রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>
আমার এক বিশিষ্ট বন্ধু তথা কমরেড ডঃ রাম কবীন্দ্র, রুশ-বিপ্লবের
শতবার্ষিকী উপলক্ষে হিন্দিতে তিনটি বই প্রকাশ করেছিলেন। বইগুলির নাম যথাক্রমে ১) রুশী
ক্রান্তিকা বিকাশ মার্গ, ২) সর্বহারা অধিনায়কত্বকা সফল প্রয়োগ এবং ৩) সোভিয়েত সঙ্ঘমে
সমাজবাদ কে পরাভব সে সমাজিক সাম্রাজ্যবাদকে বিনাশ তক। তিনটি বই-ই এত তথ্য বহুল এবং
মার্কসীয় বিশ্লেষণ-সমৃদ্ধ যে, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বিজয় থেকে বিলুপ্তি পর্যন্ত সমগ্র
বিষয়টি অনুধাবন করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যায়।
আমি নিজে এই বইগুলি পড়ে এতটাই প্রভাবিত হয় পড়ি যে, ছ'মাসের নিরলস প্রচেষ্টায় আমি তিনটি বই-ই রাংলায় অনুবাদ করে ফেলি এবং জুলাই ২০১৭ থেকে ফেসবুকে, আমার টাইমলাইনে এবং অন্য একটি গ্রুপে ধারাবাহিক ভাবে পোস্ট করেছি।
পাঠকদের বন্ধুত্বপূর্ণ মতামত, সমালোচনা সবকিছুই স্বাগত।
রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ
রুশ বিপ্লবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
"আমার মন অত্যন্ত ভরাক্রান্ত হয়ে ওঠে এইসব দেখে ও অনুভব করে যে, জারশাহী'র জল্লাদেরা, কুলীন ও পুঁজিপতিরা, আমাদের গৌরবময় দেশের ওপর কত অত্যাচারই না করে চলেছে, দেশটাকে কতই না পিষে চলেছে তার দমন-চক্রে, কত না অপমান করে চলেছে তার। একই সাথে আমার গর্ব অনুভব হয় এই ভেবে যে, এইসব বাড়াবাড়ি, আমাদের রুশীয়দের মধ্যে এমন এক তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে যে, এর মধ্যে থেকে উঠে এসেছেন রদিশ্চেভ, ডিসেম্বরবাদী ও অষ্টম শতাব্দীর রাজনোচিনৎসীর মত বিপ্লবীরা, ১৯০৫-এ স্থাপনা হয়েছে রুশী শ্রমিক শ্রেণী ও জনগনের এক শক্তিশালী বিপ্লবী পার্টির, আর এই সময়ই রুশী-কিষান হয়ে উঠেছেন গনতান্ত্রিক এবং উল্টে ফেলে দিচ্ছেন পাদ্রী তথা জমিদারদের রাজত্ব"। - লেনিন -
রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালীন সময়ে সর্বহারার
নেতৃত্বে রাষ্ট্রশক্তি স্থাপনার এক অভূতপূর্ব ও আশ্চর্য নিদর্শন। এর দ্বারা সর্বহারা
রাজত্ব কায়েম হওয়ার মার্কস-এঙ্গেলসের বিশ্লেষণের সত্যতা তো প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু
ওনাদের পূর্ববর্তী সূত্র, যে সমাজতন্ত্রিক বিপ্লব সর্বপ্রথম উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই
সম্পন্ন হবে এবং তা সংঘটিত হবে কয়েকটি দেশে একসাথে, তা খন্ডিত হয়েছে। একই সাথে লেনিনের
দুটি মূল্যায়ন সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে সাম্রাজ্যবাদী
শৃঙ্খলের সবচেয়ে দূর্বল অংশটিই (Weekest link of the Imperialist chain) সর্বপ্রথম
খন্ডিত হবে তথা সমাজতন্ত্র একটি মাত্র দেশেও জয়লাভ করতে পারে এবং তা টিকেও থাকতে পারে।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই পরিবর্তন মার্কসবাদী মূল তত্ত্বের খন্ডন বলে মনে হলেও অন্তর্বস্তুগত
দিক থেকে এটি ছিল তার বিকাশ। এরপরই মার্কসবাদে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়ে এই সিদ্ধান্ত
'মার্কসবাদ- লেনিনবাদ' নামে পরিচিত হয়েছে।
আজ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন প্রচারের চেষ্টাও চোখে পড়ে যে, এই
বিপ্লব ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া এক চমকপ্রদ ঘটনা ছিল, রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব সমাজতন্ত্রিক
বিপ্লবই ছিলনা, বরং তা ছিল সমাজতন্ত্রের দিকে পদক্ষেপ করার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের
স্থাপনা, আর লেনিন, মার্কসবাদের দীশা ভিন্ন পথে চালিত করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অসত্য
প্রচার ভবিষ্যৎ বিপ্লবের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক। অথচ, প্রকৃতপক্ষে বিপ্লব, না নিয়তি
দ্বারা পরিচালিত হয় আর না কি সেটি ঘটনাচক্রে সংঘটিত হয়। প্রতিটি বিপ্লবের মূলে থাকে
তার ঐতিহাসিক ও মতাদর্শগত ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট। থাকে সেই মতাদর্শের প্রভাবে সংগঠিত
শ্রেণীশক্তি। সংগঠনের থাকে রাজনৈতিক কর্মসূচি আর সশস্ত্র শক্তির পাশাপাশি থাকে বিশাল
এক জন সমর্থন।
অপরদিকে শাসক শ্রেণীর গণভিত্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, রাষ্ট্র
পরিচালন ব্যবস্থা উপর থেকে নিচ অবধি ভরে ওঠে পচনশীলতায়, স্বয়ং শাসক শ্রেণীর মধ্যেকার
ঐক্যে দেখা দেয় ফাটল আর বিচ্ছিন্ন হতে থাকে জনগনের উপর দমন-পীড়নের মেশিনারী।
এই সকল উপাদানের মিলিত প্রতিক্রিয়ার ফলেই বিপ্লব পোঁছতে পারে
তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে।
রুশ সর্বহারা (বলশেভিক) বিপ্লবের বিজয়ের সময় এই সমস্ত তত্ত্বগত
বাস্তবিকতা বিদ্যমান ছিল। এই বিপ্লব শুধু যে ডিসেম্বরবাদী বিপ্লবীদের কাছ থেকে প্রেরণা
সঞ্চার করেছে এবং সেই স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টি করেছে তাই নয়, বরং বিপ্লবী কবি
পুষ্কিন এর ১৮১৮'র সেই স্বপ্নকেও বাস্তবায়িত করেছে যে 'রাশিয়া নিদ্রা ভেঙ্গে জাগবেই
আর একনায়কত্বের ভগ্নস্তূপের বুকের ওপর মানুষ লিখবে আমার নাম'। পরিস্থিতির এই পরিপক্বতা
অকস্মাৎ গড়ে ওঠেনি, বিপরীতে তা ছিল মোটামুটি এক শতাব্দীর বিপ্লবী সংগ্রামের সঞিত পরিণাম।
১৮২৫-এর ডিসেম্বরবাদীদের বিদ্রোহ থেকে বলশেভিকরা যথেষ্ট প্রেরণা গ্রহণ করেছিল। ১৯০২
সালে প্রকাশিত 'ইস্ক্রা' পত্রিকার নামটির সাথেও জড়িত ছিল সেই বিদ্রোহের স্মৃতিচারণ।
এই পত্রিকার প্রথম সংস্করণের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি কোটেশন ছাপা হয়েছিল - "এই স্ফুলিঙ্গ
থেকে দাবানল সৃষ্টি হবে"। এই কোটেশন নেওয়া হয়েছিল বিপ্লবী কবি পুষ্কিন এর অভিনন্দন
পত্রের জবাবে নির্বাসিত ডিসেম্বরবাদীদের পত্র থেকে।
বলশেভিক বিপ্লব আর ডিসেম্বরবাদী বিদ্রোহের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য ছিল। ডিসেম্বরবাদীরা ছিলেন কুলীন (ধনী), আর তাদের বিদ্রোহ সীমিত ছিল কুলীন দের মধ্যে। তারা ভূদাস প্রথার উন্মুলন তথা জারশাহী'র নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় অঙ্কুশ লাগানোর পক্ষপাতী ছিলেন। এর বিপরীতে বলশেভিকরা ছিলেন শ্রমিক-কৃষকদের প্রতিনিধি তথা জারশাহী-পুঁজিশাহীর অবসান ছিল তাদের কর্মসূচী।ডিসেম্বরবাদীরা গণ বিদ্রোহ তথা গণ-সংগঠনের ব্যাপক নীতি অনুসরনের পরিবর্তে গুপ্ত সমিতি ও সেনা বিদ্রোহের নীতি অনুসরণ করত। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা জনসাধারণের বিদ্রোহকে ভয় করতেন, যেখানে বলশেভিকরা বিশ্বাস করতেন গণ বিদ্রোহে। জারশাহী'র সেনা ডিসেম্বরবাদী-বিদ্রোহ দমন করে সেই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের হয় মৃত্যুদন্ড দিয়েছে অথবা সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করেছে।
বিপ্লবীদের পরাজয়ে বিপ্লব সাময়িক ভাবে পরাজিত হয়, কিন্তু তার বিনাশ হয়না। পরাজিত বিপ্লব সমাজের গর্ভে রেখে যায় ভবিষ্যত বিপ্লবের ভ্রুণ, যা ধীরে ধীরে লালিত-পালিত তথা বর্ধিত হতে থাকে এবং অনুকূল পরিস্থিতি প্রাপ্ত হলে এক বিশেষ কালান্তরালে তা নতুন সমাজের জন্ম দেয়। এই বিশেষ কালান্তরালে কয়েক শতাব্দীর কাজ কয়েক মূহুর্তে সম্পন্ন হতে থাকে। এই সময়েই বিপ্লবী শক্তির পক্ষে বলপ্রয়োগ অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং তাদের ভূমীকা পর্যবসিত হয়, প্রসব কালে 'ধাই' এর ভূমিকায়।
জারশাহী ডিসেম্বরবাদীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল কিন্তু তাদের দুটি মূল দাবী - ভূদাস প্রথার অবসান করা এবং জারশাহী'র ক্ষমতায় অঙ্কুশ লাগানো, - রুশী সমাজের গর্ভে পালিত হতে থাকলো, আর তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল ১৮৬১ সালে। সেই সময় রুশী সমাজের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে উঠেছিল।
কি ছিল সেই পরিস্থিতি ? ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৩-৫৬) রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে সম্পুর্ণ ইউরোপের ওপর জারশাহী'র প্রতিপত্তির ভিত দূর্বল হয়ে পড়েছিল। সন ১৮১২'য় নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কে হারিয়ে অজেয় হওয়ার যে তকমা সে পেয়েছিল,এই পরাজয়ের পর তা অপসৃত হয়ে গেল। ফ্রান্স, তুর্কি ইংল্যান্ড ও সার্ডিনিয়া'র যুদ্ধজোটের কাছে পরাজিত হয়ে জারশাহী আভিজাত মহলের নজরেও পড়ে গিয়েছিল। নেপোলিয়ন কে পরাজিত করে প্যারিস কে কুচলে দেবার যে গৌরব 'কাজ্জ্বাক' রা অর্জন করেছিল, এই পরাজয়ের পর সেই গৌরব বিলীন হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাস দিশা বদলে নিয়েছিল।
নিঃসন্দেহে, এই পরাজয় ছিল আভ্যন্তরীণ দূর্বলতার পরিণাম ও পরবর্তী কালে সেই দূর্বলতাই পুঁজিবাদী সংস্কারের কারন হয়ে দেখা দিল। অভিজাত শ্রেণী থেকে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের মধ্যে এই সত্যের উপলব্ধি সঞ্চারিত হয়েছিল যে এই পরাজয় দূর্বল সেনার সেনার কারনে নয়, বরং উন্নত হাতিয়ারের আভাব ও গোলা বারুদের স্বল্পতার জন্য রাশিয়ার শাসক শিবিরে প্রথমবার এই অনুভূতি জন্ম নিল যে, আসলে পশ্চাদপদ রুশী সেনার মোকাবিলা হয়েছিল উন্নত অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর সাথে। এই পরাজয় তাদের প্রথমবার অনুভব করালো যে রাশিয়া, উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলির তুলনায় সমস্ত ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। এই চিন্তাধারার বাহক ছিল রাশিয়ার সামন্ততান্ত্রিক সমাজের গর্ভে লালিত-পালিত হতে থাকা পুঁজিপতি শ্রেণী, আর আভিজাত বর্গের একটি অংশ তৈরি ছিল তাদের সাথে যোগ দেবার জন্য।
এই ছিল সমাজের উপরের স্তরে বদলের পরিস্থিতি। নীচের স্তরের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। সারা দেশে কৃষকদের বিদ্রোহ, নিরন্তর চলতে থাকা এক ঘটনার রূপান্তরিত ধারণ করেছিল। উৎপীড়িত জাতিসত্ত্বা সমুহের বিদ্রোহের আওয়াজ উঠতে শুরু করেছিল এবং পোল্যান্ড টগবগ করে ফুটছিল। তৎকালিন সম্রাট আলেকজান্দ্রা'র ছোট ভাই নিকোলাভিচ, রাশিয়ার তুলনা করেছিল ষ্টিম বয়লারের সাথে, যেখানে বাস করা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় অসম্ভব।
১৮২৫ সালের 'কুলীন'দের বিদ্রোহের তুলনায়, রাশিয়া ইতিমধ্যে এক প্রলম্বিত দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছিল। ডিসেম্বরবাদীরা যে স্বপ্ন দেখেছিল, রুশী কৃষকদের মনে তা আলোড়ন তুলে দিয়েছিল। স্থানীয় জায়গীরদার ও ভূদাসদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হয়ে উঠছিল। মহান রুশী সাহিত্যিক দন্তয়েভস্কী'র জীবনীর ওপর আলোকপাত প্রসঙ্গে ইগোর ভোল্গিন লিখেছেন যে, ওনার পিতার হত্যা করেছিল তার ভূদাস আর তৎকালিন রাশিয়ায় এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটতে থাকতো। ১৮৩০ এর দশকের ঘটনাবলী ১৮৬০ এর দশকে অধিকতর মুখর হয়ে উঠেছিল।
রাশিয়ার পুঁজিবাদী দিশায় পদক্ষেপ, তাকে সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে এক ত্রিকোণীয় সংঘর্ষ জড়িয়ে ফেলেছিল। একদিকে ছিল জারশাহী, দ্বিতীয় দিকে পুঁজিপতি ও উদারপন্থী সামন্তবাদী জোট আর তৃতীয় পক্ষে ছিল বিপ্লবী উগ্রবাদীরা। জারশাহীর প্রতিনিধিত্ত্ব করছিল নিরঙ্কুশ আমলাতন্ত্র ও তার সুপুত্র, পুঁজিবাদের প্রতিনিধিত্ত্ব করছিল জেমেস্তোয়া-তন্ত্র, আর বিপ্লবী উগ্রবাদীরা রাশিয়ার ভবিষ্যত সর্বহারা বিপ্লবের পূর্বপুরুষের ভূমিকা পালন করছিল। ১৯১৭'র দু-দুটো বিপ্লব এই ত্রিকোণীয় সংগ্রামের অন্তিম ফয়সলা করে দিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব জেমেস্তোয়া-তন্ত্রকে ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করেছিল, জারশাহী'র প্রতি আপোষকামী মনোভাব নিয়েছিল, কিন্তু অক্টোবর বিপ্লব এই দু পক্ষকেই পিষে ফেলে সর্বহারা রাষ্ট্রের স্থাপনা করেছিল।
রাশিয়ার সর্বহারা বিপ্লবের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সূচনা হয়েছিল ১৮৬১'র পুঁজিবাদী সংস্কারের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তবুও রাশিয়া, সামন্ততান্ত্রিক বন্ধন থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। কৃষকদের প্রাপ্য জমির একটা অংশ কাট-ছাঁট করে জমিদার দের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাকে ওখানকার কৃষকেরা ওত্রেচকি বলতো। এছাড়া নিজেদের মুক্তির জন্য কৃষকদের ২০০ কোটি রুবল মুক্তিপন হিসেবে দিতে হতো আর ভূমি- দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া সত্ত্বেও জমিদারের জমিতে তাদের অত্যন্ত কঠোর শর্তে চাষ করতে বাধ্য করা হত। জমি চাষ বাবদ নগদ পাওনার অতিরিক্ত জমিদারের জমির কিছু অংশে তাদের নিজেদের চাষের উপকরণ দিয়ে বেগার (বিনা মজুরিতে) খাটতে হত। একে ওত্রাবোৎকী বা বার্শচিনা বলা হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষকদের জমিদারের জমি চাষ করে ফসল আধা আধা ভাগ করে দিতে হত। এই ছিল ভূদাসত্ব থেকে মুক্তির প্রকৃত ছবি। তা সত্ত্বেও এতটা পার্থক্য অবশ্যই হয়েছিল যে কৃষকরা ব্যক্তিগত ভাবে মুক্ত হয়ে গিয়েছিল, তাদের আর বেচা কেনা করা যেত না। ওদিকে কেরেনস্কী সরকারের অবস্থা ছিল নড়বড়ে, তার আদেশ পালন করা হচ্ছিল না। তার দুরবস্থা বুঝতে মাত্র দুটি উদাহরণই যথেষ্ট।
'কেরেনস্কী হুকুম দেয়, বলশেভিকদের পত্রিকা 'রোবোচী পুত'-এর ছাপাখানা দখল করে নেওয়া হোক। এই কাজে নিযুক্ত অফিসারকে সেপাইদের একটি দল দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। দু ঘন্টা পর তাকে বলা হয় যে কিছু সিকিউরিটি গার্ড সঙ্গে দেওয়া হবে, এবং তারপর সেই আদেশও স্মরণের অতীত হয়ে যায়।
ডাকঘর ও তারঘরগুলিকে বলশেভিকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিছু গোলা গুলিও চলে। কিন্তু তারপর সরকারি সৈনিকেরা ঘোষণা করে যে এখন তারা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে হামলা করবে না'।
কেরেনস্কী সরকারের ক্ষমতা-কেন্দ্র কতটা ডামাডোল অবস্থায় পৌঁছেছিল, তার মনোবল কোথায় নেমে এসেছিল, তার দ্বিতীয় নমুনা ---
'সন্ধ্যা হতে হতে সাইকেল সওয়ার হয়ে দুই সেপাই, বলশেভিকদের কব্জায় থাকা পীটার পল কিয়েস্কী গ্যারিসন-এর প্রতিনিধি রূপে কেরেনস্কী সরকারের সৈনিক স্টাফ সদর ভবনে পৌঁছোয়। তারা দাবী করে যে সৈনিক স্টাফরা এক্ষুনি আত্ম সমর্পণ করুক অন্যথায় সদর ভবনে গুলি বর্ষণ করা হবে।
আতঙ্কিত সৈনিক স্টাফ পদাধিকারীরা দুটি মিটিং করে এবং কিম কর্তব্য বিমূঢ় হয়ে শিশির প্রাসাদে চলে যায় ; রেড-গার্ডরা সদর ভবন কব্জা করে নেয়'। একই ভাবে শিশির প্রাসাদ দখল করার কাহিনীও ততোধিক মজার, যা লেখক জন রীড-এর কাছে এক মাঝি, এ ভাবে বর্ণনা করে ---
'প্রায় এগারোটা নাগাদ আমরা জানতে পারি যে শিশির প্রাসাদের 'নেভা' র দিকের অংশে কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই। সুতরাং আমরা দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়ি আর দু-চারজন করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে পড়ি। তারপর দেখি সিকিউরিটি গার্ডরা সব সেখানে রয়েছে আর আমাদের তারা ধরে ফেলে ও আমাদের বন্দুকগুলো কেড়ে নেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের সাথীরা আসতেই থাকে যতক্ষণ না আমরা দলে ভারী হয়ে যাই। তারপর আর কি, আমরা পাশা পাল্টি করে দিই আর তাদের কাছ থেকে বন্দুকগুলো সব কেড়ে নিই'।
বলশেভিক ক্যাম্পের অবস্থা ছিল ঠিক তার উল্টো। তাদের সমর্থকরা সব প্রাণশক্তি ও উৎসাহে ভরপুর ছিল এবং সতর্ক ছিল। সেনা মুখ্যালয়ে (মোগিল্য়োভ) জেনারেল দুখোনিনকে সোভিয়েত সরকার আদেশ দেয়েছিল যে সে তৎক্ষণাত জার্মান কতৃপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ বিরাম সম্পর্কিত বার্তালাপ করুক। কিন্তু একথা মানতে সে অস্বীকার করে। এরপর তাকে বরখাস্ত করে দেওয়া হয়, মুখ্যালয় ভেঙ্গে দেওয়া হয় ও দুখোনিন সৈনিকদের হাতে মারা পড়ে। [হিস্ট্রি অফ দী কমিউনিস্ট পার্টি অফ সোভিয়েট ইউনিয়ন (বলশেভিক)]।
এইসব কোনো আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল না। সেনার মধ্যে বিভাজন মোটামুটি এমন ভাবে হয়েছিল যে অধিকাংশ জওয়ান ছিল বলশেভিক আর বেশিরভাগ অফিসার হয় ক্যাডেট নয় মেনশেভিক নয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী বা অন্য কিছু। দুখোনিন-এর হত্যার বিবরন জন রীড, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন-এ এইভাবে দিয়েছেন -
'রেলগাড়ির যে বগিতে দুখোনিন-কে আটকে রাখা হয়েছিল, তার চারপাশে উত্তেজিত জনতার ভীড় জমা হয়ে গিয়েছিল। কিলেঙ্কো একটি ভাষন দেয় যার মাধ্যমে সে সেপাইদের অনুরোধ করে যে দুখোনিন-এর গায়ে যেন কেউ হাত না ওঠায়, কারণ তাকে পেত্রোগ্রাদে নিয়ে গিয়ে বিপ্লবী ন্যায়াধিকরণ-এর কাছে পেশ করতে হবে। ভাষণ শেষ হতেই হঠাৎ দুখোনিন নিজেই জানলার সামনে এসে যায়, যেন ভীড়ের সামনে সে কিছু বলতে চায়, লোক খেপে উঠে চিৎকার করতে করতে বগির দিকে এগিয়ে গিয়ে বুড়ো জেনারেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাকে বাইরে টেনে আনে আর প্লাটফর্মে ওপর ফেলে মারতে মারতে তার নাড়িভুঁড়ি বের করে দেয়'।
তার মানে এই নয় যে প্রতিক্রিয়াশীলরা হার মেনে বসে গিয়েছিল। কেরেনস্কী ৭ নভেম্বর পেত্রোগ্রাদ ছেড়ে পালায়। তার উদ্দেশ্য ছিল নিজের বিশ্বাসভাজন সৈন্যদের এককাট্টা করে পেত্রোগ্রাদে হামলা করা। এ ব্যাপারেও তাকে যথেষ্ট নিরাশ হতে হয়। সে পেত্রোগ্রাদ থেকে গাতচীনা হয়ে 'ওস্ত্রোভ' (প্স্কভো প্রান্ত) নামক স্থানে পৌঁছায়। সেখানে শ্রমিক ও সৈনিকদের সোভিয়েতের সাধারণ অধিবেশন, বলশেভিকদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। এখানেই শেষ নয়, উসুরী প্রান্তের কাজ্জাক-রা এবং সৈনিক প্রতিনিধিরা তাকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু দোন প্রদেশের কাজ্জাক-রা তা করতে দেয়নি। এরপর তার যাত্রা বাধাপ্রাপ্ত হয় এইজন্য যে সেখানে রেল লাইন কেটে ফেলা হয়েছিলো, যাতে রাজধানী'র বিরুদ্ধে সেনা পাঠানো না যায়।
দ্বিতীয় দিন (৮ নভেম্বর) সে মোটর গাড়িতে করে লুগা পৌঁছায় আর সেখানে তাকে ভাল ভাবে স্বাগত জানানো হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মোর্চার সদর ভবনেও তাকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। সেপাইরা পেত্রোগ্রাদ মার্চ-এ তাদের অসম্মতির কথা জানিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত সে সেনার সদর ভবনে পৌঁছায় আর বিভিন্ন মোর্চা থেকে সেনার দশটি রেজিমেন্টকে পেত্রোগ্রাদ যাবার আদেশ দেয়। এখানেও সেপাইরা তার আদেশ অস্বীকার করে দেয়। সব শেষে প্রায় পাঁচ হাজার কাজ্জাক তার সঙ্গ দেয়।
এই বিবরন থেকে ছবিটা পরিষ্কার বোঝা যায়। সেনাদের বড় অংশ ছিল বলশেভিকদের পক্ষে, কিছু ছিল তটস্থ আর ছোট একটা অংশ ছিল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো তাদের বিভ্রান্ত করে সাথে রাখা হয়েছিল। যাইহোক, কেরেনস্কী এতটা সফলতা অবশ্যই পেয়েছিল যা দিয়ে পেত্রোগ্রাদে হামলা করা যায়। যে সময়ে কেরেনস্কী পেত্রোগ্রাদে হামলা করার জন্য ফৌজ একত্রিত করছিল, সেই সময় তার সহযোগীরা তাকে স্বাগত জানানোর রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির কাজে লেগে পড়েছিল। যার ভিত্তি স্থাপন করা হয়ে গিয়েছিল সোভিয়েতগুলির দ্বিতীয় অখিল রুশী কংগ্রেস, ত্সে-ই-কাহ'র বৈঠকেই। পরিবেশ গড়ে তোলার এই প্রক্রিয়ার বিশেষ দিক ছিল এই যে, দু পক্ষই নিজের নিজের আপীল করছিলো বিপ্লব, সমাজতন্ত্র ও রাশিয়া কে রক্ষা করার নামে। রাশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্ল্যাক হানড্রেডস, অক্টোবরবাদী এবং ক্যাডেট পার্টির সম্ভাবনা ছিলোনা। যারা রঙ্গমঞ্চে ছিল, তারা কখনো- না-কখনও মার্কসবাদ অনুসরনের শপথ নিয়েছিলো ও রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র আনার কসম খেয়েছিল। তৎকালীন রাশিয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে পুঁজিবাদকে নিজের রক্তাক্ত চেহারা সমাজতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে লুকোতে হচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণী মুখোশধারী সমাজতন্ত্রকে খারিজ করে আসল সমাজতন্ত্রিক শক্তিকে চিনে নেবার কলা কৌশল ভাল মতই রপ্ত করে নিয়েছিল।
মার্তোভ (মেনশেভিক ধারার নেতা), বিপ্লবের নিন্দা করার মাধ্যমে দোষারোপ করে যে সোভিয়েতগুলির কংগ্রেসের উদ্বোধনের আগে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটি সৈনিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সমাধান করা হচ্ছে। তার পরিবর্তে তার দাবী ছিল যে, সমস্ত গণতন্ত্রিক শক্তিগুলির মান্য সংযুক্ত গণতন্ত্রিক ক্ষমতার স্থাপনা করা হোক। বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী তথা সংযুক্ত সমাজিক গণতন্ত্রীরা মার্তোভ-এর প্রস্তাবের সমর্থনে দাঁড়িয়ে ছিল। ইহুদী সামাজিক গণতান্ত্রিক-এর সংগঠন 'বুন্দ'ও তার প্রস্তাব সমর্থন করে। এই ধ্রুবিকরন ত্সে- ই-কাহ এর বৈঠকে শুরু হয়েছিল। এতে আশ্চর্য হওয়ার কোন প্রশ্ন ছিলনা কারন এই সংস্থা এই কংগ্রেস আহ্বান করার বিরুদ্ধে ছিল এবং শেষে বাধ্য হয়ে তাকে স্বাগত জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই ছিল বলশেভিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পার্টি গুলির দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বাস্তবিক অবস্থা।
এর বিপরীতে বলশেভিকরা দৃঢ়তার সাথে নিজেদের সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়িত করতে থাকে। সেই সময়েও, যখন ত্সে-ই-কাহ-তে তাদের কাজ-কর্মের বিরুদ্ধে কান্নাকাটি, হা-হুতাশ চলছিল, তখন তাঁরা অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের গ্রেফতার করে নেয় এবং তাদের ছোট ছোট সৈন্য-দলগুলি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, তারঘর ও রাজকীয় ব্যাঙ্ক দখল করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ করতে থাকে। রাশিয়ার রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য তখন উল্টে গিয়েছে। ৬ নভেম্বর কেরেনস্কী গণতন্ত্রিক পরিষদে নিজের ভাষণের মধ্যে লেনিনকে 'ফেরারি রাষ্ট্র অপরাধী' ঘোষিত করে ওনাকে গ্রেফতার করার আহ্বান করতে থাকে। কিন্তু পর দিনই তার মন্ত্রী সভার সদস্য গ্রেফতার হয়ে যায়, লেনিন রাশিয়ার প্রধান মন্ত্রী হন আর কেরেনস্কী হয় ফেরারি রাষ্ট্র অপরাধী। এই ছিল বিপ্লব।
প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা :
রাষ্ট্রক্ষমতার দুই কেন্দ্র :
তিন চার দিন পর্যন্ত এমন মনে হচ্ছিল যেন পেত্রোগ্রাদে বিপ্লবের (প্রায়) একতরফা জিত হয়ে গেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিলনা। রাষ্ট্রক্ষমতাচ্যুত পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিনিধিরা এই সময়ের সদব্যবহার করছিলো আর একবার পেত্রোগ্রাদ দখল করার প্রস্তুতির মাধ্যমে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের নেতৃত্বে 'বিপ্লব ও দেশোদ্ধার সমিতি' গঠন করা হয়েছিল। এদের আশা ভরসা টিকে ছিল কেরেনস্কীর সৈনিক প্রস্তুতির ওপর। ১১ নভেম্বর পেত্রোগ্রাদে প্রতিবিপ্লবী হামলার সূত্রপাত হয়, সৈনিক হোটেল, তারঘর ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করার মাধ্যমে। সৈনিক হোটেল ও তারঘর তৎক্ষণাৎ মুক্ত করে ফেলা হয়, প্রচুর রক্তারক্তির মধ্য দিয়ে। কিন্তু টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মুক্ত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
এই অবধি রাষ্ট্রক্ষমতার দুটি কেন্দ্র কাজ করছিল। সোভিয়েত ক্ষমতা-কেন্দ্র
স্মোল্নী এবং পুঁজিবাদী ক্ষমতা-কেন্দ্র ডুমা। প্রথমটি প্রেরণা ও প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ
এবং দ্বিতীয়টি হারের পর হার সহ্য করা, হা-হুতাশ জর্জরিত। আর এদের মাঝে ছিল বলশেভিক
পার্টির দোদুল্যমান অংশ। এই দুই কেন্দ্রের কার্যকলাপের খুবই জীবন্ত বৃত্তান্ত রয়েছে
জন রীড-এর 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন' বইটিতে ---
'স্মোল্নী ভবনের সবচেয়ে উপর তলায় সৈনিক বিপ্লবী সমিতি জোরদার কাজ করে যাচ্ছিল। তারা কোনোরকম টিলেমী না করে মারের পর মার দিয়ে যাচ্ছিল। এমন এক মেশিনের মতো তারা হয়ে উঠেছিল যার মধ্যে তরতাজা ভাব ও স্ফূর্তিতে ভরপুর লোকেরা দিন রাত, রাত দিন, নিজেদের উজাড় করে দিতো আর যখন তারা সেখান থেকে বেরোতো দম ফুরিয়ে, হাঁপিয়ে চুরমার হয়ে, ময়লা মাখা চেহারায়, ভারি কন্ঠস্বর নিয়ে, তখন কেউ বসে পড়তো তো কেউ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে থাকতো আর সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়তো '।
এর তুলনায় ডুমা র অবস্থা কী ছিল?
'নিকোলাই ভবনে ডুমা র অধিবেশন শেষ হওয়ার মুখে। কট্টর জঙ্গজু ডুমাও কিঞ্চিত স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। একের পর এক কমিসারেরা খবর দিতে থাকে : টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কব্জা হয়ে গেছে, রাস্তায় রাস্তায় লড়াই চলছে, ভ্লাদিমির স্কুল হাতছাড়া হয়ে গেছে।
এরকম অবস্থা হওয়ার পর ডুমা'র পক্ষে কেরেনস্কীর আসার অপেক্ষা আর বলশেভিকদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা। বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ ঘৃনার প্রকাশ ক্যাডেট প্রতিনিধি কেরেনস্কী-র এই ঘোষণায় প্রকাশ পায় --- 'যখন আইনি সরকারের সেনা পেত্রোগ্রাদ পৌঁছাবে, তখন তারা এই বিদ্রোহীদের, গুলিতে ঝাঁজরা করে দেবে এবং এই হত্যা নিশ্চিত ভাবে অবৈধ হবেনা'। এটা এমন একটা ঘোষণা ছিল যার সমর্থন ডুমা'র কোনো অংশের তরফ থেকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তার পার্টির লোকেরাও এই বিষয়ে নিজেদের অসম্মতি প্রকাশ করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির কেন্দ্রীয় সমিতি তো ডুমা'য় নিজেদের নেতাদের উপর অবিশ্বাস প্রকট করে দেয়। এই পার্টিতে দক্ষিণপন্থী লাইন পরাজিত হচ্ছিল আর বামপন্থা প্রভাবশালী হচ্ছিল।
এই ধরনের বিভাজন কোনো একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল না, সব জায়গায়ই নতুন করে ধ্রুবিকরন হচ্ছিল --- 'সম্পুর্ন রাশিয়াতেই বিভিন্ন গণতন্ত্রিক সংগঠন একটার পর একটা ভেঙ্গে পড়ছিল ও বদলে যাচ্ছিল। সহযোগী সমিতিগুলিতে আভ্যন্তরীণ ঝগড়া-বিবাদের কারনে ফাটল ধরছিল, কিষাণ কার্যকারিনী সমিতির বৈঠকগুলিতে জোরদার টক্কর চলছিল।এমনকি কাজ্জাকদের মধ্যেও অস্বস্তি বজায় ছিল।
এখন আমরা এই ভাঙন, ছাড়াছাড়ি ও অস্বস্তিকর প্রক্রিয়ার কিছু বাস্তব
উদাহরণ থেকে বুঝবার চেষ্টা করবো। এরমধ্যে রেলওয়ে ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এর উদাহরণ সর্বোত্তম
হবে। রেল কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন 'ভিক্লেজ', দাম্ভিক সব ঘোষণা করছিলো যে তারা
সংঘর্ষরত দুটি পক্ষের মধ্যে কারোর সমর্থন ততক্ষণ করবেনা, যতক্ষণ না তারা নিজেদের মধ্যে
সমঝোতা করবে। একই সাথে তারা ধরে রেখেছিল যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ,
না বলশেভিকরা করতে পারবে, না 'উদ্ধার সমিতি' বা কেরেনস্কীর সৈনিকরা। এই অবস্থায় রাশিয়ার
উদ্ধার কর্তা হবে ভিক্লেজের নেতাগণ। একদিকে এই সব দাম্ভিক ঘোষনা করা হচ্ছিল আর অপরদিকে
রেল শ্রমিকরা বড় বড় সভা করে নিজেদের নেতাদের হাভভাবের নিন্দা করছিল। এরা সব আর কেউ
নয়, রেলওয়ের শ্রমিক ছিল। অবস্থা এমনও ছিল যে এই শ্রমিকদের শাখাগুলি অখিল রুশী সম্মেলনের
দাবি করছিল আর নেতারা তা করতে অস্বীকার করছিল। ঠিক সেভাবেই যেমন ভাবে
ত্সে-ই-কাহ, সোভিয়েত গুলির অখিল রুশী কংগ্রেস আহ্বান করতে অস্বীকার
করছিল।
১৮৯৪ সালে এঙ্গেলস, এই সুদীর্ঘ আলোচনার সারসংক্ষেপ করেছেন এইভাবে - "রাশিয়ায় সেই সময়ে কোন বিপ্লব হয়নি, জারশাহী সন্ত্রাসবাদ দমনে জীত হাসিল করেছে যা আপাতত সমস্ত ধামাধরা সম্পত্তিধারী শ্রেণীকে জারশাহীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছে। মার্কসের চিঠির ১৭ বছর পরে পুঁজিবাদের বিকাশ তথা গ্রাম সমূহের বিচ্ছিন্ন হওয়া, দুটি বিষয়ই দ্রুততার সাথে অগ্রসর হয়েছে।"
এই উপলব্ধি তে পোঁছনো রাশিয়ার নীতি নির্ধারণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন ছিল। কিন্তু আজ তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সেই সমস্ত তত্ত্ব ও প্রক্রিয়াগুলিকে বোঝা যা এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে সাহায্য করেছে। সন্ত্রাসবাদী ও অরাজকতাবাদীরা মার্কসবাদী সাহিত্যে পুঁজিবাদের নিন্দা পড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত আর আইনি মার্কসবাদীরা বিহ্বল হত পুঁজিবাদের সামন্তবাদ বিরোধী ভূমিকায়। কিন্তু দু'পক্ষই ছিল একদেশদর্শী। এই একদেশদর্শী প্রশংসা সত্ত্বেও দু পক্ষই ছিল মার্কসবাদ বিরোধী।
অরাজকতাবাদীদের সাথে মার্কসবাদীদের বিবাদ মূলত চারটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত ছিল --- রুশ রাষ্ট্রের শ্রেণীগত ভিত্তি, রুশী বিপ্লবের প্রেক্ষিতে যৌথ-ভূস্বামীত্ত্বের মূল্যায়ন, পুঁজিবাদী বিকাশের সম্ভাবনা ও রুশ বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা।
এপ্রিল ১৮৭৫-এ এঙ্গেলসের 'রাশিয়ায় সামাজিক সম্পর্কের বিকাশ' শিরোনামে লেখা এবং ১৮৯৪-এর প্রথমার্ধে লিখিত পরিশিষ্ট-তে এই বিষয় গুলির ওপর বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধ নারদনিকবাদী নেতা ও তাত্ত্বিক প.ত্কায়েভ-এর সাথে বিবাদ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল। নারদনিকবাদীদের অভিমত ছিল যে রুশ রাষ্ট্রের কোন সামাজিক ভিত্তি নেই, তা অত্যন্ত দুর্বল ও সেই কারণে এখানে পালা-বদল ইউরোপের তুলনায় সহজসাধ্য ।
এঙ্গেলস তথ্যভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে এই ভুল মতামতকে খন্ডন
করে প্রমাণ করেছেন যে রুশ রাষ্ট্র বস্তুত অভিজাত, আমলাতন্ত্র, ব্যাবসায়ী ও উঠতি পুঁজিপতিদের
এবং তারা পুঁজিপতিদের ওপর ক্রমশ নির্ভরশীল হতে চলেছে। এই বিকাশশীল প্রক্রিয়ার পর্যালোচনায়
এঙ্গেলস ১৮৯৪ সালে এই উপলব্ধি তে পৌঁছোন যে 'রাষ্ট্র কিশোর রুশীয় পুঁজিপতি-শ্রেণীর
মজবুত কব্জায় রয়েছে। রাষ্ট্র জমিদার ও পুঁজিপতিদের দ্বারা শ্রমিক-কৃষকদের দমন-পীড়নের
হাতিয়ার হয়ে রয়েছে। তবুও, যেহেতু রুশী পুঁজিপতি শ্রেণী কিশোর অবস্থায় রয়েছে সেই হেতু
ইউরোপের তুলনায় রুশ বিপ্লব অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কিন্তু বাস্তবে, বিপ্লব পরাজিত
হয়েছে, কারণ রুশী সর্বহারাও প্রায় একই রকম কৈশোর অবস্থায় ছিল আর কৃষক শ্রেণী, যাকে সন্ত্রাসবাদীরা বিপ্লবের মূল শক্তি রূপে গন্য করত, তার চেতনার স্তর অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ছিল, বিপ্লবের শক্তির নীরিখে অনেক দূরে, অনেক পিছনে।
এখন দ্বিতীয় প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করা যাক। সন্ত্রাসবাদীরা যৌথ-ভূস্বামীত্ত্বকে রাশিয়ার বিপ্লবের পক্ষে এক অদ্ভুত বরদান ও বিরল বৈশিষ্ট্য বলে মনে করতেন। তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার বিপরীতে এঙ্গেলস প্রমাণিত করেন যে যৌথ-ভূস্বামীত্ত্ব রুশ সমাজের কোন অদ্ভুত ঘটনা নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে তা হল রাশিয়ার পশ্চাদপদতার প্রমাণ। তিনি দেখান যে,'ভূমির যৌথ-স্বামীত্ত্ব স্বয়ং এমন একটি ব্যাবস্থা যা ভারত থেকে নিয়ে আয়ারল্যান্ড পর্যন্ত বিকাশের নিম্ন স্তরে থাকা সমস্ত জনসাধারণের মধ্যে দেখা গেছে, এমন কি ভারতের প্রভাবে বিকশিত হতে থাকা প্রতিবেশী মালয় ও জাভা-য়ও তার উদাহরণ মেলে'। সেই সময় রাশিয়ায় এমনও অদ্ভুত পরিস্থিতি ছিল যে সেখানে যৌথ মালিকানার মত পরিস্থিতি বর্তমান ছিল ও বিপ্লব তার দোর গোড়ায় আঘাত হানছিল। সেই কারণেই এই প্রশ্ন এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল। যদি বিপ্লব বিজয়ী হয়ে যেত ও পারিপার্শ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলাতে সক্ষম হতো, যার উল্লেখ মার্কস-এঙ্গেলস করেছিলেন, তাহলে রাশিয়া পৃথিবীর মধ্যে এক অদ্ভুত দেশ হয়ে উঠতে পারতো, যেখানে সামন্তবাদী সম্পর্ক পুঁজিবাদী বিকাশ প্রক্রিয়ার পথ অতিক্রম না করেও সমাজতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারতো।
রাশিয়ার নারদনিকবাদীরা বিপ্লবে বিজয়ের পরেই সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছিলেন ও তাদের স্বপ্ন দেখার সবচেয়ে বড় ভিত্তি ছিল সেই 'ভূমির যৌথ-মালিকানা'। হার্জেন থেকে বুকানিন ও এমনকি ত্কাচোভও মনে করতেন রুশী কৃষক জন্মগত, পরম্পরাগত ভাবে কমিউনিস্ট। অজ্ঞতা সত্বেও তাঁরা পশ্চিম ইউরোপের জনসাধারণের তুলনায় সমাজতন্ত্রের কাছাকাছি রয়েছেন। নিশ্চিত ভাবে ওনারা শ্রেণী চেতনার গুরুত্ব উপলব্ধি করতেন না এবং বিপ্লবী-মতাদর্শকে কে হেয় দৃষ্টিতে দেখতেন।
এঙ্গেলস তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়ে দেন যে যৌথ মালিকানার ভিতরেই ব্যাক্তিগত মালিকানা ও পুঁজিবাদের বিকাশের উপাদান মজুত ছিল। এর জন্যে তিনি ত্কাচোভ-এর তথ্যেরই সাহায্য নেন --- কৃষকদের মধ্যে থেকে সুদখোর ও অভিজাতদের এক শ্রেণী জন্ম নিচ্ছে যারা কৃষক ও জমিদারদের জমি কেনে এবং ইশারায় নেয়। এটি ছিল একটি প্রবণতা ( trend ) কিন্তু তা বিকশিত হয়ে মৌলিক শ্রেণী বিভাজনের রূপ গ্রহণ করেনি । সেইজন্য তার বিকাশের দুটি সম্ভাবনাই মজুত ছিল ও তার দিশা শেষ বিচারে বাহ্যিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রথমত, রুশ বিপ্লবের সাফল্যের ওপর, আর দ্বিতীয়ত, এই বিপ্লব ইউরোপের বিপ্লবে ইন্ধন যোগাবে কি না।
একই সাথে রুশ বিপ্লবের একটি দূর্বল দিকও ছিল। সেখানে সমাজতন্ত্রের
পূর্ববর্তী অনিবার্য দুই শ্রেণী --- পুঁজিপতি ও সর্বহারা উপস্থিত ছিলনা।
কৃষকের বিশাল সমূহ ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা
--- রাষ্ট্র-ক্ষমতা বিরোধী চেতনা, জারশাহী কে নস্যাৎ করে দেবার চেতনা ছিলনা। এঙ্গেলস
যেমন বলেছেন, 'জার রুশী কৃষকদের পার্থিব ঈশ্বর স্বরূপ। ঈশ্বর অনেক উপরে এবং জার আছে
অনেক দূরে, কৃষক সঙ্কট কালে তার নাম জপ করে'। কৃষকদের রাজভক্তি প্রসঙ্গে এঙ্গেলস দেখিয়েছেন
--- 'রুশী জনতার এই সহজ সরল বিপ্লবী বাহিনী অভিজাতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগ্রাম করেছে,
কিন্তু জারের বিরুদ্ধে কখনই নয়, একমাত্র সেই সময়ে ছাড়া, যখন নকল জার জনতার অগ্রদূত
সেজে সিংহাসনের ওপর দাবি করতে থাকে'। কিন্তু বিপ্লবের বিজয়ের জন্যে জরুরী ছিল কৃষকদের
চেতনা এই স্তর অবধি পৌঁছয়, যে (শুধু স্থানীয় জমিদার ও আমলাতন্ত্র নয়) জার তাদের প্রধান
শত্রু, শ্রমিক তাদের ঘনিষ্ঠতম মিত্র এবং জারশাহী কে তছনছ করে শ্রমিকদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতা
স্থাপিত করেই তারা নিজেদের মঙ্গল সাধন করতে
পারে। রুশী কৃষকদের মধ্যে এই ধরনের চেতনার উন্নেষ ১৯০৫-এর বিপ্লবের পর্যায়ে শুরু হয় আর প্রকৃত অর্থে তার পরেই রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ার ওঠা সম্ভব হয়।
এই পর্যায়েও স্থির ছিলনা রুশী সমাজ। সমাজের অভ্যন্তরে মতাদর্শগত মন্থন ও বিকাশ প্রক্রিয়া চলছিল আর তার পরিনামে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের দুই নেতা হার্জেন ও চের্নিশেভ্স্কী'র মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। হার্জেন-এর অভিমত ছিল গ্রাম সমুদায় বজায় রাখা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র প্রদান করা, রাষ্ট্রীয় একতা বজায় রেখে গ্রাম এবং বোলোস্ত-এর স্বশাসন শহর তথা সমগ্র রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া - এই হল রাশিয়ার ভবিষ্যতের প্রশ্ন। গ্রাম সমুদায় বলবৎ রাখার অর্থ অবশ্যই যৌথ মালিকানা বজায় রাখা। বাকুনিন ও ত্কাচোভ, হার্জেন-এর এই অভিমতের সাথে সহমত ছিলেন। ত্কাচোভ তো ১৮৭৫ পর্যন্ত এই রাগ-ই আলাপ করতে থাকেন যে যৌথ মালিকানার সিদ্ধান্ত আমাদের জনসাধারণের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের শিরায় শিরায় বইছে, বলা যায় যে তাঁরা স্বভাব বশতই পরম্পরাগত ভাবে কমিউনিস্ট।
চের্নিশোভস্কি এই বোধ থেকে একধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি অনুভব করতে থাকেন যে রুশী সমাজে পুঁজিবাদী বিকাশের প্রগতি সামাজিক জড়তার সেই প্রতীক কে ধ্বংস করে দেবে। শুধু তাই নয়, তিনি এও অনুভব করতে থাকেন যে এই কষ্টকে অতিক্রম করেই সমাজ প্রগতি করতে পারে। মার্কস এই ভাবে তাঁর অভিমত নিরুপিত করেন --- রাশিয়ার ক্ষেত্রে, যেমন তার উদারপন্থী অর্থশাস্ত্রীরা চায়, গ্রাম-সমুদায়গুলিকে নষ্ট করে কাজ শুরু করা উচিত যাতে তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে পারে অথবা সে কী নিজের ঐতিহাসিক অবস্থার বিকাশের সাথে সাথে এই ব্যাবস্থার ফল, যাতনা সহ্য না করেই পেতে পারে ?
এই প্রশ্নের মধ্যে উত্তরও লুকিয়ে আছে। চের্নিশোভস্কি বুঝতে শুরু করেছিলেন যে রাশিয়া কে পুঁজিবাদী বিকাশের যাতনা সহ্য করতে হবে। এই উপলব্ধি তে পোঁছে যাওয়াটাই ওনার বিরল মেধার পরিচায়ক, কারণ রুশী সেন্সরশিপ ও জারশাহীর যাতনার কারনে তিনি ইউরোপের গতিবিধি এবং মার্কস এর রচনাবলী থেকে সার্বিক ভাবে দূরত্ব রেখেছিলেন। এইজন্য এঙ্গেলস তাঁর সম্পর্কে সঠিক টিপ্পনীই করেছিলেন যে ওনার বিশ্লেষণের ভুলগুলিকে দেখে আশ্চর্য লাগে যে এত কম ভুল কি করে হল। রাশিয়ার বিকাশ প্রক্রিয়ার এই অনন্যসাধারণ বোধের কারনে ওনাকে রুশী সামাজিক গণতন্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রদূত মনে করা হয়।
এঙ্গেলস ওনার বিবরণ সম্মানজনক শব্দে এভাবে করেছিলেন ---'রুশী গ্রাম-সমুদায় ওনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ওনাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি প্রাপ্ত করে, যাঁরা ছিলেন হার্জেন তথা ত্কাচোভ এর থেকে প্রভূত উচ্চতর। ওনাদেরই একজন ছিলেন নিকোলাই চের্নিশোভস্কি। তিনি সেই মহান চিন্তাবিদ যাঁর কাছে রুশ এতটা ঋণী, আর সাইবেরিয়ায় য়াকুতোঁ দের মধ্যে নির্বাসনের কারনে যাঁর শৌর্যঃক্ষয়ের কারণে আলেকজান্দ্রা দ্বিতীয়'র 'মুক্তিদাতা' র স্মৃতির ওপর বরাবরের জন্য কলঙ্কের টিকা লেগে থাকবে'।
১৮৬০ - ১৮৭০-এর দশকে রাশিয়ার মতাদর্শগত সংগ্রামের কাহিনী বাকুনিন-এর ভূমিকা ছাড়া সম্পুর্ণ হতে পারেনা। আমরা আগেই দেখেছি যে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারের রুশ ভাষায় অনুবাদ সর্বপ্রথম বাকুনিন-ই করেছিলেন। অর্থাৎ মার্কসবাদী সাহিত্যের সাথে রুশী বুদ্ধিজীবীদের পরিচিতি করানোর কৃতিত্বও তাঁর-ই প্রাপ্য। কিন্তু তৃতীয় সত্যটি এর চেয়ে বেশি ভয়ংকর। প্রথম ইন্টারন্যাশনাল (১৮৬৪ - ৭৪)-এ, মার্কস (এবং মার্কসবাদ)-এর সবচেয়ে মুখর বিরোধী হওয়ার এবং ওনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চক্রান্ত করে ইন্টারন্যাশনাল-কে ছিন্ন ভিন্ন করার কলঙ্কের টিকাও লেগে আছে বাকুনিন-এর মাথায়। প্রসঙ্গ কেবল রাশিয়া ও বাকুনিন-এর মধ্যেই সীমিত নয়। জার্মানী'র লাসাল ও ফ্রান্স-এর প্রুদোঁও মার্কস এর ভাল বন্ধু ছিলেন আর প্রথম দিকে ওনার চিন্তাধারার প্রচার ও প্রসারে এই দুজন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এও সত্যি যে পরের দিকে মতাদর্শগত বিকাশের প্রক্রিয়ায় তাঁরা মার্কস ও মার্কসবাদের বিরোধী হয়ে যান। এই বিরোধীরা মার্কস-এঙ্গেলস ও মার্কসবাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিলেন, তার অনুমান করা যায় এঙ্গেলসের এই উক্তিতে --- 'জনগণের রাষ্ট্র সম্পর্কে অরাজকতাবাদীরা আমাদের এতটাই উৎপীড়িত করেছে যে আমরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছি।(অগাস্ত বেবেল-কে লেখা এঙ্গেলসের পত্র ১৮-২৮ মার্চ, ১৮৭৫)।
মার্কসবাদের বিরুদ্ধে অরাজকতাবাদীদের প্রহারের এই অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হবার পর আমরা আবার একবার বাকুনিন প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সেই দিনগুলোতে তিনি অরাজকতাবাদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন, সে কারনে এ কথা বোঝা জরুরি যে মার্কস-এঙ্গেলস ও অরাজকতাবাদীদের (বাকুনিন) মধ্যে মতভেদের বিষয় গুলি কি কি ছিল। বাকুনিন পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের মধ্যেকার শত্রুতা কে প্রধান বিপদ বলে মনে করতেন না, তিনি রাষ্ট্র কে প্রধান বিপদ মনে করতেন। তিনি মানতেন না যে পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের মধ্যেকার অন্তর্বিরোধ সামাজিক বিকাশের ফসল। তিনি মানতেন না যে রাষ্ট্র, পুঁজিপতি শ্রেণী ও অন্য সম্পত্তিধারী শ্রেণীর রক্ষাকর্তা, তিনি মনে করতেন রাষ্ট্র, পুঁজি ও পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে। মার্কসবাদী মতবাদ অনুযায়ী পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক উচ্ছেদ হলে রাষ্ট্র অন্তর্হিত হয়ে যাবে। বাকুনিন আবার এই মতের প্রবক্তা ছিলেন যে রাষ্ট্র খতম হয়ে গেলে পুঁজিবাদ খতম হয়ে যাবে। এর দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায় যে মার্কস-এঙ্গেলস আর বাকুনিন, একে অপরের বিপরীত বৈচারিক মেরুতে অবস্থান করছিলেন। এঙ্গেলসের নজরে বাকুনিন-এর সিদ্ধান্ত ছিল কমিউনিজমের সিদ্ধান্ত ও প্রুদোঁ'র মতাদর্শের মিশেল। আর তিনি নিজে ছিলেন মতাদর্শ-রহিত এক ব্যক্তি।
যেহেতু বাকুনিন-এর মতে 'রাষ্ট্র' ছিল প্রধান বিপদ, তাই রাষ্ট্রের সব রকমের রূপ, রাজতন্ত্র থেকে গনতন্ত্র, মুছে ফেলা দরকার। তাঁর মতে, শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রও নিন্দনীয়। অর্থাত সূক্ষ্ম বিচারে, সর্বহারা রাষ্ট্রকে নিন্দনীয় ঘোষণা ক'রে অরাজকতাবাদ, শেষ বিচারে পুঁজিবাদের সেবা করে। এর অনিবার্য পরিনাম স্বরূপ এটাই বেরিয়ে আসে যে শ্রমিকরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকুক, বিশেষ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এই প্রতিপাদ্যের পরিপন্থী।
এই প্রতিপাদ্যকে যদি সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তবে পরিনাম স্বরূপ অনিবার্য ফল হবে, মতাদর্শগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও অল্পমতের ওপর বহুমতের সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা স্বীকৃত হবেনা আর প্রত্যেকেরই মর্জিমাফিক চলার অধিকার থাকবে। অর্থাত, সংগঠনে অনুশাসন থাকবেনা, কেউ কারও অধীনে থাকবেনা আর সংগঠন (পার্টি) স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের এক জমায়েত হয়ে রয়ে যাবে। ফ্রান্সে প্রুদোঁ এই মতাদর্শের জনক ছিলেন আর এরই প্রভাবে প্যারি কমিউন, একে আপরের প্রতি ঈর্ষান্বিত সমতুল্য পরমানু সমূহের জমায়েত হয়ে রয়ে গেছিল।
যেমন এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে শেষ বিচারে অরাজকতাবাদ পূঁজিবাদের সেবা করে, তার উদাহরণ স্বরূপ দেখা গেছে যে সেই সময়েও বিস্মার্ক ও ম্যাজ্জিনীর মত পুঁজিবাদী প্রতিক্রিয়াশীলরা বাকুনিন ও তার অনুগামীদের অন্তঃসারশুন্য স্লোগানের অপব্যবহার করে লাভবান হতো, শ্রমিক বিরোধিতার ক্ষেত্রে। শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে এই সূক্ষ্ম পার্থক্যটা বুঝতে পারা বিশেষ জরুরী, অন্যথা পথভ্রষ্ট হওয়ার বিপদ থেকে যায়। ফ্রান্সে এই প্রবণতা দেখা গেছে যে যারা বাকুনিন-এর সিদ্ধান্ত গুলিকে পরিত্যাগ করেছে তারা বাস্তবে সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাঁরই পথ অনুসরণ করেছে।
এই মতাদর্শগত বিতর্কের উত্তাপ ও এইসব সন্ত্রাসবাদী ও অরাজকতাবাদীদের মধ্যে থেকে প্লেখানভ উঠে এসেছেন, যিনি আরাজকতাবাদকে খারিজ করে মার্কসবাদের ঝান্ডা তুলে ধরেছেন। ১৮৮৩-তে 'শ্রম মুক্তি দল'-এর কর্মসূচীর ঘোষণা করে উনি তার দুটি উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন : সমাজতন্ত্রিক মতাদর্শের প্রসার তথা সমাজতন্ত্রিক পার্টি গঠণের জন্য আবশ্যক শক্তি সংহত করা। এই লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার প্রক্রিয়ায় প্লেখানভ রাশিয়ার তৎকালীন পরিস্থিতি অনুযায়ী তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
সেই সময়ে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক গতিবিধির ওপর আর্থিক বিষয়ের প্রভাব মাত্রাতিরিক্ত ছিল, তিনি শ্রেণী চেতনাকে উপরে ওঠানোর কর্মসূচী নির্দিষ্ট করেন। এই প্রেক্ষিতে তিনি মার্কস-এঙ্গেলসের রচনাবলী, যেমন 'ইশতেহার', 'মজুরী শ্রম ও পুঁজি', 'সমাজতন্ত্র-কাল্পনিক ও বৈজ্ঞানিক' প্রভৃতির রুশী ভাষায় অনুবাদ করেন ও জেনেভা থেকে প্রকাশিত ক'রে তা গুপ্ত ভাবে রাশিয়ায় বিতরণ করা হয়।
ওনার এইসব অবদানের সাথে সাথে কিছু দুর্বলতাও ছিল। নিজের প্রথম খসড়া কর্মসূচীতে তিনি কৃষি, খনন এবং উৎপাদনের সাথে যুক্ত শিল্প-সংস্থাগুলিতে রাজকীয় সহায়তার ওকালতি করেছিলেন। এটি লাসালপন্থী বিচ্যুতি ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই সঙ্গে নিরঙ্কুশ জারশাহীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকেও স্বীকৃতি দানের ওকালতি করেন । এটা নিশ্চিত ভাবে নারদনায়া বোল্য়া'র কর্ম-পদ্ধতির দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এমন হওয়া অস্বাভাবিক ছিলনা। ফ্রান্সের উদাহরণ দিয়ে এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেন যে মতাদর্শগত ভাবে বাকুনিন, এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর কার্যপদ্ধতির প্রভাব থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। প্লেখানভ নিজের দ্বিতীয় খসড়া কর্মসূচীতে এই নীতির বদল করে সংগ্রামের স্বার্থে যদি প্রয়োজন হয়, যথাসময়ে সন্ত্রাসবাদী পথ গ্রহণ করার পরিকল্পনা পেশ করেন।
এই সমস্ত ত্রুটি ও দূর্বলতা সত্বেও প্লেখানভ-এর যোগদান সীমাহীন। বিষয়টি বুঝতে আমাদের নজর দিতে হবে মার্কসবাদের প্রতি নারদনিকবাদীদের আকর্ষণের কারণের ওপর। তাদের প্রভাবিত হওয়ার মূল কারণ ছিল যে, মার্কস-এঙ্গেলস পুঁজিবাদের পরিচিতি করিয়েছেন, 'মানুষকে পতিত বানাবার ব্যবস্থা' রূপে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একপেশে হওয়ার কারণ হল মার্কস-এঙ্গেলসের বিশ্লেষণের দুটি দিককে দেখতে তারা অসমর্থ ছিল। তারা দেখতে পায়নি যে সামন্তবাদ কে ধ্বংস করে মানব ইতিহাসের অগ্রগতির জন্যে এই দুই মনীষী পুঁজিবাদের কী পরিমাণ তারিফ করেছেন! একই সাথে তারা মার্কস-এঙ্গেলসের এই কথাকেও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে যে সমাজতন্ত্রের স্থাপনার জন্য যতটা জরুরী সর্বহারা, ততটাই জরুরী পুঁজিপতি।
প্লেখানভ প্রমাণ করেছেন যে রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ হচ্ছে, আর যে গতিতে তার বিকাশ হচ্ছে, সেই একই গতিতে গ্রামে যৌথ ভূমি-মালিকানা ভেঙ্গে যাচ্ছে, সেই অনুপাতেই সর্বহারা'র জন-সমষ্টিও বেড়ে চলেছে আর তারা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে শিল্প-কেন্দ্রগুলিতে। নারদনিকবাদীদের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিতর্কের ওপর আলোকপাত করে সোভিয়েত সঙ্ঘের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস খুব স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছে :
'রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে অবরোধ তৈরি করা বিপ্লবীদের কাজ ছিলনা, কোনো ভাবেই তারা এ কাজ করতে পারত না। তাদের কাজ ছিল পুঁজিবাদের বিকাশের ফল স্বরূপ উৎপন্ন হওয়া শক্তিশালী বিপ্লবী শ্রেণীর (শ্রমিক-শ্রেণী'র) সমর্থন আদায় করা, তাদের শ্রেণী চেতনার বিকাশ ঘটানো, তাদের সংগঠিত করা ও তাদের নিজস্ব পার্টি (শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি) গড়ে তুলতে সাহায্য করা'।
নারদনিকবাদীদের সাথে মতাদর্শগত সংগ্রাম কালে প্লেখানভ এই উপলব্ধি তে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে রুশ বিপ্লবের নেতা শিল্প-সর্বহারাই হবে। এই সিদ্ধান্ত থেকে উদ্ভূত দায়-দায়িত্ব পূরণ করার উদ্দেশ্যে গঠিত নিজস্ব সংগঠন 'শ্রম মুক্তি দল'-এর খসড়া কর্মসূচীতে তিনি বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আহ্বান জানান যে তারা নিজেদের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাক, যাতে তারা পুঁজিবাদী ও বিভিন্ন রকমের প্রাক পুঁজিবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে আচ্ছন্ন না থাকেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর ইতিহাস, প্লেখানভের ভূমিকা-কে এই বিষয়গুলিতে স্বীকৃতি দেয় :
'নারদনিকবাদীরা মনে করত যে রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ হবেনা, আর তাই সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশও হবেনা। প্লেখানভ এই তত্ত্বের খন্ডন করেন। নারদনিকবাদীরা মনে করত যে, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বিকাশ সর্বহারা একনায়কত্বের পথে হবেনা, বরং গ্রামীণ কমিউন-এর পথে হবে। প্লেখানভ প্রমাণ করেন যে কমিউন একটি শ্রেণী রূপে শক্তিশালী হয়ে উঠছে না, বরং তা ভেঙে শোষক শ্রেণী এবং শোষিত শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে'।
এই দুটি বিষয়ে আলোচনা আগেই করা হয়েছে। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে নারদনিকবাদীরা বিপ্লবে নায়কের ভূমিকাকেই সবার ওপরে স্থান দিতো ও জনগণকে নিষ্ক্রিয় মনে করত। প্লেখানভ এই প্রসঙ্গে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেন যে, জনগনই যে কোনো দেশের বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি আর তারাই তৈরি করেন নেতা। কিন্তু তবুও, এ'সবের মিলিত ফল ছিল যে রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রথম প্রচারক, ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বহু সমালোচক তাঁর এই বিচ্যুতির অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে এইভাবে রাখবার চেষ্টা করেন যে সঠিক চিন্তাধারার উপলব্ধি থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বিফল হন। কিন্তু বিশ্লেষণের এই পদ্ধতি ভুল। যেমন আমরা প্রথমেই দেখেছি যে ওনার চিন্তাধারায় লাসালপন্থী ও নারদনিকবাদীদের প্রভাব ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্ব পরিস্থিতিতে আসা পরিবর্তন কে উপলব্ধি করে, সাম্রাজ্যবাদের যুগ অনুযায়ী মার্কসবাদ কে বিকশিত করে তথা সেই অনুযায়ী বিপ্লবের দিশা নির্দিষ্ট করতে তিনি বিফল হন। পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল যে সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবের ভেরী বেজে ওঠা ইস্তক তিনি পুরোপুরি অপ্রাসংগিক হয়ে যান।
মার্কস এঙ্গেলস পূর্ববর্তী কাল্পনিক-সমাজতন্ত্রবাদীদের মূল্যায়ন, প্লেখানভ এই ভাবে করেছেন ---'কাল্পনিক-সমাজতন্ত্রবাদীরা এক মহান মতাদর্শ সামাজ ব্যবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে গেছেন এবং শ্রমিকদের মনে গেঁথে যাবার পর এই মতাদর্শ উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাংস্কৃতিক শক্তি হয়ে হঠে। এই মতাদর্শের প্রচার-প্রসার, কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীদের দ্বারা করে যাওয়া সম্ভবত মানব সমাজের সবচেয়ে বড় সেবা ( উনবিংশ শতাব্দীর কাল্পনিক সমাজতন্ত্র )'।
১৯১৮-য় প্লেখানভ এর মৃত্যুর পর লেনিন, তরুণ পার্টি-সদস্যদের মাঝে ওনার পরিচয়, এই গৌরবময় উক্তি সহযোগে করেছিলেন :
'প্লেখানভ এর সমস্ত দার্শনিক রচনা গুলির অধ্যয়ন --- আমি বলতে
চাই, অধ্যয়ন ছাড়া, কেউ সাচ্চা প্রবুদ্ধ কমিউনিস্ট হওয়ার আশা করতে পারেননা, কারণ দুনিয়ায়
কোথাও মার্কসবাদ সম্পর্কে ওনার চেয়ে ভাল কিছু লেখা হয়নি'।
পার্টি নির্মাণ পর্যায় :
রুশী সমাজে মার্কসবাদের বীজ বপন করেছিল সন্ত্রাসবাদী ও অরাজকতাবাদীরা, এ কথা সত্য। একই সাথে একথাও সত্য যে পরে এই মতবাদের প্রচার-প্রসারে ও রুশ বিপ্লবের জয়ের শিখরে আরোহনের পথে এরাই বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেইজন্য প্লেখানভ, অক্সেল্রোদ তথা জেসিউলিচ-এর মত ব্যক্তিরা যখন সেই ধারা থেকে সরে গিয়ে 'শ্রম মুক্তি দল'(সন ১৮৮৩) নামক মার্কসবাদী সংগঠনের নির্মাণ প্রক্রিয়ার পথে অগ্রসর হন, তখন তাদের প্রথম মোকাবিলা করতে হয় এই অরাজকতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী দের সাথে, কারণ এগিয়ে থাকা শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নারদনিকবাদীদের ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং তাদের পরাস্ত করেই মার্কসবাদের স্থাপনা সম্ভবপর হতে পারতো।
০১ মার্চ ১৮৮১ তে নারদনিকবাদীরা বোমা মেরে রুশী জার আলেকজান্দ্রা কে হত্যা করে। কতিপয় নায়কই ইতিহাস রচনা করে আর জনগন হয় স্রেফ কিছু মূক দর্শক, --- এই চিন্তার বশবর্তী হয়ে এইসব বীর-পুঙ্গবেরা সুদীর্ঘ কাল যাবত জার কে হত্যা করার লক্ষ্যে সচেষ্ট থাকে এবং শেষ পর্যন্ত হত্যা করে বসে। এরপর নতুন জার সত্বাসীন হন। কিন্তু শ্রমিক-কৃষকের জীবন যাত্রায় কোন বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। উল্টে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থেকেছে। এর থেকে জনমানসে এই চিন্তাও বাসা বেঁধেছে যে ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি রোমাঞ্চ তৈরি করতে পারে, প্রতিশোধ এর ভাবনার জন্ম দিতে পারে ও শাসক-গোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা কে ধ্বংস করে বিপ্লবী ব্যবস্থার নির্মাণ করতে পারেনা। জনমানসে এই চিন্তা গড়ে ওঠা, নারদনিকবাদীদের পক্ষে ছিল প্রথম ধাক্কা।
এরপর জারশাহীর দমনের ফল স্বরূপ তাদের দ্বিতীয় ধাক্কা লাগে ও তাদের সংগঠনের সন্ত্রাসবাদী পরিকাঠামো তছনছ হয়ে যায়। এর পরেও বুদ্ধিজীবীদের একটি গোষ্ঠী এই মতবাদের সাথেই যুক্ত হয়ে থেকে যায়, যা চিরতরে সমাপ্ত করা মার্কসবাদী দের সবচেয়ে বড় মতাদর্শগত কর্মদায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।
নারদনিকবাদীদের তৃতীয় ধাক্কা লাগে রুশী অর্থব্যবস্থার বিকাশ
জনিত কারণে। বিগত অধ্যায়ে আমরা এঙ্গেলস ও ত্কাচোভ এর মধ্যে বিতর্ক তথা নারদনিকবাদী
ও মার্কস-এর মধ্যে পত্রাচার সম্পর্কিত আলোচনা করেছি। একই প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার মাটিতে
মার্কসবাদের মতাদর্শগত জিত-এর সৌধ নির্মাণ-পর্ব জারি ছিল।
রুশী সামাজিক গণতন্ত্রীদের দ্বিতীয় খসড়া কর্মসূচীতে প্লেখানভ আর্থিক বিকাশের বাস্তবতা এই ভাবে চিত্রিত করেন --- 'ভূমি দাসত্ব প্রথার উন্মুলনের পর থেকে পুঁজিবাদ, সফলতার পথে উল্লম্ফন করতে সমর্থ হয়েছে। নৈসর্গিক অর্থব্যাবস্থার পুরনো পরিকাঠামো পন্য উৎপাদনের জন্য জমি তৈরি করছে আর এইভাবে তা বৃহৎ শিল্পের জন্য বিশাল আভ্যন্তরীণ বাজারের দরজা খুলে দিচ্ছে। পিতৃতান্ত্রিক ভূস্বামীত্বের সমুহগত স্বরূপ দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছে । গ্রামীণ সমুদায় কিষান জনতাকে রাষ্ট্রের গোলাম বানানোর হাতিয়ার-স্বরূপ মাত্র হয়ে রয়ে গেছে আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো তা ধনবান দ্বারা গরিবের শোষণের হাতিয়ার পর্যন্ত হয়ে উঠেছে।
এই পরিবর্তন ১৮৭০-এর দশকে চলতে থাকা বিতর্কের অবসান ঘটায় এবং এ কথা সুনিশ্চিত হয়ে যায় যে রাশিয়া পুঁজিবাদী বিকাশ প্রক্রিয়া অতিক্রম করার পর-ই সমাজতন্ত্রে প্রবেশ করবে। সংক্ষেপে এ কথাও জেনে নেওয়াও উচিত যে নারদনিকবাদীদের অবস্থা শেষ পর্যন্ত ঠিক কী হয়েছিল ? সমুহগত ভূস্বামীত্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর কৃষকদের মধ্যে শ্রেণী বিভাজন হয় এবং নারদনিকবাদীদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী, 'সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি', কুলাক (গ্রামীণ পুঁজিপতি)-দের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়ায় ও গ্রামের গরিবদের বিশাল সমষ্টির শোষন-উৎপীড়নে মশগুল হয়ে যায়। পরবর্তী কালে লেনিন এই গোষ্ঠীর বিপ্লবী গুণ-সম্পন্ন অংশটিকে চিনতে পারেন ও রুশী সর্বহারার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী রূপে চিহ্নিত করে তাদের বিপ্লবী শিক্ষা-দীক্ষার কাজকে সংগঠিত রূপ দেন। এখানে এটাও উল্লেখযোগ্য যে অক্টোবর বিপ্লবের পর এই সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবীরাই লেনিনের ওপর প্রাণঘাতী হামলাও চালিয়েছে। যারা কোন এক সময়ে জার এর ওপর হামলা করে বিপ্লবী প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত জারশাহীর দমনের শিকার হয়েছিল, তাদেরই রাজনৈতিক বংশধরেরা সর্বহারা রাষ্ট্রশক্তি'র কেন্দ্রে হামলার অপরাধী হিসেবে পরিচিত হয় এবং অবশেষে নিস্পিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে যায়। কালচক্রের এই গতিকে স্মরণ ও অনুভব করাও বিপ্লবের জন্য বিশেষ জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৬৫ - ৯০ অবধি সময়কাল জারশাহীর ইতিহাসে দ্রুততার সাথে পুঁজিবাদী বিকাশের কাল ছিল। সেই কারণে এটা দেখা জরুরী যে সেই সময়ে রুশী শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা কেমন ছিল ? যে গতিতে পুঁজিবাদের বিকাশ হচ্ছিল, সেই গতিতেই শিল্প-শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল আর সস্তা শ্রমিকের সবচেয়ে বড় স্রোত হয়ে উঠেছিল গ্রামীণ সমুদায়। ভূস্বামীত্ব-প্রথার উন্মুলন সত্ত্বেও তার অবশেষ রয়ে গেছিল ওত্রাবোত্কী (বেগার শ্রম) ও ইস্পোলু (ভাগচাষ) রূপে।
এই সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ-এর ধাক্কা, তার সাথে করের অত্যধিক বোঝা ও জমিদারদের পাওনার বহর অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের আয়ের চেয়ে বেশি হয়ে উঠতো আর তারা হয়ে উঠতো চরম অভাবগ্রস্ত। এইসব দরিদ্র কৃষকরা শেষ পর্যন্ত গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে শহরে গিয়ে আশ্রয় নিত ও শিল্প-শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়ে যেত।
রাশিয়ার পুঁজিবাদী বিকাশ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু তার একটা অন্তরনিহিত দূর্বলতা ছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির তুলনায় রাশিয়া অনেক পশ্চাদপদ অবস্থায় ছিল। গ্রাম থেকে ব্যাপক পলায়ন সত্বেও ১৮৯০-এর দশকে মোট জনসংখ্যার এক ষষ্ঠমাংশই কেবল মাত্র বড়-ছোট শিল্পোদ্যোগে কর্মরত ছিল। বাকি অংশ ছিল কৃষি নির্ভর। তার থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে রাশিয়া আর্থিক ভাবে নিম্ন পুঁজিবাদী দেশ ছিল। শ্রমিকদের জীবন খুব কষ্টকর ছিল। তাদের ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো, মজদুরি ছিল কম এবং শ্রমিক সুরক্ষামূলক কোনো আইন ছিলনা। বহু সংখ্যক শ্রমিকদের ৭ - ৮ রুবল মাস মাইনে-তে জীবন নির্বাহ করতে হতো ও সর্বাধিক মজুরি ছিল মাস প্রতি ৩৫ রুবল। এই কঠিন জীবন যাত্রায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠা শ্রমিকদের পক্ষে সংগঠিত হওয়া ও সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
১৮৭০ - ৮০'র দশকে হওয়া অগনিত হরতালগুলি ছিল, শ্রমিকদের ওপর অত্যধিক অর্থদণ্ড, মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে ধোঁকাবাজি তথা বিলম্ব প্রভৃতির বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই ধরনের সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে এগিয়ে থাকা অংশ অনুভব করলো যে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তীব্রতর করতে হলে তাদের সংগঠিত হতে হবে। এই ভাবে ১৮৭৫-এ দক্ষিন রাশিয়ার ওডেসায় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে, যা মাত্র আট-নয় মাস অবধি টিকে ছিল এবং জারশাহী তা পিষে ফেলতে সমর্থ হয়েছিল। এর পর ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের প্রয়াস শুরু হয় ১৮৭৮-এ (নর্দার্ন ইউনিয়ন অফ রাশিয়ান ওয়ার্কার্স), সেন্ট পিটার্বাসবার্গ-এ। এর নেতা ছিলেন খাল্তুরিন (মিস্ত্রি) ও ওর্বোনোস্কী (ফিটার)। এর কর্মসূচী তে বলা হয়েছিল যে তাদের উদ্দেশ্য, পশ্চিম ইউরোপের সমাজবাদী গণতন্ত্রিক পার্টির কর্মসূচীর অনুরূপ। এটা ছিল দীর্ঘকালীন উদ্দেশ্য। তৎকালিন উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করা। তৎকালিন দাবীর মধ্যে কাজের ঘন্টা কম করার দাবীও ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই জারশাহী এই ইউনিয়নকেও পিষে ফেলে। কিন্তু শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে ও আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হতে থাকে।
শ্রমিক হরতালের ধারাবাহিকতায় মোরোজোবী মিল-এর হরতাল ঐতিহাসিক বলে মানে করা হয়। এই কারখানায় কর্মরত ৮০০০ শ্রমিকের জীবন ছিল নারকীয় স্তরের। মজুরি কম করে দেওয়া এবং শ্রমিকদের আর্থিক দন্ড ধার্য করা, অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৮৮২ ও ১৮৮৪-তে দু'বার মজদুরি কমানো হয়েছিল এবং ১৮৮৫-তে এক লপ্তে ২৫ শতাংশ মজুরি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হরতালের পর শ্রমিকদের ওপর চলা মোকদ্দমা কালীন সময়ে এই তথ্য উঠে আসে যে শ্রমিকদের প্রতি এক রুবল আয় থেকে ৩০ থেকে ৫০ কোপেক পর্যন্ত রাশি আর্থ-দন্ড রূপে পুঁজিপতিদের পকেটে চলে যেত।
এই হরতালের প্রস্তুতি আগে থেকেই করা হয়েছিল। এর নেতা ছিলেন প্য়োত্রো মইসিয়েঙ্কো। তিনি নর্দান ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন ও বিপ্লবী আন্দোলনের অভিজ্ঞতাও তার ছিল। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্য়োত্রো ও হরতালের অগ্রণী নেতৃবৃন্দ গোপন বৈঠকে নিজেদের দাবীপত্র তৈরি করে নিয়েছিলেন, যার প্রথম দাবী ছিল --- অর্থ-দন্ড চাপানোর নৃশংস প্রথার অবসান। সৈন্য শক্তির হস্তক্ষেপে এই হরতাল দমন করা হয়েছিল। ৬০০'র শি শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ২০ জনের ওপর মোকদ্দমা চালানো হয়েছিল।
তা সত্ত্বেও সেই বছরই অন্যান্য কারখানায়ও হরতালের বিস্ফোরণ হতে থাকে। এই সমস্ত কিছুর চাপে জারশাহী এক নতুন আইন প্রণয়নে বাধ্য হয় যে, --- শ্রমিকদের ওপর অর্থ-দন্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ পুঁজিপতিদের পকেটে যাবেনা, বরং শ্রমিকদের কল্যাণেই তা খরচ করা হবে। এটা শ্রমিকদেরই জয় ছিল। সামান্য জয়, কিন্তু গুরুত্ত্বপূর্ণ।
যে সময় শ্রমিকদের সংগ্রাম নতুন নতুন শিখর অতিক্রম করছিল, জারশাহীর সমস্ত রকমের দমন পীড়নের মোকাবিলা করছিল, সেই সময়ই বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের নির্বাসিত গোষ্ঠী এই সংগ্রামী শ্রমিকদের মধ্যে মার্কসবাদের প্রচার-প্রসারের যথা সম্ভব প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিল। এই বিষয়ে প্লেখানভের কী ভূমিকা ছিল তার বিস্তৃত আলোচনা আগেই করা হয়েছে। সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মার্কসবাদকে শ্রমিকদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের দিশা নির্দেশক সিদ্ধান্ত রূপে স্থাপিত করা তথা রুশ বিপ্লবকে জয়ের শিখরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ সম্পুর্ন করেন লেনিন।
লেনিন যে সময়ে (১৮৯০-এর দশক) রাশিয়ার বিপ্লবী রাজনীতি তে প্রবেশ করছিলেন, সেই সময় দেশের শিল্প-বিকাশের গতি ছিল তীব্র, শ্রমিকদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল ও এই শ্রেণী দেশের রাজনৈতিক জীবনে ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। ১৮৮০'র দশকে নারদনিকবাদের পরাজয়ের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, ইতিমধ্যে তা সম্পূর্ণ হয়ে গেছিল এবং মতাদর্শগত স্তরে প্লেখানভ, মার্কসবাদকে ভবিষ্যত বিপ্লবের দিশা নির্দেশক সিদ্ধান্ত রূপে স্থাপিত করে ফেলেছিলেন ।
সেই কারনে লেনিন অল্প সংখ্যক শ্রমিকদের মধ্যে মার্কসবাদের প্রচার সীমিত না রেখে, বরং আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিশাল জন সমষ্টির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।১৮৯৫ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে তিনি এই কাজ শুরু করেন।
১৮৯৬-এ লিগ অফ স্ট্রাগল এর নেতৃত্বে ৩০,০০০ টেক্সটাইল শ্রমিকরা হরতাল করেন। তাদের মূল দাবি ছিল কাজের ঘন্টা কম করতে হবে। এইসব হরতালের চাপে জারশাহী ২ জুন ১৮৯৭-এ সাড়ে এগারো ঘন্টা শ্রম দিবসের আইন প্রণয়ন করে। লেনিন ও তাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীকে ১৮৯৫-এ গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওনাদের গ্রেফতারের পরে লীগ-এর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। নতুন নেতৃত্ব এই চিন্তাধারার প্রবক্তা ছিল যে শ্রমিকদের নিজেদের সংগ্রাম কেবলমাত্র আর্থিক দাবি দাওয়ার মধ্যেই কেন্দ্রীভূত রাখা উচিত। রাজনৈতিক বিষয় ভিত্তিক সংগ্রাম শ্রমিকদের কাজ নয়, এই কাজ উদারবাদী পুঁজিপতিদের। পরবর্তী কালে এই সব লোকেদের অর্থনীতিবাদী রূপে চিহ্নিত করা হয়। রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলনে এরা ছিল, প্রথমে অর্থনীতিবাদী এবং পরে সমঝোতাবাদী ও সুবিধাবাদী। অর্থনীতিবাদ, রাশিয়ায় জন্ম নিতে থাকা সামাজিক গণতন্ত্রিক ধারায় দৃশ্যমান কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এর শিকড় নিহিত ছিল আন্তর্জাতিক সমাজবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। এর বিরুদ্ধে লেনিনের সুসঙ্গত মতাদর্শগত সংগ্রামের আলোচনা আমরা পরে করব।
লেনিন, শ্রমিকদের মাঝে সংগঠিত সকল মার্কসবাদ অধ্যয়ন গোষ্ঠীগুলিকে একজোট করে 'লীগ অফ স্ট্রাগল ফর ইমেনশিপেশন অফ ওয়ার্কিং ক্লাস'-এর গঠন করেন। সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক আন্দোলনের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সর্বপ্রথম এই দলই।
রাশিয়ায় শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, নিত্য নৈমিত্তিক সংগ্রামে তাদের অংশ গ্রহণ ও তাদের মধ্যে বৈপ্লবিক মতাদর্শ রূপে মার্কসবাদের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া জনপ্রিয়তার পরিবেশে রুশী সমাজিক গণতন্ত্রিক শ্রমিক পার্টি (আর এস ডি এল পি)'র প্রথম কংগ্রেস ১৮৯৮ সালে মস্কো তে অনুষ্ঠিত হয়। এই ঐতিহাসিক কাজের কৃতিত্ব লেনিন দ্বারা স্থাপিত লীগ অফ স্ট্রাগল (পীটার্সবার্গ, মস্কো, কিয়েভ প্রভৃতি স্থানের) ও বুন্দ-এর প্রাপ্য ছিল। বুন্দ ছিল ইহুদীদের সামাজিক গণতন্ত্রিক সঙ্ঘ। এই কংগ্রেস কিয়েভ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা, 'রাবোচায়া গাজেতা' কে নিজেদের মুখপত্র রূপে স্বীকার করে। ১৮৯৭-এ এই পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল - আগস্ট ও ডিসেম্বরে। তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হতে পারেনি, জার এর পুলিশ এই পত্রিকার মুদ্রণ কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিল। নবগঠিত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সমস্ত সদস্যদের গ্রেফতারও করে নেওয়া হয়েছিল।
এই কংগ্রেসে ছ'টি সংগঠনের মাত্র ন'জন প্রতিনিধি কে নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে লেনিন ছিলেন না, তিনি সেই সময় সাইবেরিয়ায় নির্বাসনের শাস্তি ভোগ করছিলেন। রাশিয়ায় সামাজিক গণতন্ত্রিক মজদুর পার্টি গঠনের এটা ছিল প্রথম প্রয়াস। ঐতিহাসিক কার্যকলাপের নিরিখে ও পার্টি গঠন প্রক্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্ত বোধ উদ্রেককারি হওয়ার নিরিখে এই কংগ্রেসের যতই গুরুত্ব থাক না কেন, সেই সময় রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের দিশা নির্দিষ্ট করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এর কোন বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। প্রকৃতপক্ষে পার্টি নির্মাণ হয় ১৯০৩-এর দ্বিতীয় কংগ্রেস ও ১৯০৫-এর তৃতীয় কংগ্রেসে। তবুও এই কংগ্রেস সেই পরিস্থিতি গড়ে তুলতে পেরেছিল ও সেই সমস্ত মতাদর্শগত দূর্বলতাগুলিকে নির্দিষ্ট করতে পেরেছিল, যার বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রকৃত পার্টি নির্মাণের জমি তৈরি করা গেছে। এবং এই কাজ করেন লেনিন।
এই সংগঠনের বেশ কিছু দুর্বলতা ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দূর্বলতা ছিল শ্রমিক শ্রেণী দ্বারা রাষ্ট্রশক্তি দখলের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। এর দ্বিতীয় দূর্বলতা ছিল পার্টিতে শ্রমিক শ্রেণীর প্রাধান্য সম্পর্কিত কোন আলোচনা ছিল না আর তৃতীয় দূর্বলতা ছিল, জারশাহী তথা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিক শ্রেণীর সহযোগী শ্রেণীকে চিন্হিত না কর। তার সাথে আরও দূর্বলতা ছিল। বেশ কিছু মার্কসবাদী অধ্যয়ন গোষ্ঠী এর বাইরে থেকে গিয়েছিল, যাদের সংগঠনে টেনে আনা যেত। সংগঠনের কাজ করার জন্য সমরূপ নিয়ম-নীতিও তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
এইসব দূর্বলতার ফল স্বরূপ নিচের স্তরে মতাদর্শগত বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং শ্রমিক আন্দোলনে সংশোধনবাদের জমি তৈরী হয়েছে।
রুশী সর্বহারার শ্রেণীর ইতিহাসে ১৮৮৪-৯৪-এর সময়কালকে নারদনিকবাদের ওপর মার্কসবাদের জিত ও সামাজিক গণতান্ত্রিক পার্টি নির্মাণের প্রস্তুতি-কাল রূপে গণ্য করা হয়, আবার ১৮৯৪-এর পরবর্তী পর্যায়কে অর্থনীতিবাদী বিচ্যুতি ও আভ্যন্তরীণ ভাঙ্গা গড়ার কাল বলে মনে করা হয়। সেইজন্য প্রথম পর্যায়টিতে প্লেখানভের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, এমন মানুষ-জন বা এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে মার্কসবাদী পার্টি গড়ে তোলা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে যুবক লেনিনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনীতিবাদের উঠতি ধারার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালানো, সুবিধাবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে সুস্পষ্ট রেখা টেনে দেওয়া এবং সুবিধাবাদীদের বিতাড়িত করে মার্কসবাদীদের একটি নিয়মনিষ্ঠ পার্টির মধ্যে সংগঠিত করা।
আজ সেই প্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা বিশেষ জরুরী, যেটি কার্যকর করার মাধ্যমে লেনিন সংশোধনবাদের ওপর জিত হাসিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কারণ আমরা আজ তার থেকেও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি।
অর্থনীতিবাদ কেবলমাত্র রুশিয়ার সামাজিক গণতন্ত্রের সমস্যা ছিলনা। এর উৎপত্তির কেন্দ্র ছিল খোদ ইন্টারন্যাশনাল ও তার জনক জার্মানির এডোয়ার্ড বার্নস্টাইন ও ফ্রান্সের আলেসানদ্রা মিলেরোঁ। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন এডোয়ার্ড বার্নস্টাইন। ওনার খ্যাতির পরিমাপ এই তথ্য দ্বারা আন্দাজ করা যেতে পারে যে এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর ওনার সাহিত্যিক (বস্তুত রাজনৈতিক) উত্তরাধিকারের সংরক্ষণও প্রকাশিত করার দায়িত্ব অগস্তা বেবেল এর সাথে ওনাকেই সমর্পণ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮৯৭ - ৯৮ য়েই উনি বিপরীত পথ ধরেন। ১৮৯৯-এ তাঁর বই 'সমাজতন্ত্রের পূর্বাকাঙ্খা ও সামাজিক গণতন্ত্রের কর্তব্য' প্রকাশনের পর ওনার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে।
তিনি এই কথার ওপর জোর দেন যে 'কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার', 'পুঁজি' ও অন্যান্য রচনায় মার্কস এঙ্গেলসের কিছু চিন্তাধারা হয় ভূল অথবা পুরনো হয়ে গেছে। সেইজন্য তাঁদের সিদ্ধান্ত গুলিকে শোধরানো তথা বিকশিত করার কাজ ওনাদের সমালোচনার মাধ্যমেই শুরু হওয়া উচিত। ওনার এই বিশ্লেষণের ফলস্বরূপ মার্কসবাদীদের মধ্যে একটি শিবির তৈরি হয় যারা রাশিয়ায় 'সমালোচনার স্বাধীনতা'র পক্ষে বড়সড় সওয়াল-কর্তা হয়ে ওঠে। এরা মার্কসবাদের কী ধরনের সমালোচনার পক্ষপাতী ছিল তার ব্যাখ্যা লেনিন 'কি করিতে হইবে' (What is to be done) পুস্তকে বিস্তারিত ভাবে করেছেন।
সেই সমালোচনার দিশার এক ঝলক বার্নস্টাইনের রচনায়ও পাওয়া যায়।
উনি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এর সিদ্ধান্ত গুলিকে খারিজ করেন ও কান্ট এর দর্শনে ফিরে
যাবার উপদেশ দেন। তিনি এ কথা পর্যন্ত বলতে দ্বিধা করেননি যে উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব
নেহাত কল্পনা প্রসূত এবং তা প্রমাণ করা মুশকিল। আজ এই কথাই লোহিয়াপন্থী ও ভিন্ন ভিন্ন
প্রকারের অন্যান্য সমাজতন্ত্রীরা এমন ভাবে বিবৃত করে যেন তারা কোন আশ্চর্য আবিষ্কার
করে বসেছেন। মার্কসবাদের আত্মা, 'সর্বহারার একনায়কত্ব'কে
খারিজ করে ওনারা বলেছেন যে এটা ভুল ও লুপ্ত হয়ে যাবার যোগ্য একটি চিন্তাধারা।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রশক্তি কে ধ্বংস করার মার্কসবাদী চিন্তাধারার
বিপরীতে বার্নস্টাইনের পরামর্শ ছিল যে শ্রমিক শ্রেণীর উচিত বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি কে
এতটা সক্ষম করে তোলা যাতে তা সামাজিক সংস্কারের লীভার (lever) হয়ে দাঁড়ায় ও তারপর তা
বিলোপের কল্পনা করা যেতে পারে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কে বিলোপের সিদ্ধান্ত গড়ে তোলা বার্নস্টাইন,
হিংসাশ্রয়ী গতিবিধি ও জনগনের কার্যকলাপ কে বিদ্ধংসী শ্রেণীভূক্ত করে শ্রমিকদের, পুঁজিপতিদের
সাথে মিলে মিশে সংস্কার আন্দোলন চালাবার মন্ত্র দিয়েছেন।
কথা প্রসঙ্গে এও জেনে নেওয়া যাক যে এই বার্নস্টাইনী ফাঁপা বুলির উৎসটি কোথায় ছিল। বস্তুত সেটি ছিল ১৮৯০ এর দশকে পুঁজিবাদী জগতের সাময়িক ফুলে ফেঁপে ওঠার মধ্যে। এর থেকে তিনি এই সিদ্ধান্ত টেনে আনেন যে গ্রাম থেকে শহর অবধি সমৃদ্ধশালী অংশের সংখ্যা বাড়ছে, কার্টেল ও ট্রাস্ট এর স্থাপনার পর অতি উৎপাদন কে কেন্দ্র করে সঙ্কট অতীতের কাহিনী হয়ে গেছে, সর্বহারার দারিদ্রের দিন এখন অতিক্রান্ত হয়েছে, শ্রেণী বিরোধ শেষ হওয়ার মুখে এবং শ্রেণী সংগ্রাম অতীতের বিষয় হয়ে গেছে। আর তাই, উপসংহার হিসেবে ওনার বক্তব্য হচ্ছে --- 'সমাজতন্ত্রের অন্তিম লক্ষ্য হিসেবে যা বলা হয়ে থাকে, তা আমাদের ধর্তব্যের মধ্যেই নয়, আমাদের কাছে আন্দোলন ই সবকিছু'। তার মানে আন্দোলনের দিশা কিছুই নয়,গতিই সব কিছু।
বার্নস্টাইনের এই অধঃপতনের বিরুদ্ধে প্রায় সমস্ত খ্যাতিপ্রাপ্ত নেতা, কাউটস্কি, বেবেল, লিবনেখ্ট, প্লেখানভ, মেহেরিং প্রভৃতি, দৃঢ়তার সাথে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
আজও মার্কসবাদী নামধারী কিছু সংগঠনের কার্যকলাপে বার্নস্টাইন-বাদ প্রভাব বিস্তার করেছে আর তাদের পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীরা সেটিকেই মার্কসবাদ মনে করায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে ।
এই ছিল রুশী অর্থনীতিবাদের আন্তর্জাতিক উৎস। কিন্তু শুধুমাত্র এটুকুই জানা যথেষ্ট নয়। আমাদের বুঝতে হবে যে রাশিয়ায় অর্থনীতিবাদের শেকড় কোথায় ছিল এবং তা কোথা থেকে রস সংগ্রহ করছিল।
১৮৯০-এর দশকে রাশিয়ায় মার্কসবাদের আরও একটি একপেশে ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করা হয়েছিল, --- কেবলমাত্র সেই অধ্যায়টিকেই তুলে ধরা হয়েছে যেখানে মার্কস-এঙ্গেলস পুঁজিবাদের প্রশংসা করেছেন। বস্তুত তাঁদের এই প্রশংসা ছিল সামন্ততন্তকে ধ্বংস করে সমাজ কে অগ্রগতি প্রদান করার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের ভূমিকা প্রসঙ্গে এবং সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়া বোঝানোর জন্য যা ছিল একান্ত ভাবে জরুরি। যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা এই একপেশে বক্তব্য রাখার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন, রাশিয়ার ইতিহাসে তারা 'আইনি মার্কসবাদী' রূপে পরিচিত। পরবর্তী কালে এঁরা 'সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক (পুঁজিবাদী) পার্টির মূল স্তম্ভ হয়ে ওঠেন ও তার নেতা ছিলেন পিটার স্ত্রূভে। স্ত্রূভে এই ভাবনার বশবর্তী ছিলেন যে রাশিয়া সাংস্কৃতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা দেশ এবং এগিয়ে যাবার জন্য তার পুঁজিবাদী শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজন।
যেই সময় জারশাহীর নজর পুরোপুরি নিবদ্ধ ছিল নারদনিকবাদীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্যে, সেই সময় 'আইনি মার্কসবাদী'রা সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখে নিজেদের প্রচার চালাতো। এই মঞ্চের সদব্যবহার সেই সময়ে লেনিনের মতো সাচ্চা মার্কসবাদীরাও করেছিলেন। এই কাজ সুফল প্রদানকারি ছিল, কিন্তু মার্কসবাদী শিবিরে তা মিশ্র-প্রভাবের জন্ম দিয়েছিল। একদিকে মতাদর্শগত ভাবে দূর্বল অংশটি সেইদিকে আকর্ষিত হয়েছে আবার আরেকদিকে অর্থনীতিবাদের ভিতও মজবুত হয়েছে। ১৮৯৯ সালে রাশিয়ায় অর্থনীতিবাদীদের এক গোষ্ঠী (প্রোপোকোভিচ-এর নেতৃত্বে) একটি ইশতেবার প্রকাশ ক'রে আপিল করে যে সর্বহারা শ্রেণীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পার্টি তৈরি করার চিন্তা ত্যাগ করা উচিত। এই আপিলের সাথে, বার্নস্টাইনের কথার সাথে কত মিল! পরে এরাই 'সাংবিধানিক গণতন্ত্রী' হয়ে ওঠে।
লেনিন অর্থনীতিবাদীদের সঙ্গে তীব্র সংগ্রাম করেন এবং বিপ্লবী
পার্টি নির্মাণের ওপর জোর দেন। এই কাজের শুভারম্ভ তিনি 'ইস্ক্রা' নামক রুশী পত্রিকার
মাধ্যমে করেন। এই পত্রিকার কাজ ছিল সামাজিক গণতন্ত্রের চিন্তাধারার প্রচার এবং তার
চারপাশে বিপ্লবীদের জড়ো করা। লেনিনের শিক্ষার ভিত্তিতে অর্থনীতিবাদের কিছু উল্লেখযোগ্য
বৈশিষ্ট্য নিম্নোক্ত রূপে চিহ্নিত করা যায় :
* অর্থনীতিবাদ শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলার সচেতন
প্রয়াসের বিপরীতে তাদের স্বতস্ফূর্ত বিকাশের ওকালতি করে।
* এই মতবাদ শ্রমিকদের পুঁজিবাদী রাজনৈতিক পার্টির বিরুদ্ধে
সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি গঠনের পরিবর্তে তাদের শুধুমাত্র ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলনের
মধ্যে সীমিত রাখার চেষ্টা করে।
* অর্থনীতিবাদীরা আর্থিক সংগ্রামের ওপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করে
এবং রাজনৈতিক সংগ্রামকে অবহেলা করে। এই ভাবে তারা শ্রমিকদের পুঁজিবাদের ধামাধরা বানিয়ে
দেওয়ার চেষ্টা করে।
* অর্থনীতিবাদীরা সংগ্রামের স্থানীয় বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় গুলিকে উপেক্ষা করে।
লেনিন শ্রমিকদের মধ্যে মার্কসবাদী চিন্তাধারার গুরুত্ব কে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। প্রথমত, আর্থিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে মতাদর্শগত সংগ্রাম নেহাত জরুরি এবং বিপ্লবের নেতৃত্ব সেই পার্টিই করতে পারে যে সবচেয়ে উন্নত মতাদর্শের দ্বারা নির্দেশিত হয়। ফলে যথার্থ ভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে এই মতাদর্শ যাবে কি করে ও কাদের দ্বারা? এই সমস্ত প্রশ্নেরই জবাব দিতে গিয়ে লেনিন দ্বিতীয় বিষয়ের উপর জোর দেন যে শ্রমিকদের মধ্যে মতাদর্শগত চেতনা সব সময়ই বাইরে থেকে যায়, অর্থাত ট্রেড ইউনিয়নের নিত্য নৈমিত্তিক আর্থিক সংগ্রামের বাইরে থেকে আসে ও তাদের মধ্যে সেই চেতনা নিয়ে যাবার কাজ করে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা। উন্নত পুঁজিবাদী দেশে এটা সম্ভব ছিল যে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে থেকেই এই রকম বুদ্ধিজীবী জন্ম নিতে পারে, কিন্তু রাশিয়ার মত পিছিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশে শ্রমিক শ্রেণীকে এই কাজের জন্য নিম্ন-পুঁজিবাদী বুদ্ধিজীবীদের ওপরেই নির্ভর করতে হয়েছে।
এই বিতর্কের মাধ্যমে লেনিন বিপ্লবী পার্টি নির্মাণের মৌলিক
বিষয় ও শর্তাবলীর রচনা করছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি দুটি প্রশ্নের সোজা-সাপটা উত্তর
দিয়ে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান করে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন গুলি ছিল --- শ্রমিকদের
ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির মধ্যে কী পার্থক্য তথা অর্থনীতিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের
মধ্যে কী সামঞ্জস্য আছে ? প্রশ্ন দুটিরই জবাব লেনিনের কথাতেই জেনে নেওয়া ভাল। প্রথম
প্রশ্নের জবাবে ওনার বক্তব্য ছিল ---
'শ্রমিকদের সংগঠনকে প্রথমত ব্যাবসিয়িক সঃগঠন হতে হবে, দ্বিতীয়ত তা যত বেশি সম্ভব ব্যাপক হওয়া চাই, আর তৃতীয়ত এর জন্য জরুরি যে সেটি যথা সম্ভব কম গোপনীয় হবে'। এর বিপরীত, 'বিপ্লবী সংগঠনকে সর্বপ্রথম ও প্রধানত এমন লোকেদের সংগঠন হতে হবে যারা বিপ্লবের কাজকে পেশাগত ভাবে গ্রহণ করেছে, আর যেহেতু এই বিশেষত্ব সংগঠনের সকল সদস্যদের মধ্যেই থাকা বাঞ্ছনীয়, তাই এটাও আবশ্যক যে, কেবল শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেকার ভেদাভেদই নয়, বরং আলাদা আলাদা ব্যাবসা বা পেশার সমস্ত ভেদাভেদ সম্পূর্ন মিটিয়ে ফেলতে হবে। এরকম সংগঠনের জন্য এটাও জরুরী যে তা খুব বেশি ছড়িয়ে থাকা না হোক এবং সর্বাধিক গোপনীয় হোক'।
এই কর্মদায়ীত্বকে কেন্দ্র করে লেনিন পেশাদার বিপ্লবীদের সংগঠনের
পক্ষে সওয়াল করেন। পেশাদার বিপ্লবীদের এই সংগঠনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যে এর মধ্যে
এরকম কোন বিভেদ থাকেনা যে কে শ্রমিক শ্রেণী থেকে এসেছেন বা কে বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে।
সংগঠনের এই প্রয়োজন কে লেনিন নিম্নলিখিত সূত্রে নিরূপিত করেন।
* নেতাদের একটি স্থায়ী ও ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে যেতে সক্ষম
সংগঠন ছাড়া কোন বিপ্লবী আন্দোলনই টিকে থাকতে পারেনা।
* যত বেশি সংখ্যায় ব্যাপক জনসাধারণ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে আকর্ষিত
হয়ে আন্দোলনের ভিত্তি হয়ে উঠবে ও তাতে অংশ গ্রহণ করবে, এই ধরনের সংগঠন গড়ে তোলা তত
জরুরী হয়ে উঠবে এবং সংগঠনকে ততটাই বেশি মজবুত করে তুলতে হবে।
* এই ধরনের সংগঠনে প্রধাণত এমন লোকেদের থাকা উচিত যারা বিপ্লবের
কাজকে পেশা রূপে গ্রহণ করেছে।
* নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রে এই ধরনের সংগঠনের সদস্যতাকে আমরা যত বেশি
সম্ভব এমন লোকেদের মধ্যে সীমিত রাখবো যারা পেশাদার বিপ্লবী এবং যারা রাষ্ট্রের পুলিশ
বাহিনী কে মাত করে দেবার বিদ্যা রপ্ত করেছে।
* শ্রমিক শ্রেণী ও সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর অধিকাধিক মানুষের পক্ষে এক্ষেত্রে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করা ও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া সম্ভবপর হবে।
এ সম্পর্কে লেনিনের মনে রাখার মত একটি উক্তি হচ্ছে --- পদার্থ বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস বলেছিলেন যে, তোমরা যদি আমাকে এমন একটি লিভার (lever) দাও যার কেন্দ্র থাকবে আকাশে, তাহলে আমি পৃথিবীটাকে উল্টে দেবো। এই বিষয়েই লেনিনের উক্তি ছিল যে আমাকে বিপ্লবীদের সংগঠন।দাও, আমি যে কোন সরকারকে গদিচ্যুত করে দেবো। কিন্তু এর সাথেই হিমালয় পর্বতের মত বিশাল প্রশ্ন উঠে আসে যে এরকম শক্তি আসবে কোথা থেকে এবং তা জন্ম নেবে কি করে ?
এই সমস্যার সমাধানের জন্য লেনিনের দ্বিতীয় প্রশ্নের দিকে ফেরা যাক --- সন্ত্রাসবাদী ও অর্থনীতিবাদীদের মধ্যে কী মিল রয়েছে ? লেনিনের জবাব হচ্ছে যে এই দুই পক্ষই জনগণের স্বতস্ফূর্ততার পুজো করার দৃষ্টিতে একে অপরের সমান। 'অর্থনীতিবাদী ও সন্ত্রাসবাদীরা স্বতস্ফূর্ততার দুটি আলাদা- আলাদা দিকের পুজো করে, অর্থনীতিবাদীরা বিশুদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের সতস্ফূর্ততার পূজো করে, আবার সন্ত্রাসবাদীরা সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের জ্বলন্ত ক্রোধের স্বতস্ফুর্ততার পূজো করে যাদের মধ্যে বিপ্লবী কাজকে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত করার ক্ষমতা, হয় থাকেনা অথবা তারা সেই সুযোগ পায়না। যারা এই তত্ত্বের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে অথবা যারা কখনো এই তত্ত্ব বিশ্বাস করেনি, তাদের পক্ষে ক্রোধ অথবা বিপ্লবী সক্রিয়তা ব্যক্ত করার জন্য সন্ত্রাস ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোঁজা সত্যিই কঠিন'।
লেনিনের এই মতাদর্শগত সংগ্রাম, মার্কসবাদে এক বিরাট সংযোজন। তিনি সংশোধনবাদের মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক শেকড়গুলিকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন এবং বিপ্লবী সংগঠনের এক নতুন মাণদন্ড স্থাপিত করেছেন। মার্কসের উক্তি ছিল : শ্রমিক শ্রেণী হয় বিপ্লবী হবে নয়ত কিছুই নয়। লেনিন এই সূত্র কে বিকশিত করেছেন এবং সেই সমস্ত পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন যার দ্বারা 'কিছুই নয়' কে বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত করা যায়, শুন্য থেকে শুরু করে সর্বহারা বিপ্লবের জয় পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়।
রাশিয়ার তৎকালীন পরিস্থিতি সেই প্রক্রিয়া শুরু করার মত অনুকূল
হয়ে গিয়েছিল। বার্নস্টাইন বিশ্ব পুঁজিবাদের মানুষখেকো চেহারার ওপর মানবপ্রেমিক হওয়ার
যে মনোরম প্রলেপ লেপন করেছিল, তার পরত চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই খসতে শুরু করে। ইউরোপ
১৯০২-০৩ এর মধ্যে শিল্প সঙ্কটে ফেঁসে গিয়েছিল, যার প্রভাব পড়েছিল রাশিয়ায়ও। সেই সঙ্কটে
এক লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পথে বসেছিল আর যারা চাকরি বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে তাদের বেতন
হ্রাস করা হয়েছিল। এর ফলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে এবং মে ১৯০১-এ, সেন্ট
পীটার্সবার্গে ও মার্চ ১৯০২-এ বাতুম-এ জবরদস্ত হরতাল হয়। বহু জায়গায় শ্রমিক ও পুলিশের
মধ্যে সংঘর্ষের মত পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং শ্রমিকদের মধ্যে থেকে 'নিরঙ্কুশ জারশাহী
মুর্দাবাদ' শ্লোগান উঠতে থাকে। ১৯০২-এ ইউক্রেন ও ভোল্গা অঞ্চলে কৃষকেরাও পথে নেমে এসে
শ্রমিকদের সাথে হাত মেলায়। তারা জমিদারদের মহল ভস্মীভূত করতে থাকে, তাদের জমি দখল করতে
থাকে এবং মারতে ও মরতেও ময়দানে নেমে পড়ে। বিদ্রোহের এই স্ফুলিঙ্গ ছাত্র যুবকদের মধ্যেও
ছড়িয়ে পড়ে ও জারশাহী কে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হয় এবং হাজার হাজার ছাত্রদের জেলে
পোরা হয়।
রুশী সামাজিক গণতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস :
জুলাই ১৯০৩-এ সম্পন্ন হওয়া সামাজিক গণতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস তথা ১৯০৫-এর তৃতীয় কংগ্রেস, রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে রয়ে গেছে। এই দুই কংগ্রেসের মাধ্যমেই পার্টির মজবুত ভিত্তি স্থাপন ও বিপ্লবের মূল রণনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় কংগ্রেসের সূচনা করা হয় ব্রাসেল্স-এ, কিন্তু পরে বেলজিয়াম পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদের শহর ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ করা হয়। সেই কারণে পরবর্তী বৈঠক লন্ডন-এ অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ২৬ টি সংগঠনের ৪৩ জন প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করেন। এই কংগ্রেসের মূল উদ্দেশ্য ছিল 'ইস্ক্রা' মারফত প্রতিপাদিত সিদ্ধান্তসমূহ ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে বাস্তবিক পার্টির নির্মাণ করা। কংগ্রেস নিজস্ব মূল উদ্দেশ্য সাধনে সফলও হয়। এই কংগ্রেসে স্বীকৃত কর্মসূচী বিপ্লবের সম্পুর্ণ কালাবধিতে দিশা নির্দেশক তত্ত্ব হিসাবে কার্যকরী হয়। বিপ্লবের পর অনুষ্ঠিত অষ্টম কংগ্রেসেই কেবল এই কর্মসূচী ও দিশা নির্দেশক তত্ত্ব বদল করে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
এই পরিবর্তন সম্ভব হয় এই কারণে যে বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত সকল প্রশ্নেই ভরপুর বিতর্ক হয় এই সম্মেলনে। অন্য ভাবে বলা যায় যে , ১৮৮৯-এর প্রথম কংগ্রেসে যে সমস্ত প্রশ্নগুলি আলোচনা না করে ছেড়ে আসা হয়েছিল, এখানে সেই সকল প্রশ্নেরই সমাধান করা হয়। কিন্তু এই সকল প্রশ্নে কংগ্রেস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সেই সময়ে বিভাজনের যে রেখা অঙ্কিত হয়,পরে তা বিশাল খাদ-এর আকার ধারণ করে এবং ১৯১৭'র দুটি বিপ্লবেই দুই শিবিরের নেতাকে একে অপরের প্রতি যুদ্ধরত অবস্থায় দেখা যায়। অক্টোবর বিপ্লবের বিজয়ের পর তো পুরো দুনিয়ায় 'বলশেভিক' শব্দটি বিপ্লবের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় ও 'মেনশেভিক' শব্দটি প্রতীক হয় সংশোধনবাদের। এই কংগ্রেসের সম্পুর্ণ বিতর্ক মূলত চারটি বিষয়ে কেন্দ্রিভূত ছিল - সর্বহারার একনায়কত্ব, বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী, পার্টি সঞ্চালনের নিয়মাবলী এবং রীতি নীতি ও জাতীয়তার প্রশ্ন।
রুশী সামাজিক গণতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয় ও তৃতীয় কংগ্রেস একে অপরের পরিপূরক ছিল। দ্বিতীয় কংগ্রেস পার্টি কর্মসূচী, সর্বহারার একনায়কত্বের প্রয়োজন, শ্রমিক শ্রেণীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগীর চিন্হিত করন তথা পার্টির নিয়মাবলী প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেও রণকৌশলগত প্রশ্নের সমাধান করা যায়নি। ১৯০৫-এর বিপ্লবে পার্টির ভূমিকা নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন এত বেশি জরুরী হয়ে উঠেছিল যে তা মুলতবি রাখা যেত না। নিজের বিরোধীদের সাথে লেনিনের বিতর্কের পর্যায়ে এটা প্রতিষ্ঠিত হয় যে পার্টির ঐক্যের স্বার্থে শুধুমাত্র মতাদর্শ ও কর্মসূচীর স্তরে ঐক্যই যথেষ্ট নয় (যেমনটি আজকাল মনে করা হয়ে থাকে), বরং এটাও জরুরী যে কৌশলগত স্তরেও ঐক্য অর্জিত হোক। দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রথম দুটি প্রশ্নে অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও বিভাজন সাময়িক ভাবে স্থগিত থেখে ঐক্যের প্রচেষ্টা করা হয়েছে, যা তৃতীয় কংগ্রেসে পাকাপোক্ত হয়।
শ্রমিক-কৃষক জোটের প্রশ্নে লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মার্কসবাদে এক নতুন অধ্যায় সংযোজনের মত। 'এই তত্ত্ব অনুযায়ী কৃষক সমুদায়ের সাথে সর্বহারার জোট হয়ে গেলে পুঁজিবাদী বিপ্লবে সর্বহারার নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারার নেতৃত্বে বিকশিত হয়ে যাবে। তখন সর্বহারা অন্য মেহনতি ও শোষিত জন-সমুদায়ের সাথে ফ্রন্ট তৈরি করে শ্রমিক-কৃষকের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের প্রয়োগের মাধ্যমে সর্বহারার সমাজতন্ত্রিক একনায়কত্বের জমি তৈরি করবে'- এই ছিল লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি।
এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাশিয়ার বিপ্লব, বিকশিত ইউরোপীয় দেশগুলিতে বিপ্লবের প্রচলিত ধারণার থেকে ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে চলেছিল। সেইসব দেশে এই ধারনা প্রচলিত ছিল যে পুঁজিপতি শ্রেণী পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করবে আর তাতে শ্রমিক শ্রেণী সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তারপর এক প্রলম্বিত অন্তরালের পর যখন পুঁজিবাদী বিকাশ এক নির্দিষ্ট শিখরে গিয়ে পৌঁছবে এবং শ্রমিক শ্রেণী দেশের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ হয়ে যাবে, তখন তাঁরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করবে। এর বিপরীতে লেনিন এই ধারনার ওপর জোর দিয়েছিলেন যে রাশিয়ার পুঁজিবাদী বিপ্লব পুঁজিপতি শ্রেণীর নেতৃত্বে হবেনা, তা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের সম্মিলিত শক্তির দ্বারা সম্পন্ন হবে এবং পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক কর্মসূচী সম্পুর্ন করে সমাজতন্ত্রের পর্যায়ে প্রবেশ করে যাবে।
অপরদিকে প্লেখানভের অভিমত ছিল যে, পুঁজিপতি ও সর্বহারা ছাড়া আমাদের দেশে এমন কোন সামাজিক শক্তি চোখে পড়েনা যেখান থেকে বিপক্ষ বা বিপ্লবী জোট সমর্থন পেতে পারে। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য যথেষ্ট স্পষ্ট। লেনিনের বক্তব্য অনুযায়ী রাশিয়ার পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক বিপ্লবে জারশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে রুশী সর্বহারাকে নিজের সহযোগী খুঁজতে হতো কৃষক সমুদায়ের মধ্যে, আর প্লেখানভের বক্তব্য অনুযায়ী তা খুঁজতে হতো পুঁজিপতি শ্রেণীর মধ্যে। এই সূত্রায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যত বিপ্লবকে দুই নেতার বিরোধী ভূমিকার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
প্লেখানভ রাশিয়ার পরিবর্তিত শ্রেণী-সমীকরণের ছবি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি তখনও এঙ্গেলসের বিশ্লেষণ --- 'জার রুশী কৃষকদের পার্থিব ঈশ্বর' --- সেই দুনিয়াতেই রয়ে গিয়েছিলেন, অথচ বিংশ শতাব্দীর শ্রমিক, কৃষকদের সাথে হাত মেলাতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। এই পরিবর্তন কে লেনিন অনুভব করেন এবং তাকে রাজনৈতিক সূত্রে গেঁথে নেন।
কংগ্রেসে বিতর্কের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল - পার্টি সংগঠনের
স্বরূপ। বিতর্ক এই বিন্দু থেকে শুরু হয় যে পার্টির সদস্য কাকে করা হবে ? লেনিনের মতে
পার্টির সদস্য তাকেই করা উচিত যে ---
* পার্টির কর্মসূচী ও রণকৌশল কে স্বীকৃতি দেয়।
* পার্টি তহবিলে আর্থিক সহায়তা করে ।
* পার্টির কোন একটি সংগঠনে সক্রিয় ভাবে কাজ করে।
মেনশেভিক নেতা মার্তোভ এর প্রথম দুটি শর্ত মঞ্জুর ছিল কিন্তু শেষেরটি নয়।
এই বিবাদ আকস্মিক ছিল না। এর পিছনে একটি রাজনীতি ছিল, যার অনুসারে এবং সংগঠনের স্বরূপ দেখে বোঝা যায় যে তা বিপ্লবী মতবাদ ও সূত্র গুলি নিয়ে অতি বিপ্লবী বাহাদুরি দেখাচ্ছে নাকি সত্যিই তা বাস্তবায়িত করার বিষয়ে যত্নশীল। এই প্রেক্ষিতে নির্ধারিত হয় যে, কেউ মার্কসবাদের অধ্যয়ন ও ভাষণ দেওয়ার মধ্যেই সীমিত থাকতে চায় নাকি সক্রিয় ভাবে তার প্রয়োগ করতেও ইচ্ছুক।
লেনিন বিপ্লবীদের সংগঠন ও শ্রমিকদের সংগঠনের মধ্যে যে ধরনের প্রভেদের বিষয়ে তাঁর পুস্তক 'কি করিতে হইবে'-তে উল্লেখ করেছেন, তা বাস্তবায়িত করার সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত এটাই হতে পারতো। এর প্রতি মনযোগ দিলে একটা কথা পরিস্কার হয়ে যায় যে লেনিনের সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক কর্মসূচি তথা তা বাস্তবায়িত করার পক্ষে উপযুক্ত সাংগঠনিক স্বরূপ নিশ্চিত করার বোধের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য ছিল। এর বিপরীতে প্লেখানভের বোধ এর ক্ষেত্রে না ছিল সামঞ্জস্য না ছিল দৃঢ়তা। তিনি সংগঠনের স্বরূপ সম্পর্কিত বিষয়ে লেনিন এর বোধ এর সাথে একমত ছিলেন কিন্তু শ্রমিক-কৃষক ঐক্য ও সর্বহারার একনায়কত্বের বিষয়ে সহমত ছিলেন না।
যদি এই দুটি কংগ্রেসের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করা হয়, তবে তা রুশ বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন ও তাকে বাস্তবায়িত করার দিশায় এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রূপে প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু ভাঙ্গা-গড়া ও বিচ্ছিন্নতার যে পর্যায় ১৮৯৮-এ শুরু হয়েছিল, তা এই কংগ্রেস রোধ করতে সমর্থ হয়নি। এই কংগ্রেসেই রুশী সামাজিক গণতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় --- বলশেভিক ও মেনশেভিক, আর কিছু লোক এই দুই এর মধ্যে দোদ্যুল্যমান অবস্থায় থেকে যায়। এমন লোকেদের মধ্যে প্লেখানভ ও ট্রটস্কিও ছিলেন।
১৯০৫-এর বিপ্লব :
ডিসেম্বর ১৯০৫-এর বিপ্লব ছিল রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়, - অক্টোবর বিপ্লবের রিহার্সাল। সেইজন্য অক্টোবর বিপ্লবকে স্মরণ করতে গিয়ে এ কথাও বোঝা অত্যন্ত জরুরী যে পূর্ববর্তী সেই বিপ্লব কোন্ পরিস্থিতিতে হয়েছিল এবং কেন তা পরাজিত হয়েছিল ? যেমন আমরা দেখেছি, বিংশ শতাব্দীর আগমন হয়েছিল পুঁজিবাদী অর্থব্যাবস্থার সঙ্কট সঙ্গে নিয়ে এবং রাশিয়া সেই ঘূর্ণাবর্তে আটকে পড়েছিল। শ্রমিক-কৃষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও পুঁজিপতিদের একটা অংশের ওপর অবধি এর ধাক্কা এসে পড়ে। এটা ছিল একটা টগবগে আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আর রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় এই পরিস্থিতিকে আরও বিস্ফোরক করে তোলে।
ইতিপূর্বে ক্রিমিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়, রুশী শাসক-শিবিরকেও অনুভব করিয়ে দিয়েছিল যে জারশাহী'র প্রভাব ক্ষুন্ন করা ছাড়া রাশিয়ার বিকাশ সম্ভব নয়। তারপর জাপানের কাছে এই হার সেই চিন্তাকে দু কদম এগিয়ে দিয়েছিল, কারণ ক্রিমিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার হার হয়েছিল ইউরোপীয় দেশগুলির কাছে, আর তার অবমাননাও ঘটেছিল ইউরোপের মধ্যেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যুদ্ধে হার হয়েছিল এশিয়ার একটি দেশের কাছে আর তার দ্বারা এশিয়ার ওপর ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার ভেঙে গিয়েছিল। বস্তুত এই যুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে যুদ্ধ আর তার উদ্দেশ্য ছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রান্ত কব্জা করা ও চীন-এর ভাগ বাটোয়ারা করা।
এই যুদ্ধের ভিত্তি প্রস্তরের স্থাপনা হয়েছিল ১৯০০ সালের আগেই। সেই বছরেই চীন-এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে চীনা জনতার বিদ্রোহ দমনের জন্য বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশ (বৃটেন, জাপান, জার্মানী, ফ্রান্স ও রাশিয়া) সংযুক্ত সৈন্য অভিযান চালিয়ে ছিল। এই বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল তৎকালীন চীনা সামন্তীরাজ ব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদের জোট দ্বারা দমন এবং ১৯০১-এ, এক সন্ধি মারফত চীনকে এজন্যে ভর্তুকি দিতে হয় এবং সেখানে সামরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুত্বপূর্ণ বহু সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত করা হয়। এই যুদ্ধের আগেই রাশিয়া, পোর্ট-আর্থার সহ চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড কব্জা করে নিয়েছিল। উত্তর মাঞ্চুরিয়ায় রাশিয়ান রেলওয়ের লাইন বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর তার তদারকি করার জন্য রুশী সেনা সেখানে গেড়ে বসেছিল। এরপর জার-এর নজর পড়ে কোরিয়ার দিকে আর সেই দিশায় সে পা-বাড়ায়, আর এটাই ছিল জাপানের সাথে তার সঙ্ঘাতের কারন।
যুদ্ধের প্রাথমিক উদ্যোগ জাপানের তরফ থেকেই নেওয়া হয়েছিল। ১৯০৪-এ তারা আচমকাই পোর্ট আর্থার-এ রুশী সৈন্য শিবিরে হামলা করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তৎকালীন মোড়ল বৃটেন গোপনে জাপানকে সাহায্য করছিল। তারা চাইতো না যে ঐ ভূখন্ডে রাশিয়ার প্রতিপত্তি বাড়ুক। এই যুদ্ধে প্রচুর ধ্বংস-লীলা সংঘটিত হয় আর রাশিয়াকে হারের পর হার স্বীকার করতে হয়। জার ও তার সহযোগীরা ভেবেছিল এই যুদ্ধের অজুহাতে অন্ধ-জাতীয়তাবাদের হাওয়া দিয়ে তারা বিপ্লব দমন করতে সফল হবে। কিন্তু ফল হয় উল্টো ও এই লজ্জাজনক হার বিপ্লবের আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে।
এই যুদ্ধ চলার সময় মেনশেভিকরা 'পিতৃভূমি রক্ষা'র নীতি গ্রহণ করে আর বলশেভিকরা জারশাহীর বিরোধিতা করে। পিতৃভূমি রক্ষার অজুহাতে মেনশেভিকরা জারশাহীর (বড় পুঁজিপতি ও বড় জমিদারদের রাজত্ব) সমর্থন করছিল আর বলশেভিকরা জনসাধারণকে বোঝচ্ছিল যে এই যুদ্ধ থেকে তাদের কিছুই পাওয়ার নেই ও জারশাহীর পরাজয়ের ফলে বড় পুঁজিপতি ও বড় জমিদারদের প্রতিষ্ঠা ঘা খাবে, তারা দূর্বল হবে এবং তাদের দূর্বলতা শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির পথ প্রশস্ত করবে। জারশাহীর হারের পর লেনিনের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া সবকিছু পরিষ্কার করে দেয় --- পোর্ট আর্থার-এর হার বস্তুত একনায়কত্বের পতনের সূত্রপাত। এখানে মেনশেভিকরা পুঁজিবাদী অন্ধ জাতিয়তাবাদের ওকালতি করেছিল আর বলশেভিকরা গ্রহণ করেছিল সর্বহারার নীতি।
ডিসেম্বর ১৯০৪-এ বাকু তৈল ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সুসংগঠিত হরতাল হয়। এই হরতালের নেতৃত্বে ছিল বলশেভিকদের বাকু কমিটি। এই লড়াইয়ে শ্রমিকদের জিত হয় এবং মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সামগ্রিক সমঝোতা হয়। রাশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবার এমন হয়েছিল। এই বিজয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব পর্যালোচনা করতে গিয়ে স্তালিন বলেন -'বাকু হরতাল ছিল সমগ্র রাশিয়ার জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির গৌরবময় কার্যকলাপের সঙ্কেত'।
এই হরতাল প্রকৃতপক্ষে একটি স্ফুলিঙ্গ রূপে কাজ করেছে। ৩ জানুয়ারি ১৯০৫-এ সেন্ট-পিটার্সবার্গ এর কারখানায় হরতাল শুরু হয়। এই হরতাল হয়েছিল চারজন শ্রমিককে বরখাস্ত করার প্রতিবাদে। এরপর যা হয়েছিল তা ইতিহাসে এক আশ্চর্য ঘটনার নিদর্শন। শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে থাকা জার-এর এক এজেন্ট অজান্তেই বিপ্লবের বাহক হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাসনিক ব্যাবস্থার সঞ্চালকেরা বিপ্লব ভ্রমিত করার উদ্দেশ্যে যে কূট কৌশল রচনা করেছিল, বাস্তবে তা বিপ্লবের উৎপ্রেরক রূপে কাজ করে।
সঙ্কটকালিন পর্যায় শুরু হতেই দুটি প্রবৃত্তি সমান্তরাল ভাবে অগ্রসর হতে থাকে। একদিকে শ্রমিকেরা সামাজিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বপক্ষে কেন্রীভূত হতে থাকে, অপরদিকে রাষ্ট্রশক্তি শ্রমিকদের পথভ্রষ্ট করার প্রচেষ্টা তীব্রতর করতে থাকে। এই প্রসঙ্গে দুটি উদাহরণ উল্লেখযোগ্য - প্রথমটি জুবাতোভ শ্রমিক সোসাইটির, যার গঠন ১৯০২-এ করা হয়েছিল এবং যা রুশী ইতিহাসে 'পুলিশ সমাজতন্ত্র' নামে খ্যাত, আর দ্বিতীয়টি ১৯০৪-এ ফাদার গেপোন-এর নেতৃত্বে 'এসেম্বলী অফ রাশিয়ান ওয়ার্কার্স অফ সেন্ট পীটার্সবার্গ'। এই দুটি সংগঠনেরই পরিণতি হয় তার নেতাদের আকাঙ্খার বিপরীত। জুবাতোভ ছিল জারশাহীর বড় পুলিশ অফিসার আর তার উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের মধ্যে এই মতের প্রচার করা যে জারশাহী শ্রমিকদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম এবং ইচ্ছুকও, তাই বিপ্লবের দিকে যাওয়ার কি প্রয়োজন ? কিন্তু তার মতামত ও সংগঠন বিপ্লবের ঝড়ে খড়কুটোর মত উড়ে যায়। একই ভাবে ফাদার গেপোন শ্রমিকদের বোঝাতে চেয়েছিল যে জার হচ্ছেন জনতার পিতা সমান ও করুণার অবতার। কিন্তু এই জার-ই প্রজাদের রক্তস্নাত করে প্রমাণ করে দিয়েছে যে শোষক শ্রেণীর রাষ্ট্রশক্তি কখনও করুণার প্রতীক হতে পারেনা এবং প্রার্থনার ভাষাও বোঝেনা, বোঝে শুধু রণক্ষেত্র ও লড়াই-এর ভাষা।
এবার এই ফাদার এর ভূমিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক। হরতাল যখন
শুরু হয়, এই মহাশয় নিজের সংগঠনের বৈঠকে এক সাঙ্ঘতিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। পরিকল্পনা
অনুযায়ী, ৯ই জানুয়ারি (রবিবার) সমস্ত শ্রমিকদের একত্রিত করে ও চার্চের ব্যানারে জার-এর
ছবি সেঁটে শান্তিপূর্ণ মিছিল করে শীত-প্রাসাদে (জার-এর নিবাস) যাওয়া হবে, যেখানে জার
তাদের সম্মুখে এসে সকলের দুঃখ দুর্দশা শুনবে। এই মিছিলে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও
সামিল হয় এবং সেন্ট পীটার্সবার্গের রাস্তায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের জমায়েত হয়। কিন্তু
জার, দুঃখ দুর্দশা শোনাতে আসা 'নিজের সন্তানদের' গুলি করে স্বাগত অভিনন্দন করে।
যে জারশাহী জাপানী হামলায় পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করে পালিয়ে নিজের
পিঠ বাঁচিয়েছে, সে নীরিহ-নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ করতে লাগলো। জারশাহীর এই
রাক্ষুসে আক্রমণে হাজারের ওপর মানুষ মারা যায় ও দুহাজারের বেশি মানুষ ঘায়েল হয়। সেন্ট-পিটার্সবার্গের
রাস্তা শ্রমিকদের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে এবং সেই দিনটি রাশিয়ার ইতিহাসে 'খুনী রবিবার'
রূপে কুখ্যাত হয়ে রয়ে যায়। এই মিছিলে সেন্ট-পীটার্সবার্গর বলশেভিক শ্রমিকরাও সামিল
হয়েছিল এবং তাদেরও প্রাণ যায়।
এই ঘটনার প্রভাবেই হরতালী শ্রমিকদের দাবীপত্রে কয়েকটি রাজনৈতিক
দাবি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। যখন শ্রমিকদের সভায় দাবীপত্রটি পড়া হচ্ছিল সেইসময় সেই মঞ্চ
থেকে বলশেভিক শ্রমিকরাও নিজেদের বক্তব্য রাখে, নিজেদের সাংগঠনিক পরিচয় গোপন রেখে। এর
প্রভাব বশত দাবিপত্রে নিম্নলিখিত রাজনৈতিক দাবিসমুহ সামিল করা হয় --- সংবাদমাধ্যমের
স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংগঠন বানানোর স্বাধীনতা, রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন
হেতু সংবিধান সভার গঠন, আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার, রাষ্ট্র থেকে চার্চকে স্বতন্ত্র
করা, যুদ্ধের অবসান এবং কৃষকের হাতে জমির হস্তান্তর করা ইত্যাদি।
এইসব দাবি তালিকায় যুক্ত করা ফাদার গেপোন-এর উদারতার পরিচায়ক ছিলনা, বরং তা ছিল শ্রমিকদের রাজনৈতিক চেতনার পরিচায়ক। জারশাহীর সেই এজেন্ট ভাল মতই জানতো যে এই দাবিগুলি সেই ব্যবস্থায় অর্জিত হতে পারে না, কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষোভ নিরসন হবে, এ কথা ভেবেই সেগুলিকে দাবিপত্রে সামিল করা হয়।
এই নরসংহারের পর শ্রমিক আন্দোলনের বিস্ফোরণ সমগ্র রাশিয়ায় ছড়িয়ে
পড়ে।
'খুনী রবিবার'-এর বিকেলেই সেন্ট পীটার্সবার্গ-এর শ্রমিক বিভিন্ন
এলাকায় ব্যারিকেড গড়ে তোলে।
শ্রমিকদের বক্তব্য ছিল ---
'জার আমাদের কিছু দিয়েছে, এবার আমরা তাকে দেবো'। রুশী জনসাধারণের বিরুদ্ধে জারশাহীর জঘন্য অপরাধের খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ শ্রমিকদের মনে জারশাহীর প্রতি এত বেশি ঘৃণা ও বিদ্বেষের সঞ্চার হয় যে পুরো দেশে হইচই পড়ে যায়। এমন কোনো শহরই বোধহয় অবশিষ্ট ছিল না যেখানে শ্রমিকেরা কোনো না কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন খাড়া করেনি। তাদের শ্লোগান ছিল - 'নিরঙ্কুশ শাসন নিপাত যাক'! শুধু জানুয়ারি মাসেই প্রায় ৪,৪০,০০০ শ্রমিক হলতালে সামিল হয়। এক শতাব্দীর কাজ এক মাসে সম্পন্ন হয়ে যায়, আর্থিক সংগ্রাম রাজনৈতিক বিস্ফোরণের রূপ ধারণ করে এবং এই ভাবে রাশিয়ায় বিপ্লবের বিউগল বেজে ওঠে।
শ্রমিকদের এই আওয়াজ গ্রামেও পৌঁছে যায়। কৃষকেরা বড় বড় জমিদারদের ওপর হামলা করতে শুরু করে। শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের বলশেভিক নীতির সত্যতা বাস্তবে প্রমাণিত হয়। কৃষকদের দাবি ছিল - জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের হস্তান্তর করা হোক। তারা শুধু দাবি করেই থেমে থাকেনি, বরং শত্রুদের ওপর হামলা করা শুরু করে। কৃষক বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনার জওয়ান ও কজ্জাকের দল পাঠানো হয়। গুলি চলে, আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার ও তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়। কিন্তু কৃষক সংগ্রাম থামেনি। তা বৃহৎ রাশিয়ার মধ্যভাগে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক গণতান্ত্রিক পার্টির প্রভাব বিস্তারও হতে থাকে সেই অনুপাতেই।
খুনী রবিবার, রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে দাঁড়ায়। আর তা হয়েছে মোটামুটি তিন অর্থে - শ্রমিকেরা আর্থিক সংগ্রামের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, তাদের সংগ্রাম এক শহর থেকে আর এক শহরে এবং এক শিল্পক্ষেত্র থেকে অন্য শিল্পক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে, আর তারা নিজেদের লড়াইয়ে কৃষক, ছাত্র- যুবক এবং সৈন্যদের অবধি টেনে এনেছে। অন্যদিকে অবস্থা এতদূর এগিয়েছে যে শ্রমিকেরা জার-এর সশস্ত্র পুলিশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে টক্কর নিতে থাকে। সেন্ট পিটার্সবার্গ, মস্কো, ভার্সা, রীগা ও বাকু, শ্রমিক-সংগ্রামের কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। ঐ বছরই মে-দিবসের অবসরে ভার্সা তে শ্রমিক ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে রক্তাক্ত সংগ্রাম ঐতিহাসিক হয়ে ওঠে। পোল্যান্ডের সামাজিক গণতন্ত্রীদের আহ্বানে শ্রমিকেরা জারশাহীর গণ হত্যার জবাব গণ হরতালের মাধ্যমে দিয়ে দেয়। পোলিশ শিল্পকেন্দ্র লোদজ-এ শ্রমিক ও সশস্ত্র বাহিনীর লড়াই নতুন উচ্চতা ছুঁয়ে যায়। সেখানে সাধারণ রাজনৈতিক হরতাল ও সশস্ত্র সংগ্রাম, দুটো একসাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। লেনিন এই ঘটনা কে বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং সেটিকে রাশিয়ায় শ্রমিকদের প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম বলে অভিহিত করেন।
এরকমই সাহসী সংগ্রামের পরিচয় দিয়েছেন ইভানোভ ভেজ্নোসেন্সক-এর শ্রমিকেরা। তাদের হরতাল দু মাসাধিক কাল যাবত চলতে থাকে। এর নেতৃত্বে ছিলেন বলশেভিক পার্টির উত্তর প্রান্তীয় কমিটি। হরতাল দমন করার জন্য জারশাহীকে সেখানেও গুলি বর্ষণ করাতে হয়। এই বৈপ্লবিক কর্মকান্ড রুশী জনতার মধ্যে যেমন উৎসাহ ও প্রেরণার সঞ্চার করে, জারশাহীর শিবিরে ততটাই হতাশা সৃষ্টি হয়। কাউন্ট ভিট্টে সেই পরিস্থিতির বর্ননা করেন এইভাবে, ---'সেই সময় প্রতিটি মানুষ পাগল হয়ে উঠেছিল, বা অন্ততপক্ষে বেশিরভাগ লোক পাগল হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। সকলেই জন-প্রতিনিধিত্ত্বের অতিবাদী গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে রুশ সাম্রাজ্যের পুনর্ণির্মাণের দাবী করছিলেন।
অপরদিকে জারশাহী-শিবিরে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। বোঝা যাচ্ছিল না যে ক্ষমতার কেন্দ্র ঠিক কোথায় অবস্থান করছে। সকাল থেকে সমস্ত চার্চ থেকে জার-এর ঘোষণা জারি করা হয়, যার মাধ্যমে বিপ্লব দমন করার কথা বলা হয়। দুপুরে সেনেট নিজের ঘোষণার মাধ্যমে নাগরিকদের কাছে আপীল করে যে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সংস্কারের লক্ষ্যে জার-এর কাছে নিজেদের প্রস্তাব পাঠাক। বিকেলে মন্ত্রী ও স্টেট কাউন্সিলের কিছু সদস্যের সঙ্গে জার এর মন্ত্রণা সভা বসে। মন্ত্রী ও সভাসদদের পরামর্শ ছিল যে সমাজের সংবেদনশীল অংশের দুশ্চিন্তা দূর করতে কিছু সংস্কার করা দরকার। এই পরামর্শে বিরক্তি প্রকাশ করে জার বলে --- মনে হচ্ছে আপনারা বিপ্লবের ভয়ে ভীত হয়েছেন। এই কথার সাথে সহমত হয়ে সদ্য বহাল হওয়া গৃহ মন্ত্রী আলেকজান্ডার বুলিমিন জানায় - 'মহামহিম, বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে'।
শ্রমিকদের এই বলিদান বৃথা যায়নি। তাদের এই বলিদানের ফলস্বরূপ রাশিয়ায় শ্রমিক-কৃষকের সাথে সশস্ত্র জওয়ানদের ঐক্যের নতুন জমি তৈরি হচ্ছিল। কৃষকদের বাড়তে থাকা বিদ্রোহের উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে। এখানে কৃষ্ণ সাগর (Black sea) স্থিত রণতরীর নাবিকদের বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। এটা ছিল সৈন্য বাহিনীর প্রথম বিদ্রোহ। রণতরীটি ওডেসা'র (শিল্পক্ষেত্র, যা শ্রমিকদের হরতাল দ্বারা প্রভাবিত ছিল) নিকটে অবস্থিত ছিল। এই জাহাজের নাবিকেরা বিদ্রোহ করে এবং সেটিকে ওডেসায় নিয়ে আসে। এই সৈনিকেরা শ্রমিক-কৃষকদের পক্ষে দাঁড়ায়। অবশ্য জারশাহী এই বিদ্রোহকে তৎক্ষণাত দমন করে। কিন্তু সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বিপ্লবের এমন ঢেউ উঠে যায় যে রাশিয়ার প্রতিটি এলাকা, তার আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র তাতে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে রুশী রাজনৈতিক সংগ্রামের এটা ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা।
শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা দেখে জারশাহী ভয়ে কেঁপে
উঠেছিল। এই পরিস্থিতি সামলাতে সে দ্বিমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৭ অক্টোবর ১৯০৫-এ ঘোষনা-পত্র
জারি ক'রে সে রাশিয়াকে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে পরিবর্তিত করার দিশায় অগ্রসর হবার ইচ্ছা
প্রকাশ করে। সে মানুষের ব্যক্তিগত সুরক্ষার গ্যারান্টি, তাদের বাক স্বাধীনতা, সভা ও
সংগঠন করার অধিকার ইত্যাদি অক্ষুণ্ণ রাখার অঙ্গীকার করে। একই সাথে ডুমা গঠন করার নির্নয়
গ্রহণ করে, যার প্রতিনিধি বেছে নেবার জন্য ভোট দেওয়ার অধিকার প্রদান করা হল সকল শ্রেণীর
জনসাধারণকে। ইতিহাসে এই প্রতিনিধি সভা, বুলিগিন ডুমা নামে পরিচিত।
এই সবই ছিল সুন্দর ঘোষনাবলী। কিন্তু অপর দিকে সমাজের বাস্তবিক জীবনে অত্যন্ত বিভৎস সব ঘটনা ঘটে চলেছিল। জনগনের মধ্যে বিভাজনের উদ্দেশ্যে ইহুদীদের গণসংহার করা হচ্ছিল এবং পুলিশের তত্ত্বাবধানে গুন্ডা বাহিনী সংগঠিত করা হচ্ছিল। এই ধরনের গুন্ডা সংগঠন তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার, ব্যাবসায়ী, চার্চের পুরোহিত এবং অপরাধী চক্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র 'ব্ল্যাক হানড্রেডস' নামে কুখ্যাত হয়। তারমানে একদিকে গণতন্ত্রের ঘোষণা করা হচ্ছিল আর অপরদিকে গণতন্ত্রের ভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছিল। এই ছিল তৎকালীন রুশী সমাজের বাস্তব অবস্থা।
রাশিয়ার শ্রেণী সচেতন সমাজ এই বাস্তবিকতা উপলব্ধিও করতে পারছিল এবং এই ভাষায় তা ব্যক্ত করছিল --- 'মৃত মানুষের জন্য মুক্তি আর জীবন্ত দের জন্য জেল'। এই সত্য যতই বিভৎস হোক, এর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল জারশাহীর পরাজয় ও জনগনের জিত। লেনিন এই দ্বিমুখী সত্যকে রুশী সমাজে আসা শক্তির ভারসাম্যের অস্থায়ী পরিবর্তন রূপে দেখেন। তাঁর মতে, ১৭ই অক্টোবরের ঘোষণা-পত্র ছিল শ্রমিক-কৃষকের বিদ্রোহী শক্তিতে ভয়ভীত জারশাহীর দান। এই শক্তির ভারসাম্য অনুসারে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য এতটা শক্তিশালি ছিলনা যে তা জারশাহীর সিংহাসন উল্টে দিতে পারে, আবার জারশাহীও এতটা শক্তিধর ছিলনা যে সে পুরনো পদ্ধতিতে শাসন চালাতে পারে। আর তাই বিপ্লবের জিত কেবলমাত্র এই বিষয়টির উপর নির্ভরশীল ছিল যে প্রতিটি মোর্চায় বেশি বেশি মাত্রায় শক্তি সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে, কে সফল হতে পারে।
রুশী শ্রমিক শ্রেণী এই ঝঞ্ঝাময় দিনগুলিতেও জারশাহীর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অধিকার গুলির সদব্যবহার শুরু করে দেয়, নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন নির্মাণের জন্য, শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত গঠণের মাধ্যমে। এইসব সোভিয়েত গুলির রাজনৈতিক গুরুত্ব কে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সঙ্ঘের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-এর ইতিহাসে লেখা আছে --- 'শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত গুলিতে সমস্ত মিল ও কারখানার প্রতিনিধিদের সমাগম হয়েছিল। তাঁরা শ্রমিক শ্রেণীর বিশেষ প্রকারের রাজনৈতিক গণ-সংগঠনের প্রতিনিধিত্ত্ব করতেন, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। ১৯০৫-এ যে সোভিয়েত অস্তিত্বে আসে, তা ছিল ১৯১৭'য় বলশেভিকদের নেতৃত্বে স্থাপিত সোভিয়েত রাষ্ট্রের পূর্ব রূপ'।
এইভাবে বলশেভিকদের দৃষ্টিতে শ্রমিকদের সোভিয়েতগুলি ছিল সর্বহারা রাষ্ট্রের ভ্রুণ। এর বিপরীত মেনশেভিকরা সোভিয়েতগুলিকে স্থানীয় স্বশাসনের গণতন্ত্রিক রূপ হিসেবে দেখতো। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, সেন্ট পীটার্সবার্গ ও মস্কোর সোভিয়েত গুলির ভূমিকা দ্বারা বোঝা যেতে পারে। মস্কো শ্রমিক সোভিয়েতের নেতৃত্ব বলশেভিকদের হাতে ছিল। বলশেভিক পার্টি ও শ্রমিক সোভিয়েতের যৌথ প্রয়াসে মস্কোতে সৈনিক সোভিয়েতের গঠনও হয়েছিল। শ্রমিক সোভিয়েতগুলির গঠন হয়েছিল অধিকাংশই শিল্পকেন্দ্রে, কিছু এলাকায় কৃষক সোভিয়েতও গঠিত হয়েছে। কোথাও আবার সৈনিক সোভিয়েতও হয়েছে, কিন্তু এই ব্যাপারে বিশেষ সফলতা পাওয়া যায়নি।
শ্রমিক সোভিয়েগুলি জারশাহীর মাথাব্যথার কারন হয়ে উঠেছিল, যদিও
সেগুলির সাংগঠনিক কাঠামো পুরোপুরি মজবুত হয়ে ওঠেনি। সেগুলো তাড়াহুড়ো করে গড়ে তোলা হয়েছিল
এবং তার কোন আইনি অধিকার ছিলনা। তা সত্ত্বেও এই সংগঠনগুলি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও
আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের আইন এনে দিয়েছিল। তারা লোকেদের ট্যাক্স না দেওয়ার আবেদনও করেছিল।
কিছু ক্ষেত্রে তারা সরকারি কোষ বাজেয়াপ্ত ক'রে, বিপ্লবের কাজে তা ব্যবহার করে। এইভাবে
দুটি রাষ্ট্রশক্তি মুখোমুখি হতে থাকলো - একটি ভ্রুণ রূপে ও দ্বিতীয়টি মরনোন্মুখ হয়ে।
এই দুই এর মধ্যে সঙ্ঘাত অবশ্যম্ভাবি ছিল আর ডিসেম্বর ১৮০৫-এ তাই হয়েছিল।
জারশাহীর বিরুদ্ধে জনতার বিদ্রোহ থামার কোন লক্ষণই চোখে পড়ছিল না। ইতিমধ্যে তা সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিবর্তিত হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বলশেভিকেরা জারশাহী ও জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান জানায়। তাঁরা মানুষকে বোঝায় যে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবি। তাঁরা সৈন্যদের মধ্যে বিপ্লবী কার্যকলাপ তীব্রতর করে দেয় আর পার্টির সৈন্য সংগঠনে শামিল হওয়া শ্রমিকদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিতে থাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
জারশাহী ইতিমধ্যে জাপানের সাথে অপমান জনক সমঝোতা করে বাইরের আক্রমণ থেকে রেহাই পেয়ে গিয়েছিল। এখন তার সামনে একটাই কাজ বাকি থাকে --- গণ বিদ্রোহ দমন করা। কৃষক বিদ্রোহের এলাকাগুলিতে মার্শাল ল জারি করা হল। সেইসব এলাকায় ফরমান জারি করা হল --- 'কাউকে গ্রেফতার কোরোনা এবং একটাও বুলেট নষ্ট কোরোনা'। বিপ্লবী নেতাদের গ্রেফতার করার আদেশও জারি করে দেওয়া হল।
জারশাহীর এই পদক্ষেপের জবাবে মস্কোর বলশেভিকরা ও শ্রমিক সোভিয়েতগুলি অবিলম্বে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৫ই ডিসেম্বরে মস্কোর বলশেভিক কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় যে সোভিয়েতগুলির শ্রমিকদের সর্বাত্মক হরতালের আহ্বান করা হোক। এই আহ্বানের অন্তরনিহিত উদ্দেশ্য ছিল যে এই সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাক।
হলোও তাই। ৭ই ডিসেম্বর মস্কোয় শুরু হয়ে গেল সর্বাত্মক হরতাল। কিন্তু সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে পূর্ণ সমর্থন পাওয়া গেল না এবং সম্পূর্ণ দেশে তার প্রসারের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেল। এইভাবে শুরুতেই বিপ্লবের পরাজয়ের সংকেত পাওয়া গেল। রেলওয়ের হরতালও হতে পারেনি ও যাতায়াত ব্যবস্থা অব্যাহত থেকে গিয়েছিল। মস্কোতেও গ্যারিসন দোটানার শিকার হয়ে পড়ে।
৯ই ডিসেম্বর থেকে শ্রমিকেরা ব্যারিকেড খাড়া করা শুরু করে দেয়। পুরো শহর ছেয়ে যায় ব্যারিকেডে। পরিস্থিতি সামলাতে সৈন্য মোতায়েন করা হয় ও কামান আনানো হয়। শ্রমিকরাও ডেঁটে মোকাবিলা করে। সংগ্রাম চলতে থাকে নয় দিন পর্যন্ত । সৈনিকের সংখ্যা বাড়ানো হয় এবং আরও অনেক অনেক কিছু ----- কিন্তু তা সত্বেও, শ্রমিকদের গৌরবান্বিত সংগ্রাম অবশেষে পরাজিত হয়।
পরাজয়ের কারণ সম্পর্কে উপরে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু
এই পরাজয়ের অন্য একটি কারণও ছিল। মস্কো বলশেভিক কমিটির সদস্যদের গ্রেফতার করে নেওয়া
হয়েছিল। অন্যান্য নেতাদেরও হয় গ্রেফতার করা হয়েছে অথবা ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে।
ফলস্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন এলাকার সশস্ত্র বিদ্রোহগুলি একে আপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১৯ দিন পর্যন্ত শ্রমিকেরা জারশাহীর সেনার মোকাবিলা শৌর্যের সাথে চালিয়ে যায়। কিন্তু
শেষ পর্যন্ত বিপ্লবকে পিষে ফেলা হয়। প্রায় একই পরিণতি অন্যান্য শহরে জ্বলে ওঠা বিদ্রোহের
অগ্নিশিখার ক্ষেত্রেও হয়েছে। উৎপীড়িত জাতি সমূহের মধ্যেও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে,
জর্জিয়া ছিল সবার শীর্ষে, ইউক্রেনের বড় এলাকায় এবং লাত্ভিয়া ও ফিনল্যান্ড-এও বিপ্লবের
মশাল জ্বলে ওঠে। কিন্তু একে একে সমস্ত বিদ্রোহই দমন করা হয়।
বিপ্লবের পরাজয় ও প্রতিবিপ্লবের পূর্ণ বিজয়ের মধ্যবর্তী কাল :
বিপ্লবের পরাজয়ের পরেও অবস্থা পুরোপুরি শান্ত হয়নি। রাশিয়া তবুও জ্বলছিল ধিক ধিক করে। বিপ্লবী শ্রমিক-কৃষকও সংগ্রাম জারি রেখে একটু একটু করে পিছু হটতে থাকে। সংগ্রামে নতুন নতুন শ্রমিক যোগ দিতে থাকে। ১৯০৬-এ, ১০ লাখের বেশি শ্রমিক হরতালে অংশ নিয়েছিল, ১৯০৭-এ অংশ নেয় ৭,৪০,০০০ জন শ্রমিক। জারশাহীর রাশিয়ার গ্রামীন অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক অংশ ১৯০৬-এর প্রথমার্ধে কৃষক আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিল, বছরের শেষার্ধে যা নেমে আসে প্রায় এক পঞ্চমাংশে। সেনা ও নৌ সেনার মধ্যে বিক্ষোভ জারি ছিল। এইসবই সম্ভবত অন্তিম পরাজয়ের পূর্বাবস্থার অস্থিরতা ছিল। ১৯০৭-এর শেষ আসতে আসতে বিপ্লব পুরোপুরি পরাস্ত হয়ে যায়।
বিপ্লব পরাজিত অবশ্যই হয়েছে কিন্তু ভবিষ্যত বিপ্লবের জন্য তা মজবুত জমি তৈরি করে গেছে। এই সত্য কে বুঝতে হলে আমাদের বিপ্লব-পূর্ব অবস্থায় বলশেভিক-মেনশেভিক বিবাদ এবং বিপ্লবের পরাজয়ের পর তার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দুই শিবিরের মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল, তার প্রতি মনোনিবেশ করা দরকার। যেমন ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে বলশেভিকরা রাশিয়ার গণতন্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী রূপে গণ্য করতো কৃষকদের, অপরদিকে মেনশেভিকরা সেক্ষেত্রে নিজেদের বিশ্বস্ত সহযোগী বলে মনে করতো পুঁজিপতিদের। এই বিপ্লব প্রমাণ করে দিয়েছে যে বলশেভিকরাই সঠিক ছিল।
কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে আর শ্রমিকেরা পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে জীবন মরনের লড়াই লড়ছিল এবং কৃষক ও শ্রমিক সোভিয়েতগুলির মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠছিল, আবার পুঁজিপতিরা, জারশাহীর রাষ্ট্রশক্তির অধীনে নিজেদের অংশীদারি বাড়াতে ও মজবুত করতে দর কষাকষিতে নেমে এসেছিল।
বিপ্লবোত্তর মূল্যায়ন, এর চেয়েও ভয়াবহ বার্তা রেখে গেছে। মেনশেভিকদের মত ছিল শ্রমিকদের অস্ত্র ধারণ করা উচিত হয়নি, সেখানে বলশেভিকদের মনে হয়েছে যে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি আরও জোরদার এবং সুব্যবস্থিত ভাবে করা উচিত ছিল। বলশেভিকদের বিশ্লেষণে এই প্রয়াস লুকিয়ে ছিল যে এই পরাজয়ের কারণ খুঁজে ভবিষ্যতের বিপ্লবের পথ খোঁজা যাক।
এই পরাজয়ের কারণ তারা খুঁজে বার করেছেন এবং তার বিশ্লেষণ করেছেন এই ভাবে ---
* জারশাহীর বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের জোটবদ্ধতা স্থায়ী এবং মজবুত
হয়ে ওঠেনি।
* বৃহৎ সংখ্যক কৃষক, জমিদারদের বিরুদ্ধে তো ছিল কিন্তু জার-এর
প্রতি তাদের আস্থা বরাবর ছিল এবং ডুমা'র প্রতিও তারা আস্থাবান ছিল।
* কৃষক জনসাধারণের বড় অংশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের অনুগামী
ছিল, বলশেভিকদের নয়। কৃষকদের দোদুল্যমান মানসিকতার প্রভাব সেনার উপরেও পড়ে কারণ তাদেরই
সন্তানেরা সেনার উর্দি প'রে কর্মরত ছিল। সেনাদের কিছু অংশ যদিও বিদ্রোহ করেছিল, কিন্তু
অধিকাংশ জওয়ান বিদ্রোহ দমনের কাজেই সক্রিয় ছিল ।
* শ্রমিকদের ক্রিয়াকলাপেও পর্যাপ্ত ভাবে সমন্বয় ছিল না। যেখানে
শ্রমিকদের অগ্রণী অংশ ১৯০৫-এই বিপ্লবী সংগ্রামে নেমে পড়ে, সেখানে ছোট-মাঝারি শিল্পের
পিছিয়ে থাকা অংশ ১৯০৬ থেকে একে একে ময়দানে নামতে শুরু করে। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি
(রুশী সমাজতন্ত্রিক শ্রমিক পার্টি) নিজেও যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধ ছিল না।
* বিপ্লব দমনের জন্য জার, পশ্চিম ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি
থেকে প্রচুর সাহায্য পেয়েছে। ফ্রান্সের ব্যাঙ্কগুলি এই কাজের জন্য ঋণ দিয়েছে তথা জার্মান
সরকারতো হস্তক্ষেপ করার জন্য তৈরি হয়ে বসে ছিল। জাপানের সাথে জার-এর সমঝোতাও, বিপ্লব
দমনের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে।
* মেনশেভিকরা বিপ্লব-এ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির দুটি আলাদা আলাদা উৎস ছিল। মেনশেভিকরা সব সময় শ্রমিকদের স্মরণ করাতো যে রাশিয়ার গণতন্ত্রিক বিপ্লব পুঁজিপতিদের কাজ, তাই এই কাজে পদক্ষেপ করার আগে শ্রমিকদের একথা মনে রাখা দরকার যে এর ফলে পুঁজিপতিরা যেন ভয় পেয়ে না যায়। এদের এই চিন্তাধারা অনুযায়ী শ্রমিক শ্রেণীর উচিত পুঁজিপতিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। যদিও মেনশেভিকদের এই আপসপন্থী মনোভাবের কারণে শ্রমিকদের স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল যে তাদের আসল বন্ধু ও নেতা হচ্ছে বলশেভিকরা।
এই বিপ্লবের চাপে জার, ডুমা গঠন করে পুঁজিবাদী সংষ্কারের দিশায়
গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেছিল --- তার সীমা যতই সঙ্কীর্ণ হোক না কেন, কিন্তু এটা নিশ্চিত
যে, যে সংস্কার হাসিল করার জন্য জেমেস্তোবাদীরা চার দশক ধরে সচেষ্ট ছিল অথচ সফল হয়নি,
সেই সংস্কার শ্রমিক-কৃষকের বিদ্রোহ মাত্র এক বছরের মধ্যেই আদায় করে নিয়েছিল।
ডুমা সম্পর্কিত বিবাদ :
এবার প্রশ্ন হল, ডুমা নামক এই প্রতিষ্ঠানের সদ্ব্যবহার, বিপ্লবের স্বার্থে কী ভাবে ও কোন পরিস্থিতিতে করা যায়। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ১৯০৪-এ আহূত ডুমা (বুলিমিন ডুমা), যার কেবলমাত্র পরামর্শ দেবার ক্ষমতা ছিল, তা বিপ্লবের ঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল। এই ডুমা'র বহিস্কারের বলশেভিক নীতি সঠিক ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। আবার ১৯০৫-এ এক 'আইনী ডুমা' গঠনের ঘোষণা করা হয়। এই ডুমা'কে আইন প্রণয়ন-এর অধিকারও প্রদান করা হয়েছিল।
নিজেদের তেমরফোর্স সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বলশেভিকরা এই ডুমা'রও বহিস্কার করে। কিন্তু পরে লেনিন এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। আগামী দিনগুলোতে সংগঠনের দিশা বিপ্লবী হবে না সংশোধনবাদী, তা স্থির করার একটি মানদন্ড এও হয়ে গিয়েছিল যে বুর্জোয়া সংসদে সর্বহারা পার্টিগুলির অংশ গ্রহণ কি ভাবে ও কোন পরিস্থিতিতে হতে পারে।
বিষয়ান্তরে যাওয়ার আগে দেখা এবং বোঝা দরকার যে কী কারণে জারশাহীর এই ডুমা নামক সংগঠনটির উপর অনুরাগ ঝরে পড়লো। তাৎক্ষণিক কারন হিসেবে তো বোঝাই যায় যে বিপ্লবের থেকে মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর দরকার ছিল। দীর্ঘকালীন উদ্দেশ্য ছিল কৃষক তথা অচেতন শ্রমিকদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রী, মেনশেভিক তথা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের রাজনৈতিক গন্ডিতে নিয়ে আসা। বিপ্লবী উত্থানের সময়েও এই সব পার্টিগুলি এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছে যে বিদ্রোহ না করেও মানুষ নিজেদের প্রত্যাশিত ব্যবস্থা অর্জন করতে পারে, সুতরাং বিপ্লবের কি দরকার ?
সেই সময় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল যে জনসাধারণের ওপর এইসব পুঁজিবাদী/নিম্ন পুঁজিবাদী দলগুলির প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য কোন মঞের সদব্যবহার করা যায়। বিপ্লবের উত্থানের দিনগুলিতে বলশেভিকরা এই চালবাজির জবাবে ডুমা বহিষ্কার করে এবং দেখিয়ে দেয় যে তাদের বহিষ্কারের জন্যই বুলিমিন ডুমা অস্তিত্বে আসতে পারেনি। ১৯০৬-এ বিপ্লবের পরাজয়ের সময়ে তাদের বহিস্কার সত্ত্বেও ভিট্টে ডুমা অস্তিত্বে আসে। সমস্ত সাবধানতা ও চালবাজি সত্ত্বেও প্রথম ডুমা র গঠন জারশাহীর ইচ্ছার বিপরীতে যায়। ৪৪৮ সদস্যের সংসদে ১৫৩ টি আসনে সাংবিধানিক গণতন্ত্রী (ক্যাডেটস) আসীন হয়ে যায়, ১০৭ আসন ত্রুদোবিকদের কব্জায় আসে, ১০৫ আসন উদার বামপন্থীদের ভাগে যায়, যারা নির্দল হিসেবে কাজ করছিল আর ৬৩ টি আসনে উৎপিড়িত জাতিসত্ত্বা (পোলিশ, ইউক্রেন, লিথুয়ানিয়ান ও অন্যান্য)-র প্রতিনিধি জয়ী হয়েছিলেন, যারা নিজ নিজ জাতিসত্ত্বার স্বশাসনের দাবি করে আসছিলেন। ইউরোপীয় দেশগুলির সংসদীয় ইতিহাসে এটি সম্ভবত প্রথম ঘটনা ছিল যেখানে প্রথম সংসদেই ব্যবস্থার বিরোধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। সেই অর্থে প্রথম ডুমা-ই জারশাহীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই মাথা ব্যাথায় অঙ্কুশ লাগানোর জন্য নির্বাচন বিধিতে নিয়ম রাখা হয়েছিল যে ডুমায় প্রবেশ করার আগে প্রতিনিধিরা জারশাহীর প্রতি নিষ্ঠার শপথ নেবেন। প্রত্যেক প্রতানিধি এমন শপথ নিয়েও ছিলেন, কিন্তু পালন কেউ করেননি। কিন্তু এই আপদ থেকে জারশাহীকে নিষ্কৃতি পেতেই হত। সেইজন্য ১৯১০-এ গঠিত স্টেট কাউন্সিলে (তৎকালীন সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণ সংস্থা) সংশোধনী আনা হয়। বলার জন্য এটিকে ডুমা'র সমান্তরাল হিসেবে বলা হয় কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাকে ডুমা'র উপরে বসিয়ে দেওয়া হয়। ১৭ অক্টোবর ১৯০৫-এর ঘোষণাপত্রে ডুমা-কে প্রদত্ত অধিকারসমূহে কাটছাঁট করা হয়। ডুমায় পেশ করা ড্রাফট, কাউন্সিলে খারিজ হয়ে গেলে তা জার-এর কাছে বিচারের জন্য পাঠানো হবে না। এই কাউন্সিলে অর্ধেকের বেশি সদস্য জার দ্বারা মনোনীত হতো এবং অবশিষ্ট সদস্যদের চয়ন করা হত সম্পত্তির পরিমাণের ভিত্তিতে।
এখানেও বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মতভেদ খুবই স্পষ্ট ছিল। মেনশেভিকরা এই নীতির অনুসারী ছিল যে সাংবিধানিক গণতন্ত্রীদের সাথে নির্বাচনী সমঝোতা করা উচিত এবং ডুমা র ভিতরে এই শক্তিগুলিকে সমর্থন করা উচিত। বলশেভিকরা এই নীতির বিরুদ্ধে ছিল। তাদের মত ছিল যে পুঁজিবাদী নীতিসমূহ প্রনয়ণের জন্য সাংবিধানিক গণতন্ত্রীদের সাথে একটি ব্লক রূপে কাজ করার দরকার নেই। আমাদের এই মঞ্চের সদ্ব্যাবহার, বিপ্লবের স্বার্থে করতে হবে।
এই বিবাদের ফয়সলা হয় মে, ১৯০৭-এ, লন্ডনে আয়োজিত পার্টির পঞ্চম কংগ্রেসে। এখানে ডুমায় অংশ গ্রহণ করা পার্টি গুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। প্রথম শ্রেণীতে সেই সমস্ত পার্টিগুলিকে রাখা হয় যারা খোলাখুলি ভাবে বিপ্লব বিরোধী, যেমন ব্ল্যাক হানড্রেডস গ্রুপের পার্টিগুলি, আক্টোবরবাদী, কমার্শিয়াল এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্টি তথা পার্টি অফ পিসফুল রিনোভেশন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিল উদারবাদী পুঁজিবাদী সাংবাধানিক গণতন্ত্রী পার্টি। এদের ব্যাপারে কংগ্রেসের নির্ণয় ছিল যে এই পার্টির অন্তঃসার শুন্যতার তীব্র বিরোধীতা করা হোক। তৃতীয় শ্রেণীতে সেই সমস্ত পার্টি ছিল যারা শহুরে তথা গ্রামীণ নিম্ন-পুঁজিবাদী (মধ্যবিত্ত) স্বার্থের প্রতিনিধিত্ত্ব করতো। এর মধ্যে প্রমুখ ছিল 'সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি'। এদের সঙ্গে সংগ্রাম ও সমঝোতার নীতি নিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদের সমাজতান্ত্রিক হওয়ার দাবী খন্ডন করার সাথে সাথে জারশাহী তথা সাংবিধানিক গণতন্ত্রী পার্টির বিরুদ্ধে তাদের সাথে আতাঁতের পথ গ্রহন করা হয়। এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন যে এইসব নীতির ওপর বলশেভিক রাজনীতির প্রভাব পুরোপুরি বিদ্যমান ছিল। দ্বিতীয় ডুমাতেও জার কোনো রেহাই পায়নি। ৫১৮ সদস্যের ডুমায় ২২২ আসনে জার বিরোধী শক্তি স্থান দখল করেছিল।
পঞ্চম কংগ্রেসের ঠিক পরে ৩ জুন,১৯০৭-এ জার দ্বিতীয় ডুমা ভেঙ্গে
দেয়। এটি ভেঙ্গে জার, ১৭ অক্টোবরের নিজেরই ঘোষণাপত্রের উল্লঙ্ঘন করেছিল। সেই ঘোষণাপত্রে
বলা হয়েছিলো যে, যে কোনো নতুন আইন ডুমা'র সম্মতিতেই প্রনয়ণ করা হবে। কিন্তু জার সেই
কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। বিষয়টিকে রাশিয়ার ইতিহাসে 'রাষ্ট্রের উপর কব্জা' রূপে মনে করা
হয়। ডুমা'র সামাজিক গণতান্ত্রিক গ্রুপের ৬৫ জন প্রতিনিধিকে গ্রেফতার করে সাইবেরিয়ায়
নির্বাসিত করা হয়। পরবর্তী ডুমা'র নির্বাচনে আদবকায়দায় বিরাট পরিবর্তন আনা হয়। এটা
সুনিশ্চিত করে নেওয়া হয় যে পরবর্তী ডুমা'য় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সংখ্যা-গরিষ্ঠতা বজায়
থাকবে। এর সাথেই শুরু হয়ে যায় প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণ। গ্রামে ও শহরে হাজারে হাজারে
কৃষক ও শ্রমিকদের গুলি করে মেরে ফেলা হয় অথবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বিপ্লবীদের
শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। তাদের নিশানায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ছিল বলশেভিকরা।
স্তলিপিন প্রতিক্রিয়ার পর্যায়ে :
১৯০৫-এর বিপ্লব দমনের পর প্রতিবিপ্লবের স্বল্পমেয়াদি কিন্তু খুব কঠিন একটা পর্যায়কাল (১৯০৮-১২) এসেছিল যাকে স্তলিপিন প্রতিক্রিয়ার কাল বলা হয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় ডুমা'য় বিপ্লবী ও গণতন্ত্রিক শক্তির প্রভাব বেশি ছিল, সেইজন্য এই দুটিকে তাদের কার্যকাল সম্পূর্ণ হবার আগেই সমাপ্ত করে দেওয়া হয়। নতুন ডুমা'র প্রাকরূপ জারশাহীর পছন্দের অনুকূল বানানোর উদ্দেশ্যে নির্বাচন বিধি-নিয়মে বিরাট পরিবর্তন করা হয়। শেষমেষ জার ও তার পারিষদদের ইচ্ছে অনুযায়ী তৃতীয় ডুমা অস্তিত্বে আসে। এই ডুমায় বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্ত্ব ছিল এই রকম --- ব্ল্যাক হানড্রেডস ১৭১, অক্টোবরবাদী ১১৩, সাংবিধানিক গণতন্ত্রী ১০১, সামাজিক গণতন্ত্রী ১৮ ও ত্রুদোবিক ১৩ । এই দলগুলির শ্রেণীগত অবস্থান থেকে ডুমা'র জার-পক্ষীয় প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়।
ব্ল্যাক হানড্রেডস ছিল সমাজের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের নিকৃষ্টতম প্রতিনিধি। এরা ছিল সেই সমস্ত লোক যারা কৃষকদের চাবুক মারতো, আর যারা ইহুদী ও পোলিশদের বিরুদ্ধে গণসংহার রচণায় নেতৃত্ব প্রদানকারি ভূমিকায় থাকতো। এদের গোষ্ঠীতে জমিদারদের গুন্ডা, উঠতি ব্যবসায়ীদের লেঠেল এবং সমাজের লম্পট শ্রেণীর লোকেরা থাকতো। অক্টোবরবাদীরা ছিল পুঁজিপতি ও নবজাত বড় পুঁজিবাদী-জমিদারদের (কুলাক) স্বার্থের রক্ষক। সাংবিধানিক গণতন্ত্রীরা ১৯০৫-এর বিপ্লবের সময় পুঁজিবাদী বিপক্ষের ভূমিকা পালন করার অভিনয় করতো, কিন্তু বিপ্লব দমন কালে এরা নিজেদের রং বদলাতে শুরু করে দেয়। ১৯০৯-এ অল্প কিছু জানা পরিচিত সামাজিক গণতন্ত্রী নিজেদের লেখার মাধ্যমে জারশাহীকে এজন্য ধন্যবাদ দেয় যে, সে বিপ্লব কে সফলতা পূর্বক পিষে ফেলে সমাজকে অরাজকতার গর্তে পতিত হাওয়া থেকে রক্ষা করেছে। সুতরাং বোঝাই যায় যে এই ডুমায় ব্ল্যাক-হানড্রেডস ও অক্টোবরবাদীরা সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের প্রতিনিধিত্ত্ব করতো আর সাংবিধানিক গণতন্ত্রীরা দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল।
এমন এক পরিস্থিতিতে জনতার স্বার্থের প্রতিনিধিত্ত্বকারী মাত্র দুটি পার্টিই অবশিষ্ট ছিল। নিম্ন-পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক অংশের প্রতিনিধি ছিল ত্রুদোবিক আর সামাজিক গণতন্ত্রীরা শ্রমিক-স্বার্থের প্রতিনিধিত্ত্ব করতো। স্বভাবতই, সামাজিক গণতন্ত্রীদের ভিতর বলশেভিক-ধারা ও মেনশেভিক-ধারার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর নীতি নিয়ে গভীর মতভেদ ছিল। এইভাবে এই ডুমায় প্রতিক্রিয়াশীলদের বাড় বাড়ন্ত বরাবর বজায় থাকতো আর সেইজন্য তৃতীয় ডুমাকে 'ব্ল্যাক-হানড্রেডস' ডুমাও বলা হত।
এই প্রতিক্রিয়াশীল উত্থানের ভিত্তি কী ছিল ? বিপ্লবের পরাজয়ের পর্যায়ে ৯ নভেম্বর ১৯০৬-এ নয়া কৃষি আইন বলবৎ করা হয়েছিল। এই আইন অনুযায়ী --- কৃষকদের কমিউন ছেড়ে যাবার স্বাধীনতা ছিল, সরকারের তরফে তাঁদের জমি বন্টন করা হচ্ছিল, সেই জমি উপযোগিতায় আনার সাথে সাথে বিক্রি করার অধিকারও তাদের দেওয়া হচ্ছিল, ভালো জমি কুলাকদের দেওয়া হচ্ছিল, তাদের জমি কেনার জন্য এবং কৃষি কাজের জন্য কৃষি ঋণও দেওয়া হচ্ছিল। এই সব আইনের গভীর প্রভাব পড়ে। কমিউন ব্যবস্থা, যার ওপর অরাজকতাবাদীদের গর্ব ছিল ও যার জোরে তারা সোজা সমাজতন্ত্রে প্রবেশ করার স্বপ্ন দেখছিল, সে সবই পুঁজিবাদের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। পরিসংখ্যান বলছে যে, ১৯০৬-১৫'র দশকে প্রায় ২০ লাখের বেশি কৃষক পরিবার কমিউন ছেড়ে দিয়েছিল। এই সংস্কারের ফলস্বরূপ গ্রামীন এলাকায় কুলাক ও ছোট-বড় পুঁজিবাদী জমিদারদের একটি অংশ জন্ম নেয়, যারা জারশাহীর শ্রেণীগত ভিত্তি হয়ে ওঠে।
এরফলে তৎকালিন রূপে জারশাহীর হাত শক্তিশালী হচ্ছিল অবশ্যই কিন্তু দীর্ঘকালীন রূপে তার কবর খোঁড়ার কাজও তীব্র গতিতে এগোচ্ছিল। যে গতিতে কুলাকদের ছোট ছোট গোষ্ঠী জন্ম নিচ্ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি তীব্রতার সাথে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের বিশাল জনগোষ্ঠী গড়ে উঠছিল, যারা শহুরে শ্রমিকদের সাথে মিলে বিপ্লবের অভেদ্য দুর্গ তৈরি করার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তথ্য বয়ান করছে যে ১৯০৭-০৯-এর মধ্যে কুলাক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছিল আর কৃষক আন্দোলন স্তিমিত অবস্থায় ছিল, কিন্তু ঠিক এক বছর পরে ১৯১০-১১'র মধ্যে কুলাক ও জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে বিরাট উত্থান আসে।
কৃষিতে উপরোক্ত বিকাশের সাথে সাথে শিল্পক্ষেত্রেও বিকাশ প্রায় একই গতিতে হচ্ছিল। শহুরে শ্রমিকদের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তাদের ওপর পুলিশের সাথে সাথে জমিদারদের ভাড়াটে গুন্ডারা পরিকল্পনা মাফিক হামলা করছিল। পুঁজিপতিরাও সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে আদৌ পিছিয়ে ছিলনা। মজুরি কমানো হচ্ছিল, কাজের ঘন্টা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। প্রতিদিন ১০-১২ ঘন্টা কাজ করানো সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কথায় কথায় শ্রমিকদের বার করে দেওয়া, অর্থ-দন্ড লাগানো এবং কারখানা লক আউট করা সেই সময়ে খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বিপ্লবের পরাজয়ের পর শিল্প-সংস্থাগুলিতে এক নতুন পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। পুঁজি ও শিল্পের একীকৃত হওয়া এবং বিদেশী পুঁজির প্রবাহ তীব্র গতিতে সংঘটিত হচ্ছিল। বিদেশী পুঁজিপতি ও রুশী পুঁজিপতিদের জোটবদ্ধতা মজবুত হয়ে উঠছিল। তারসাথে রাশিয়ার শিল্পায়নের ভিত ছিল দুর্বল। দেশে মেশিন ও মেশিন তৈরির উপকরনের উৎপাদন না হওয়ার ফলে সেই সমস্ত কিছু বিকশিত পুঁজিবাদী দেশ থেকে আমদানি করা হতো। রাশিয়ায় নিজস্ব অটোমোবাইল শিল্প ও রসায়ন শিল্প ছিলনা। তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করারও কোন কারখানা ছিলনা। মৌলিক শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল উপভোক্তা ও বাজারের সঙ্কুচিত অবস্থা।
বিপ্লবের পরাজয় ও প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রসারের প্রভাব শুধু শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যেই সীমিত ছিলনা, এর প্রভাব পড়ে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির ওপরেও। বিপ্লবের প্রসারের সময় প্রায়ই নানারকম শৌখিন-বিপ্লবী পার্টিতে ঢুকে পড়ে। তারা যে গতিতে এসে ঢোকে, বিপ্লবের পরাজয়ের সময়ে সেই গতিতেই ময়দান ছেড়ে পালায়ও। এর মধ্যে একটি অংশ ছিল এমন লোকেদের যারা বিপ্লবী শিবির ছেড়ে সরাসরি শত্রু শিবিরে সামিল হয়ে যায় এবং তাদের চেষ্টা ছিল পার্টির ভিতরে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা। রাশিয়ায়ও প্রতিক্রিয়ার সেই পর্যায়ে পলায়নবাদীদের সংখ্যা ছিল প্রচুর। এইরকম লোকেদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে নিজেদের ভীরুতা লুকোনোর জন্য তারা বিপ্লবী মতাদর্শকে ভাঙা-গড়ার কাজে লেগে পড়ে। রাশিয়ায়ও এই সব হচ্ছিল। কিছু লোক মার্কসবাদকে পুরোনো ও অপর্যাপ্ত আখ্যা দিয়ে তাকে নতুন করে সংশোধন করার ওকালতি করতে থাকে। এইরকম অবস্থায় লেনিন মতাদর্শগত ফ্রন্ট সামলেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে দোষ মার্কসবাদের নয়, বরং তা রয়েছে সেই মহানুভবদের পলায়ন প্রবৃত্তিতে।
এইরকম পরিস্থিতি খুব ভয়ানক হয়ে থাকে এবং এই অবস্থায় বিপ্লবীদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। যেভাবে বিজয়ের সময়ে সংগঠিত ভাবে বিপ্লবী অভিযানে নেতৃত্ব দিতে হয়, সেভাবেই পরাজয়ের সময়ও জরুরী হয়ে ওঠে, সংগঠিত ভাবে পিছু হটা। এই পর্যায়ে বলশেভিকরা প্রমাণ করে দেয় যে তারা এই দুটি ক্ষেত্রেই সবার চেয়ে নিপুণ।
সেই সময়ে সামাজিক গণতান্ত্রিক পার্টির ভিতর তিন ধরনের প্রবনতা কাজ করছিল।মেনশেভিকদের নীতি ছিল যেমন করে হোক আইনি পথে থেকে যাওয়ার সমস্ত উপায় বের করা হোক। এর জন্যে দরকার পড়লে গোপন পরিকাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হোক। তাদের ভেতর এমন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হওয়ার দুটি কারণ ছিল। প্রথমত তাদের মৌলিক চিন্তাধারা যে, গণতন্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে প্রধান ভূমিকা থাকে পুঁজিপতি শ্রেণীর এবং শ্রমিক শ্রেণী তাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় কারণ ছিল তাদের সাংগঠনিক প্রস্তুতির মধ্যে। যেমন আমরা দেখেছি, মেনশেভিকরা এই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিল যে, যে কোনো বুদ্ধিজীবি যদি পার্টির কর্মসূচীর সাথে সহমত পোষণ করেন, তবে তাকে পার্টির সদস্য বানিয়ে নেওয়া উচিত। এই দুই নীতির ফলস্বরূপ এই সঙ্কট কালে তাদের পরিকাঠামো ভেঙ্গে যাওয়াই ছিল ভবিতব্য।
বলশেভিকরা শুরু থেকেই তাদের পার্টির গোপন পরিকাঠামোকে মজবুত করে তোলা এবং সংগ্রামের সব ধরনের রূপেরই যথাযথ প্রয়োগের নীতিতে অটল ছিল। সেইজন্য এই অবস্থায় তাদের নীতি ছিল যে গোপন পরিকাঠামোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং প্রকাশ্য মঞ্চ ব্যবহারের পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে প্রতিবিপ্লবের এই পর্যায়ের পর বিপ্লবের পর্যায় অনিবার্য ভাবেই আসবে, সেইজন্য এই সময়ের সদ্ব্যবহার করা উচিত বিপ্লবের প্রস্তুতির কাজে এবং তাঁরা তা করেও ছিলেন।
এই পর্যায়ে তাঁরা ভবিষ্যৎ বিপ্লবের শ্লোগানগুলির ব্যাপক প্রচার করেন। শ্লোগানগুলি ছিল --- জনগণতন্ত্র, আট ঘণ্টার শ্রম দিবস, বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করা ও কৃষকদের মধ্যে তার বিতরন সংক্রান্ত। তাঁরা মেনশেভিকদের নীতিগুলিকে বিলোপবাদী ঘোষিত করে তা খারিজ করে দেন।
কিন্তু বলশেভিক পার্টির ভিতরেই একটি এমন ধারা কাজ করছিল, যাদের
লাইন ছিল, সমস্ত কিছুই গোপন (underground) হওয়া উচিত, খোলা মঞ্চের প্রয়োগ বন্ধ করা
উচিত। তাঁরা ডুমা'র প্রতিনিধিদেরও ফিরিয়ে আনার শ্লোগান দেন।
এই ধারা দৃশ্যত বিলোপবাদীদের থেকে ভিন্ন মনে হলেও, তাদের নীতি প্রয়োগের অনিবার্য পরিণতি তাইই হতো যা বিলোপবাদীদের কারণে হচ্ছিল। কারণ বিচ্যুতি অতিবাম হোক বা দক্ষিণপন্থী, অন্তিম বিচারে ফল একই হয়ে থাকে। আর তাই, এই কঠিন সময়েও বলশেভিক নেতৃত্ব এই ধারার লোকেদের সংগঠন থেকে বের করে নিজেদের অবস্থান শক্ত-পোক্ত করে তোলে।
এই দুই ধারা থেকে স্বতন্ত্র তৃতীয় একটি ধারাও ছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন ট্রটস্কি। তার দাবি ছিল যে তিনি বলশেভিক ও মেনশেভিক, এই দুই ধারার থেকে ভিন্ন নতুন এক ধারার নির্মাণ করছেন। লেনিন তার সম্পর্কে উক্তি করেছিলেন --- 'ট্রটস্কি সবচেয়ে ঘৃণ্য কেরিয়ারবাজ ও উপদলবাজের মত আচরণ করে ---- সে মুখে পার্টির কথা বলে কিন্তু নিকৃষ্টতম উপদলবাজের থেকেও খারাপ ভাবে কাজ করে'। তার মধ্যপন্থী নীতির রাজনৈতিক আবরণ উন্মোচন করে স্তালিন লিখেছেন --- 'মধ্যপন্থা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। এর চিন্তাধারা হল পরিস্থিতি অনুযায়ী রং বদলানো, শ্রমিকদের পার্টির মধ্যে থেকেও নিম্ন পুঁজিবাদী স্বার্থের অধীনতা স্বীকার করা'। তার আচরণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে সে মধ্যপন্থার মুখোশ পরে বিলোপবাদের ওকালতি করেছে।
প্লেখানভ, যিনি মেনশেভিক শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন, এই বিতর্কে বলশেভিকদের কাছাকাছি ছিলেন। যদিও বহু বিষয়ে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা মেনশেভিকদের সাথেই মিলে যেতো, তবুও বলশেভিকদের সাথে সাংগঠনিক ব্লক-এর নির্মাণ সেই কঠিন যুগে অত্যন্ত ইতিবাচক চিন্তা ছিল।
১৯১২ সাল একটি মাইল ফলক হয়ে ওঠে। বলশেভিকরা প্রাগ সম্মেলনের আয়োজন ক'রে নিজেদের দলকে মেনশেভিকদের থেকে পুরোপুরি আলাদা করে নেয়। এই সম্মেলনে তারা নিজেদের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে ... এই কমিটিতে বিপ্লবের বাস্তবিক কার্যকলাপ চালানোর জন্য স্তালিনের নেতৃত্বে একটি ব্যুরো গঠন করা হয়। এই ঘটনা রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ ছিল।
এই (প্রাগ) সম্মেলনের রাজনৈতিক গুরুত্বকে তুলে ধরে লেনিন গোর্কির
নামে একটি পত্র লেখেন ---
'বিলোপবাদীদের চালবাজি সত্ত্বেও আমরা পার্টি ও কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরি করেছি ও বাঁচিয়ে রাখতে সফল হয়েছি। আশাকরি এই প্রসঙ্গে তুমি আমাদের সাথে একমত হয়ে আনন্দ প্রকাশ করবে।' লেনিনের এই প্রতিক্রিয়া এ কথা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট যে মেনশেভিকরা কতটা দম আটকানো পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল।
এই বিভেদের রাজনৈতিক গুরুত্ব একটি অন্য ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা যায়। রোজা লুক্সেমবার্গ এই ভাঙ্গনের জন্য লেনিনকে দোষারোপ করে বলেছিলেন যে তিনি পার্টি ভঙ্গকারীর ভূমিকা নিয়েছেন। ১৯১৮'য় যখন রোজা নিজেই জার্মান সামাজিক গণতন্ত্রীদের থেকে আলাদা হন এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে মারা যান, তখন লেনিন বলেন যে, বিশ্বাসঘাতকদের সাথে বিচ্ছেদে উনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। বোঝাযায় যে ১৯১২'য় বলশেভিকরা নিজেদের শিবির পুরোপুরি আলাদা না করলে, সম্ভবত তাঁরা বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে সফল হয়ে উঠতেন না।
সুতরাং দেখতে গেলে, এই বছরটি প্রতিক্রিয়ার অন্তিম বছর তো ছিলই, তারসাথে বিপ্লবী আন্দোলনের নতুন জোয়ার ও তার প্রস্তুতির নতুন পর্যায়ের সূচনার বছরও ছিল। এই বছরেই এপ্রিলে, লীনা'য় স্বর্ণখনির শ্রমিকদের হরতাল হয়, যার ওপর জারশাহী গুলি চালায় এবং ৫০০'র বেশি শ্রমিককে মেরে ফেলে। এই ঘটনার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে স্তালিন লিখেছেন যে বরফ গলে যাচ্ছে ও শ্রমিক আন্দোলনের নব যুগ আরম্ভ হতে চলেছে। এই বছরই চতুর্থ ডুমা'র নির্বাচন হয়। এটা জারশাহীর অধীনে ডুমা'র অন্তিম নির্বাচন হয়ে দাঁড়ায়। প্রাগ সম্মেলনে বলশেভিকরা মেনশেভিক-ধারার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে আলাদা পার্টির ঘোষণা করে। সেই বছরই (২২ শে এপ্রিল) বলশেভিক দৈনিক পত্রিকা 'প্রাভ্দা'র প্রকাশনা শুরু হয়।
এক বছরের মধ্যে এত উপলব্ধি নিশ্চিত ভাবে আগামী দিনে ধেয়ে আসা তুফানের সঙ্কেত ছিল।
আর হয়েছেও তাই। লীনা গুলিকান্ডের পর পুরো দেশে, বিশেষ করে বড়
বড় শিল্পকেন্দ্রে শ্রমিকদের হরতাল বন্যার মত ধেয়ে আসতে থাকে। কিন্তু জারশাহী ও তার
প্রশাসন বিপ্লবী আন্দোলনে নতুন জোয়ারের বিপদ সঙ্কেত কোনভাবেই অনুভব করার মত অবস্থায়
ছিলোনা। আসলে, চতুর্থ ডুমা'ও তৈরি হয়েছিলো জারশাহীর মনের মত। এতে অক্টোবরবাদী ও সাংবিধানিক
গণতন্ত্রীরা মিলিত হয়ে বহুমত গড়ে নিয়েছিল। এদের মনোবাঞ্ছা ছিল রাশিয়াতেও ব্রিটেনের
মত সাংবিধানিক রাজতন্ত্র কায়েম হোক, যেখানে জনসাধারণ সম্পুর্ণ গনতন্ত্র পাক আবার রাজশাহীও
ঐতিহাসিক প্রতীক হয়ে রয়ে যাক। জারশাহী পরম নিশ্চিন্ত ছিল এ কথা ভেবে যে সামাজিক গণতন্ত্রীরা
বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
চতুর্থ ডুমা'য় বলশেভিকদের মাত্র ছয় জন প্রতিনিধি জিতে এসেছিল, যাদের মধ্যে একজন (মেলিনোভস্কি) পুলিশ এজেন্টের ভূমিকা নিয়েছিল। এই ডুমা'য় মেনশেভিক প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল সাত, কিন্তু এই দুই তরফের অবস্থার মধ্যে গুনগত প্রভেদ ছিল। বলশেভিক প্রতিনিধিরা বড় কারখানার শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ত্ব করতো, যখন কিনা মেনশেভিকরা ছোট কারখানায় কার্যরত শ্রমিকদের।
রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস এ কথার সাক্ষী যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্থায়িত্বের প্রশ্নটি রাজনৈতিক সংস্থায় প্রতিনিধিত্ত্বের সংখ্যা দ্বারা নির্ধারিত হয়না। শেষ বিচারে সেটি তার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়গুলির বিকাশ ও স্থায়িত্বের দ্বারা নির্ধারিত হয়। ১৯০৫-এর বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার আর্থিক-সামাজিক পরিকাঠামোয় যথেষ্ট এগিয়ে গিয়েছিল। পুঁজিবাদী বিকাশ দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। যারফলে রাষ্ট্রশক্তির পরিকাঠামোর মধ্যেও নতুন সম্পর্ক জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে পুরোনো সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়ছিল। এই সমস্ত ঘটনাবলি রাষ্ট্রশক্তির পরিকাঠামোর ভিতরের দুটি ঘটনার দ্বারা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যেতে পারে।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক রাশিয়ার ইতিহাসে অর্থনৈতিক উত্থানের কাল বলে মনে করা হয় এবং ১৯১৩ সালটিকে এই পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাল হিসেবে ধরা হয়। স্তলিপিন যদি শ্রমিক-কৃষকের দমন-উৎপীড়নের জন্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির মধ্যে ঘৃণার পাত্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে, তবে শাসক শ্রেণীর মধ্যে সে ততটাই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিল। তার বেড়ে ওঠা সম্মানকে জারও ঈর্ষা করতে শুরু করেছিল আর ভীতও হয়ে পড়েছিল। এই কারণে তার হত্যার নিমিত্ত হিসেব ইতিহাসবিদরা জারকেই দায়ী বলে মনে করে।
স্তলিপিন এর হত্যা হয়েছিল ০১ সেপ্টেম্বর ১৯১১-য়। দিনটি ছিল রুশী জার আলেকজান্দ্রা দ্বিতীয়'র জমিদারি উন্মুলন (১৮৬১)-এর ৫০ তম বার্ষিকী উদযাপনের দিন। সমারোহ চলাকালীন অপেরা প্রদর্শনের বিরতির সময় পুলিশের এজেন্ট বাগরোভ তাকে গুলি করে। কেন সে তাকে গুলি করলো তার কোনো সন্তোষজনক উত্তর সে দিতে পারেনি। কিন্তু নিজের মায়ের নামে জার-এর একটি চিঠি সবকিছু পরিষ্কার করে দেয় --- 'বেচারা স্তলিপিন, সেই রাত্রে ভয়ঙ্কর ছটফট করছিল ও তাকে মরফিন ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। পরদিন ২ সেপ্টেম্বর, সে গৌরবময় কুচকাওয়াজের আনন্দ উপভোগ করে।
দ্বিতীয় ঘটনা সামনে আসে, চতুর্থ ডুমা'য় অক্টোবরবাদী নেতা আলেকজান্ডার
গুজকোভ-এর ভাষণের মাধ্যমে ---
'রাষ্ট্রের সৃষ্টিশীলতা শেষ হয়ে গেছে, সরকার প্যারালাইসিসে
আক্রান্ত হয়েছে......রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা অতীতের যে কোন অবস্থার চেয়ে খারাপ হয়ে গেছে।'
গুজকোভের এই বক্তব্য এই বিষয়ের সঙ্কেত ছিল যে জারশাহীর আমলে পুঁজিবাদেরও দম আটকে আসছিল আর জারশাহীর জন্যে তা ছিল একটি বিপদ সঙ্কেত ।
বিশ্বযুদ্ধের পর্যায়ে বিপ্লবের অগ্রগতি :
"অসম আর্থিক তথা রাজনৈতিক বিকাশ, পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবি
নিয়ম। সেই কারণে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে কিছু দেশে অথবা একটি মাত্র পুঁজিবাদী দেশেও
সমাজতন্ত্রের জয়ী হওয়া সম্ভব। উক্ত দেশের বিজয়ী সর্বহারা শ্রেণী পুঁজিপতিদের সম্পত্তি
বাজেয়াপ্ত করে এবং স্বয়ং নিজেদের সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সংগঠিত করে অন্যান্য দেশের উৎপীড়িত
শ্রেণীকে নিজ আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করার মাধ্যমে সেই সমস্ত দেশের পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত করতে দরকার পড়লে শোষক শ্রেণী ও তার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র
বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে একদিন ময়দানে নেমে শেষ পুঁজিবাদী বিশ্বের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াবে।"
- লেনিন -
রুশ বিপ্লব থমকে ছিল দুটি পথের সংযোগ-স্থলে। একদিকে পুঁজিপতি শ্রেণী চাইছিল জারশাহীকে ক্ষমতাচ্যুত ক'রে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে এবং অপরদিকে বলশেভিকদের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সম্পুর্ন প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল, পুঁজিবাদী বিকাশের জরুরী দায়িত্ব শ্রমিক শ্রেণীর তত্ত্বাবধানে সম্পুর্ণ করা হবে এবং তারপর সমাজতন্ত্রিক বিকাশ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। এই নীতির স্বপক্ষে বলশেভিকরা চতুর্থ ডুমা'য় দু তরফা নীতি গ্রহণ করেছিল। একদিকে তাদের নিশানায় ছিল জারশাহীর সমর্থক পার্টিগুলি, অপরদিকে ছিল পুঁজিবাদের প্রতিনিধি সাংবিধানিক গণতন্ত্রীরা।
রাশিয়ায় চলতে থাকা এই আভ্যন্তরীণ ওলট পালটের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘন্টা বেজে ওঠে। এই যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে ছিল ব্রিটেন ফ্রান্স ও রাশিয়া, যাদের জোট ১৯০৭-এই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। আরেকদিকে ছিল জার্মানী, অস্ট্রিয়া ও ইটালি। পরে ইটালি এই শিবির পরিত্যাগ ক'রে এবং তুর্কি ও বুলগেরিয়া এতে সামিল হয়। নিশ্চিত ভাবে, এই জোট গড়ে উঠেছিল উপনিবেশগুলির পুনর্বিভাজনের জন্য। এরমধ্যে জার্মান শিবির ছিল আক্রমনাত্মক এবং বৃটেনের শিবির ময়দানে ছিল উপনিবেশগুলির ওপর নিজেদের অধিকার কায়েম রাখার স্বার্থে।
সেই সময়ে রাশিয়ার কি অবস্থান ছিল ? এর আগেই বলা হয়েছে যে রাশিয়ার পুঁজিবাদী বিকাশ হচ্ছিল এমন একটি ভিত-এর ওপর দাঁড়িয়ে, যেখানে সে বৃটেন ও ফ্রান্সের করদ রাজ্য এবং আধা উপনিবেশিক দেশগুলির মত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। এই অবস্থায় এই দুই দেশের লেঠেল-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াই ছিল জার-এর নিয়তি।
এই বিকট পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা, কিন্তু সে তা করতে পারেনি। যখন যুদ্ধের ঘন্টা বাজলো আর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সরকার জনগণের কাছে মিথ্যে কথা বলার রেকর্ড তৈরি করে ফেললো এই বলে যে, তারা আক্রমণ করেনি, বরং আক্রমণের জবাব দিচ্ছে এবং এর সাথেই তারা নিজের দেশের শ্রমিকদের 'পিতৃভূমীর রক্ষা'য় এগিয়ে আসতে আহ্বান করলো, তখন দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের অধিকাংশ পার্টি নিজ নিজ দেশের পুঁজিবাদী সরকারের ভন্ডামি ফাঁস করে দেওয়ার বদলে তাদের মিথ্যাচারের ওপর শ্রমিক শ্রেণীর সমর্থনের সিলমোহর লাগিয়ে দিল।
এই পরিস্থিতির আলোকে বিচার করতে হবে যে যুদ্ধের ব্যাপারে রাশিয়ার বিভিন্ন পার্টি কী নীতি নিয়েছে? ব্ল্যাক হানড্রেডস বড় পুঁজিপতিদের পার্টির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের পক্ষেই ছিল। নিম্ন-পুঁজিবাদী পার্টি (সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী) তথা সামাজিক গণতন্ত্রের সংশোধনবাদী ধারা (মেনশেভিক পার্টি) সমাজতন্ত্রের মুখোশ পরে পীতৃভূমী রক্ষার শ্লোগান নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বলশেভিকরাই একমাত্র শ্রমিকদের এই বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে এই যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠনকারীদের মধ্যেকার যুদ্ধ এবং শ্রমিক শ্রেণীর একমাত্র কাজ এই হতে পারে যে তাদেরকে সমস্ত সম্ভাব্য উপায়ে এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। অল্পমত ও বহুমত-এর দৃষ্টিতে দেখলে মেনশেভিকরা ইন্টারন্যাশনালের বহুমত-এর সঙ্গেই ছিল, কারণ জার্মানী, ফ্রান্স, বেলজিয়াম তথা অন্যান্য দেশের সামাজিক গণতন্ত্রীদের বহুমত সেইরকম নীতিই গ্রহণ করেছিল।
ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে এইসব দলগুলির বহুমতের পক্ষে অবস্থান, অতীতে তাদেরই নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াল। ১৯১০-এ দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের কোপেনহেগেন কংগ্রেসে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, সমস্ত দেশের সমাজতান্ত্রিক সাংসদ যুদ্ধের বিপক্ষে ভোট দেবে। একই ভাবে ১৯১২'র ওয়েস্লে কংগ্রেসে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থে এই সমস্ত দেশের শ্রমিকেরা একে অপরের রক্ত ঝরাবে না। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার সন্ধিক্ষণে এদের সবাইকে বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। জার্মানী, ফ্রান্স, ব্রিটেন তথা বেলজিয়াম এর সামাজিক গণতন্ত্রীদের অধিকাংশ সাংসদ প্রতিনিধি যুদ্ধের স্বপক্ষে মতদান করে আর পিতৃভূমী রক্ষার শ্লোগানের সাথে খোলাখুলি ভাবে গিয়ে দাঁড়ায়। আবার কিছু এমন লোকও ছিল যারা এই বিষয়ে মতদানের সময় সংসদের বহিষ্কার করে নিজের সম্মান রক্ষার চেষ্টা করে। এমনই লোকেদের আদর্শ প্রতিনিধি ছিলেন কাউটস্কি। ওনার মধ্যপন্থী নীতির প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে লেনিন বলেছিলেন যে মধ্যপন্থীরা হচ্ছে আমাদের শিবিরে পুঁজিপতিদের চর। রোজা লুক্সেমবার্গও কাউটস্কি সম্পর্কে খুব সঠিক ভাবে কৌতুকের ছলে বলেন যে, কাউটস্কি, 'দুনিয়ার শ্রমিক এক হও' শ্লোগানের বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। এখন ওনার শ্লোগান হচ্ছে,'দুনিয়ার শ্রমিকরা শান্তির সময়ে এক থাকো ও যুদ্ধের সময় বিভক্ত হয়ে যাও'। এই ভাবে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের বহুমত, মার্কসবাদের মানদণ্ডে দেউলিয়া প্রমাণিত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
সেই সময়ই লেনিন সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদের অসমান বিকাশের পরিপ্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করে নিজের থিসিস পেশ করেছিলেন যে, একটি মাত্র দেশেও সমাজতন্ত্রের জয়ী হওয়া সম্ভব। অবশ্যই এটা ছিল মার্কসবাদে নতুন অধ্যায় সংযোজনের মত সাহসী কাজ। আজকাল লেনিনের নাম করে ওনার এই অবদানকে পর্দার আড়াল করে ফেলার অপপ্রয়াস পরিপূর্ণ ভাবে করা হচ্ছে। এটা বলা আজ ফ্যাশন-এর পর্যায়ে চলে গেছে যে লেনিন একটি মাত্র দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয়ের কথা চিন্তাও করেননি, স্তালিন ওনার চিন্তা ভাবনাকে ওলটপালট করে এই একটি মাত্র দেশেও সমাজতন্ত্রের জয়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত আমদানি করেছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে এই সিদ্ধান্ত লেনিনেরই এবং রুশ বিপ্লবে এই সিদ্ধান্তের পরিপূর্ণ অবদান ছিল।
এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে লেনিন দ্বিতীয় নিবন্ধ পেশ করেছিলেন যে, এখন আর জরুরি নয় যে বিপ্লব উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই হতে হবে, এখন সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের কমজোর অংশ ( link ) ভাঙবে সবার আগে। কিন্ত সেক্ষেত্রে কমজোর অংশের নির্ধারণ হয় কি ভাবে ? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে লেনিন দুটি শর্তের উল্লেখ করেন --- সেই দেশ, যে দেশে সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ়মুষ্টির করাল গ্রাসের প্রভাব হবে কম এবং শ্রমিক কৃষকদের রাজনৈতিক চেতনা হবে উন্নত মানের। এই মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের সবচেয়ে কমজোর অংশ হিসেবে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।
এই চিন্তাধারার প্রভাবেই একদিকে যখন সংশোধনবাদীরা বিপ্লব সম্পর্কে গড়িমসি করছিল, অন্যদিকে তখন বলশেভিকরা প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও সেই যুদ্ধে জিত হাসিল করার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। তাদের প্রথম মোর্চা ছিল ডুমা। ডুমা'র বলশেভিক সদস্যরা বিভিন্ন আইনি ও প্রকাশ্য সংগঠনে যাতায়াত করতো ও মানুষকে যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলশেভিক নীতির সাথে পরিচিত করাতো। নভেম্বর ১৯১৪'য় যুদ্ধ সংক্রান্ত নীতির ওপর বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য বলশেভিক গ্রুপের সম্মেলন করা হয়েছিল। এতে অংশ গ্রহণ করা প্রত্যেকটি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নাশ করে দেওয়া হয়েছিল ও তাদের সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়েছিল। মোকদ্দমার সময় বলশেভিক ডুমা প্রতিনিধিরা ন্যায়ালয় মঞ্চের ব্যবহার করেছিল নিজেদের নীতির প্রচার প্রসার ও জারশাহীর আক্রমণাত্মক নীতির মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য। কামেনেভ ছিল এদের মধ্যে এক বিপরীত দৃষ্টান্ত। সে বলশেভিকদের নীতির প্রতি অসম্মতি জানিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তাদের দ্বিতীয় মোর্চা ছিল --- যুদ্ধের জন্য উদ্যোগ কমিটির বিরুদ্ধে। সেই সময় জারশাহীর সাথে সাথে জমিদার ও পুঁজিপতিদের পার্টিগুলি জনমতকে যুদ্ধের স্বপক্ষে নিয়ে আসার সম্ভাব্য সমস্ত রকমের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের শ্লোগান ছিল --- 'সমস্ত কিছু যুদ্ধের জন্য, সমস্ত ব্যক্তি যুদ্ধের জন্য'। এই শ্লোগানকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে তারা প্রচার শুরু করে যে, কারখানাগুলিতে উৎপাদন যুদ্ধের প্রয়োজনের অনুরূপ হওয়া উচিত। শ্রমিকরা উৎসাহের সাথে উৎপাদনে যোগদান করুক, এজন্য জরুরী ছিল উপযুক্ত কমিটিতে শ্রমিকদের যোগদান করানো। সেই উদ্দেশ্যে শ্রমিক-গ্রুপ গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মেনশেভিকরা পুঁজিপতিদের এই অভিযানের পক্ষে ছিল, কিন্তু বলশেভিকরা এর বিপক্ষে যায়। তাঁরা শ্রমিকদেরকে আহ্বান করেন এই গ্রুপের বহিষ্কার করার জন্য। এর জোরদার প্রভাব পড়ে এবং সেপ্টেম্বর ১৯১৫'য় এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শ্রমিক প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়। অধিকাংশ শ্রমিক প্রতিনিধি এতে অংশ গ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে তারা যুদ্ধের পক্ষে নয়, শান্তির পক্ষে, এবং জারকে সিংহাসন-চ্যূত করার পক্ষে।
জনসাধারণের মধ্যে যুদ্ধ-বিরোধী ও জারশাহী-বিরোধী জোরদার অভিযান চালানোর সাথে সাথে বলশেভিকরা সেনা বাহিনীর মধ্যেও প্রচার কার্য ও সংগঠন বানানোর কাজ ব্যাপকভাবে শুরু করে। তারা শুধু স্থলসেনার মধ্যেই নয়, নৌ সেনার মধ্যেও ভ্রুণ-সংগঠন তৈরি করে ফেলে। একদিকে তারা ক্রোনস্তানদুত-এ সৈনিক সংগঠন খাড়া করে তো আর আরেকদিকে পেত্রোগ্রাদ-এ সংগঠনের একটি এমন সেনা কমিটি বানায়, যা সেনাদের মধ্যে রাজনৈতিক কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সংগঠনও গড়ে তোলে। তারা সেনাদের মধ্যে এমন প্রচার করেও সফল হয় যে দুটি দেশের সৈনিক একে অপরের শত্রু নয়, বরং তার বিপরীতে, সব দেশের পুঁজিপতি শ্রেণী ও তার সরকার হচ্ছে তাদের শত্রু। ১৯১৭'য় বিপ্লবী প্লাবন জন্ম নেবার আগে তারা সেনার মধ্যে কতটা প্রভাব বিস্তার করছিল তার অনুমান করা যায় উত্তরের মোর্চা থেকে সেনা মুখ্যালয়ে পেশ করা এক রিপোর্ট থেকে, যেখানে লেখা হয় যে বলশেভিকরা এই মোর্চার মধ্যে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়েছে।
বলশেভিকরা যুদ্ধ সম্পর্কিত যে প্রচার অভিযান চালিয়েছিল, তা
সমস্ত মোর্চাতেই সঠিক প্রমাণিত হচ্ছিল, বিশেষ করে যুদ্ধের মোর্চায়। যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ
লোক মারা গিয়েছিল, শুধুমাত্র শত্রু পক্ষের গুলিতেই নয়, বরং যুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষ
ও মহামারীতেও। অবস্থা এমন হয়েছিল যে দেশের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ প্রায় বন্ধ হবার মুখে।
প্রায় দেড় কোটি লোককে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে সরিয়ে সৈন্য বাহিনীতে পাঠানো হয়েছিলো।
ক্ষেতমজুরের অভাবে জমি নিষ্ফলা হয়ে রয়ে গিয়েছিল। একদিকে জনসাধারণের জন্য যুদ্ধ, ধ্বংসের অশনি সঙ্কেত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তো অপরদিকে পুঁজিপতি ও জমিদারদের জন্য তা ছিল ধন অর্জন করার সুবর্ণ সুযোগ। এরফলে মানুষের মধ্যে নিরাশার সাথে সাথে আক্রোশের মনোভাবও জন্মাতে লাগলো।
যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থা ছিল, --- জার-এর সেনা পরাজয়ের পর পরাজয়ের
সম্মুখীন হচ্ছিল। একদিকে জার্মান সেনা ছিল সর্বগ্রাসী ক্ষমতা সম্পন্ন ও উন্নত অস্ত্র
সম্বলিত, তো অপরপক্ষে রুশী সেনার কাছে না ছিল যথেষ্ট খাদ্য সামগ্রী ও জল, আর না ছিল
লড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত হাতিয়ার। ১৯১৬ শেষ হতে হতে প্রায় দু লাখ সৈন্য, সেনা-বাহিনী
ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল এবং যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে তখন পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ কর্মচারী চাকরি
ছেড়ে দিয়েছিল। ইতিমধ্যে এ কথা খোলসা হয়ে যায় যে জার এর যুদ্ধ-মন্ত্রী সুখোম্লিনোভ,
বাস্তবে ছিল জার্মান সেনার এজেন্ট। জার্মান গুপ্তচরের মাধ্যমে প্রাপ্ত আদেশ পালনের
সাথে সাথে সে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রস্তুতির খবরও শত্রু শিবিরে পৌঁছাতো। এরকম পরিস্থিতিতে
রাশিয়াকে হারের মুখ থেকে কে বাঁচাতে পারতো ? যদিও জার নিজের মান বাঁচাতে যুদ্ধমন্ত্রীকে
দোষের ভাগী বানিয়ে দেয়, তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ও তার ওপর দেশদ্রোহের মামলা চলে। তা
সত্ত্বেও জারশাহীর বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকদের ক্রোধ ও ঘৃণা কম হবার কোন লক্ষণই দেখা যায়নি।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব :
একদিকে দেশ অতিক্রম করছে এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে, অপরদিকে রাজ-দরবার হয়ে রয়েছে ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র-স্থল। বিদ্বেষ মূলক পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে ১৬-১৭ ডিসেম্বরের রাতে, গ্রিগোরি রাসপুতিন-কে তার মহলে হত্যা করা হল। হত্যাকারী হিসেবে কাউন্ট ফ্লিক্স তথা ডুমা'র এক প্রতিনিধি ভ্লাদিমির পুরুশ্কেভিচ এর নাম উঠে এল। গ্রিগোরি, জনসাধারণের কাছে খুবই ঘৃণার পাত্র ছিল, কারন ১৯০৫-এর বিপ্লব দমনের ক্ষেত্রে তার ক্রিয়াকলাপ ছিল বহুচর্চিত। কিন্তু রাজ দরবারে তার বিশেষ প্রাধান্য ছিল। তার হত্যার খবরে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত প্রসন্নতা অনুভব করে, এই ভেবে যে, আপদ চুকলো।
বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। স্তলিপিন প্রতিক্রিয়ার বছরগুলিতে পুঁজিপতি ও জমিদার শ্রেণীর যে জোট তৈরী হয়েছিল, তাতে ফাটল সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। পুঁজিপতিদের মনে এই আশঙ্কা ভর করেছিল যে, নিজের সিংহাসন সুরক্ষিত রাখতে জার, জার্মানীর সাথে সমঝোতা না করে বসে। এই সম্ভাবনার কথা কল্পনা করে তাদের শিবির ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছিল। রুশী পুঁজিপতিদের মৌলিক পরিকাঠামো বৃটিশ ও ফ্রান্সের পুঁজিপতিদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেই জন্য এই দুই পক্ষের স্বার্থ এক হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবে বৃটেন ও ফ্রান্স কখনই এমনটা চাইতোনা যে রাশিয়া যুদ্ধ ছেড়ে বেরিয়ে আসুক। সে ছিল এই দূই শক্তির জন্য যুদ্ধের অগ্রবর্তী ফ্রন্টের সুরক্ষা কবচ। এই ভয়ের পরিবেশে ক্ষমতাসীন জোট রাজমহলের ভিতর থেকেই ক্ষমতা পরিবর্তনের চেষ্টা করে। চেষ্টা করা হয় জার-এর ভাই মিশেল রোমানোভকে জার এর সিংহাসন সঁপে দেওয়ার। এটা সম্ভব হয়ে উঠেনি, কিন্তু এটা অবশ্যই হয়েছে যে রাষ্ট্র ক্ষমতার অলিন্দে জার পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১৯১৭ সালের প্রারম্ভ হল আবার একবার দেশব্যাপী রাজনৈতিক হরতাল দিয়ে, ৯ ই জানুয়ারি তারিখে। সেইদিন পেত্রোগ্রাদ, মস্কো ও বাকু'র মত সমস্ত শিল্পকেন্দ্রে জবরদস্ত হরতাল হয়। এইবারের হরতাল আগের হরতালগুলির চেয়ে গুনগত ভাবে ছিল ভিন্ন, আর এর সূত্রপাত হয় পেত্রোগ্রাদ থেকে যেখানে শ্রমিকদের বিক্ষোভ প্রদর্শনে সেনার জওয়ানরাও অংশ গ্রহণ করে। সেই সময় জনগনের মানসিকতার আভাষ পাওয়া যায় পুলিশের এই রিপোর্ট থেকে --- সাধারণ হরতালের মানসিকতা সম্পন্ন নতুন নতুন সমর্থক দিন প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে এবং তারা আজকাল ততটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে যতটা ছিল ১৯০৫-এ।
১৯০৫ সন আবার একবার সামনে এসে গেল, কিন্তু এইবারে শক্তিসাম্য বদলে গিয়েছিল। জারশাহী ছিল বেচারার মত দশায় আর শ্রমিক-কৃষক-সেনা হয়ে উঠেছিল আক্রমাত্বক। ২৫ শে ফেব্রুয়ারি (১০ মার্চ) দিনটি রাশিয়ার ইতিহাসে একটি নিষ্পত্তিমূলক দিনের বার্তা নিয়ে এলো। সেই দিন আবার সারা দেশব্যাপী হরতাল হলো, কিন্ত হরতালের ব্যানারে মজুরি বা কাজের ঘন্টার কথা লেখা ছিলোনা, যা লেখা ছিল তা হচ্ছে --- 'জারশাহী মুর্দাবাদ', 'যুদ্ধ নীতি মুর্দাবাদ', 'যুদ্ধ নয় রুটি চাই'।
পরদিন ঘটলো সেই ঘটনা, যার অপেক্ষা বিপ্লব বহু বছর ধরে করে আসছে।
পাভ্লোভস্কি রেজিমেন্টের চতুর্থ কোম্পানির রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ান শ্রমিকদের ওপর গুলি
চালাতে অস্বীকার করলো এবং গুলি চালালো পুলিশের সেই দলের উপর যারা শ্রমিকদের সাথে সংঘর্ষে
লিপ্ত ছিল। রাশিয়ার ইতিহাসে শ্রমিক-কৃষক-সেনা ঐক্যের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়ে উঠলো, আর
জারশাহী'র দিন এলো ফুরিয়ে। সেই দিনই জারশাহী জারি করলো এক রাজ্যাদেশ ---
'রাষ্ট্রের মৌলিক আইনের ধারা ৯৯-এর অধীনে আমি আদেশ দিচ্ছি যে রাষ্ট্র-ডুমা ও কাউন্সিল অফ স্টেট-এর অধিবেশন স্থগিত রাখা হচ্ছে এবং আপতকালীন পরিস্থিতির ওপর নজর রেখে ১৯১৭'য় আবার তা আহ্বান করা হবে। সেনেট এই রাজ্যাদেশ প্রয়োগ করার জন্য দায়ীত্ব পালন করবে'।
এটি ছিল নিকোলাস দ্বিতীয়'র অন্তিম রাজ্যাদেশ যা আমল করা হয়নি।
২৭ ফেব্রুয়ারি জারশাহীর পতনের দিন ছিল। পেত্রোগ্রাদের ফৌজি
ছাউনি শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে আর তাদেরই জমায়েতে সামিল হতে থাকে। সেদিন
সকালে প্রায় দশ হাজার সৈনিক শ্রমিকদের পক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু সন্ধ্যা হতে হতে
তাদের সংখ্যা প্রায় ষাট হাজার হয়ে দাঁড়ায়। এই সৈন্যেরা এখানেই থেমে থাকেনি। তারা জার
এর মন্ত্রী ও সেনার জেনারেলদের গ্রেপ্তার করা এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করা শুরু
করে দেয়। জেল থেকে মুক্ত হওয়া রাজনৈতিক লোকেরা জারশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল হয়ে
যায়। এইভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে শুধুই যুদ্ধ জয়ের সংবাদ।
অবশেষে বিধ্বস্ত হয়ে যায় জারশাহী এবং শুরু হয় নতুন রাষ্ট্র ব্যাবস্থা কায়েম হওয়ার অপেক্ষা, সোভিয়েত রূপে।
১৯০৫-এর বিপ্লবেই সোভিয়েত গঠনের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুটির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল। সেই সময়ে শুধু শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত গঠন হয়েছিল। যখন কিনা ২৭ শে ফেব্রুয়ারি চলছিল ক্ষমতার একটি নতুন ব্যুহ রচনার কাজ। মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের সাথে গুপ্ত আঁতাতের ভিত্তিতে চতুর্থ ডুমা'র উদারনৈতিক প্রতিনিধিদের এক বৈঠক হয় যেখানে অধ্যক্ষ রোদজ্য়ান্কো-র নেতৃত্বে এক 'অস্থায়ী কমিটি' গঠন করা হয়। এটি ছিল ক্ষমতা কেন্দ্র স্থাপন করার তৎকালিক প্রয়াস।
কিছুদিন পরেই ডুমা'র অস্থায়ী কমিটি এবং শ্রমিক ও সৈনিকদের সোভিয়েত-এর কার্যকারিনী কমিটির মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক হয়, যেখানে প্রিন্স ল্বোভ-এর নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের সাথে সাথেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে জার-কে ছাড়াই জারশাহী জারি থাকবে। এই প্রিন্স ছিল সেই ব্যক্তি যাকে জার ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আগে নিজের প্রধান মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা মনস্থ করেছিল।
এই অস্থায়ী সরকারে সংবিধানিক গণতন্ত্রীদের নেতা মিল্য়ুকোভ এবং অক্টোবরবাদীদের নেতা গুচকোভকে সামিল করা হয়। এইভাবে এই সরকার পুঁজিপতি ও জমিদারদের সরকার হয়ে দাঁড়ায়। লোক দেখানোর জন্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের নেতা কেরেনস্কীকে মন্ত্রী মন্ডলে সামিল করা হয়।
০২ মার্চ-এ এমন একটি ঘটনা ঘটে যা অস্থায়ী সরকারের জার-পক্ষীয় চরিত্র দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দেয়। সরকার গুচকোভ ও শুল্গিনকে জার-এর কাছে এই প্রস্তাব সহ পাঠায় যে তার ভাই মিশেল রোমানোভকে জার নিযুক্ত করে দেওয়া হোক। ভিতরে ভিতরে এই সব কথা চলছিল, তার মধ্যেই রেল কর্মীদের এক সভায় গুচকোভ অতি উৎসাহী হয়ে 'জার মিশেল জিন্দাবাদ'-এর শ্লোগান দিয়ে ওঠে। শ্রমিকদের তরফ থেকে এর তীব্র বিরোধিতা করা হয় ও দাবি উঠতে থাকে যে গুজকোভকে অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক। এরপর অস্থায়ী সরকারের তরফ থেকে খোলাখুলি জার-এর পক্ষপাতীত্ব করার এজেন্ডা বন্ধ হয়ে যায়।
অপরদিকে শ্রমিক ও সৈনিক সোভিয়েতের ক্ষমতার কেন্দ্রও গড়ে উঠছিল।
এইসব সৈনিক প্রতিনিধিরা মূলত সেই কৃষকরা ছিল যাদের যুদ্ধের সময়ে সেনায় পাঠিয়ে দেওয়া
হয়েছিল। এইসব প্রতিনিধিরা পরের দিকে শ্রমিক ও কৃষক সোভিয়েতগুলির মধ্যে ঐক্য স্থাপনার
কাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই পর্যায়ে রাশিয়া তার রাজনৈতিক জীবনের
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিল, যেখানে দুটি ক্ষমতার কেন্দ্র
একসাথে বিদ্যমান ছিল। একদিকে ছিল অস্থায়ী সরকার, যা পুঁজিবাদী একনায়কত্বের প্রতিনিধিত্ব
করছিল আর অপরদিকে ছিল শ্রমিক-সৈনিকদের সোভিয়েত, যা প্রতিনিধিত্ব করছিল শ্রমিক-কৃষকের
নেতৃত্বের।
সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবের পথে :
নতুন ক্ষমতা-কেন্দ্র স্থাপনার পর বলশেভিকদের মধ্যে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে যে এই সরকারের প্রতি কি মনোভাব পোষণ করা হবে এবং বিপ্লবের পরবর্তী কৌশল কী হবে ? তারই সাথে এই প্রশ্নও জুড়ে ছিল যে শ্রমিকদের এমন অগ্রণী ভূমিকা সত্ত্বেও রাশিয়ায় পুঁজিবাদী সরকারের স্থাপনা হয়ে গেল কি ভাবে ?
এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে লেনিন বলেন যে রাশিয়া বর্তমানে ইউরোপের সবচেয়ে বড় নিম্ন পুঁজিবাদী দেশ, সেইজন্য বিপ্লবের ক্ষেত্রে এই নিম্ন-পুঁজিবাদী শ্রেণীর চিন্তাধারার প্রভাব পড়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রাশিয়ার সামাজিক কাঠামোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, সেনা থেকে আরম্ভ করে শ্রমিকদের মধ্যে পর্যন্ত বিরাট সংখ্যক এমন কৃষকরা সামিল হয়েছেন, যাদের মধ্যে নিম্ন পুঁজিবাদী চিন্তাধারার প্রভাব যথেষ্ট মজবুত ভাবে ছিল। সেইজন্য বিষয়টি নিম্ন পুঁজিবাদী শ্রেণীর সংখ্যাগত ভাবে বহুমত হওয়ার মধ্যে নয়, বরং সেটি নিহিত ছিল তার চিন্তাধারার মতাধিক্য হওয়ার মধ্যে।
এই পরিস্থিতিতে বলশেভিকরা বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি কর্মদায়ীত্ব সামনে নিয়ে আসে --- মানুষের কাছে নতুন সরকারের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র তুলে ধরা, মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা ফাঁস করা এবং মানুষকে এ কথা বোঝানো যে শান্তি স্থাপনা একমাত্র তখনই হতে পারে যখন ক্ষমতা পুরোপুরি ভাবে সোভিয়েত-এর হাতে কেন্দ্রীভূত হবে।
অস্থায়ী সরকারের প্রতি মনোভাব প্রসঙ্গে বলশেভিকদের মধ্যে মতভেদ
তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ৩ এপ্রিল, লেনিনের আসার পর বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিপ্লবের
এই উচ্চতায় পৌঁছে থেমে যাওয়াটা সর্বহারা শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতি পূর্ণ নয়,
এমনকি রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বা জনস্বার্থের সঙ্গেও তা সঙ্গতি পূর্ণ নয়। সেইজন্য তিনি সমাজতান্ত্রিক
বিপ্লবের পরবর্তী লক্ষ্যের রূপরেখা পেশ করেন। ওনার এই কর্ম-যোজনা 'এপ্রিল থিসিস' নামে
পরিচিত। এই থিসিস-এ তিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য যে সমস্ত বিষয়গুলিতে জোর দেন
তা হল ---
ভূমির রাষ্ট্রীয়করণ এবং বড় বড় জমিদারির জমি অধিগ্রহণ, সমস্ত
ব্যাঙ্ককে একীকৃত করে জাতীয় ব্যাঙ্কের স্থাপনা ও তাকে শ্রমিকদের সোভিয়েতের অধীনে আনা
এবং সামাজিক উৎপাদন ও উৎপাদিত দ্রব্যের বিতরণ শ্রমিকদের সোভিয়েতের অধীনে নিয়ে আসা,
সংসদীয় গণতন্ত্রের জায়গায় সোভিয়েত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং নতুন ইন্টারন্যাশনাল-এর
স্থাপনা। এই সমস্ত কার্যাবলীর সাথে লেনিন বলশেভিক পার্টিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের
দিকে নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে যেতে আহ্বান করেছিলেন। ওনার শ্লোগান ছিল,
'অস্থায়ী সরকারকে কোন সমর্থন নয়'। ২৪ এপ্রিল প্রকাশ্য সম্মেলন
করে বলশেভিকরা এই কর্মসূচীকে পার্টির নীতি রূপে গ্রহণ করে নেয়। এই ঘোষণার সাথে সাথেই
পুঁজিবাদী পার্টিগুলি-সহ মেনশেভিক তথা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের মধ্যেও উৎকণ্ঠা বেড়ে
যায়।
মেনশেভিকরা ঘোষণা করে দেয় যে বিপ্লব বিপদগ্রস্ত। স্বভাবতই শ্রমিক-কৃষকের হাতে ক্ষমতা সঁপে দেওয়ার শ্লোগানে তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্লেখানভ নিজ পত্রিকা 'যদিনেস্তভ'(একতা)-এ লেনিনের ৩ এপ্রিল-এর ভাষণকে 'মাথামুন্ডুহীন পায়ের প্রলাপ' বলে ঘোষণা করেন।
১৮ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের বিদেশ মন্ত্রী মিল্য়ুকোভ, মিত্র-রাষ্ট্রগুলির কাছে সংবাদ পাঠায় যে রাশিয়ার জনসাধারণ চুড়ান্ত জয়লাভ পর্যন্ত যুদ্ধ জারি রাখার পক্ষে। সেইজন্য সরকার মিত্র রাষ্ট্রের সমর্থনে জার-এর সন্ধি বজায় রাখতে ইচ্ছুক। শ্রমিক ও সৈনিকরা এই ঘটনার খবর জানতে পারে। বলশেভিক পার্টি এর বিরুদ্ধে ২০ এপ্রিল হরতালের ডাক দেয়। তারা এ কথা স্পষ্ট করে দেয় যে জারশাহীর পতন হওয়া সত্ত্বেও তার নীতিসমূহ দস্তুরমত জারি রয়েছে। এই আহ্বানের ফলস্বরূপ লাখ লাখ শ্রমিক ও সৈনিকরা পথে নেমে আসে। তাদের ব্যানারে লেখা ছিল --- 'গুপ্ত সমঝোতার খোলাসা করো! যুদ্ধ শেষ করো! সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে দিতে হবে'!
হরতালীদের বিশাল মিছিল পেত্রোগ্রাদের রাস্তায় এগোতে থাকে। তার মধ্যেই কার্নিলোভ সেই মিছিলের ওপর গুলি চালানোর আদেশ দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর জওয়ানেরা সেই আদেশ মানতে অস্বীকার করে। এই পরিস্থিতিতে উৎসাহিত হয়ে পেত্রোগ্রাদ পার্টি কমিটির কিছু সদস্য অস্থায়ী সরকারকে অবিলম্বে উৎখাত করার শ্লোগান দিয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় কমিটি এই শ্লোগানটিকে বাম-বিচ্যুতি আখ্যা দিয়ে তার সমালোচনা করে। তারা এই পর্যায় কে শান্তিপূর্ণ বিকাশের পর্যায় রূপে চিহ্নিত করে। তাদের বক্তব্য ছিল, এই ঘটনার দ্বারা এটুকুই প্রমাণিত হয় যে অস্থায়ী সরকার সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
সরকার তার সঙ্কটের সমাধান খুঁজে নেয়। ১২ মে, মিল্য়ুকোভ ও গুচকোভকে সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের সরকারে শামিল করে সংযুক্ত অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। বলশেভিকদের অভিযোগ পুরোপুরি সত্য বলে প্রমাণিত হয় যে এরা শ্রমিক-কৃষকের শিবিরে বসে থাকা পুঁজিপতিদের সেবক।
৩০শে মে থেকে ৩রা জুন পর্যন্ত পেত্রোগ্রাদ ফ্যাক্টরী কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রতিনিধিদের তিন চতুর্থাংশ বহুমত বলশেভিকদের নীতির সমর্থন করে। মনে হচ্ছিল যেন পেত্রোগ্রাদের সর্বহারারা বলশেভিকদের শ্লোগান, 'সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে দিতে হবে'র সমর্থনে উঠে দাঁড়িয়েছে। এই ছিল আগামী বিপ্লবের দিশায় উদ্যোগী হওয়া বলশেভিক আহ্বানের জবাব, শ্রমিক জনতার পক্ষ থেকে।
দোসরা ও তেসরা জুনেই সোভিয়েতগুলির প্রথম অখিল রুশী কংগ্রেস সম্পন্ন হয়। বলশেভিকরা এতে অল্পমতে ছিল এবং মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা ছিল বিশাল বহুমতে। তবুও, বলশেভিক প্রতিনিধিরা এই কংগ্রেসে পুঁজিপতিদের সঙ্গে সমঝোতার বিপদ এবং এই যুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের ওপর যথেষ্ট জোরালো বক্তব্য রাখেন। লেনিন, তাঁর ভাষণে এ কথা প্রমাণিত করেন যে একমাত্র সোভিয়েত ক্ষমতাই শ্রমিকদের রুটি ও কৃষকদের জমি দিতে পারে এবং শান্তি স্থাপন করে দেশকে অস্থিরতার পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই বক্তব্যের সাথে সঙ্গতি-সম্পন্ন শ্লোগানের সাথেই পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত-এর কার্যকারিনীর সামনে এক মিছিল বার করা হয়, যার মাধ্যমে বলশেভিক নীতির যথার্থতা তুলে ধরা হয়।
তা সত্ত্বেও অস্থায়ী সরকার যুদ্ধের মোর্চায় আক্রমণ-অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা এমন সাহসী পদক্ষেপ এইজন্য নিতে পারে যে সোভিয়েতগুলির অখিল রুশী কংগ্রেসের সমর্থন তাদের পক্ষে ছিল। এই ঘোষণার মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর কাছে তারা এই বার্তা দেয় যে, তারা সাম্রাজ্যবাদী নীতি জারি রাখতে চায়, বৃটেন ও ফ্রান্সের সাম্রাজ্যবাদীদের ইচ্ছের কাছে নতজানু হয়ে থাকতে চায়। পুঁজিপতি শ্রেণীর ধারণা ছিল যে দেশ কে যুদ্ধের কবলে ছুঁড়ে দিয়ে তারা পুরোপুরি ভাবে ক্ষমতা দখল করতে পারবে। তাদের এই পরিকল্পনাও ছিল যে এই অভিযানে হার হলেও সেই দায় তারা বলশেভিকদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে, এই বলে যে তারা সেনার মধ্যে ভাঙনের অবস্থা তৈরি করেছে।
কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কে যথার্থ ধারণা তাদের ছিল না। যুদ্ধে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেবার এই সিদ্ধান্তের ঠিক পরে পেত্রোগ্রাদে শ্রমিক ও সৈনিকদের স্বতঃস্ফুর্ত প্রদর্শন (৩ জুলাই) শুরু হয়। এই অবস্থা সারাদিন চলতে থাকে আর শেষ পর্যন্ত এই সশস্ত্র-প্রদর্শন দাবী করে যে সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে সঁপে দিতে হবে। সেই সময়ে বলশেভিক পার্টি সশস্ত্র কার্যকলাপের পক্ষে ছিলো না। তাদের মূল্যায়ন ছিল যে এখন বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ বিকাশের কাল আর এই অবস্থা ততক্ষণ বজায় থাকবে যতক্ষণ না মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের সাম্রাজ্যবাদ-পক্ষীয় চরিত্রের পুরোপুরি আবরণ উন্মোচিত হচ্ছে এবং যতক্ষণ না বিপ্লবের পক্ষে আরও বেশি সেনার সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যে ভয় ছিল তাই হল। পেত্রোগ্রাদে বাইরে থেকে সৈনিক ডেকে আনা হয় এবং শান্তিপূর্ণ প্রদর্শনের ওপর গুলি চালানো হয়। রাজধানীর পথ শ্রমিক ও সৈনিকদের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে।
৭ জুলাই লেনিনের বিরুদ্ধে আরও একবার গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। ওনার ওপর উস্কানি দেওয়া ও জার্মান এজেন্ট হওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়। ওনার সাথে সাথে অন্য কয়েকজন বলশেভিক নেতার ওপরেও রাষ্ট্রদ্রোহের মোকদ্দমা করা হয়। লেনিনকে আরও একবার রাশিয়ার বাইরে ফিনল্যান্ডে আশ্রয় নিতে হয়। রাশিয়া, যা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হয়ে উঠেছিল, আবার একবার গণতন্ত্রের কন্ঠরোধে নেমে পড়ে। যে কাজ পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি মিল্য়ুকোভ ও গুচকোভ করতে পারেনি, তা কেরেনস্কী ও তার অনুচরেরা করে দেখায়। সোভিয়েত রাষ্ট্রশক্তির কন্ঠ-রোধ করা হয়, রাষ্ট্রশক্তির দু-তরফা কেন্দ্রের ব্যবস্থা শেষ হয়ে যায় আর তার সাথেই বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ বিকাশের সম্ভাবনার ইতি হয়ে যায়।
ইতিহাসের বিচিত্র বৈপরীত্য চোখে পড়ে, একদিকে লেনিন অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন আর অন্য দিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির নেতা কেরেনস্কী, ৮ই জুলাই, অস্থায়ী সরকারের দায়িত্ব সামলাতে ব্যস্ত ছিলেন। এবার পুঁজিবাদী সরকারের নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রের মুখোশ পরা পুঁজিবাদের দালালের হাতে ন্যস্ত ছিল আর সর্বহারা বিপ্লবের নেতৃত্ব ছিল আসল সমাজতন্ত্রিক নেতার হাতে। দুজনে ছিল একে অপরের সামনা সামনি, শত্রু রূপে।
এই পরিস্থিতিতে পার্টি কংগ্রেসের আয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছিল। দশ বছরের দীর্ঘ অন্তরালের পর পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের আয়োজন করা হয় ২৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত। এখানে একথা উল্লেখযোগ্য যে জারশাহীর পতন সত্ত্বেও এবং শাসন ক্ষমতা সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবী নেতা কেরেনস্কী'র হাতে থাকা সত্ত্বেও বলশেভিক পার্টির কংগ্রেস চলছিল গোপন ভাবে।
লেনিন এই কংগ্রেসে যোগদান করেননি। তিনি গোপন অবস্থান থেকে কংগ্রেস কে দিশা-নির্দেশ প্রদান করছিলেন। এই পরিস্থিতিতে আরও একবার প্রমাণিত হল যে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র বিদ্রোহী শ্রমিকদের দমন করা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। কিন্তু দমন প্রত্যেক সময়ই কার্যকর হাতিয়ার রূপে সফল হয়না। যখন তার টক্কর হয় বিদ্রোহী জনতার সাথে, তখন দমনের প্রতিটি প্রয়োগ নতুন বিদ্রোহের জন্ম দেয়। রাশিয়া এমনই এক স্তরে এসে দাঁড়িয়েছিল আর এই স্তরে পৌঁছতে বলশেভিকদের রাজনৈতিক প্রচার অভিযান বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তাদের প্রচার-পরিকাঠামোল বিষয়ে অনুমান এই দেখে করা যায় যে, ৩ জুলাই পর্যন্ত, অর্থাত যখন অবধি বলশেভিকরা প্রকাশ্য এবং আইনি ভাবে কাজ করছিল, তাদের তদারকিতে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৪১ টি যারমধ্যে ২৯ টি রুশ ভাষায় এবং ১২ টি অন্যান্য ভাষায়।
এই ব্যাপক প্রচার অভিযান আর সমঝোতা-বিহীন সংগ্রামেরই ফল ছিল যে দমন মূলক কার্যকলাপের পর কেরেনস্কী সরকার এবং মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের ওপর শ্রমিক-কৃষকের মোহভঙ্গ তীব্রতার সাথে হয়ে চলল আর এদের পরিচিতি হতে থাকলো 'সোশ্যাল জেলর' হিসেবে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়াল যে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক-কৃষক, মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের সদস্য-কার্ড ছিঁড়ে ফেলে বলশেভিক পার্টিতে সামিল হতে থাকলো। বিখ্যাত বই, 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন'-এর লেখক আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলেছিলেন যে, জুলাই পর্যন্ত যে বলশেভিকরা লুকিয়ে-চুরিয়ে বেড়াতো, অক্টোবর আসতে আসতে তারাই রাশিয়ার ভাগ্য বিধাতা কি করে হয়ে গেল ! এসব সম্ভব হতে পারলো এই কারণে যে বলশেভিকরা অস্থায়ী সরকারে সামিল না হয়ে এবং সমাজতান্ত্রিক নামধারী পার্টিগুলির প্রকৃত চরিত্র চিত্রনের যথার্থ কৌশল গ্রহন করে চলে, ক্রমাগত ভাবে।
ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেস ছিল এই সংগ্রামের পরবর্তী পদক্ষেপ। এই কংগ্রেসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, বিপ্লবের পরবর্তী লক্ষ্য অর্থাৎ সশস্ত্র বিদ্রোহের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যকলাপের যথার্থ সমন্বয় ও সংযোজন সাধন করা। পার্টি এই কাজ সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করে এবং শ্রমিক ও সৈন্যদের আহ্বান করে যে এই কর্মদায়ীত্ব পালন করতে তারা যেন তৈরি থাকে। কিন্তু বিতর্কের মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক বিন্দু ছিল --- বিপ্লবের পর শ্রমিক-কৃষকের রাজত্বে প্রধাণ কর্মদায়ীত্ব কী হবে ?
দীর্ঘকাল যাবৎ মেনশেভিক ও বলশেভিক ধারার মধ্যে দোল খাওয়া ট্রটস্কি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এই কংগ্রেসে বলশেভিক পার্টির সদস্যতা গ্রহণ করেছিল। তার এক সমর্থক কংগ্রেসে প্রস্তাব পেশ করে যে রাশিয়া, সমাজতন্ত্রের দিশায় তখনই অগ্রসর হতে পারবে যখন পশ্চিমের দেশগুলিতে বিপ্লব সম্পন্ন হবে। এই প্রস্তাবনার খন্ডন করে স্তালিন বলেন যে এই সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায়না যে, পুরো পৃথিবীকে সমাজতন্ত্রের পথ দেখানো প্রথম দেশ হতে পারে রাশিয়া। একই সাথে তিনি এই আহ্বানও করেন যে, আমাদের এই পুরনো চিন্তা ছেড়ে দেওয়া উচিত যে ইউরোপই সমাজতন্ত্রের পথ প্রদর্শক হতে পারে। এটি পুরোনোপন্থী মার্কসবাদ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সৃষ্টিশীল। এই দ্বিতীয় চিন্তাধারার অনুসরনই আমাদের করা উচিত।
এই কংগ্রেসেই বুখারিন শ্রমিক-কৃষক সংশ্লেষনের বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন। তার জবাবে স্তালিন স্পষ্ট করেন যে কৃষক সমুদায়ের মধ্যে আলাদা আলাদা গোষ্ঠীবদ্ধতা রয়েছে। ধণী কৃষক পুঁজিপতিদের পক্ষে আছে এবং গরিব কৃষক আছে শ্রমিকদের সাথে জোটবদ্ধতার পক্ষে। সার্বিক ভাবে এই কংগ্রেস লেনিনের 'এপ্রিল থিসিস'কে বিপ্লবের বর্তমান পর্যায়ে কর্মদায়ীত্ব রূপে স্বীকৃতি দেয়। 'নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও' তথা 'পার্টির ব্যানারের নীচে ঐক্যবদ্ধ হও'-এর শ্লোগানের সাথে কংগ্রেসের সমাপন হয়।
একদিকে বলশেভিক বিপ্লবের কৌশলের ভাঙ্গা-গড়া চলছিল, তো আরেকদিকে প্রতিক্রিয়াশীলরা গণ বিদ্রোহ দমনের নতুন নতুন উপায় খুঁজে বার করছিল। এক পক্ষ সোভিয়েতকে নাস্তানাবুদ করে দিতে সচেষ্ট ছিল, তো অন্য পক্ষ কঠোর অনুশাসনের নামে বিদ্রোহী সৈন্যদের দমন-এর প্রস্তুতি করতে শুরু করেছিল। সেনা প্রমুখ কোর্নিলোভ, যে যুদ্ধের মোর্চায় সৈনিকদের মৃত্যুদন্ডের নিয়ম বলবৎ করেছিল, সে এখন দাবি করতে থাকে যে এই নিয়ম শান্তিপূর্ণ এলাকায়ও লাগু করা হোক।
রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে অস্থায়ী সরকার 'কাউন্সিল অফ স্টেট'
গঠনের উদ্দেশ্যে জমিদার, পুঁজিপতি, সেনা প্রমুখ ও কাজ্জাকদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করে।
সেখানে কেরেনস্কী খুব গর্বের সাথে ঘোষণা করে যে বিপ্লবের সমস্ত প্রয়াস বলপূর্বক দমন
করা হবে। জমিদারদের জমি দখলের জন্য কৃষকদের অনধিকার প্রয়াসও একই রকম কঠোরতার সাথে দমন
করা হবে। বলশেভিকরা এই অপপ্রয়াস-এর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের হরতালের আহ্বান করে আর তার
প্রভাব দেখা যায় দেশব্যাপী।
এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের সাথে সাথে সৈন্য ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতিও চলছিলো যা 'কার্নিলোভ ষড়যন্ত্র' নামে পরিচিত। এই ষড়যন্ত্রের ঔচিত্য প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছিল যে, বলশেভিকরা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ষষ্ঠ মাসের সমাপ্তির অবসরে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অজুহাতে তারা পেত্রোগ্রাদে হামলা করতে চাইছিল। শুরুতে কেরেনস্কী সরকার এই অভিযানের পক্ষে ছিল, কিন্তু পরে সে পিছু হটে।
বলশেভিকরা এই পরিস্থিতির মোকাবিলা অত্যন্ত সাহসের সাথে করে এবং ষড়যন্ত্রটিকে বিফল করার চৌতরফা প্রয়াস শুরু হয়। শ্রমিক ও সেনাদের আহ্বান করা হয় যে তারা এই ষড়যন্ত্রের কঠোর ভাবে মোকাবিলা করুক। এই আহ্বান অনুযায়ী প্রস্তুতিও হতে থাকে। শ্রমিকরা সশস্ত্র হতে থাকে, ব্যারাক তৈরি করা ও রেল লাইন তছনছ করা চলতে থাকে, অবরোধ গড়ে তোলা হয় এবং সেনা জওয়ানরা যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। একদিকে এই প্রস্তুতি চলছিল আর অন্যদিকে সৈন্য ইউনিট গুলোতে এমন সব প্রতিনিধিদের পাঠানো হতে থাকে, যারা জওয়ানদের কার্নিলোভ-এর প্রকৃত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করতে পারে। এর প্রভাব পড়ে এবং সত্য জানবার পর জওয়ানেরা 'পেত্রোগ্রাদ মার্চ' অভিযানে যেতে অস্বীকার করে। নিজের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর কার্নিলোভ আত্মহত্যা করে আর তার সহযোগী দেনিকিন-কে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু কেরেনস্কী সরকার উদারতা দেখিয়ে তৎক্ষণাত তাকে ছেড়ে দেয়।
কার্নিলোভ কান্ডে পুরো দুনিয়ার কাছে পরিসষ্কার হয়ে যায় যে রুশী সমাজে এক গুণগত পরিবর্তন এসে গিয়েছে। বিপ্লবী আর প্রতিবিপ্লবী শক্তির মধ্যে বিপ্লবীদের পাল্লাই ভারী। এর সত্যতা বোঝা যায় এই বিষয়টি থেকে যে বলশেভিকরা ক্ষমতাসীন ছিলোনা, কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল তাদেরই পক্ষে। শ্রমিক ও জওয়ানেরা নিঃসঙ্কোচে তাদের নির্দেশ পালন করছিল। এর প্রভাব গ্রামীন সমাজেও পড়ে। গরীব কৃষকরা সদলবলে বলশেভিক শিবিরে আসতে থাকে। মধ্যম কৃষকরা পর্যন্ত অনুভব করতে থাকে যে তাদের স্বার্থ বলশেভিকদের পক্ষে থেকেই সুরক্ষিত থাকতে পারে। শক্তির ভারসাম্যে এই পরিবর্তনের ফলে গ্রামে জমিদারদের জমি দখলের অভিযান তীব্রতার সাথে শুরু হয়ে যায়। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো সোভিয়েত বলশেভিকদের পক্ষে চলে আসে।
স্বাভাবিক ভাবেই শ্রেণীগত ভারসাম্যে আসা এই পরিবর্তনের প্রভাব রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপরেও পড়তে বাধ্য। এরফলে মেনশেভিক ও সমাজতান্ত্রিক-বিপ্লবী দলের মধ্যে ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় এবং তাদের বাম অংশ বলশেভিকদের পক্ষে আসতে থাকে।
শক্তির ভারসাম্যে এই পরিবর্তন সত্ত্বেও পুঁজিপতিশ্রেণী শাসন ক্ষমতা ছাড়তে তৈরি ছিলোনা। তারা জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য আবার একবার গণতন্ত্রের আবরণ দেওয়ার চেষ্টা করে। এই উদ্দেশ্যে ১২ ই সেপ্টেম্বর অখিল রুশী গণতান্ত্রিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সমাজতান্ত্রিক নামধারী পার্টিগুলি, সমঝোতা-পন্থী সোভিয়েত গুলি, ট্রেড ইউনিয়নগুলি, জেমোস্তোভো প্রতিনিধিরা এবং পুঁজিপতিরা সামিল হয়েছিল। এই সম্মেলনে গণতন্ত্রের অস্থায়ী একটি সংস্থা গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়, যা প্রী-পার্লামেন্ট নামে পরিচিত।
বলশেভিকরা এর বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নিজেদের পুরোনো দাবীতে অটল থাকে --- সমস্ত ক্ষমতা (রাষ্ট্র-ক্ষমতা) সোভিয়েতের হাতে দিতে হবে। নিজেদের এই দাবীকে বাস্তবতায় পরিবর্তিত করতে তারা অক্টোবরের শেষার্ধে সোভিয়েতের দ্বিতীয় অখিল রুশী কংগ্রেসের আয়োজন করতে থাকে। কিন্তু এই দলেরই সদস্য কামেনেভ এবং জিনোভিয়েভ-এর মত লোকেরা প্রী-পার্লামেন্টে সামিল হওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিল।
পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোর সোভিয়েতগুলিতে সংখিগরিষ্ঠতা হাসিল করার পর বলশেভিকরা গণ বিদ্রোহের প্রস্তুতিতে লেগে পড়ে। বিপ্লব সঞ্চালনের কৌশল নির্ধারিত করতে ১০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই বৈঠকে বিশ্ব পরিস্থিতি তথা রাশিয়ার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির মূল্যায়ণ করে লেনিন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে রাষ্ট্র- ক্ষমতা দখল করার অনুকূল সময় এসে গেছে। তিনি নিজের প্রস্তাবে এই বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করেন যে অস্থায়ী সরকার রুশী রাজধানী পেত্রোগ্রাদ থেকে মস্কোয় স্থানান্তরিত করার প্রস্তুতি চালাচ্ছে আর এর পিছনে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিপ্লবের এই কেন্দ্রটিকে জার্মান জল্লাদদের হাতে অর্পণ করে দেওয়া। তিনি আরও সতর্ক করেন যে দ্বিতীয়বার কার্নিলোভ-ষড়যন্ত্রেরও রচনা করা হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে এটা উচিত এবং জরুরি যে পুঁজিবাদী দালালদের রাষ্ট্র-ক্ষমতা থেকে বেদখল করে দেওয়া হোক। এই বৈঠকেই বিপ্লবী সৈন্য কমিটিও (পেত্রোগ্রাদ) গঠন করা হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। তারা ছিলো পুঁজিবাদী গণতন্ত্র স্থাপনার পক্ষে। তাদের বিরোধিতা এখানেই থেমে থাকেনি। ১৬ অক্টোবরের বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বিদ্রোহের যে বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছিল, এরা তারও বিরোধিতা করে। এই প্রশ্নে কমিটির ভিতর পরাজিত হওয়ার পর ১৮ অক্টোবর এই দুজন, মেনশেভিক পত্রিকা 'নোবায়া জিজ্ন'-এ সম্পুর্ন পরিকল্পনা প্লকাশ করে নিজেদের বিরোধিতা প্রকাশ্যে জাহির করে দেয়। এটা ছিল পার্টি ও বিপ্লবের প্রতি প্রকাশ্য বিশ্বাসঘাতকতা।
অন্যদিকে কেরেনস্কী'র প্রতিক্রিয়াশীল সরকারও নিজেদের প্রস্তুতিতে জোরদার ভাবে লেগে থাকে। একদিকে সেনার মধ্যে অফিসারদের সংগঠন 'অফিসার্স লীগ' গঠন করা হচ্ছিল, অন্যদিকে বিপ্লব সমলানোর জন্য 'শক-ব্যাটেলিয়ান' তৈরি করা হচ্ছিল। যেমন তেমন ভাবে ৪৩ টি 'শক ব্যাটেলিয়ান' দাঁড় করানো হয়। নিজেদের প্রস্তুতি অনুযায়ী তারা ১৯ অক্টোবর সৈনিক শিবির থেকে সৈন্য দলগুলিকে পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোর উদ্দেশ্যে ডেকে নিতে থাকে। মস্কোতে তা সফল ভাবে করেও নেয়। পেত্রোগ্রাদে তাদের পরিকল্পনা ছিল যে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত ও বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির মুখ্য কার্যালয় স্মোল্নী'র ওপর সেই দিনই হামলা করে দেওয়ার, যেদিন সোভিয়েতগুলির অখিল রুশী সম্মেলন চলবে।
কেরেনস্কী সরকার বিপ্লবী আন্দোলনের ওপর মোক্ষম হামলা চালায় ২৪ অক্টোবরেই। বলশেভিক পার্টির মুখপত্র 'রাবোচায়া পুত'-এর মুখ্যালয়ে হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের আক্রমণ। কিন্তু রেড গার্ড ও বিপ্লবী জওয়ানদের প্রতি-আক্রমণের সামনে তাদের পিছু হটতে হয়। এবং সকাল ১১টা বাজতেনা বাজতেই 'অস্থায়ী সরকারকে উপড়ে ফেলো' আহ্বানের সাথে সংবাদপত্র মারফত সেই খবর জনসমক্ষে চলে আসে। এর সাথেই বিপ্লবের দিশা নির্দেশের জন্য গঠিত পার্টি সেন্টার-এর আদেশে জওয়ান ও লাল ফৌজ-এর বাহিনী স্মোল্নী ভবনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
২৪ অক্টোবর লেনিন স্মোল্নী পৌঁছোন আর সেখানকার কাজকর্মের দায়িত্ব
নিজের হাতে তুলে নেন। রেড গার্ড ও সেনার ছোট ছোট দল গুলোকে পাঠিয়ে দেন অস্থায়ী সরকারের
মুখ্য কার্যালয়, শীত প্রাসাদ ঘিরে ফেলতে। ২৫ অক্টোবর (৭ নভেম্বর) পেত্রোগ্রাদের রেল
স্টেশন, ডাক ঘর, মন্ত্রণালয় ও স্টেট ব্যাঙ্ক, বিপ্লবীরা কব্জা করে নেয়। সেই দিনই বলশেভিকরা
জনতার নামে এক ইশতেহার জারি করে, যাতে বলা হয় যে পুঁজিবাদী 'অস্থায়ী সরকার'-কে ধ্বংস
করে দেওয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্র-ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে এসে গেছে।
একই দিনে স্মোল্নী-তে সোভিয়েতের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ রাতে শুরু হয়। এতে বলশেভিকদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে মেনশেভিক, বুন্দ তথা দক্ষিণপন্থী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা এই সম্মেলনের বহিষ্কার করে। তারা এই অধিবেশনেই বক্তব্য জারি করে এই বিপ্লব কে 'সামরিক ষড়যন্ত্র' বলে ঘোষনা করে দেয়। অধিবেশন তাদের এই কার্যকলাপের নিন্দা করে খুশী ব্যক্ত করে এই ভেবে যে বিশ্বাসঘাতকরা বিদায় নিল।
এরপর সোভিয়েতের এই কংগ্রেস ঘোষণা করে --- 'শ্রমিক, সৈন্য ও কৃষকদের বিশাল বহুমতের সমর্থনে এবং পেত্রোগ্রাদে সম্পন্ন হওয়া শ্রমিক ও সেনা জওয়ানদের জয়ী হওয়া বিপ্লবের সমর্থনে, এই কংগ্রেস, রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে'।
এই ঘোষণার সাথে সাথেই বলশেভিকদের চির প্রতীক্ষিত শ্লোগান 'সমস্ত ক্ষমতা (রাষ্ট্র-ক্ষমতা) সোভিয়েতের হাতে' বাস্তবায়িত হল। পরদিন এই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দুটি আদেশ জারি করা হয়, শান্তি সম্পর্কে ও জমির প্রশ্নে। প্রথম আদেশ-এ রুশী সরকারের শান্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয় এবং যুদ্ধরত দেশগুলির সরকার এবং শ্রমিকদের শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব পাঠানো হয়। দ্বিতীয় আদেশ-এ ঘোষণা করা হয় যে জমির উপর জমিদারদের স্বত্বাধিকার বিনা ক্ষতিপূরনে খারিজ করা হচ্ছে ও জমির উপর রাষ্ট্রের স্বত্বাধিকার কায়েম করা হচ্ছে। একই সাথে এও ঘোষণা করা হয় যে জমিদারদের, জার পরিবারের, চার্চের ও ধার্মিক সংস্থার জমিতে এযাবৎ চাষ করতে থাকা চাষিদের বিনামূল্যে জমি দেওয়া হবে। এই আদেশের পর ৪০ কোটি একরেরও বেশি জমি চাষিদের হাতে চলে আসে। তেমনি ভাবেই কৃষকেরা জমিদারকে কর দেওয়া থেকেও মুক্ত হয়ে যায়, যারফলে প্রায় ৫০ কোটি রুবল কৃষকদের আয়ের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এই আদেশ বলে খনিজ সম্পদ, জঙ্গল ও জলস্রোতকেও ব্যাক্তিগত সম্পত্তির আওতা থেকে মুক্ত করে সার্বজনিক সম্পত্তি রূপে ঘোষণা করা হয়।
এর সাথেই কংগ্রেস, প্রথম সোভিয়েত সরকার গঠন করে, যার অধ্যক্ষ হিসেবে চয়ন করা হয় লেনিনকে।
এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমেই রুশ বিপ্লবের প্রথম অধ্যায় --- রাষ্ট্র
ক্ষমতা দখলের অধ্যায় সম্পুর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তী অধ্যায় এর চেয়েও বেশি কন্টকাকীর্ণ
ছিল। তাতে ঘরোয়া এবং বিদেশী প্রতিক্রায়াশীলদের হামলার সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের নকল
সমাজতন্ত্রীদের অন্তর্ঘাত-এর মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কোন একটি দেশে সমাজতন্ত্রের জয়ী
হওয়ার যে স্বপ্ন লেনিন
দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত হল। এরপর প্রতি পদক্ষেপে নিজের শত্রু
ও সমালোচকদের মোকাবিলা করে লেনিন, ও পরে স্তালিন, সমাজতন্ত্র কে এগিয়ে নিয়ে যান এবং
রাশিয়া, পুরো দুনিয়ার সর্বহারা বিপ্লবের ভরসা-স্থল হয়ে দাঁড়ায়।
শব্দ পরিচয়
* ডিসেম্বরবাদী --- অভিজাত বিপ্লবীদের সংগঠন। ডিসেম্বর ১৮২৫-এ
ভূদাস প্রথার অবসান ও জারশাহীর একনায়কত্ব সীমিত করার লক্ষ্যে বিদ্রোহের সূচনা করে।
এই কারনে ডিসেম্বরবাদী বলা হত।
* নারদনিকবাদী --- নিম্ন পুঁজিবাদী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ১৮৮১-তে
জার-কে হত্যার পর তাদের বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়। এরা রাশিয়ায় পুঁজিবাদী বিকাশের পরিপন্থী
ছিল এবং কৃষকদের বিপ্লবের প্রধান শক্তি বলে মনে করতো। রাশিয়ায় মার্কসবাদের প্রথম প্রচারক
প্লেখানভ, প্রথমে এই ধারার সদস্য ছিলেন।
* সামাজিক গণতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টি --- রুশী শ্রমিক শ্রেণীর
পার্টি। ১৮৯৮-এ স্থাপিত।
* বলশেভিক --- রুশী সামাজিক গণতন্ত্রিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয়
কংগ্রেস (১৯০৩)-এর বিভাজন পর্বে সংখ্যাগুরু অংশের প্রতিনিধি। লেনিনের নেতৃত্বে রুশ
বিপ্লবে ধারাবাহিক ভাবে মার্কসবাদের অনুসরন করে এবং বিপ্লবকে জয়ের শিখরে নিয়ে যায়।
তখন থেকে বলশেভিক শব্দটি বিপ্লবের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।
* মেনশেভিক --- রুশী সামাজিক গণতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টির দ্বিতীয়
কংগ্রেসে বিভাজন পর্বে সংখ্যালঘু অংশের প্রতিনিধি।
* ইস্ক্রা (স্ফুলিঙ্গ) --- ১৯০২-এ লেনিন দ্বারা স্থাপিত পত্রিকা।
অর্থনীতিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরে সংশোধনবাদীরা পত্রিকাটি
হাতিয়ে নেয়।
* অর্থনীতিবাদ --- শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিতে সংশোধনবাদী ধারা,
যারা মনে করতো শ্রমিকদের কাজ নিজেদের আর্থিক লড়াইয়ের মধ্যেই সীমিত রাখা উচিত।
* সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী --- ১৯০২-এ বিচ্ছিন্ন নারদনিকবাদী
গ্রুপগুলিকে মিলিয়ে তৈরি করা পার্টি। কুলাকদের স্বার্থ রক্ষাকারী। এদের দক্ষিণ পন্থী
ধারার নেতা কেরেনস্কী, যে পরে পুঁজিবাদী সরকারের প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এর বামপন্থী ধারা
অক্টোবর বিপ্লবের সমর্থন করে, কিন্তু ১৯১৮'য় বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়।
* ব্ল্যাক হানড্রেডস --- রুশী সমাজের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল
সামন্তী জমিদারদের নিকৃষ্টতম প্রতিনিধি। ১৯০৫-এ গঠিত। জমিদারদের গুন্ডা, ব্যাবসায়ীদের
লেঠেল তথা সমাজের লম্পট শ্রেণীর দল।
* অক্টোবরবাদী --- ১৭ অক্টোবর ১৯০৫-এ জার-এর ঘোষণার সমর্থক।
এইজন্য অক্টোবরবাদী বলা হত। বড় পুঁজিপতি ও নবজাত বড় পুঁজিবাদী-জমিদারদের (কুলাক) স্বার্থের
সেবক।
* সাংবিধানিক গণতন্ত্রী (ক্যাডেট) --- উদারপন্থী পুঁজিবাদ তথা
জারশাহীর সমর্থক। আইনি মার্কসবাদীদের বিচ্ছিন্ন লোকেদের নিয়ে ১৯০৫-এ গঠিত দল।
* ত্রুদোবিক --- নিম্ন পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক অংশের প্রতিনিধি।
- সমাপ্ত -
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন