাজ গণতন্ত্রীশব্দটি বোঝাতে লাগলো বিপ্লব বিরোধীদের এবং বিপ্লবীরা নিজেদের পরিচয় দিলেন কমিউনিস্টবলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, সংশোধনবাদীরা সোশ্যালিস্ট পার্টি জার্মানি (SPD)-তে নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠে এবং SPD-কে জার্মান রাষ্ট্রের উপাঙ্গে পরিণত করে। ১৯১৪ সালে, যুদ্ধের প্রশ্নে SPD সাম্রাজ্যবাদের   পক্ষে ভোট দেয় এবং প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমন করতে ও ১৯১৯  সালের বার্থ বিপ্লবের সময় অগ্রণী কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে খুন করতে জার্মান সরকারকে সাহায্য করে। সংশোধনবাদীদের সেরা বিবৃতি সামনে  এসেছিল ১৮৯৯ সালে, এডওয়ার্ড বার্নস্তাইনের The  Preconditions of Socialism বইটি প্রকাশিত হবার পর। বার্নস্তাইন ছিলেন SPD-র  একজন বুদ্ধিজীবী এবং ১৮৯৫ সালে এঙ্গেলসের মৃত্যু পর্যন্ত তার একজন সহকারী। বার্নস্তাইন, মার্ক্সের পুঁজিবাদের গতির নিয়মাবলীর প্রায় সবটাই তার বইতে অস্বীকার করেন। তিনি labour theory of value-কে বাতিল করেন এবং দাবি করেন যে, পুঁজিবাদে বিরাট মাপের কোন অর্থনৈতিক সংকট বা গুটিকয়েক কোটিপতির হাতে পুঁজির  কেন্দ্রীভূত হবে না। বিপ্লবের পরিবর্তে বার্নস্তাইন বললেন  যে, ইলেকশন জেতা, ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠন এবং SPD-র প্রভাবে ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্র অর্জিত হবে। আজকের দিনের সমাজ গণতন্ত্রীদের মধ্যেও এইরকমের ধারণা দেখতে পাওয়া যায়।

দ্বন্দ্বতত্ত্ব এবং বিপ্লবঃ

বার্নস্তাইন দাবি করেছিলেন যে, মার্ক্সীয় রাজনীতিতে বিপ্লবের কেন্দ্রীয়  ভুমিকা হল দ্বন্দ্বের। তিনি অভিযোগ করলেন যে, মার্ক্সবাদ মিথ্যা মিথ্যাই বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তির অপরিমেয় সৃষ্টিশীল শক্তিকেপালন  করে চলেছে বার্নস্তাইন বললেন, শ্রমিকের জীবনের মান পুঁজিবাদের  মধ্যেই ধীরে ধীরে উন্নত হবে এবং তাই বিপ্লব অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু হেগেলীয় নীতি অর্থাৎ দ্বন্দ্বতত্ত্ব এই দাবিকে অস্বীকার করে। প্রকৃতপক্ষে,  পুঁজিবাদের বৈজ্ঞানিক দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ আমাদের দেখায় যে, পুঁজিবাদের সংকট কখনও শেষ হয় না এবং এর বিরোধ উত্তরোত্তর তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে যা, একসময়, কমিউনিস্ট বিপ্লবের দিকে নিয়ে যায়।  তাই   সংশোধনবাদীরা অবশ্যই দ্বন্দ্বতত্ত্বকে অস্বীকার করবে কারণ তারা  বিপ্লবের বিরোধিতা করে।

সংস্কারবাদ এবং ভাববাদী নৈতিকতা (Reformism and Idealist Morality):

বার্নস্তাইন এবং অন্যান্য সংশোধনবাদীরা দ্বন্দ্বের একটি বিকল্প চাইছিলেন এবং তারা বেছে নিলেন অষ্টাদশ শতকের জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ভাববাদী নৈতিকতা। এটি ছিল মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের দ্বারা বিকশিত বস্তুবাদী নৈতিকতার বিপরীত। মার্ক্স-এঙ্গেলস জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, তাদেরকে শ্রমিক শ্রেণীর অর্পিত কাজ (task) বা আহ্বানে(calling) সাড়া দিতে হবে যাতে করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলা যায় এবং সমাজকে কমিউনিজমের জন্য পুনর্গঠিত করা  যায়। এটি হল শোষিত শ্রেণীর বস্তুগত অবস্থার নিরিখে একটি আদর্শ বৈপ্লবিক কাজ। কমিউনিস্ট নৈতিকতা গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদের দ্বারা নিষ্পেষিত শ্রমিক শ্রেণীর প্রয়োজনের নিরিখে এবং কমিউনিজমের জন্য গন-সমাবেশের দ্বারা আমরা কি সম্পন্ন করতে পারি তার উপর ভিত্তি করে। সংশোধনবাদীরা সিদ্ধান্ত করলেন, বিপ্লবের যুক্তিযুক্ততাকে বাতিল করবার জন্য তারা কান্ট-এ ফিরে যাবে।

কান্টের মত অনুযায়ী, নৈতিকতার লক্ষ্য মানবের সুখ-সমৃদ্ধি নয়। তার লক্ষ্য হলো শুধুমাত্র ব্যক্তির যুক্তিযুক্ত আচরণ (rational action of individuals) ক্যান্ট মনে করতেন ঈশ্বর আছেন এবং তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন যাতে করে ভালো কাজ” (good actions)-কে  “সুখ”(happiness) দিয়ে পুরস্কৃত করা যায়; কিন্তু তিনি এটাও বললেন যে, কেউ এটিকে প্রমান করতে পারবে না। তিনি নৈতিকতাকে গ্রহণ করলেন এই বিমূর্ত (abstract) ধারণা থেকে যে, একজন ব্যক্তির ইচ্ছার (will) মধ্যে  কখনওই নিজের প্রতি ইচ্ছা এবং পরের প্রতি ইচ্ছার মধ্যে বিরোধে থাকবে না। কান্ট আশা করেছিলেন, যুক্তির (reason) এমন একটি অ-বস্তুগত প্রভাব থাকবে যা, জনগণকে কোন  নীতি মানতে বাধ্য করবে। তার নৈতিকতা ছিল শাসকের বিবেকের  প্রতি আহ্বান কান্ট বিপ্লব বা গন-প্রতিবাদের বিরোধিতা করতেন।  কান্ট শোষণের নিন্দা করেছেন। কিন্তু মজা হলো, পুঁজিবাদীদের পক্ষে কান্টের এই বার্তাকে গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল কারণ শ্রমের শোষণই হল  তাদের ব্যবস্থার হৃদয়।

এটি খুব সহজেই অনুমেয় যে, কেন কান্টের দর্শন শ্রমিক সংগ্রামের  জন্য একবারেই অনুপযুক্ত এবং কেনই বা সারা ইউরোপ জুড়ে সংশোধনবাদীদের মধ্যে কান্টবাদ এত জনপ্রিয় হয়েছিল। সংশোধনবাদীরা চেয়েছিল দ্বান্দ্বিক সমাজতন্ত্রকে নৈতিক সমাজতন্ত্রের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে। অর্থাৎ তারা কমিউনিস্ট সংগ্রামকেই প্রতিস্থাপিত করে দিতে চেয়েছিল শাসকের প্রতি আবেদন নিবেদনের রাজনীতির দ্বারা।  

 সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বতত্ত্বঃ

 সংশোধনবাদীরা মার্ক্সবাদের অধিকাংশই বাতিল করেন; বিশেষ করে দ্বন্দ্বতত্ত্ব। কারণ তারা এই সিদ্ধান্তকে বাতিল করেছিলেন যে, পুঁজিবাদের মধ্যেকার গড়ে ওঠা বিরোধ বিপ্লবকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে। সংশোধনবাদীরা বস্তুবাদকেও বাতিল করেন। কারণ তারা চেয়েছিলেন, পুঁজিবাদের গতির নিয়মাবলী শ্রমিক শ্রেণীর জন্য যে বৈপ্লবিক কাজ ধার্য করেছে তাকে কান্টের ভাববাদী শ্রেণীহীন নৈতিকতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে। সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় দেশগুলির কমিউনিস্টরা সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক লড়াই পরিচালনা করেন এবং সংশোধনবাদীদের দ্বারা সমর্থিত সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধের বিরোধিতা করেন। এসবের মধ্যে, দ্বন্দ্বতত্ত্ব এবং বস্তুবাদের পক্ষে সবচেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লড়াই এলো রাশিয়ার কমিউনিস্টদের কাছ থেকে, যাদের  মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জি।প্লেখানভ এবং ভি।আই।লেনিন।

প্লেখানভ ছিলেন রাশিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার ভুমিকা ছিল একাধারে প্রবল স্ববিরোধী, উল্লেখযোগ্য অবদান সম্বলিত, ভ্রান্তি এবং বেইমানি মিশ্রিত। শুরু থেকেই প্লেখানভ তীব্র ভাবে আক্রমণ করেন সংশোধনবাদীদের ভাববাদকে। তিনি তার বই, আর্টিকেল এবং বক্তৃতার মাধ্যমে দ্বন্দ্বতত্ত্বকে ব্যাখ্যা করেন, রক্ষা করেন এবং এর বিকৃতির প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন।

 আইনি মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে প্লেখানভ (Plekhanov Against “Legal Marxism”):

প্লেখানভ তার আমাদের সমালোচকদের সমালোচনা” (Criticism of our Critics) বইতে রাশিয়ান সংশোধনবাদী পি। স্ত্রুভে-র বাজে যুক্তিগুলিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। স্ত্রুভে মার্ক্সবাদকে এমনভাবে অদলবদল ঘটান যাতে করে তা আইনি মতবাদে পরিণত হয়, যা কিনা ৎজারের বিবাচনের  (censorship) মধ্যে গ্রহণীয় হয়। তিনি বললেন যে, পুঁজিবাদের বিরোধকে ভোঁতা করে দেওয়া যেতে পারে যাতে তা বিপ্লবের দিকে আর এগোবে না। প্লেখানভ, স্ত্রুভের ভোঁতাক্রন”-কে অপ্রমান করতে  দার্শনিক বিশ্লেষণ এবং অর্থনৈতিক তথ্যাবলীকে সংযুক্ত করেন। তিনি দেখান যে, কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে, দ্বন্দ্বকে ভোঁতা করবার মধ্য দিয়ে তার নিরসন ঘটে নি; উল্টে তা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। প্লেখানভ যুক্তি দেন যে, সামাজিক উৎপাদন, পুঁজিবাদকে রক্ষাকারী গঠনের (form) থেকে শক্তি ক্রমশই হরণ করে চলেছে এবং এটি হল দ্বান্দ্বিক মার্ক্সবাদের বৈপ্লবিক অন্তরবস্তু।

নারোদনিকদের বিরুদ্ধে লেনিন:

লেনিনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজের অভিমুখ ছিল নারোদনিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং সেই কাজের মধ্যেকার একটি অংশ ছিল শুধুমাত্র বস্তুবাদ এবং দ্বন্দ্ব তত্ত্ব।

নারোদনিকরা রাশিয়ায় জারশাহীর বিরোধিতা করতেন সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের মধ্য দিয়ে, যথা জারকে হত্যা প্রভৃতি যদিও নারোদনিকদের একটি বড় অংশ কিন্তু পুঁজিবাদের বিরোধিতা করতেন না। তারা ছোট কৃষক-কে বিপ্লবী শ্রেণী হিসাবে বিবেচনা করতেন।

লেনিন তার আক্রমণ কে পরিচালনা করেন নারোদনিকদের বিরুদ্ধে যার সূচীমুখ ছিলেন নারোদনিক এন।কে। মিখাইলভস্কি। মিখাইলভস্কি   দ্বন্দ্বতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং শ্রেণী সম্পর্ক ও শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে যে শ্রেণী সমাজের বিকাশ ঘটে, এই বস্তুবাদী ধারণাকে বাতিল করতে সচেষ্ট হন। লেনিন লক্ষ করলেন যে, মিখাইলভস্কি দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে  আক্রমণের জন্য ব্যবহার করছেন একটি প্রচলিত কৌশল। মিখাইলভস্কি হেগেলের দ্বন্দ্ব তত্ত্বের বিশেষ গঠনকে আক্রমণ করেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌছতে চেষ্টা করেন যে, কমিউনিস্টরাও একই ভুল করছে। তিনি দাবি করেন যে, থিসিস অ্যান্টি থিসিস  সিনথেসিস, এই ত্রয়ী পদ্ধতি (Triad Pattern) হল দ্বান্দ্বিক বিকাশের ভিত্তি।

এখানে ছোট করে এই ত্রয়ী সম্পর্কে বলে নেওয়া যেতে পারে। এই ত্রয়ী বা Triad হেগেল তার লেখায় ব্যবহার করেছেন কিন্তু Thesis – antithesis – synthesis, এই নামকরণ হেগেল করেন নি। এটি করেছেন Johann Fichte

Thesis বলতে বোঝায়, কোন ধারণা বা কোনও বৌদ্ধিক প্রস্তাব। Antithesis বলতে বোঝায়, সেই ধারণা বা সেই বৌদ্ধিক প্রস্তাবের অপ্রমান এবং

Synthesis বলতে বোঝায়, এই প্রস্তাব (Thesis) এবং তার অপ্রমানের (Antithesis) মধ্য দিয়ে নতুন ধারণার গড়ে ওঠা।

লেনিন দেখালেন যে এঙ্গেলস বহু আগেই লিখে গেছেন যে, এই ত্রয়ী (Triad), কমিউনিস্ট দ্বন্দ্ব তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয় এবং এটা দিয়ে কিছুই প্রমান করা যায় না। মিখাইলভস্কির বিকৃতিকে প্রতিহত করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব তত্ত্বের মর্মস্থলকে ব্যাখ্যা করলেন যাকে, তিনি বললেন সমাজবিদ্যার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। দ্বন্দ্ব তত্ত্বের উপর লেনিনের এই গুরুত্ব আরোপণ সংক্রান্ত প্রথম দিককার লেখা পরবর্তী কালের  লেখাতেও স্থান পেয়েছে। সব ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পেয়েছে কমিউনিস্ট তত্ত্ব এবং প্রায়োগিক রাজনৈতিক কাজকর্ম। তিনি দেখিয়েছেন যে, দ্বন্দ্ব তত্ত্ব এবং রাজনীতি হাত ধরাধরি করে এগোয়।

 যান্ত্রিক বস্তুবাদ বনাম দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদঃ

সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের সফল বিকাশের সাথে সাথে বলবিদ্যা (mechanics) দর্শনের একটি নতুন আদর্শ হিসাবে সামনে এলো। এই ধারার নাম হলো যান্ত্রিক বস্তুবাদ” (mechanical materialism) যান্ত্রিক বস্তুবাদ বলে যে, বস্তুর পরিবর্তন ঘটে কারণ বস্তুর উপর বহিস্থ কারণ ক্রিয়াশীল হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর কিছু দার্শনিক মানব সমাজের উপর এই ধারণার প্রয়োগ ঘটান। দোলবাখ  (D’Holbach) দাবি করলেন, জনগণের চাহিদা নির্ধারিত হয়  তাদের  বহিস্থ কারণের দ্বারা। মনতেস্কিউ (Montesquieu) দাবি করলেন যে,  আবহাওয়া এবং জমি-ই মুলত সমাজের গঠনকে নির্ধারিত করে। দ্বন্দ্ব তত্ত্ব এই ধারণাকে অস্বীকার করে যে, বস্তুর সমস্ত পরিবর্তন বহিঃস্থ প্রভাবে সংঘটিত হয়। বরঞ্চ দ্বন্দ্ব তত্ত্ব বলে, কোন একটি প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনার অভ্যন্তরীণ গঠন এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধই হল পরিবর্তনের মূল কাণ্ডারি। বহিঃস্থ উপাদানের প্রভাব অবশ্যই আছে কিন্তু পরিবর্তন মুলত অভ্যন্তরীণ উপাদানের বিরোধের ফলেই পরিবর্তিত হয়। এই দ্বান্দ্বিক ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ আমরা পাই কমিউনিস্ট ইশতেহারে। শ্রেণী বিভক্ত মানব সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণীর মধ্যেকার সামাজিক সম্পর্কগুলি-ই নির্ধারণ করে দেয় কিভাবে এবং কখন বহিঃস্থ প্রভাবগুলি সমাজ পরিবর্তনে ক্রিয়াশীল হবে। পুঁজিবাদী সমাজের সাথে একটি কমিউনিস্ট সমাজে বহিঃস্থ প্রভাব স্বরূপ আবহাওয়ার পরিবর্তন বা খরা, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতুলতা বা অপ্রতুলতা সম্পূর্ণ ভিন্ন রুপে সামনে আসে। পুঁজিবাদী সমাজে এই ধরণের বহিঃস্থ শর্তের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেবার সময় অর্থ, লাভালাভ, পুঁজিবাদী শত্রুতামূলক প্রতিযোগিতা প্রভৃতি পথ রোধ করে দাঁড়ায় প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া দেবার ক্ষেত্রে। কিন্তু কমিউনিস্ট সমাজে এগুলি অনুপস্থিত থাকে ফলে প্রতিক্রিয়া যথাযথ হয়।

প্লেখানভ এবং যান্ত্রিক বস্তুবাদঃ

দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে একটি সাধারণ তত্ত্ব হিসাবে রক্ষা করলেও, পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে প্লেখানভের বিশ্লেষণ ছিল যান্ত্রিক বস্তুবাদী বিশ্লেষণ। তিনি দাবি করেছিলেন যে, ভৌগলিক পরিবেশের উপাদান (properties of the geographical environment) সমাজের উৎপাদিকা শক্তির (productive force) বিকাশকে নির্ধারণ করে এবং এই উৎপাদিকা শক্তি আবার সমস্ত প্রকার সামাজিক সম্পর্ককে নির্ধারণ করে।

সমাজের উৎপাদিকা শক্তি বলতে বোঝায় জনগণ, যন্ত্রপাতি, সম্পদ (প্রাকৃতিক এবং আহিত) এবং জ্ঞান যা উৎপাদনকে সম্ভব করে।

প্লেখানভের এই দাবি যে, ভৌগলিক উপাদান উৎপাদিকা শক্তিকে নির্ধারণ করে, একটি বিশুদ্ধ যান্ত্রিক বস্তুবাদী দাবি কারণ তা মানব সমাজের বহিঃস্থ শক্তি। এটি শুধুমাত্র একটি বাজে দ্বন্দ্ব তত্ত্বই নয়, এটি একটি ভ্রান্ত ঐতিহাসিক বিশ্লেষণও। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, গত দুই হাজার বছর ধরে, ইউরোপে দাস ব্যবস্থার উথান ও পতন, সামন্ত সমাজের  উত্থান ও পতন, পুঁজিবাদের উত্থান এবং তার সাম্রাজ্যবাদে বিকাশ সংঘটিত হয়েছে এবং উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু ইউরোপের, এই পুরো পর্যায় জুড়ে ভৌগলিক উপাদান প্রায় একই থেকেছে; আবার ইউরোপের মতন ভৌগলিক উপাদান আছে, পৃথিবীর এমন দেশে উৎপাদিকা শক্তির ভিন্ন বিকাশ ঘটেছে।

আসলে ইউরোপের ভিন্ন প্রকার বিকাশের কারণ হলো, সামন্তবাদের তুলনামূলক দুর্বল উপস্থিতি যা ইউরোপের মানব সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তি।

প্লেখানভের দাবির দ্বিতীয় ভাগ হলো যে, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তর একটি সমাজের সামাজিক সম্পর্কের নির্ধারক শক্তি। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস, উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্কগুলিকে একটি শ্রেণী সম্পর্কের নিরিখে দেখেছিলেন যা একে অন্যকে প্রভাবিত করে। কিন্তু প্লেখানভ দাবি করলেন যে, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তরই সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে মূল নিয়ন্ত্রক শক্তি। প্লেখানভের এই ভ্রান্তি রাশিয়ায় বিপ্লব বিরোধী রাজনীতি গড়ে উঠবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা নিয়েছিল এবং পরবর্তীতে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এই রাজনীতির বিকাশে প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্লেখানভ দাবি করলেন যে, যেহেতু রাশিয়ার উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তর অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া তাই কমিউনিস্ট বিপ্লবকে একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য পিছিয়ে দিতে হবে। প্লেখানভ রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশকে স্বাগত জানান এবং ১৯০৫ সালের বুর্জোয়া বিপ্লবের জন্য লেনিন  ও বলশেভিক পার্টির সমালোচনা করেন। পরবর্তীতে প্লেখানভ জারের রাশিয়াকে, প্রথম বিশ্বজুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে সমর্থন করেন।

লেনিনের বিষয়ীগত সত্যের পক্ষে লড়াই (Lenin’s fight for Objective Truth):

 রাশিয়ায় ১৯০৫ সালের ব্যর্থ বিপ্লবের পর, বহু কমিউনিস্টকে হয় হত্যা করা হয় বা সাইবেরিয়া বা অন্যত্র নির্বাসিত করা হয়। কারখানার মালিকেরা রাজনৈতিক এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের কালো তালিকাভুক্ত করেন। পার্টির সে এক মহা দুর্দিন। সেই সময় মনোবল হারিয়ে অনেক কমিউনিস্ট এই দাবি তোলেন যে, পার্টি ভেঙে দেওয়া হোক। কিছু বলশেভিক বুদ্ধিজীবী এমন দর্শন প্রচার করতে লাগলেন যা বস্তুবাদী নয়, একটি নতুন ধর্ম গোছের মতবাদ এবং তারা দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে আক্রমণ করলেন। প্লেখানভ এবং অন্যান্য সংশোধনবাদীরা সঠিক ভাবেই এইসব বলশেভিক দার্শনিকদের সমালোচনা করলেন। লেনিনও উপলব্ধি করলেন যে, এই সমস্ত মানুষেরা যে দর্শন প্রচার করছেন তা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমূহ ক্ষতি সাধন করবে। ১৯০৮ সালে তিনি এদের দর্শনের বিরুদ্ধে নিয়ে এলেন তাঁর বিখ্যাত বস্তুবাদ এবং অভিজ্ঞতা বিচারবাদী সমালোচনা” (Materialism and  Empirio-Criticism) এই বইটি-ই ছিল পরবর্তী কালে কমিউনিস্ট দর্শনের  বিকাশের ক্ষেত্রে একটি মূল স্তম্ভ।  

বিষয়গত ভাববাদ (Subjective Idealism):

যে ভুল ধারণ কিছু বলশেভিক দার্শনিক প্রচার করেছিলেন তাকে বলা হয় বিষয়গত ভাববাদ (Subjective Idealism)। এই মত বলে যে একমাত্র মন এবং সেই মনে ধারণার অনুভূতির অস্তিত্বের-ই শুধুমাত্র অস্তিত্ব আছে। বিষয়গত ভাববাদ বলে, ব্যক্তির মনের বাইরে কোনও দিনদুনিয়া নেই; আমরা জেগুলিকে বলি পাথর বা মানুষ বা শ্রেনী বা পর্বত – সেগুলি আসলে কতকগুলি অনুভূতির জটিলতা (Complexes of sensations)। পাগলের মতন হলেও, এই ধারণা বিগত ৩০০ বছর ধরে অন্যতম পুঁজিবাদী দর্শন হিসাবে জনপ্রিয় থেকেছে।

বিষয়গত ভাববাদের যে তর্জমা (version) এই বলশেভিক দার্শনিকরা প্রচার করছিলেন তাকে বলা হত নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদ” (Neutral Monism) এটির বিকাশ ঘটেছিল জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদ (Neutral Monism):

নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদের উল্লেখযোগ্য বিশিষ্টতা হলো এই যে, এটি সব কিছু অনুভুতি ও ধারণার দ্বারা গঠিত, এইটা না বোলে, বলে যে সবকিছুই উপাদানের দ্বারা গঠিত। উপাদান বলতে এনারা বোঝান এমন কিছু যা না মানসিক, না শারিরিক; আবার একই সাথে তা দুইয়ের মাঝামাঝি কিন্তু দুই হতে নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদীরা দাবি করলেন যে, তারা না বস্তুবাদী, না ভাববাদী; এবং তারা এই দুই ধারার বিরোধকে অতিক্রম করেছেন।

নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদীদের উপাদান”-এর ধারণাকে একটু খুঁটিয়ে বিচার করলেই দেখা যায় যে তা আসলে অনুভুতির-ই (sensation) নামান্তর। অগ্রগণ্য নিরপেক্ষতাবাদী আরন্সট মাখ বিষয়টিকে এইভাবে রেখেছেন, রং, শব্দ, চাপ, সময় (অর্থাৎ যেগুলিকে আমরা অনুভুতি বা Sensation বলে থাকি) ইত্যাদি হল জগতের প্রকৃত সত্য উপাদান; আর বস্তুগত উপাদান হল শুধুমাত্র এই অনুভুতিগুলির তুলনামূলক ভাবে স্থায়ী চিহ্ন বা অনুভুতির জটিল বিন্যাস

বস্তুবাদ বনাম নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদ (Materialism vs. Neutral Monism):

নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদীরা বাস্তব জগত সংক্রান্ত বস্তুবাদী ধারণাকে নাকচ করে দেয় এবং বস্তুগত জ্ঞান অর্জন কিভাবে সম্ভব সে সংক্রান্ত নতুন একটি পথের কথা বলেন। বলশেভিক নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদী আলেকজান্ডার বোগদানভ, যিনি লেনিনের গ্রন্থের মূল লক্ষ্য ছিলেন, আমাদের অভিজ্ঞতা ব্যাতিত কোনও বাস্তবতার অস্তিত্ব নেই। বস্তুগতভাবে তিনি দাবি করলেন যে, আমাদের চিন্তন বাস্তবতার অনুরুপ হবে, এই বস্তুবাদী মতের কোনও অর্থ নেই। এটির অর্থ শুধু এই যে, আমাদের অভিজ্ঞতাগুলি সামাজিক ভাবে সংগঠিত (Socially organized) এবং পরস্পরের সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ (Harmonize) তিনি সত্যকে দেখলেন শুধুমাত্র ধারাবাহিকতা (consistency) এবং পারস্পরিক সহমতের (agreement) নিরিখে। সকলেই সম্মত হবে এমন কিছুই বোধহয় পাওয়া অসম্ভব কিন্তু কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনও একটি ভ্রান্ত ধরনার ক্ষেত্রে আবার প্রায় সব মানুষের সহমত পাওয়া আবার বেশ সহজ। এটি কোনদিনই সত্য ছিল না যে, পৃথিবী সমতল, ঈশ্বর আছেন বা মহিলারা পুরুষদের তুলনায় হীনতর কিন্তু এগুলি সম্পর্কে একটি সামাজিক ভাবে সংগঠিত সহমত বা বোঝাপড়া ছিল।

বস্তুগত সত্য এবং কমিউনিজম (Objective Truth and communism): 

এটি সহজেই বোঝা যায় যে, কেন লেনিন পার্টির সংবাদপত্রের কাজ থেকে সময় বের করেছিলেন এই আবর্জনাকে দূর করতে। সত্য মানেই তা সামাজিক ভাবে সংগঠিত হতে হবে, এর কোনও বাস্তবতা নেই। বিশ্বাসের মধ্যে সর্বদাই বিরোধ থাকে। এই বিরোধ-ই আবার জনগণকে তাদের চিন্তনকে সংশোধন করতে চালিত করে। আমরা কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামে কখনওই বিজয় অর্জন করতে পারবো না যদি না আমরা এটা বুঝি যে, বস্তুগত সত্য আছে এবং সেই সত্যের গভীর গুরুত্ব  রয়েছে যদিও তা অধিকাংশের দ্বারা গৃহীত নয়।

বস্তুবাদের জন্য লেনিন সংগ্রাম শুরু করলেনঃ

আমরা আগেই দেখেছি লেনিন নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদের অবস্তুবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। অদ্বৈত বস্তুবাদ বলে যে, সমস্ত কিছুই উপাদানের (elements) দ্বারা গঠিত এবং এই উপাদান হল না মানসিক, না শারিরিক যদিও তারা শেষ বিচারে শুধুই অনুভুতি এবং চিন্তন।

লেনিনের প্রধান যুক্তিগুলিঃ

লেনিন এক্ষেত্রে মুলত চারটি পয়েন্ট দিয়েছেন। এক) নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদ প্রকৃত বিচারে বিষয়ীগত ভাববাদের একটি ছদ্ম রুপ যা বলে যে, ব্যক্তির মনের বাইরে কোনও জগত নেই এবং বস্তু হলো আসলে জটিল অনুভুতির সমাহার। দুই) নিরপেক্ষতাবাদ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে বেমানান। তিন) নিরপেক্ষতাবাদ ধর্মকে (religion) তুলে ধরে। চার) নিরপেক্ষতাবাদ ভিতর থেকেই পরস্পর বিরোধী বা সামঞ্জস্যহীন।

নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদ আদপে বিষয়ীগত ভাববাদ:

নিরপেক্ষতাবাদীরা দাবি করেছিলেন যে, তারা ভাববাদী বা বস্তুবাদী কোনোটি-ই নন এবং তারা বস্তুবাদ এবং ভাববাদের বিরোধকে অতিক্রম করেছেন। নিরপেক্ষতাবাদীদের বিভিন্ন লেখাপত্রকে বিশ্লেষণ করে লেনিন দেখালেন যে, তাদের মধ্যেকার মতভেদ সত্ত্বেও তারা প্রত্যেকেই দাবি করছেন যে, বস্তুগত মহাবিশ্ব আদপে অনুভুতি এবং চিন্তনের ফসল। এটি বস্তুবাদের ঠিক বিপরীত। বস্তুবাদ বলে যে চিন্তন বা অনুভুতি বস্তুগত উপাদান যথা, স্নায়ু, মস্তিস্ক প্রভৃতি ব্যাতিরেকে অসম্ভব।

নিরপেক্ষতাবাদ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে বেমানানঃ

লেনিনের সময়কার বিজ্ঞান এটা জেনে গেছিল যে, পৃথিবীতে জীবন বা মানুষের আবির্ভাবের সময়ের থেকে পৃথিবী নিজে অনেক বেশি প্রাচীন। সুতরাং পৃথিবী কারোর অনুভুতি বা চিন্তার ফসল হতেই পারে না কারণ পৃথিবীর আবির্ভাবের সময় তা করবার মতন কেউ উপস্থিতই  ছিল না। এই পয়েন্টটি বিষয়ীগত ভাববাদের প্রামান্য বিরধিতার একটি  ভেদ (variation) অর্থাৎ যেহেতু জঙ্গলে কোনও শ্রোতা ছিল না তাই গাছের পতনের কোনও কারণ নেই! ভাববাদীদের এক্ষেত্রে দাবি এরকম,    ঈশ্বর আছেন, তিনি সবকিছুই দেখছেন, শুনছেন এবং তিনি বৃক্ষ পতনের শব্দও শুনেছেন। অধিকাংশ নিরপেক্ষতাবাদী ঈশ্বরের বিষয়টিকে এড়িয়ে যান ঠিকই কিন্তু তারা এই বিরোধকে অন্যভাবে নাড়াচাড়া করেন। তারা দাবি করেন যে মানুষের আগে পৃথিবীর অস্তিত্বই ছিল না। তারা আরও বলেন, মানুষ নিজেকে মানসিকভাবে অতীতে প্রজেক্ট করতে পারে এবং এতে করে তাদের চেতনা ও অনুভুতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে অতীত গড়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে লেনিন বললেন যে, যদি আমরা নিজেদেরকে মানসিক ভাবে প্রোজেক্ট করতে পারি তাহলে আমাদের বর্তমান হয়ে পড়বে কাল্পনিক কিন্তু বাস্তবে মানুষের পূর্বে পৃথিবীর অস্তিত্ব একটি বাস্তবতা।

নিরপেক্ষতাবাদ বিশ্বাস এবং ধর্মকে তুলে ধরেঃ

লেনিনের অন্যতম বিরোধী আলেকজান্ডার বোগদানভ সত্যের সংজ্ঞা দিলেন এইভাবে, সত্য হল একটি আদর্শগত গঠন যা গঠিত হয় মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে। বোগদানভ আরও বললেন, সামাজিক ভাবে সংগঠিত বিষয়গত অভিজ্ঞতা অবশ্যই বাদবাদকি যৌথ অভিজ্ঞতার সাথে সুসামঞ্জস্যে থাকবে এবং থাকবে একটি কার্যকারণ সম্পর্কে।  লেনিন দেখালেন যে, এই সংজ্ঞার সাথে ক্যাথলিকবাদ একেবারে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। লেনিন আরও বললেন, নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদীদের সত্যের প্রতি যে আচরণ, তার দ্বারা সে সত্য ধারণা এবং মিথ্যা  ধারণার প্রভেদ বলতে অক্ষম। তাদের বক্তব্যে শুধু এইটুকুই উঠে আসে না যে, ধর্ম সত্য; পাশাপাশি তার ধর্মকে উৎসাহও দেয়। তাদের বক্তব্য হলো, জনগণ প্রমান ছাড়াই যে কোনও ধারণাকে গ্রহণ করবে। কিন্তু সাধারণভাবে নিরপেক্ষতাবাদের অসামঞ্জস্যগুলিকে শুধুমাত্র দার্শনিক তত্ত্বের ফলাফল দিয়ে বিস্তারে বোঝা মুশকিল। প্রয়োজন সেই দার্শনিক তত্ত্বের সংসক্তি এবং সামঞ্জস্যকে (coherence and consistency) বোঝা। লেনিন তার নিরপেক্ষতাবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণে এই বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করলেন।

আত্মজ্ঞানবাদ (Solipsism) হল সেই আজগুবি ধারণা যে বলে যে আমার মনই হল সেই একমাত্র বস্তু, যার বাস্তবতা আমি জানতে পারি। অতএব আমার মন ব্যতীত বাদবাকি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র বাস্তবতা  আমার মনে। নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদীরা, আত্মজ্ঞানবাদকে বাতিল করলেন কারণ তাকে মানলে তাদের অবস্থান হয়ে যায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ সমাজের অবস্থান যদি আমার মনের মধ্য হয় (আত্মজ্ঞানবাদ অনুযায়ী) তাহলে সত্যকে আর সামাজিক ভাবে সংগঠিত অভিজ্ঞতা বলা যায় না! লেনিন কিন্তু যুক্তি দিয়ে দেখালেন যে, নিরপেক্ষবাদ এর জায়গা থেকে শুরু করলে নিজ ব্যতিত অন্য কারোর অস্তিত্বের বাস্তবতায় পৌঁছানো অসম্ভব। লেনিন বললেন, “ যদি আমি এই সিদ্ধান্তে পৌছতে না পারি যে, আমার অনুভুতির কারণ (cause of sensations) আমি ব্যতিত অন্য বাস্তব অস্তিত্ব তাহলে আমি এই সিদ্ধান্তেও আসতে পারবো না যে, আমার ব্যাতিত অন্য কোন মন  বাস্তবে অস্তিত্বশীল।অতএব, নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদ, আত্মজ্ঞানবাদ কে বাতিল করতেই পারে না এবং ফলত দুটিই আজগুবি এবং প্রতিক্রিয়াশিল।

লেনিন এবং পরাবর্তন (Lenin and Reflection):

আমরা ইতিমধ্যেই, লেনিন তার বস্তুবাদ এবং অভিজ্ঞতা বিচারবাদী সমালোচনা”-  (Materialism and Empirio-Criticism) বস্তুবাদের পক্ষে যে  লড়াই করেছেন তা আলোচনা করেছি। এই বইটি পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মার্ক্সীয় দর্শনের একটি মূলগত সুত্রতে পরিণত হয়েছিল। যদিও বইটিতে ভাববাদের বিরুদ্ধে একটি অসাধারণ লড়াই আমরা পেয়েছি কিন্তু মানুষ তার অভিজ্ঞতা থেকে কিভাবে শেখে, যা এই বইতে লেনিন বলেছেন, তা ছিল মূলগত ভাবে ত্রুটিপূর্ণ। আমরা এবারে সেই ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করবো এবং দেখবো যে এই আলোচনা কিভাবে কমিউনিস্ট রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

পরাবর্তনের তত্ত্ব (The Theory of Reflection):

মার্ক্স এবং এঙ্গেলস প্রায়শই, বাস্তবিকতাই (reality) যে আমাদের ধারণার উৎস, এই গুরুত্বপূর্ণ বস্তুবাদী ধারণাকে প্রকাশ করতে পরাবর্তন (reflection) পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন। এঙ্গেলস বলেছেন, “সমস্ত ধারণাই হল পরাবর্তন, তা সে যথার্থ (True) হোক বা বিকৃত (distorted) এবং তা অভিজ্ঞতা থেকেই আসে বাস্তবিকতার পরাবর্তন  যে ধারণার জন্ম দেয় তা যথার্থ হতেই হবে এমন কোনও কথা নেই, এমনকি তা সম্পূর্ণ ভ্রান্তও হতে পারে। এঙ্গেলস লিখেছেন, “সমস্ত ধর্ম ...... সেই সমস্ত বাহ্যিক শক্তির, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নিয়ন্ত্রন করে, সেইগুলির মানুষের মনের মধ্যে গড়ে  ওঠা একটি কাল্পনিক পরাবর্তন; এমন একটি পরাবর্তন যেখানে লৌকিক শক্তিগুলিকে অলৌকিক শক্তি হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। অর্থাৎ কিছু মানুষের মনে লৌকিক শক্তিগুলির পরাবর্তন অলৌকিক শক্তি রুপে হচ্ছে মানে  এটা কখনওই নয় যে, অতিপ্রাকৃত অলৌকিক পরাবর্তন একটি বাস্তবতা। পুঁজিবাদী প্রচারের ফলে পুঁজিবাদের চীর স্থায়িত্বের যে পরাবর্তন গঠিত হয় তাও একই ভাবে বাস্তবিকতা নয়।

পরাবর্তনের তত্ত্বের বোঝাপড়ায় লেনিনের ভ্রান্তিঃ

পরাবর্তন সম্পর্কিত লেনিনের বক্তব্যগুলিকে আসুন আমরা চুম্বকাকারে দেখে নি। কোন কিছু জানার অর্থ হল বাস্তবিকতার নকল (copying) করাধারণা এবং চিন্তন হল বাস্তবিকতার রূপকল্প (images)বস্তু হল একটি দার্শনিক বিভাগ যা বিষয়ীগত বাস্তবিকতাকে (objective reality) প্রকাশ করে। এই প্রকাশ মানুষের কাছে পৌঁছায় অনুভুতির মাধ্যমে। আর এই অনুভুতি হলো বাস্তবিকতার  অনুলিপি (copy), ছবি (photograph) 

·       তত্ত্বকে অনুলিপি হিসাবে স্বীকার করা, তাকে বিষয়ীগত বাস্তবিকতার প্রায় ঠিক অনুলিপি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়াই হলো বস্তুবাদ।

লেনিনের ব্যবহৃত রূপকল্প (image), অনুলিপি (copy) বা ছবি (Photograph) প্রভৃতি রুপক এই ধারণাকে প্রকাশ করে যে অনুভুতির উপলব্ধি এবং তার তাত্ত্বিকীকরণ, বাস্তবিকতা সম্পর্কে সত্য বা প্রায় সত্যের তথ্য দিতে পারে। এখন এই যে অনুলিপি বা ছবি প্রভৃতি এই ধারণাই দেয় যেন, কোন কিছু জানা বিষয়টি একটি সরল এবং  স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া, যা একেবারেই সত্য নয়। আবার কিছু ধারণা বা  অনুভূতির উপলব্ধি একেবারেই অনুলিপি নয়। যেমন পচা মাছের দুর্গন্ধ আমাদের তা খেতে বারণ করে (শুঁটকি প্রেমিকরা আহত হবেন না; এটি উদাহরণ। আপনারা এক্ষেত্রে পচা ডিম পড়তে পারেন।) কিন্তু এই দুর্গন্ধ মাছের কোন অনুলিপি বা রসায়নের অনুলিপি নয়। কোনও কিছুকে জানা মানেই তার অনুলিপি তৈরি করা নয়। লেনিনের পরাবর্তন সম্পর্কিত তত্ত্বে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পরে গেছে। এক) জ্ঞাতার (knower) ব্যবহারিক এবং মানসিক কার্যকলাপ (activity) এবং দুই) তত্ত্ব এবং প্রয়োগের দ্বন্দ্ব।

জ্ঞাতার কার্যকলাপ (Activity of the knower):

একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অভিজ্ঞতা থেকে কি শিখবেন তা নির্ভর করে তার পূর্বানুমানগত ধারণা (Preconception) এবং সে বা তারা কি করেন (what they actually do) তার উপর। ভ্রান্ত বিশ্বাস, জাতিবাদ, কুসংস্কার, অসততা, আলস্য, ঔদ্ধত্য এবং অন্যান্য ব্যক্তি-ত্রুটি কোন কিছু থেকে সঠিক অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অভিজ্ঞতা থেকে শেখা অনুলিপি বা ছবির মতন বিষয় নয়। কারণ কোন কিছু থেকে সঠিক অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন এক) সঠিক অবস্থান (right position to see), দুই) বিষয়ের প্রতি মনোযোগ (paying attention) এবং তিন) action অনেকটা ফুটবলের রেফারির মতন। আবার পুরানো তত্ত্বের মেরামতি বা নতুন তত্ত্বের প্রণয়ন একেবারেই অনুলিপি তুল্য বিষয় নয়।

তত্ত্ব এবং প্রয়োগের দ্বন্দ্ব (The Dialectics of Theory and Practice):

লেনিন বুঝেছিলেন যে, প্রয়োগের ক্ষেত্রে সফলতা বা ব্যর্থতা আমাদের ধারণার সঠিকতা সম্পর্কে বলে। তিনি লিখলেন, “বস্তুর অবস্থান আমাদের বাইরে। আমাদের উপলব্ধি এবং ধারণা হল সেগুলির রূপকল্প। প্রয়োগ এই রূপকল্পগুলিকে যাচাই করে, বাস্তব এবং মিথ্যা রূপকল্পকে আলাদা করে। এখানে যেটা বাদ গেছে তা হলো, সত্য তত্ত্বকে খুঁজে পাবার ক্ষেত্রে প্রয়োগের বা অনুশীলনের ভুমিকা এবং প্রয়োগের বা অনুশীলনের দিগদর্শক হিসাবে তত্ত্বের ভুমিকা। আরও ভালো প্রয়োগ বা অনুশীলন আরও ভালো তত্ত্বের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে যা আবার আরও ভালো অনুশীলনকে সম্ভব করে তোলে। বাস্তবিকতার অনুলিপি কোনও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি নয়; দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি হলও বাস্তবিকাতার সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া (interactions) জানা হলো একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া যেখানে মানুষ দুনিয়াকে বদলায় তাকে বুঝবার জন্য এবং বোঝে তাকে বদলাবার জন্য। লেনিনের তত্ত্ব এক্ষেত্রে ফোকাস করেছে শুধুমাত্র জ্ঞাতার উপর প্রকৃতি এবং সমাজের প্রভাব বিষয়ে যেটি একটি যান্ত্রিক বস্তুবাদী আবেদন, দ্বান্দ্বিক নয়।

পরবর্তী বিকাশগুলিঃ

এখানে আলোচিত বহু পয়েন্টের মান্যতা পাওয়া যাবে পরবর্তী সোভিয়েত দর্শনে যা জ্ঞাতার কার্যকলাপকে অন্তর্ভুক্ত করবার মধ্য দিয়ে আরও ভালো পরাবর্তনের তত্ত্বকে নিয়ে এসেছিলো। লেনিনও তার পরবর্তী কাজগুলিতে দ্বন্দ্বতত্ত্বের ধারণাকে নিয়ে এসেছিলেন। চীনে, মাও সেতুং তত্ত্ব এবং প্রয়োগের দ্বান্দ্বিকতাকে ব্যখ্যা করেন। সোভিয়েতের দার্শনিক  নোট-বুকে লেনিনের এই ভ্রান্তিগুলির সমালোচনা কোনদিনই স্থান পায়  নি; এর কারণ সম্ভবত লেনিনের নামে গড়ে ওঠা অভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের সংস্কৃতিযা অবশ্যই অমার্ক্সীয়। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় আমরা দেখতে পেলাম লেনিনের এই ভ্রান্তিকেই অস্ত্র করলো পুঁজিবাদের পথের পথিকেরা। এই তত্ত্ব এই কারণে তাদের কাজে লেগেছিল যে, জ্ঞানের অর্থ এখানে করা হয়েছিল বাস্তবিকতার অনুলিপি এবং যেহেতু কমিউনিজম তখনও বাস্তবিকতা ছিল না তাই তার জ্ঞানকে বাতিল করা যাচ্ছিল এই ভ্রান্তিকে আশ্রয় করে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে কমিউনিজম সম্পর্কে আমরা জানি বাস্তবিকতার অনুলিপি গঠনের মধ্য দিয়ে নয়; বরঞ্চ বিগত বিপ্লবগুলির তাত্ত্বিক এবং প্রায়গিক জ্ঞানগুলিকে একত্রিত করে তাকে শ্রমিক শ্রেণীর হাতে তুলে দেবার মধ্য দিয়ে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আন্তর্জাতিকতাবাদের সমাজতান্ত্রিক বেইমানি হতে পাওয়া শিক্ষাঃ বিপর্যয় এবং বিপ্লবের দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কে লেনিনঃ

এদিকে ১৯১৪ সালের ঘটনাবলি লেনিনকে দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে আরও বিস্তারিত ভাবে অধ্যয়নের জন্য এবং কমিউনিস্ট দর্শনের বিকাশের বিষয়ে প্রোৎসাহিত করলো  

১৯১৪ সালে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা পুঁজিবাদী লুঠের স্বার্থে শুরু করলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যাতে বলি হলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ইউরোপের সোশ্যালিস্টরা (দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক) এই আসন্ন যুদ্ধের আভাস পেয়েছিলেন এবং অধিকাংশ দেশের সোশ্যালিস্ট পার্টি এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বিরোধিতার আবেদন জানান এবং পাশাপাশি যুদ্ধ শুরু হয়ে  গেলে তাকে ব্যপক ধর্মঘটের মাধ্যমে বিরোধিতার প্রস্তাব দেন। কিন্তু  বাস্তবে সোশ্যালিস্ট পার্টিগুলির প্রায় সব নেতাই তাদের নিজের নিজের দেশের যুদ্ধবাজ সরকারকে সমর্থন করেন এবং এই যুদ্ধকে বিপ্লবে পরিণত করবার কমিউনিস্ট শ্রমিকদের প্রচেষ্টাকে আটকাবার চেষ্টা করেন।

যে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে মনে হচ্ছিল যে তারা পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করবে, তা তার বিপরীতে পরিবর্তিত হয় এবং সাম্রাজ্যবাদ কে সাহায্য করে ও শ্রমিক শ্রেণীকে দমনের ভুমিকা গ্রহণ করে। যদিও লেনিন সেই সময় সচেষ্ট ছিলেন একটি নতুন ধরণের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে যে কিনা যুদ্ধকে বিপ্লবের সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করবে। যুদ্ধ শুরু হতেই লেনিন, হেগেলের দ্বন্দ্ব মূলক দর্শন  অধ্যায়নে রত হলেন। লেনিনের সেই সময়ের বক্তব্য বা আর্টিকেলে সেই অধ্যায়নের ফলে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তের কিছু আভাস পাওয়া গেলেও তার নোটবুকে অনেক বেশি এবং বিস্তারে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত  আমরা পাই। তবে এই নোটবুক প্রকাশিত হয়েছিল লেনিনের মৃত্যুর পর। আমরা লেনিনের সেই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলিকে এবার আলোচনা করবো।

বিকাশের দ্বান্দ্বিকতা (The Dialectics of Development):

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের এই ধারণা যে, মানব সমাজের ঐতিহাসিক  বিকাশ অর্থাৎ শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশ ধাপে ধাপে বিবর্তিত হবে,   আকারে এবং শক্তিতে বাড়তেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে পুঁজিবাদকে উৎখাত করতে পারে, সেই ধারণা ১৯১৪ সালের বিপর্যয়ের ফলে বিরাট ধাক্কা খেলো। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পর্কিত দুটি মূলগত দৃষ্টিকোণের একটিকে লেনিন নির্দিষ্ট করলেন।  

পরিবর্তনকে হ্রাস বৃদ্ধির পুনরাবৃত্তিহিসাবে দেখা যেখানে, কোনও  নির্দিষ্ট পরিবর্তনের কারণের কোনও ব্যাখ্যা নেই।

এর বিপরীত দৃষ্টিকোণ হলো দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় যে, পরিবর্তন, বিকাশের হ্রাস বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রায়শই এগিয়ে যায় লাফ মেরে, সামাজিক এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও  বিপ্লবের মধ্য দিয়েধারাবাহিকতার এই ছেদহল আসলে বস্তু, ঘটনা এবং সমাজের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলির এবং ঝোঁকগুলির বিরোধ এবং সংঘর্ষেরদ্বারা চালিত প্রক্রিয়া। বিরোধের প্রবণতা থাকে আরও তীব্র হয়ে ওঠার যা, বিস্ফোরণ বা অর্থনৈতিক সংকটের মতন হটাৎ  পরিবর্তনের মতন ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ দ্বন্দ্ব তত্ত্ব হটাৎ পরিবর্তনকে (যেমন আরব বসন্ত”) বা হটাৎ পতনকে (যেমন  গালফ যুদ্ধে ইরাকি   বাহিনীর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরাজয়) প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে দেখে। লেনিন বললেন, এটিই হলও বিপরীতের ঐক্য (unity of opposites), প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিত, যা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত কিন্তু একই সাথে পরস্পরকে বাতিল করে; এবং এটিই বাস্তব জগতের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারে।

বিপরীতে পরিবর্তন (Turning into Opposite):

বাস্তব প্রক্রিয়ায় আমরা এক কে, তার বিপরীতে পরিবর্তিত হতে দেখি।  অর্থাৎ এক, তার বিপরীতের চরিত্র গ্রহণ করে। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের  আগের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, যুদ্ধের সময়, সাম্রাজ্যবাদের একটি সহায়কে পরিণত হলো। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সংস্কারবাদী এবং       স্ব-বিজ্ঞাপিতদের নেতা হয়ে উঠতে অনুমোদন দিয়েছিল, বিশেষত ট্রেড ইউনিয়নের আমলা যারা, পুঁজিবাদীদের সাথে সহযোগিতা গড়ে তুলেছিল তাদের আরামদায়ক কাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এই সমস্ত সুবিধাবাদীদের, বিপ্লবীদের পাশাপাশি, তাদের বৈধ সদস্য হিসাবে সহ্য করেছিল। যুদ্ধের শুরুতে, বুর্জোয়াপন্থীরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ভিতরের শ্রেণী সংগ্রামে জয়লাভ করে এবং সাম্রাজ্যবাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় যা ছিল, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের  লক্ষ্যের বিপরীত।  

যুদ্ধের সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার বিপ্লবীরা গড়ে তুললো  কমিউনিস্ট পার্টি বা বলশেভিক পার্টি এবং যুদ্ধের তিন বছরের মাথায়, ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে বিপ্লবের সফল রুপায়ন সম্পন্ন  করলো। এটিও বিপরীতে পরিবর্তন।

বিপরীতের সংগ্রাম (The Struggle of Opposites)

লেনিন এই বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন যে, বিপরীতের ঐক্য সর্বদাই অস্থায়ী এবং সীমাবদ্ধ (প্রেক্ষিত ও প্রয়োগের দিক থেকে) কিন্তু পারস্পরিক ভাবে স্বতন্ত্র ও বিপরীতের সংগ্রাম হল পরম, যেরকম ভাবে বিকাশ এবং গতি পরম” (“The struggle of mutually exclusive opposites is absolute, just as development and motion are absolute”) দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের বিপ্লবী এবং সংস্কারবাদীদের ঐক্য, (বিপরীতের ঐক্য) যুদ্ধ শুরু হতেই,  ভেঙে  যায় (কারণ তা অস্থায়ী এবং সীমাবদ্ধ) কিন্তু এই দুই অংশের বিরোধ ততদিন থাকবে যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে (এমনকি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যতদিন পুঁজিবাদের রেশটুকুও থাকবে, ততদিন থাকবে)। ইতিহাসের প্রক্রিয়ার ঝোঁক হলো তার ভিতরের বিরোধের  আরও তীব্র হয়ে ওঠা এবং পূর্বেকার বিপরীতের ঐক্যে ভেঙে যাওয়া। লেনিন বললেন, পূর্ণের (the whole) বিরোধাত্মক দিকে ভেঙে যাওয়াই  হলো দ্বন্দ্ব তত্ত্বের সারৎসার” (essence of dialectics)

লেনিনের দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রধান প্রধান অংশের পর্যালোচনাঃ

অসমান বিকাশের নিয়ম (The Law of Uneven Development):

লেনিনের চোখে দ্বন্দ্ব বলতে বোঝায় যে, পরিবর্তন ঘটে বিপ্লবের দ্বারা   এবং তার নিরবিচ্ছিন্নতায় ছেদ ঘটে; বিকাশ শুধুমাত্র একটি মসৃণ ও ধারাবাহিক হ্রাস বৃদ্ধিমাত্র নয়। এই ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ তিনি ঘটান তার আলোচনায়। লেনিন এই ধারণার দ্বারা দেখালেন যে,  সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যুদ্ধ ছাড়া পৃথিবীকে ভাগ বাঁটোয়ারা করতে পারে না। এই ভাগ বাঁটোয়ারাতে অংশগ্রহণকারী অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তিগুলির সমান মাত্রায় পরিবর্তন ঘটে না কারণ বিভিন্ন পুঁজিবাদের মধ্যেকার বিভিন্ন সংগঠনগুলির সমান বিকাশ অসম্ভব। সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে কে কতটা শ্রম বা সম্পদকে শোষণ করবে, এই বোঝাপড়া ভেঙে যায় কারণ কিছু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং আরও বেশি দাবি করে অপরদিকে, কিছু সাম্রাজ্যবাদী  শক্তি তুলনায় হীনবল হয়ে পড়লেও তাদের নিজের নিয়ন্ত্রনে থাকা লুঠের অধিকার ছাড়তে রাজি হয় না। বিংশ শতাব্দীতে জাপান, জার্মানি এবং আমেরিকা ছিল উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। বর্তমানে চীন হলো   উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যারা আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এগুলি হলও আসলে, সাম্রাজ্যবাদী   শক্তিরগুলির মধ্যেকার শত্রুতার দ্বন্দ্ব।

সর্বজনীন সংযোগ (Universal Connection):

হেগেলের উপর অধ্যায়নের থেকে লেনিন, জগতের নিরপেক্ষ (all- sidedness) এবং সর্বব্যাপী (all-embracing) অন্তঃসংযোগকারী  চরিত্রের ধারণার উপর জোর দেন। প্রতিটি প্রকৃত বস্তু বা প্রক্রিয়ার, জগতের  বিভিন্ন বস্তু ও প্রক্রিয়ার সাথে আছে জটিল সংযোগ। তাই কোনকিছু সম্পূর্ণরূপে বুঝতে হলে এই সমস্ত সংযোগগুলিকে আবিস্কার করতে হবে এবং এই আবিস্কার করবার প্রক্রিয়া এমন একটি প্রক্রিয়া যা কোনদিনই সম্পূর্ণ হবে না! লেনিন একটি সাধারণ জলের গ্লাসকে এই বিষয়ের উদাহরণ হিসাবে নিলেন। গ্লাস একটি নলাকার বস্তু কিন্তু একে একটি ক্ষেপণাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায়; এটি একটি পেপার ওয়েট হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, ব্যবহৃত হতে পারে একটি প্রজাপতিকে আটকে রাখবার বাক্স হিসাবে বা এর উপরে দুর্লভ শিল্পকর্ম এঁকে একে করা যেতে পারে একটি মহামূল্যবান বস্তু। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা এই এতকিছুর সাথে এই বিষয়ের কোন সম্পর্কই নেই যে এটি একটি জল পান করবার উপায়, বা এটি কাঁচের তৈরি বা এর আকৃতি নলাকার। এখন এই গ্লাসের কোন পরিপ্রেক্ষিত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ভর করবে আমাদের প্রয়োজন এবং আগ্রহের উপর। একজন মানুষ যিনি জল পান করতে চান তিনি এসব কিছুকেই গুরুত্ব দেবেন না শুধু দেখবেন যে গ্লাসে ফুটো আছে কিনা। একটি বস্তুর পূর্ণ সংজ্ঞাতে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে মানবের পূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্থাৎ যুগপৎ সত্যের মানদণ্ড এবং মানুষের চাহিদার সাথে এর সংযোগের প্রায়োগিক সুচককে।

ভাববাদ সম্পর্কে লেনিনের বোঝাপড়াঃ

কোন কিছুর গুরুত্বপূর্ণ পরিপ্রেক্ষিত বাদ দেওয়া বা কোনও   পরিপ্রেক্ষিতের উপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপণ হলো কোনো কিছুকে বুঝবার ভুল পদ্ধতি। একেই বলে পক্ষপাতিত্ব (“one-sidedness”) লেনিন যুক্তি দিয়ে বললেন, আমরা ভাববাদকে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পূর্বেকার ধারণাগুলির মতন শুধুমাত্র মুর্খামি বা অজ্ঞতা না বলে  বলবো পক্ষপাতী (one-sided)  পুরানো, যান্ত্রিক বস্তুবাদ, ধারণাকে  (ideas) কারণ(cause) হিসাবে নয়, দেখে সত্যের প্রভাব  (effects) হিসাবে এবং ধারণার যে এই পৃথিবীতে পরিণাম (results) থাকতে পারে, তা অস্বীকার করে। লেনিন দেখেছিলেন  যে, ধারণা সত্য হয়ে উঠতে পারে যদি তা জনগণকে নতুন কিছুর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারে। ভাববাদের ভ্রান্তি এখানেই যে, সে ধারণার  উপলব্ধির প্রক্রিয়ার সাথে বস্তু এবং প্রকৃতির সংযোগ সাধন করতে ব্যর্থ। লেনিন লিখলেন, বোকা বোকা বস্তুবাদের চেয়ে ধীযুক্ত ভাববাদ (Intelligent Idealism) বা দ্বান্দ্বিক ভাববাদ,  দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অনেক কাছাকাছি পৌঁছিয়েছে

দ্বান্দ্বিক যুক্তি এবং অনুশীলন (Dialectic Logic and Practice):

হেগেলের ধারণা (Idea) এবং অনুশীলনের (Practice) বস্তুবাদী পুনঃব্যাখ্যা অর্থাৎ উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত মানবিক কাজ আমরা  লেনিনের নোটে পাই। সত্য জানবার পদ্ধতিটি হলো, “জীবন্ত উপলব্ধি (living perception) হতে বিমূর্ত চিন্তন (abstract thought), এবং সেখান থেকে অনুশীলনে (to practice) এমনকি দ্বন্দ্ব তত্ত্বের নীতিগুলি নিষ্কাশিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ অনুশীলনের পুনরাবৃত্তি এবং তারপর অনুশীলনরত জনগণকে serve করবার মধ্য দিয়ে।

 দ্বন্দ্ব তত্ত্বে লেনিনের প্রভাবঃ

 লেনিনের নেতৃত্ব এবং দ্বন্দ্ব তত্ত্ব সম্পর্কে তার অধ্যয়ন এবং লেখাপত্রের,  আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দর্শনের উপর গভীর প্রভাব আছে। লেনিন জোর দিয়েছিলেন পার্টির হেগেলের পাশাপাশি প্লেখানভের উপর পাঠচক্র পরিচালনায়।

বলশেভিকরা সিদ্ধান্ত কোরে সংশোধনবাদী এবং অদ্বান্দ্বিক দর্শনগুলিকে,  যেগুলি ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রে প্রবল ছিল, বাতিল করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, সোভিয়েত ইউনিয়নে, ১৯৩০ সালের আগে, দ্বন্দ্ব তত্ত্বের মুল ধারণাগুলিকে সুত্রায়িত ও গ্রহণ  করা সম্ভব হয় নি। আমরা এবার সেই সুত্রায়নের দুর্বলতাগুলি আলোচনা করবো।

 সোভিয়েত ইউনিয়নে যান্ত্রিক বস্তুবাদঃ

সময়কাল ১৯২০ ও ১৯৩০-র এর দশক। এই সময়কালে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে দেখতে পাই দ্বন্দ্ব তত্ত্বের মুল নীতিগুলির উপর এবং সেই নীতিগুলির রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রয়োগকে ঘিরে চলা তীব্র সংগ্রাম। এই পর্যায়ে আমরা আলোচনা করবো যান্ত্রিকতা বা যান্ত্রিক বস্তুবাদ নামক ভ্রান্ত দর্শন নিয়ে।

বিজ্ঞানের যে শাখা বল (force) এবং গতির পিছনের কারণ স্বরূপ যে বল দায়ী, তাকে নিয়ে আলোচনা করে, তাকে বলে বলবিদ্যা  (mechanics) বলবিদ্যার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে বলের কম্বিনেশনের উপর। নির্দিষ্ট করে বললে, কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা সিস্টেমের উপর ক্রিয়াশীল সম শক্তির বিপরীতমুখি বল একে অপরকে বাতিল করে এবং ফলে গতির কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

যান্ত্রিকতাবাদ:

বলবিদ্যার কিছু পরিপ্রেক্ষিতের (aspects) অনুকরণে দার্শনিক যান্ত্রিকতাবাদ (Philosophical mechanism) গঠিত হয়েছে। এই মত প্রচার করেন প্রভাবশালী বলশেভিক নেতা নিকোলাই বুখারিন। এই মতকে বুখারিন ব্যবহার করেন তার পুঁজিবাদীপন্থী নীতিগুলিকে রক্ষা  করতে। তাঁর লেখা দার্শনিক পাঠ্য বইতে বুখারিন একটি বিরোধের সংজ্ঞা দিলেন এরকম, “বিভিন্ন দিকে ক্রিয়াশীল বলের বৈরিতা। বিরোধের এই ধারণা গুরুতর প্রমাদের জন্ম দিল।

এই সংজ্ঞা নিয়ে একটি সমস্যা হচ্ছে যে, শুধুমাত্র বল-ই বিরোধাত্মক হয় না। মার্ক্স দেখিয়েছেন যে, লাভের হারের পতনের প্রবণতা, মজুরির পতনের প্রবণতার সাথে বিরোধাত্মক, কিন্তু ঝোঁক বা প্রবণতা বা মজুরী ছাঁটাই কোনোটাই বল নয়। শুধুমাত্র ঝোঁক বা প্রবণতা নয়,  অন্যান্য জিনিসও যেমন, প্রয়োজন বা চাহিদা এবং ধারণাও বিরোধের  একটি দিক হতে পারে। ওদিকে বুখারিন কিন্তু বৈরিতাকে ব্যাখ্যা করেন নি এবং ব্যাখ্যা করেন নি বৈরিতা, বিরোধ থেকে কিভাবে আলাদা, তা 

বিপরীতের ঐক্য সমালোচনামূলক:

বিরোধের প্রান্তগুলি কিভাবে সংযুক্ত থাকে, সে সম্পর্কে বুখারিন কিছুই বলেন নি। দ্বান্দ্বিক বিরোধ, সংগ্রাম এবং একতা, উভয়কেই একত্রিত (combine) করে। বিপরীতের মধ্যে একটি পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সংযোগ থাকে যাকে বলে জৈবিক সম্পর্ক” (organic relation) বুখারিন যে কোনো প্রকার জৈবিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করলেন।  কিন্তু বিরোধের একতা বাস্তবে জরুরি।

সংযোগের (connection)  একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকার হল এইরকম, আয়নার সামনে যাই আসবে, সে পাবে তার বিপরীত। ফুটবল খেলায়, প্রতিটি  দল, তার বিপরীত দলের শক্তিকে কমিয়ে দিতে চায় এবং নিজের খামতিকে অতিক্রম করতে চায়। যদি বিপরীত দলে একজন স্টার স্ট্রাইকার থাকে তাহলে একটি টিম, হতে পারে, তার মিড ফিল্ডের   শক্তিকে সেই স্টার স্ট্রাইকারকে মার্ক করবার কাজে ব্যবহার করবে। অন্য টিমের ক্ষেত্রে আবার সে তার খেলোয়াড়দের অন্য ভাবে সংগঠিত করবে। খেয়াল করলে দেখবো যে, প্রতিটি দিক (এক্ষেত্রে দুটি ফুটবল টিম) অংশত তার বিপরীত টিমের দ্বারাও নির্ধারিত।

বিপরীত কিন্তু আবার একে অন্যের ভিতর প্রবেশও করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যেহেতু মালিক জানে যে, সে তার শ্রমিককে  লড়াই করা থেকে আটকাতে পারবে না, তাই সে ব্যবহার করে আইন, মিডিয়া, ঘুষ প্রভৃতি যাতে করে মালিকপন্থী (দালাল) নেতৃত্ব ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং শ্রমিকের আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়।

বিপরীত, এক এ অন্যের মধ্যে প্রবেশ করে, এটি হলো দ্বন্দ্ব তত্ত্বের একটি  মূলগত সত্য যা যান্ত্রিক বস্তুবাদীরা অবজ্ঞা করেছিল।

যেহেতু বিপরীতমুখি বল একে অন্যকে বাতিল করতে পারে, তাই বুখারিন বললেন, যে এটি বিরোধের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। তখন আমরা পাবো একটা বিরামের অবস্থা (state of rest) অর্থাৎ তাদের প্রকৃত সংঘর্ষকে (conflict) লুকিয়ে ফেলা হয়েছে (concealed)”

বুখারিন তার এই ধারণাকে প্রয়োগ করলেন যুযুধান সাম্রাজ্যবাদীদের উপর। তিনি দাবি করলেন যে, যে সকল সাম্রাজ্য সম-বলশালী তারা একটি বোঝাপড়ায় আসতে পারে যখন একের অন্যের উপর বিজয় লাভ স্বপ্নাতীত এবং লড়াই অর্থহীন। বুখারিনের এই উদাহরণ স্পষ্ট দেখায় যে, বুখারিনের ধারণার গোড়ায় গলদ রয়েছে। সম-বলশালী সাম্রাজ্যের মধ্যেকার সংঘর্ষের তীব্রতা খুবই প্রবল হতে পারে যেমনটি আমরা দেখতে পাই ৬০, ’৭০ এবং ৮০-র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। এমনকি তারা যখন সরাসরি সামরিক নাক গলানোকে পরিহার করেছে তারা তাদের লড়াই জারি রেখেছে স্পন্সর করা ছোট শক্তির লড়াইয়ের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই লড়াই চালিয়েছে ৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এবং ৭০-এর দশকে ইজিপ্টের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। উল্টোদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই একই কাজ করেছে ৮০-র দশকে আফগান যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েক দশক ধরে ইজরায়েলের  মাধ্যমে। দুটি দিক যখন পরস্পরকে রুখে দেবার মতন শক্তিশালী থাকে তখন তাদের মধ্যেকার বিরোধের তীব্রতা, একদিক শক্তিশালী ও অপরদিক দুর্বলের মধ্যেকার বিরোধের তীব্রতার তুলনায় অনেক বেশী তীব্র হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০০৮ সালে রাশিয়া যখন জর্জিয়াকে আক্রমণ করে তখন জর্জিয়া সে অর্থে কোনও কার্যকরী প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারে নি। এর কারণ হলো, বিরোধের থাকে সংগ্রাম এবং একটা, বিরোধের দুটি দিক একে অন্যতে প্রবেশ করে। মোদ্দা কথা বিরোধের দুটি দিক পরস্পরকে বাতিল করে না।

গুণগত পরিবর্তনকে বাতিল করা (Rejecting Qualitative Change):

যান্ত্রিকতাবাদীরা বলবিদ্যাকে এমন একটি বিজ্ঞান হিসাবে দেখতেন যা  কিনা শুধুই পরিমাণ নিয়ে কাজ করে অর্থাৎ যাকে সংখ্যায় মাপা যায়। যেহেতু তারা বলবিদ্যাকে একটি বেসিক বিজ্ঞান হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন, তাই তারা প্রায়শই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন যে, গুণ এবং গুণগত পরিবর্তন বাস্তব নয়। জলের ফুটে বাস্পে পরিণত হওয়ার মতন ফ্যাক্ট থাকা সত্ত্বেও, যা পদার্থবিদ্যার অন্য শাখায় চর্চা করা হয়, কিছু সোভিয়েত বিজ্ঞানী বললেন যে, গুণগত পরিবর্তন কোনো বস্তুগত  বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট নয়। তারা দাবি করলেন যে, কোনও নির্দিষ্ট গুনের থাকা বা না থাকা নির্ভর করে লোকে কোন গুণকে আলাদা করতে চাইছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। এই কারণে তারা পরিমাণের গুণগত পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিক নিয়মকে বাতিল করেন। অন্যান্য যান্ত্রিকতাবাদীরা পরিমাণের গুণগত পরিবর্তনকে এই কারণে বাতিল করলেন যেহেতু বলবিদ্যার একটি নিরবিচ্ছিন্নতার নিয়ম আছে তাই হটাত কোনও গুণগত পরিবর্তন সম্ভব নয়। অর্থাৎ বিপ্লব সম্ভব নয় এবং বিপ্লব কোনো বাস্তব ঘটনা নয়।

সাম্যাবস্থার উদ্ভট কল্পনা (Fantasies of Equilibrium):

যান্ত্রিকতাবাদীদের আরেকটি টিপিকাল মত তারা ধার করে তাপ-গতিবিদ্যা থেকে। তাপ-গতিবিদ্যার একটি নিয়ম হচ্ছে যে, একটি বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র ব্যবস্থায় (isolated system) কোন বস্তু যখন কোনও কোনরূপ বস্তু বা শক্তির আদানপ্রদান করে না তার পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থার সাথে, তখন সেটি একটি সাম্যাবস্থায় যাবার প্রবণতা দেখায়। সাম্যাবস্থায় থাকা বস্তু, বাহির থেকে প্রভাবিত না হলে পরিবর্তিত হবার কোনও ঝোঁক প্রদর্শন করে না। 

যান্ত্রিকতাবাদীরা এই প্রবণতাকে, বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ছাড়াও, সমস্ত  ব্যবস্থায় প্রযোজ্য বলে ধরে নিলেন। তারা দাবি করলেন যে, জনগণ এবং সমাজ সর্বদাই সাম্যাবস্থায় পৌঁছতে চায় যদিনা তাকে বাইরে থেকে উত্তেজিত করা হয়। অর্থাৎ শ্রেণী সংগ্রামের মতন অভ্যন্তরীণ কারণ ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণ নয়! যান্ত্রিকতাবাদীরা সামাজিক সংঘর্ষকে দেখলেন নিজের থেকে খতম হয়ে সাম্যাবস্থায় পৌঁছানোর  একটি প্রবণতা হিসাবে যা, বাস্তবে মার্ক্সবাদের ঠিক  বিপরীত।   

যান্ত্রিকতাবাদীদের এই দাবি দাড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ বোগাস ফিজিক্সের উপর। একজন মানুষ, যে কিনা তার পারিপার্শ্বিকের সাথে কোনও শক্তি বা বস্তু বিনিময় করছে না সে অস্তিত্বহীন। এমনকি মৃতদেহও পারিপার্শ্বিকের সাথে বস্তু ও শক্তির বিনিময় করতে বাধ্য। একটি সমাজও একই ভাবে বস্তু ও শক্তির বিনিময় না করলে সে অস্তিত্বহীন। আসলে যান্ত্রিকতাবাদীদের তর্কটা দাঁড়িয়েই আছে একটি ছদ্ম বিজ্ঞানের (pseudo-science) উপর।

ভুল দ্বন্দ্ব তত্ত্ব সমস্যা তৈরি করেঃ

সমস্ত ব্যবস্থা সাম্যাবস্থার দিকে এগোয় এই ভুল ধারণা, সোভিয়েত রাশিয়ায় ১৯২০ সালে কৃষিতে সমবায় গড়ে তুলবার বিতর্কে সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। সেই সময় প্রায় সমস্ত খাদ্যই কৃষকরা উৎপন্ন করতেন। শহরের শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহের বেশীরভাগটাই নিয়ন্ত্রন করতো  গ্রামীণ ধনী চাষিরা যাদের বলা হতো কুলাক। এই কুলাকরা ছিল সোভিয়েত সরকারের প্রতি শত্রু মনোভাবাপন্ন। সেই সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা, নিকোলাই বুখারিন, তার যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা চালিত হয়ে, কুলাক এবং সোভিয়েত সরকারের মধ্যেকার এই সংগ্রামকে দেখলেন ক্রমান্বয়ে ক্ষীয়মাণরাজনৈতিক সংগ্রাম হিসাবে। তিনি কুলাকদের হয়ে ওকালতি করে বললেন যে, কুলাকদের প্রতি সদয় হতে হবে আরও বেশী ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের দ্বারা। এতে করে নাকি  কুলাকরা আরও বেশী শস্য ফলানোর উৎসাহ পাবে!

স্তালিন এই মতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, কুলাকদের সাথে চলা শ্রেণী সংগ্রাম ঘটনাক্রমে শেষ হয়ে যাবে না; বরঞ্চ তা আরও তীব্র হবে। স্তালিনের এই ধারণা সত্য প্রমানিত হলো যখন ১৯২৮ সালে কুলাকরা শহরে শস্য আসা আটকে দিল এবং সশস্ত্র শ্রমিক বাহিনীকে ২৩টি গ্রামে পাঠাতে হল শস্য উদ্ধারের জন্য। স্তালিন বললেন, কুলাকরা হলো শোষক এবং তারা তাদের শ্রেণীর অবলুপ্তিকে প্রবল ভাবে প্রতিরোধ করবে এবং শোষকের এই প্রতিরোধ অবধারিত ভাবে শ্রেণী সংগ্রামকে তীব্র করবে

দ্বন্দ্ব তত্ত্বের দিক থেকে স্তালিনের লাইন ছিল সঠিক লাইন। যতদিন শ্রেণী থাকবে, শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিরোধ থাকবেই এবং তার তীব্র হয়ে ওঠার ঝোঁকও থাকবে। যান্ত্রিক মত অর্থাৎ গুণগত পরিবর্তন বাস্তব নয়”, “সংঘর্ষ নিজের থেকেই থেমে যায়বা বিপরীতমুখী বিরোধ পরস্পরকে প্রশমিত করে” – এগুলি হলো ভুল সিদ্ধান্ত যা কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামের ক্ষতি করেছিল।

 

২০-এর দশকের সোভিয়েত রাশিয়া

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের পুনঃআবিস্কার ও বিকাশঃ

২০-এর দশকে সোভিয়েত রাশিয়ায় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ শেখা ছিল বেশ মুশকিলের। এর দুটি কারণ ছিল। এক) ভালো স্টাডি ম্যাটেরিয়ালস এর অনুপস্থিতি। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কি এবং কি উপায়ে একে কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামে ব্যবহার করা যায় এ সম্পর্কিত সঠিক বই ছিল হাতে গোনা। দুই) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর বেশীর ভাগ বই ছিল সংশোধনবাদীদের লেখা, বিশেষত মেনশেভিকদের। এই লোকগুলো তখনও তাদের পুরানো সমাজ গণতন্ত্রী রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে ছিল এবং ফলত তাদের দর্শন ছিল ভ্রান্ত। কিছু ছিল অদ্বান্দ্বিক যান্ত্রিক বস্তুবাদী যাদের সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। বাকি কিছু ছিল যারা দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রচার তো করতেন কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব তত্ত্ব ছিল অ-বিরোধের, যা কিনা লেনিনের বিপ্লবের দ্বন্দ্ব তত্ত্বের  বিপরীত।

এই দুই দুর্বলতা ছিল পরস্পরের সাথে নিবিড় ভাবে সংযুক্ত। যেহেতু বলশেভিক পার্টির দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রধান বিষয়গুলির উপর একটি সুবিকশিত পার্টি পজিশন ছিল না,  তাই তারা জনগণকেও সঠিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের শিক্ষা দিতে অপারগ ছিল।

এই অবস্থার অবসান ঘটে ১৯৩২ সাল নাগাদ, প্রায় দশ বছরের কঠিন সংগ্রামের পর।

আমরা এবার সেই লড়াইকে জানবো।  

নতুন সুত্রগুলিঃ

অদ্বান্দ্বিক যান্ত্রিকতাবাদী দর্শনের যথেষ্ট প্রভাব ছিল ভৌত বিজ্ঞানীদের উপর এবং ধর্মের (religion) বিরুদ্ধে পার্টির প্রচারের লড়াইতে এই দর্শন পার্টিও ব্যবহার করতো। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের স্বপক্ষের এই লড়াইয়ের একটি অস্ত্র ছিল পূর্বে অপ্রকাশিত মার্ক্স, এঙ্গেলস এবং লেনিনের রচনা। হেগেলের দ্বন্দ্ব তত্ত্বের মার্ক্সকর্তৃক প্রথম দিককার সমালোচনা, এঙ্গেলসের প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার উপর বই, লেনিনের হেগেলের উপর অধ্যায়নের উপর নোটস এগুলির সবগুলিই প্রকাশিত হয়েছিল ২০-এর দশকে।

এই বইগুলি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন সম্পর্কে জানাবোঝাকে পুনঃআবিস্কার করতে এবং সঠিক লাইনের লক্ষ্যে লড়াই পরিচালনা করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিল।

যান্ত্রিকতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইঃ

অদ্বান্দ্বিক যান্ত্রিকতাবাদী দর্শনের যথেষ্ট প্রভাব ছিল ভৌত বিজ্ঞানীদের উপর এবং ধর্মের (religion) বিরুদ্ধে পার্টির প্রচারের লড়াইতে এই দর্শন পার্টিও ব্যবহার করতো।

এই দর্শনের বিরুদ্ধে প্রধান লড়াই চালিয়েছিলেন প্লেখানভের অনুগামী,  প্রাক্তন মেনশেভিক আভরাম দেবোরিন এর ছাত্ররা। দেবোরিনিয়রা(The  Deborinities) যান্ত্রিকতাবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই চালিয়েছিলেন  বইপত্র, বিভিন্ন কনফারেন্স এবং অ্যাকাডেমিক জার্নালের মাধ্যমে। ১৯২৯ সালে একটি বিশাল সম্মেলনে যান্ত্রিকতাবাদকে পার্টি নেতৃত্ব পরাজিত ঘোষণা করেন এবং এই দর্শনের নিন্দা করা হয়।

দেবোরিনিয়দের সমালোচনা ছিল অত্যন্ত মুল্যবান কিন্তু তাদের  নিজেরদের দর্শনেই ছিল গুরুতর ত্রুটি। খুব শীঘ্রই দর্শনের কিছু ছাত্র, যারা পার্টির Institute of Red Professors থেকে সদ্য পাশ করে বেড়িয়েছিল, দেবোরিনিয়দের দর্শনকে আক্রমণ করতে শুরু করলেন। এদের কাজের সমর্থনে এগিয়ে এলেন স্বয়ং স্তালিন।

দেবোরিনিয়দের দর্শনকে একাধিক কারণে সমালোচনা করা হয়েছিল। সেগুলি হলো এক) তারা আঁকড়ে ছিল তাদের পুরানো সমাজ গণতন্ত্রী দর্শনকে এবং এই কাজে লেনিনের করা অগ্রগতিকে বুঝতে ব্যর্থ  হয়েছিল, দুই) তাদের দর্শন ছিল পার্টির প্রায়গিক কাজ, রাজনৈতিক লড়াই এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠন সংক্রান্ত প্রচারের সাথে সাথে সম্পর্কহীন এবং তিন) তারা তাদের কাজকে একটি বিকাশমান ধারায় এবং পার্টির নিজস্ব দর্শনের প্রতিরোধী ধারায় প্রতিষ্ঠিত করে নি। মার্ক্সের বিপরীতে গিয়ে দেবোরিনিয়রা দাবি করে যে, হেগেলের দার্শনিক  নির্মাণকে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক বলে মান্যতা দিতে হবে। তারা হেগেলের এই ধারণাকে সমর্থন করে যে, যখন কোনও বিরোধের দুটি বিরোধাত্মক দিক একটি সমাধানে আসে, তখন ওই দুটি দিক একটি উচ্চতর একতা গঠন করে যা সংঘর্ষহীন। এক্ষেত্রে মার্ক্স প্রমান করেছিলেন যে, বিরোধাত্মক দুটি দিক সমাধানে পৌঁছতে পরস্পরের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত  হয় এবং এতে করে এক পক্ষ হারে এবং আরেক পক্ষ জেতে। মার্ক্সের এই দাবি, ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হবার পর, দেবোরিনিয়রা তা পত্রপাত বাতিল করে দেয়।  

দেবোরিনিয়দের বিরুদ্ধে বিজয়ঃ

ব্যাপক বিতর্কের পর, ১৯৩১ সালে, দেবোরিনিয়দের সরিয়ে দেওয়া হয়। যে ছাত্ররা দেবোরিনিয়দের বিরুদ্ধে প্রচার ও সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল তাদেরই দায়িত্ব দেওয়া হয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উন্নততর সুত্রায়নের এবং ব্যপক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পাঠ্য বই প্রস্তুতের। দুটি পাঠ্য বই এই সময় রচিত হয় যার একটি রচনা করে মস্কো গ্রুপ এবং অপরটি করে লেনিনগ্রাদ গ্রুপ। এই বইগুলিই পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয় এবং ঘটনাক্রমে আজ আমরা সেই বইগুলির বিশ্লেষণকেই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অধ্যায়নের ক্ষেত্রে বেসিক ধরে থাকি।

এই বইগুলি চীনা ভাষাতেও অনুদিত হয় এবং চীনে এগুলির নিবিড় পাঠ শুরু হয়। এই বইগুলি মাও সেতুং-কে তার পরবর্তী দার্শনিক লেখাপত্রের ক্ষেত্রে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল।

এই বইপত্রগুলি ছিল এক বিরাট উল্লম্ফন। কিন্তু ৩০-এর দশকের সোভিয়েত দর্শনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতাও ছিল। এবারে আমরা সেগুলি আলোচনা করবো।

সমস্ত বিরোধই বৈরিতামূলক (All Contradictions are Antagonastic):

আমরা ইতিমধ্যেই দেখলাম যে, সোভিয়েত পাঠ্যবই, দ্বন্দ্ব তত্ত্বের একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছিল তার উপস্থাপনার ক্ষেত্রে। এই উপস্থাপনার ভিত্তি ছিল এঙ্গেলসের দ্বন্দ্ব তত্ত্বের তিনটি নিয়ম এবং একটি বিপরীতের তালিকা যেমন, বাস্তবতা এবং সম্ভাব্যতা (actuality and possibility), উপস্থিতি এবং নির্যাস (appearance and essence) প্রভৃতি। এই পাঠ্যবইগুলি বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়লো এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হলো। ১৯৩৭ সালে লেনিনগ্রাদ পাঠ্যবইয়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলো। জাপানে পাঠরত চীনা ছাত্ররা জাপানি এবং রুশিয় ভাষায় অনুদিত বইগুলির চীনা ভাষায় অনুবাদ করলো যা চীনে কমিউনিস্ট দর্শনের বিকাশে মূলগত ভুমিকা পালন করেছিল।

সোভিয়েতের এই দ্বন্দ্ব তত্ত্বের পাঠ্যবইগুলি বিশ্বজুড়ে দ্বন্দ্ব তত্ত্বের বিকাশ ঘটালেও এর মধ্যে কিছু মূলগত ভ্রান্তি থেকে গিয়েছিল। এই ভ্রান্তিটি ছিল এই দার্শনিক ধারণা যে, সমাজতন্ত্র, তার মজুরি ব্যবস্থার অসাম্যকে নিয়েই কমিউনিজমে পৌঁছে যায় এবং এর জন্য কোনও নতুন বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না।

এই ভ্রান্ত ধারণাকেই বলে অবৈরিতামূলক বিরোধ” (non-antagonistic contradiction)

দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রসারঃ

দ্বন্দ্ব তত্ত্বের অধ্যায়ন থেকে লেনিন এই গভীর সিদ্ধান্তে উপনীত  হয়েছিলেন যে, বিরোধের মুল রুপ কখনই একতা নয়। তিনি বললেন, “বিপরীতের একতা হলো শর্তসাপেক্ষ, অস্থায়ী, ক্ষণস্থায়ী এবং আপেক্ষিক। পারস্পরিক ভাবে স্বতন্ত্র ও বিপরীতের সংগ্রাম হল পরম, যেরকম ভাবে বিকাশ এবং গতি পরম” (The unity … of opposites is conditional, temporary, transitory, relative. The struggle of mutually exclusive opposites is absolute, just as development and motion are absolute) অর্থাৎ একটি বিরোধের মধ্যে যে সংগ্রাম চলে তা নিজের  থেকে ধ্বংস হয় না বা ফুরিয়ে যায় না; উলটে ঘটনাক্রমে তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং কমপক্ষে একটি দিকের ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে তার নিরসন(resolved) হয়।

সমাজতান্ত্রিক দ্বন্দ্ব তত্ত্ব (Socialist Dialectics):

১৯৩০ সাল নাগাদ রাশিয়ার কমিউনিস্টরা দ্বন্দ্ব তত্ত্বের একটি আলাদা দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন করলেন। তারা দার্শনিক পরিভাষা হিসাবে অবৈরিতামূলক বিরোধ” (non-antagonistic contradiction) এবং রাজনৈতিক পরিভাষা হিসাবে অবৈরিতামূলক শ্রেণী সম্পর্ক (non-antagonistic class relationship)-এর ব্যবহার শুরু করেন। এই পরিভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে দাবি করা হলো যে, সমাজতন্ত্রের পুঁজিবাদের মতন শ্রেণী শোষণ নেই। সোভিয়েত পাঠ্যবইগুলি এই ধারণাকে সমর্থন করলো যে, সমাজতন্ত্রের বিরোধ, কালে কালে, নিজের থেকেই শেষ হয়ে যাবে এবং এই বিরোধ যাতে তীব্র হয়ে বিদ্রোহে বা  বিপ্লবে পরিণত না হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ন্ত্রনযোগ্য।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের ইতিহাস দেখায় যে, এই ধারণা মূলগত ভাবে ভুল।

সোভিয়েত রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণী (শস্যের খরিদ্দার) এবং কৃষকদের (শস্য বিক্রয়কারী) যে বিরোধ বর্তমান ছিল তারই পরিণামে বার বার কৃষক প্রতিরোধ এবং কখনও কখনও গন প্রতিবাদে ফেটে পড়তো। একটি মহা মীমাংসার (grand compromise) সুত্র ধরে ৩০-এর দশকের মধ্যভাগে কৃষকদের যৌথ খামারে সংগঠিত করা হয় কিন্তু পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পশু রাখা এবং তাদের উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রয়ের অধিকার দেওয়া হয়। এই ব্যক্তিগত ব্যবসা অবিরত ভাবে যৌথ অর্থনীতির চলনের মধ্যে নাক গলাতে থাকে। কৃষক সমস্যার থেকেও  আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে একটি নব্য পুঁজিবাদী শ্রেণীর উদ্ভব। এই নব্য পুঁজিবাদী শ্রেণী গঠিত হয়েছিল পার্টি নেতৃত্ব, কারখানার ম্যানেজার এবং সামরিক অফিসারদের নিয়ে। ৩০-এর দশকে একটি ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং ব্যপক গ্রেপ্তার ও প্রাণদণ্ড লাগু করবার মধ্য দিয়ে এবং ৫০-এর দশকে স্থানীয় বিদ্রোহীদের শ্রমিক  শ্রেণীর দ্বারা প্রতিরোধের ঘটনা সংগঠিত হয়। ৬০-এর দশকে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তি পরাজিত হয় এবং তাকে প্রতিস্থাপিত করে একটি ধনী লাল বুর্জোয়া” (The Red Bourgeoisie) শ্রেণী। এই নব্য লাল বুর্জোয়া শ্রেণী”-ই ওকালতি করতে  শুরু করে সাম্রাজ্যবাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের (Peaceful coexistence) নীতিকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়।

কোনও বিরোধ-ই অবৈরিতামূলক নয় (No contradictions are non-antagonistic):

শ্রেণী সংগ্রাম হতে প্রাপ্ত প্রমাণ, যুদ্ধ, ভৌত বিজ্ঞান ইত্যাদির বিশ্লেষণ সহ কিভাবে বিরোধের (contradictions) নিষ্পত্তি হয় তার বৈজ্ঞানিক স্টাডি নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত করেঃ

এক) বিরোধের একমাত্র নিষ্পত্তি ঘটে বা নিষ্পত্তি ঘটবার দিকে এগোয় বিপরীতের সংগ্রামের তীব্রতার বৃদ্ধির দ্বারা, বিরোধাত্মক দিকগুলির  ঋণাত্মক সম্পর্কের একের অন্যের সাথে তীব্র সংগ্রামের দ্বারা এবং এই সংগ্রামের দ্বারা বিরোধাত্মক দিকগুলির একটির  ঘটনাক্রমে ধ্বংসসাধন ঘটে।

দুই) বিরোধকে আরও তীব্র করবার উপায় নির্ভর করে সেই বিরোধাত্মক ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার উপর।

তিন) সমাজতন্ত্রের বিরোধ অবৈরিতামূলক, এই ধারণা একটি ধ্বংসাত্মক মিথ্যা। এই মিথ্যা ধারণা সমাজতন্ত্রের পুঁজিবাদী চরিত্রকে নিরীহ চেহারা দিয়ে আড়াল করে রাখে যাতে করে মনে হয় যেন মজুরি ব্যবস্থা বজায় রেখেই কমিউনিজমে পৌঁছে যাওয়া যাবে।

চার)  কমিউনিস্ট দ্বন্দ্ব তত্ত্ব সিদ্ধান্ত করে যে, বিরোধ নিজের থেকে ক্ষয় প্রাপ্ত হয় না। এর একমাত্র ক্ষয় সম্ভব তীব্র থেকে তীব্রতর শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কমিউনিজমের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করবার জন্য এই ধারণা খুবই প্রয়োজনীয়।

সমাজতন্ত্রের বিরোধ (contradictions of socialism):

আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি মূলগত ভ্রান্তি নিয়ে অর্থাৎ অবৈরিতামূলক দ্বন্দ্ব নিয়ে। সোভিয়েত লেখকেরা কোনদিনই একটি স্পষ্ট ব্যখ্যায় সহমত হতে পারেন নি যে,  কি সে উপাদান যা কোনও বিরোধকে বৈরি বা অবৈরি হিসাবে গঠন করে। যদিও তারা দাবি করেছিলেন যে সমাজতান্ত্রিক (socialist) সমাজে বিরোধ তীব্র হয়ে উঠবার, সংকটে বা বিস্ফোরণে পরিণত হবার ঝোঁক দেখা যায় না বা সেই সংকটকে হিংসার দ্বারা নিষ্পত্তি সাধন করতে হয় না।

কিন্তু এই ধারণা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে বা পরবর্তী কালে চীনে যা ঘটেছিল তার বিপরীত।

অবৈরিতামূলক দ্বন্দ্ব ভুল হলেও এর একটি সঠিক দিকও ছিল। পার্টির বা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেকার বিরোধের নিষ্পত্তি যেভাবে করা হয়,  সেইভাবে কিন্তু পুঁজিবাদী এবং তাদের এজেন্ট, রাজনীতিবিদ, সেনানায়ক, পুলিশ, ইউনিয়নের নেতা প্রভৃতিদের মধ্যেকার বিরোধের নিষ্পত্তি করা হয় না। পার্টির মধ্যেকার বিরোধ এবং শ্রমিক এবং তার বস-এর মধ্যেকার বিরোধের নিষ্পত্তি শুধুমাত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই সম্ভব। সংগ্রাম বিরোধের বিকাশ ঘটায়; অর্থাৎ সংগ্রাম বিরোধের দুটি দিককে স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত ও তীক্ষ্ণ করে। পার্টির মধ্যেকার বিরোধ এবং জনগণ ও তার নেতার বিরোধের পার্থক্য হল সেই বিরোধের বিকাশ ও তীব্র হয়ে উঠবার পথ।

পার্টি সদস্যরা একটি সাধারন সত্যকে রুপ দেবার একটি সাধারন অঙ্গীকারের অংশীদার। সেই সাধারন অঙ্গীকারটি হলও কমিউনিজমে পৌঁছানোর সেরা পথটিকে নির্ধারণ করা। বলশেভিকরা এই পথটিকে বলতেন সমালোচনা এবং আত্ম-সমালোচনা” (criticism and self-criticism) এমনকি বিপ্লবের আগেই লেনিন লিখেছিলেন, খোলাখুলি ভাবে একটি ভুলকে স্বীকার করা, তার কারণ খুঁজে বের করা, যে পরিস্থিতি সেই ভুলকে পুষ্টি যুগিয়েছে তাকে বিশ্লেষণ করা এবং তাকে সংশোধনের উপায় সম্পর্কে বিস্তারে আলোচনা করা এটিই হল একটি সিরিয়াস পার্টির পরিচয়-চিহ্ন; এইটিই হলো সেই পথ যাকে অনুসরণ করে সে তার কর্তব্য পালন করবে, এইটিই হলো সেই পথ যা প্রথমে শ্রেণীকে এবং তার পরে জনগণকে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করবে।

বলশেভিক দার্শনিকরা প্রায়শই দাবি করতেন যে, সমস্ত অবৈরি দ্বন্দ্বকেসমালোচনা এবং আত্ম-সমালোচনার দ্বারা মীমাংসা করা যায়।

অবৈরিদ্বন্দ্বের বিষয়টিকে এইভাবে স্পষ্ট করা যেতে পারে, জনগণ (বা   পার্টি) যখন সঠিক লাইন খুঁজে বের করবার জন্য নিবেদিত হয়ে লড়াই করে, প্রাথমিক ভাবে তাদের বিরোধ থাকে ধারণায় (idea) এই বিরোধ কিন্তু নিরসনের সাথে সাথে তীব্র হয়ে ওঠে কারণ এতে একটা সংখ্যাগুরু অংশ বিজিত হয় এবং একটা সংখ্যালঘু অংশ পরাজিত হয়। ভ্রান্তি পরাজিত হয় কিন্তু যে মানুষগুলো ভ্রান্তির পক্ষে ছিল তারা হয় না। এই পদ্ধতি তখনই সফল হয় যখন সকল সদস্য আন্তরিক ভাবে তাদের ভুল মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, এতদকালীন সেরা নেতৃত্বও, এ কাজে খুব একটা  সফল হন নি।

সমাজতন্ত্রে আয় এবং সুবিধার নিরিখে একটি সুবিধাভোগী ক্রম (hierarchy) গড়ে উঠেছিল। যাদের এই সুবিধা ছিল তারা তাকে বজায় রাখতে ও আরও বাড়াতে চাইতেন। শুরুর দিন থেকে পার্টি ও রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থরা জনগণের থেকে উচ্চতর জীবনের মান ভোগ করতেন। এদের মধ্যে অনেকেই যৌথ খামার গড়ে তোলা এবং ভারি শিল্প গড়ে তোলার তীব্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে তাদের অবস্থানকে বিপদে ফেলতে চাইতেন না।  

অবৈরিদ্বন্দ্বকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করা হোক না কেন, সোভিয়েত বাস্তবতায় দেখা গেছে যে সেটি ছিল অবাস্তব।

স্তালিনের দ্বন্দ্ব তত্ত্বঃ

স্তালিন বুঝেছিলেন যে, শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে শ্রেণী সংগ্রাম শেষ হয়ে যায় না; বরঞ্চ যতদিন পুঁজিবাদকে সম্পূর্ণ রুপে মুছে দেওয়া না যায়, ততদিন তা আরও তীব্র হতে থাকে। ১৯০৬ সাল নাগাদ স্তালিন নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে, যতদিন না পুঁজিবাদীদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যাচ্ছে, তাদের সমস্ত সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্ত করা যাচ্ছে, ততদিন শ্রমিক শ্রেণীর প্রয়োজন একটি প্রোলেতারিয় বাহিনীর, একটি সামরিক শক্তির যারা মরণশীল বুর্জোয়াদের প্রতিবিপ্লবী আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারে।

অক্টোবর বিপ্লবের পর, স্তালিন কুলাকদের পরাজিত করবার জন্য এই ধারণার প্রয়োগ করেন।

স্তালিন বলেছিলেন, যত আমাদের অগ্রগতি হবে ততই বাড়বে পুঁজিবাদী উপাদানের প্রতিরোধ এবং ততই তীব্র হবে শ্রেণী সংগ্রাম...... এরকম কখনই ঘটবে না যে মরণশীল শ্রেণী নিজের থেকে প্রতিরোধ ছেড়ে আত্মসমর্পণ করবে।

সোভিয়েত ইউনিয়েনের দর্শনের ক্ষেত্রে স্তালিনের প্রভাব শুধুমাত্র লেখাপত্র বা বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নবীন কমরেডদের দেবোরিনিয়দের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করবার জন্য উৎসাহিত করেন।

কিন্তু পাশাপাশি স্তালিন অবৈরি বিরোধের ভুল ধারণারও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ১৯৩৮ সালে সোভিয়েত পার্টি তাদের নিজের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রকাশ করে। সেই ইতিহাসের একটি অংশ স্তালিন লেখেন যা কিনা পরবর্তীতে প্যামফ্লেট আকারে প্রকাশিত হয় দ্বান্দ্বিক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ” (Dialectical and Historical Materialism) এই শিরোনামে। সোভিয়েত প্রেস এই প্যামফ্লেটটিকে একটি ভয়ঙ্কর অগ্রগতি হিসাবে ঘোষণা করে।

কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল একটি ভয়ঙ্কর পশ্চাৎ অপসরণ।

এই প্যামফ্লেট এঙ্গেলসের নেতিকরণ এর নেতিকরণ”-কে (negation of negation) বর্জন করেছিল। এই সুত্র বলে যে, ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্ত না করলেও তার আংশিক বিপর্যয় সম্ভব। স্তালিন ভেবেছিলেন যে, সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ যত অব্দি পৌঁছায় তত অব্দি সে অপরিবর্তনীয় (irreversible) স্তালিন, এঙ্গেলসের এই দ্বন্দ্ব তত্ত্বের নিয়মটিকে কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই বাদ দেন।

চীনে কমিউনিস্ট দ্বন্দ্ব তত্ত্বের বিকাশঃ

১৯২১ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার থেকে তিন দশক পর্যন্ত সেখানে কমিউনিস্ট দর্শনের প্রধান উৎস ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। রুশীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সম্পর্কে চীন জানতে পারে সেইসব গুটিকয়েক   চীনা বামপন্থীদের কাছ থেকে যারা, রুশী ভাষা জানতেন। কিন্তু  বৃহত্তর সুত্র ছিল জাপানি কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রকাশিত সোভিয়েত ম্যাটেরিয়ালস। বহু দশক ধরে জাপানে পাঠরত চীনা ছাত্রদের দ্বারা  জাপানি ভাষা হতে অনুদিত লেখাপত্র ছিল চীনে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী  তত্ত্বের প্রধান উৎস।

এরকমই একজন প্রথম দিককার কমিউনিস্ট দর্শনের লেখকের নাম ছিল ছু ছুইপাই (Qu Quibai) ছু রাশিয়াতে পড়াশুনা করেছিলেন   এবং  সেখানেই একজন সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতে করতে একজন কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন। ১৯২৩ সালে তিনি নতুন প্রতিষ্ঠিত সাংহাই  বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্ক্সীয় দর্শন পড়াতে এলেন এবং সিপিসি-র কেন্দ্রীয়  কমিটির সদস্য নির্বাচিত হলেন। ১৯২৪ সালের শুরুতে ছু বেশ কিছু  প্রভাবশালী বই প্রকাশ করলেন যেগুলি কমিউনিস্ট দর্শনের মুল ধারণাকে ব্যখ্যা করলো। কমিউনিস্ট তত্ত্বে ছু-এর অন্যতম আগ্রহ ছিল  কমিউনিস্ট বিজয়ের অবশ্যম্ভাবিতার মধ্যে সচেতন রাজনৈতিক কার্যক্রম (Role of conscious political action within the framework of the inevitability of the victory of communism) প্রাথমিকভাবে সোভিয়েত দর্শন সম্পর্কে ছু-এর জ্ঞান, সাহায্যের থেকে বেশী ছিল   প্রতিবন্ধকতা কারণ তিনি সমস্ত পরিবর্তন বহিঃস্থ কারণে ঘটে, এই অদ্বান্দ্বিক যান্ত্রিক দৃষ্টিকোণকে ব্যবহার করতে চাইতেন। ১৯৩০ সালের প্রথমদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে এই ভুল দৃষ্টিকোণ পরাজিত হয় এবং এই সংক্রান্ত বহু পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়। চীনে এই উন্নততর সোভিয়েত দর্শনকে প্রায়শই নতুন দর্শনবলা হতো। ছু এই নতুন দর্শন”-কে গ্রহণ করেন এবং নিজেকে এই ধারণার দ্বারা সংশোধিত করেন যে, বহিঃস্থ নয়, অভ্যন্তরীণ বিরোধই বিকাশের মুল কারণ। ১৯৩৫ সালে জাতীয়তাবাদী কুয়োমিংতানিদের দ্বারা তিনি হত হন (executed)

চীনে নতুন দর্শন”-এর ক্ষেত্রে আরেকজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হলে লী তা (Li Da) ইনি বেশ কিছু রুশীয়, জাপানি এবং জার্মান মার্ক্সবাদীর  লেখা  মার্ক্সীয় দর্শনের বই, জাপানি ভাষা থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করেন।  লী ছিলেন সিপিসি-র একজন প্রথমদিককার সদস্য কিন্তু তিনি ১৯২৩ সালে পার্টি থেকে সরে যান। লী আবার পার্টিতে ফেরেন ১৯৪৯ সালে। কিন্তু তবু লী-এর নিজস্ব এবং অনুবাদিক লেখাপত্রের একটি বিশাল প্রভাব ছিল। লী-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত সমাজবিদ্যার উপাদানগুলি” (Elements of Sociology) এই বইতে মার্ক্সীয় দর্শনের উপর একটি বেশ বড় অধ্যায় রয়েছে। এই বইটি যে যে বিষয়গুলির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিল সেগুলি  হলো, দ্বন্দ্ব তত্ত্ব এবং বস্তুবাদ, পরিবর্তনের চালিকা শক্তি হলো দ্বান্দ্বিক  বিরোধ, গুণগত বনাম পরিমাণগত পরিবর্তন, জ্ঞান একটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি যার শুরু হয় মনুষ্য অনুশীলন থেকে এবং যা আবার মানুষে ফেরত যায় তার পথপ্রদর্শক হিসাবে। তাত্ত্বিক ভাবে কঠোর হলেও লী-র চর্চার লক্ষ্য বৃহত্তর জনগণ ছিল না যা, কমিউনিস্ট  আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।

এই কাজটি অর্থাৎ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে জনপ্রিয় করা এবং তাকে রক্ষা করার কাজটিকে মুল উদ্দেশ্য হিসাবে নিলেন এআই সাচি (Ai Siqi) এআই, লী এবং ছু-র চেয়ে অনেকটাই বয়সে নবীন ছিলেন।   এআই-এর লেখাপড়া সম্পন্ন হয় জাপানে যেখানে তিনি মার্কসবাদ ও রুশীয় ভাষা শেখেন। তিনি একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন এবং  নতুন দর্শন”-কে ব্যাখ্যা করেন এছাড়া তিনি কমিউনিস্ট দর্শনের উপর বহু প্রভাবশালী বই লেখেন। এআই-এর অন্যতম প্রভাবশালী দুটি বই হল, ১৯৩৬ সালে রচিত জনগণের দর্শন (Philosophy for the Masses) এবং ১৯৩৭ সালে রচিত দর্শন এবং জীবন (Philosophy and Life)

এআই সাচি (Ai Siqi):

জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে এআই, কমিউনিস্ট দর্শনকে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি চীনে প্রবল জনপ্রিয় চার্লি চ্যাপলিনের ফিল্মকে ব্যবহার করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বিভিন্ন ধারণাকে ব্যাখ্যা করতেন। এআই প্রাথমিক ধারণার  (perception) তত্ত্বকে এইভাবে তার একটি ম্যাগাজিনে ব্যাখ্যা করলেনঃ জ্ঞানের প্রথম স্তর হচ্ছে প্রাথমিক ধারণা যেটা আমরা পাই দেখা (seeing), অনুভব করা (feeling) এবং ঘ্রাণের (smelling) মাধ্যমে। প্রাথমিক ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাকে যুক্তিযুক্ত ধারণায় (reasoning) বিকশিত (expanded) ও শোধিত (corrected) করতে হয়। চার্লি চ্যাপলিনের এবং হিটলারের গোঁফ তাদেরকে বাহ্যিক ভাবে একই রকম দেখায়; কিন্তু আরও সতর্ক পর্যবেক্ষণ তাদের মধ্যেকার পার্থক্যকে প্রতিভাত করে। যুক্তিযুক্ত জ্ঞান এবং তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রয়োজন হয়, প্রাথমিক জ্ঞানে প্রতিভাত বাহ্যিক সমতার বা বিরূপতার ধারণাকে  বুঝতে।

এখানে উল্লেখিত দার্শনিকদের অবদানকে স্বীকার করেও একথা বলতে হবে যে, চীনে সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিকের নাম হলো মাও সেতুং। মাও নতুন দর্শনকে গ্রহণ করেছিলেন এবং স্বীকার করেছিলেন যে উপরে উল্লেখিত দার্শনিকদের থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। ১৯৩৬-৩৭ সালে, ইয়ানানের মুক্তাঞ্চলে, গভীর যৌথ অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে মাও, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের একটি সারৎসার প্রস্তুত করেন। এই সারৎসার থেকেই বেড়িয়ে আসে মাও-এর দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা, “অন প্র্যাকটিসএবং অন কন্ট্রাডিকশন। এবারে আমরা এই দুটি রচনা নিয়ে আলোচনা করবো।

মাও-র অন প্র্যাকটিস”:

১৯৩৬-৩৭ সালে মাও এবং তার নেতৃত্বে পরিচালিত একটি স্টাডি গ্রুপ সোভিয়েত পাঠ্য পুস্তকগুলিকে এবং চীনা কমিউনিস্ট দার্শনিকদের কাজগুলিকে অত্যন্ত গভীর ভাবে অধ্যায়ন করেন। এরই ফলশ্রুতিতে প্রস্তুত হয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর বক্তব্যের নোটস”-এর খসড়া   (Lecture Notes on Dialectical Materialism) এখানে যে বক্তব্য বেড়িয়ে এলো তা সোভিয়েত পাঠ্য পুস্তকগুলির বক্তব্যই কিন্তু, এতে  যেটা যুক্ত হলো তা হলো, চীনা বাস্তবতার বা পরিস্থিতির উপর বিশেষ  গুরুত্ব আরোপণ। এই কাজের থেকে দুটি রচনা ব্যপক ভাবে প্রচার করা হলো। এর একটি হলো অন প্র্যাকটিসএবং অপরটি হলো অন কন্ট্রাডিকশন। এখানে আমরা প্রথমে অন প্র্যাকটিস”-এর উপর আলোচনা করবো কিন্তু মুল লেখাটি সকলেরই আলাদা করে পড়ে নেওয়া উচিত।

মাও লিখলেন, সামাজিক অনুশীলনই হলো একমাত্র সকল জ্ঞানের উৎস এবং সত্যের মানদণ্ড। সামাজিক অনুশীলন বলতে বহুরকমের কার্যক্রম বোঝায়; এদের মধ্যে প্রধান তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হলো, এক) সামাজিক উৎপাদন, দুই) শ্রেণী সংগ্রাম এবং তিন) বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এগুলির মধ্যে আবার মূলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সামাজিক উৎপাদন। সামাজিক উৎপাদনের সময় মানুষ,  তার সাথে প্রকৃতির সম্পর্ককে বিভিন্ন প্রকার মাত্রায় ও প্রকারে বুঝতে শেখে; সে   বুঝতে শেখে মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ককে। মাও বললেন, উৎপাদন হল সেই প্রাথমিক উৎস যার থেকে মানুষের জ্ঞান বিকশিত হয়। বিশাল মাত্রায় উৎপাদন এবং শ্রমিক শ্রেণীর উত্থান, মানব সমাজের ব্যাপক এবং বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়াকে সম্ভব করেছে। আর এই বোঝাপড়াই হলো মার্কসবাদ। মাও লিখলেন, একমাত্র মানুষের সামাজিক অনুশীলনই হল বিশ্বের জ্ঞান তথা সত্যের একক স্রস্টা। এর অর্থ হলো, আমরা যখন কোন কিছুকে সত্য ধরে কোন কাজের পরিকল্পনা করি তখন, সেই  কাজের প্রায়গিক অভিজ্ঞতা আমাদের দেখিয়ে দেয় যে আমাদের ধারণা সঠিক, নাকি ভ্রান্ত। সফলতা প্রমান করে যে, আমাদের ধারণা সত্য বা সত্যের কাছাকাছি। অপরদিকে ব্যর্থতা আমাদের দেখিয়ে দেয় যে আমাদের ধারণাকে আবার বিচার করা উচিত এবং তাকে আবার প্রয়োগে এনে পরীক্ষা করা উচিত।

মাও জ্ঞানকে দুটি স্তরে ভাগ করলেন:

প্রথম স্তর হলো প্রপঞ্চ (phenomena) সম্পর্কে তথ্য। প্রপঞ্চ হলো সেই সবকিছু যাকে আমরা হৃদয়ঙ্গম (perceived) করতে পারি আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বা যাকে সহজে আলাদা করে চেনা যায় (recognized) বা ভাসা ভাসা তথ্য যাতে বস্তুর মধ্যেকার লুকানো সম্পর্ক সম্পর্কে কিছু বলে না। যেমন ধরুন কোন মানুষ যদি প্রথমবার কোলকাতায় বেড়াতে আসে তাহলে তার কোলকাতা সম্পর্কে প্রাথমিক যে জ্ঞান অর্জিত হবে তাই হলো প্রপঞ্চ বা জ্ঞানের প্রথম স্তর।

জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর হলো ধারণার গঠন যাকে প্রপঞ্চের উপর প্রয়োগ করা যায় এবং তাকে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন, কোলকাতায় প্রথম আসা সেই ব্যক্তি যদি , কোলকাতায় তার দেখা বস্তি কেন গড়ে উঠেছে তা খুঁজতে ও বুঝতে শুরু করে তাহলে তার জ্ঞান এই দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করবে।

জ্ঞানের প্রথম স্তর থেকে দ্বিতীয় স্তরে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন, প্রাথমিক জ্ঞানগুলিকে (perceptual knowledge) সাজানো ও পুনর্গঠিত করা (arranging and reconstructing) প্রপঞ্চ (phenomena) হতে ধারণা (concepts), গুণগত ভাবে আলাদা। ধারণা আমাদের প্রপঞ্চের  প্রকৃত প্রকৃতি এবং তাদের অন্তর সংযোগকে দেখিয়ে দেয় এবং প্রপঞ্চ থেকে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত বের করতে শেখায়।  

এই সিদ্ধান্তই হলো জ্ঞানের তত্ত্ব যাকে মাও বলেছেন যুক্তিযুক্ত” (logical) বা র‍্যাশানাল জ্ঞান। লেনিনকে উদ্ধৃত করে মাও বললেন, বস্তু (matter), “প্রকৃতির নিয়মাবলী” (laws of nature) এবং মুল্য” (value) হলো এই সিদ্ধান্তের উদাহরণ। জ্ঞানের প্রথম স্তর হলো দ্বিতীয় স্তরের ভিত্তি। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বস্তুগত বহির্জগৎ সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান থেকেই সমস্ত প্রকার জ্ঞান জন্মায়। প্রাথমিক জ্ঞান হোক বা তাত্ত্বিক জ্ঞান, তাকে অবশ্যই প্রয়োগের পথপ্রদর্শক হতে হবে যাতে করে প্রয়োগে ভুল ধরা পড়লে তাকে সংশোধিত করা যায়।

মাও ব্যক্তির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং পরোক্ষ অভিজ্ঞতাকে (অন্যের অভিজ্ঞতা হতে প্রাপ্ত জ্ঞান) আলাদা ভাবে চিহ্নিত করলেন। যদিও মাও বললেন যে, আমাদের বেশীর ভাগ জ্ঞান আসে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে, কিন্তু বিশেষ জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ। মাও বললেন, যদি তুমি পরমাণুর গঠন এবং ধর্ম (properties) জানতে চাও তাহলে তোমাকে ভৌত বা রাসায়নিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরমাণুর  অবস্থাকে বদলাতে হবে। যদি তুমি বিপ্লবের তত্ত্ব এবং প্রক্রিয়াকে জানতে চাও, তাহলে তোমাকে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে হবে।

মাও, কমিউনিস্ট আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখা, জ্ঞানতত্ত্বের বিভিন্ন ভুল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করেন। এই ভুল দৃষ্টিভঙ্গিগুলির একটি হল, জ্ঞান, বিকাশের পর্যায়এ, প্রাথমিক জ্ঞানেই আটকে যেতে পারে  এবং র‍্যাশানাল জ্ঞান বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই তত্ত্বের নাম হলো অভিজ্ঞতাবাদ” (empiricism) অভিজ্ঞতাবাদ এটি বুঝতে ব্যর্থ যে, প্রাথমিক জ্ঞান একটি ভাসা ভাসা, একপেশে জ্ঞান এবং এই জ্ঞান ঘটনার বা বস্তুর নির্যাস, তাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ম যা তাকে নিয়ন্ত্রন করছে এবং সম্পূর্ণতায় প্রকাশ করছে, তা বুঝতে অপারগ। আরেকটি মারাত্মক ভ্রান্তি হলো যুক্তিবাদ” (rationalism) যা তত্ত্বকে প্রাথমিক জ্ঞান হতে নিরপেক্ষ (independent) হিসাবে দেখে। র‍্যাশানাল জ্ঞান সর্বদাই প্রাথমিক জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল এবং তাকে প্রয়োগের ব্যর্থতা বা আংশিক সাফল্যের দ্বারা সংশোধিত করতে হয়।

অতএব জ্ঞানের অভ্যন্তরীণ বিরোধ জ্ঞানের বিকাশের প্রক্রিয়াকে চালিত করে। স্পষ্ট করে বললে, কমিউনিস্ট রাজনীতি, অর্থনীতি এবং দর্শনের র‍্যাশানাল জ্ঞান আমাদের কমিউনিজমের জন্য সংগ্রামে পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে। 

মাও-এর অন কন্ট্রাডিকশন”:

সম্ভবত বর্তমান পৃথিবীতে যত মানুষ জীবিত আছেন যারা, দ্বন্দ্ব তত্ত্বের  উপর বইপত্র পড়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মানুষ বোধহয় মাও-এর অন কন্ট্রাডিকশনপড়েছেন। নতুন দর্শনকে ব্যখ্যা করে লেখা কাজকর্মের সাথে, যা গড়ে উঠেছিল ৩০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে, মাও-এর এই কাজকে তুলনা করে বলা যায় যে, এর বেশীর ভাগই সঠিক। পাশাপাশি এই কাজ পত্তন করলো ১৯৩৫ সালের আন্তর্জাতিকের গৃহীত ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক লাইন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টেরচীনা কমিউনিস্ট পার্টির তর্জমা।

যেহেতু ভুল দর্শন ভুল রাজনৈতিক লাইনের জন্ম দেয়, তাই এই রচনার থেকে ভুল আর সঠিককে আলাদা করতে হবে। কারণ তাহলেই আমরা চিহ্নিত করতে পারবো মিথ্যা এবং প্রতিক্রিয়াশীল কে।

দুই বিশ্বের দর্শন (Two World Outlooks):

অন কন্ট্রাডিকশন শুরু হয় অধিবিদ্যক চিন্তা (Metaphysics) এবং দ্বান্দ্বিক (Dialectics) চিন্তার পার্থক্য করবার মধ্য দিয়ে। এই দুটি চিন্তাধারা হলো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে দেখবার দৃষ্টিকোণ এবং তার পরিবর্তনের পদ্ধতির ব্যাখ্যা।

অধিবিদ্যক চিন্তন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে দেখে একটি বিচ্ছিন্ন (isolated), অপরিবর্তনীয় (unchanging) বস্তুসমষ্টি হিসাবে। এই চিন্তাধারা জগতকে স্থির, নিশ্চল, অপরিবর্তনীয় বা কোন কিছুর পরিমাণের হ্রাস-বৃদ্ধি জনিত পরিবর্তন হিসাবে দেখে। অধিবিদ্যক চিন্তন দাবি করে যে, পুঁজিবাদী শোষণ এবং প্রতিযোগিতা সমস্ত প্রকার মানব সমাজেই উপস্থিত ছিল; এমনকি আদিম শ্রেণীহীন সমাজেও। এটি পরিবর্তনের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে বহিঃস্থ শক্তি যেমন, ভূগোল, আবহাওয়া প্রভৃতিকে।

মাও-এর এই লেখা বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক দর্শনকে ব্যখ্যা করে, যা বলে  যে, বস্তুর প্রকৃত পরিবর্তন ঘটে গুণে এবং এই পরিবর্তন এমন বস্তু  উৎপন্ন করে যা আগে ছিল না। এই পরিবর্তন প্রাথমিক ভাবে বহিঃস্থ শক্তির নয়, অভ্যন্তরীণ বিরোধের পরিণতি; বস্তুর এবং প্রক্রিয়ার আভ্যন্তরীণ বিরোধাত্মক প্রবণতার পরিণতি। মহান সমাজ পরিবর্তন  প্রধানত ভূগোল বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে হয় না; হয় আভ্যন্তরীণ সামাজিক শক্তির কারণে। মাও যখন এই লেখা লিখছেন তখন চীনে বিশাল পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে চলেছে কিন্তু তার জন্য আবহাওয়া দায়ী ছিল না; দায়ী ছিল আভ্যন্তরীণ উপাদান যথা শ্রেণী  সংগ্রাম। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে বহিঃস্থ উপাদানের প্রভাবেরও প্রয়োজন থাকে কিন্তু তা কখনই প্রাথমিক কারণ নয় পরিবর্তনের। প্রকৃতির মধ্যে যে পরিবর্তন সংঘটিত হয় তাও মুখ্যত হয় আভ্যন্তরীণ কারণের ফলে। মাও, এর একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝালেন।  মুরগির একটি নিষিক্ত ডিম কে উপযুক্ত তাপমাত্রায় (বহিঃস্থ শক্তি) রাখলে ডিম ফেটে একটি মুরগির ছানা বের হয়ে আসতে পারে। কিন্তু কোনও তাপমাত্রাই একটি পাথর থেকে একটি মুরগির ছানা বের করতে পারবে না। তাপমাত্রা মুরগির বাচ্চার বিকাশের জন্য জরুরি কিন্তু ডিমের ভিতরের উপাদানই মুল নির্ধারক যে সেটি থেকে মুরগির বাচ্ছা বের হবে, কি হবে না। মাও এই আভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণকে যুদ্ধের উপর প্রয়োগ করলেন। তিনি বললেন, যুদ্ধে একটি সেনাদল বিজয়ী হয় এবং অন্যদল পরাজিত হয় এবং বিজয় ও পরাজয় উভয়ই আভ্যন্তরীণ কারণের দ্বারা নির্ধারিত হয়। বিজয়ী অংশের থাকে ক্ষমতা এবং ভালো নেতৃত্ব। অপরদিকে পরাজিত অংশের থাকে দুর্বলতা এবং অযোগ্য নেতৃত্ব। এখানে খেয়াল করতে হবে যে, মাও এখানে বলছেন না যে শুধু শক্তিশালী দিকই জেতে। একটি দুর্বল বাহিনী যার নেতৃত্ব তাদের দুর্বলতাকে বোঝে সে পরাজিত নাও হতে পারে। তারা যুদ্ধে পিছিয়ে আসতে পারে বা মারো এবং পালাওকৌশল নিতে পারে। মাও একইভাবে দেখিয়েছেন ১৯২৭ সালে চীনা পুঁজিবাদী শক্তির কাছে কমিউনিস্ট শক্তির পরাজয়ের কারণ ছিল রাজনৈতিক ভ্রান্তি (সুবিধাবাদ)। মাও উপসংহার টেনেছেন, বিপ্লবকে বিজয় অব্দি পৌঁছাতে গেলে পার্টিকে নির্ভর করতে হবে তারা রাজনৈতিক লাইনের সঠিকতার উপর এবং সংগঠনের মজবুতির উপর।

বিরোধের সার্বজনীনতা (The Universality of Contradiction):

মাও লিখেছেন যে, বিরোধ (contradiction) দুইভাবে সর্বজনীন। এক)   প্রকৃতি, সমাজ সবকিছুর মধ্যে বিরোধ বর্তমান এবং এই বিরোধই বিকাশ এবং পরিবর্তনকে নির্ধারণ করে। দুই) বিরোধের বিপরীত দিকগুলি, বিরোধাত্মক প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে।

বিরোধের বিশেষত্ব (The Particularity of Contradiction):

বিভিন্ন গতির বস্তুর বিরোধ গুণগত ভাবে আলাদা। একটি চলমান গাড়ির বিরোধ, মুদ্রা সঞ্চালনের বিরোধ বা জ্ঞানের বিকাশের বিরোধ প্রতিটি বিশেষ ভাবে আলাদা এবং প্রতিটির নিজস্ব বিশিষ্টতা বর্তমান। মাও লিখলেন, বিভিন্ন বিরোধের নিষ্পত্তি করতে হবে বিভিন্ন ভাবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বললেন, শ্রমিক মালিক বিরোধের নিষ্পত্তি করতে হবে বিপ্লবের মাধ্যমে এবং পার্টির অভ্যন্তরীণ বিরোধের নিষ্পত্তি করতে হবে সমালোচনা এবং আত্ম- সমালোচনার মাধ্যমে।

মাও সঠিক ভাবেই বলেছেন যে, বিভিন্ন প্রকার বিরোধের বিভিন্ন প্রকার নিষ্পত্তি প্রয়োজন। কিন্তু তিনি যেটা বলেন নি সেটা হল, এই বিভিন্ন প্রকার বিরোধের বিভিন্ন প্রকার নিস্পত্তির মধ্যেকার সাধারণ  সিদ্ধান্তটি (resolution) কি।

সেই সাধারণ সিদ্ধান্তটি হলো, বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে তার আরও তীব্র হয়ে উঠবার মধ্য দিয়ে, বিরোধের দুটি দিকে একে অন্যের মধ্যে আরও বেশী বেশী করে নাক গলাবার মধ্য দিয়ে। একটি বিরোধ ধীরে ধীরে,   নিজের থেকে খতম হয়ে যায় না। পুঁজিবাদীরা নিজের থেকে আত্মসমর্পণ করে শ্রমিক হয়ে যায় না; কমিউনিস্ট আন্দোলন যত শক্তিশালী হতে থাকে তারা ততই কঠিন সংগ্রাম করতে থাকে। একইভাবে পার্টির ভিতরের বিরোধও নিজের থেকে উবে যায় না। এই বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে তীব্র আলোচনা এবং তার দ্বারা অধিকাংশকে জয় করে নেবার মধ্য দিয়ে।

মাও ব্যাখ্যা করেন নি যে, নিস্পত্তির জন্য প্রয়োজন তীব্রতা কারণ,  তিনি তা বিশ্বাস করতেন না। তিনি ভেবেছিলেন নিস্পত্তির জন্য সংগ্রামের প্রয়োজন কিন্তু তা একটি নির্দিষ্ট শর্তের অধিন, আর তা হলো অবৈরিতামূলক। 

উপসংহার: 

কমিউনিস্ট দ্বন্দ্বতত্ত্ব একটি বিজ্ঞান; এবং এটি বিকশিত হয়ে চলেছে বিজ্ঞানের চলনকে মেনে। বিজ্ঞানের অপরাপর সকল শাখার মতনই, সে তার ভ্রান্তিকে অতিক্রম করেছে এবং করে চলেছে। অতীতের দার্শনিক প্রাপ্তি, তার সংশোধন ও প্রয়োজনীয় বিকাশ – এগুলিকে আত্মস্থ করা বিপ্লবের অতি আবশ্যিক শর্ত। এ প্রয়াসকে তাই চলমান রাখা সকল মার্ক্সবাদীর বৈপ্লবিক কর্তব্য। কমিউনিস্ট দ্বন্দ্বতত্ত্বের ইতিহাস জানার সার্থকতা ও প্রয়োজনীয়তাও এখানেই।

 

<চারুদত্ত নীহারিকা রজত দ্বারা সংগৃহীত, ঈষৎ সংক্ষেপিত এবং অনুদিত> 

 

### কমিউনিস্ট দ্বন্দ্বতত্ত্বের ইতিহাস সমাপ্ত ###

 

 

 

 

 

 

 

 

 

        

 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম - অনুবাদে রুমা নিয়োগী(প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)

রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>