সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম - অনুবাদে রুমা নিয়োগী(প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)




সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম

চেন ইয়েন শি

১। অর্থনীতিবাদ এবং বার্নস্টাইনবাদের খন্ডন

সর্বহারাশ্রেণির বৈপ্লবিক রণনীতিগত কর্তব্য

১৮৮০-র দশকের শেষদিকে লেনিন যখন বিপ্লবের পথে যাত্রা শুরু করলেন, তখন তিনি তরুণ। রাশিয়ায় তখন রাজত্ব করছে জারের নির্মম, প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরতন্ত্র। মেহনতি জনতা, শ্রমিক, কৃষকরা নিষ্ঠুর শোষণের শিকার এবং সব ধরনের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে সর্বহারাশ্রেণির বৃদ্ধি ঘটছিল, তারা গণ ধর্মঘট শুরু করেছে। এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ায় মার্কসবাদ বিস্তার লাভ করতে শুরু করে এবং প্রথম মার্কসবাদী চক্রগুলির জন্ম হয়। কিন্তু এই মার্কসবাদী চক্রগুলির শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের সঙ্গে কোন যোগ ছিল না বললেই চলে, এবং শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার এবং বিক্ষোভমূলক কাজের প্রয়োজন সম্পর্কেও তারা ছিল অজ্ঞ। সেসময় রুশ মার্কসবাদীদের মূল জরুরি কাজটা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সংযোগ ঘটানো এবং চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মার্কসবাদী চক্রগুলিকে একটি ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক পার্টিতে সংহত করা। এর পরবর্তী পদক্ষেপ হবে জারের স্বৈরতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার লড়াইয়ে শ্রমিকশ্রেণিকে নেতৃত্ব দেওয়া, যাতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা যায়।

সেসময়কার রুশ মার্কসবাদীদের মধ্যে একমাত্র মহান লেনিনেরই ছিল এইসব ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্বন্ধে সবচেয়ে দৃঢ় এবং সবচেয়ে স্বচ্ছ ধারণা। ১৮৯৪ সালে তিনি লিখলেন, “‘জনগণের বন্ধু’ কারা এবং তারা কিভাবে সমাজ-গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে”। এতে তিনি বললেন

যখন রুশ শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণী প্রতিনিধিরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণাকে, রুশ শ্রমিকের ঐতিহাসিক ভূমিকার ধারণাকে আত্মস্থ করবে, যখন এইসব ধারণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং যখন শ্রমিকদের এখনকার বিক্ষিপ্ত অর্থনৈতিক সংগ্রামকে সচেতন শ্রেণি সংগ্রামে রূপান্তরিত করার জন্য স্থায়ী সংগঠন গড়ে উঠবে --- তখন রুশ শ্রমিকশ্রেণি, সমস্ত গণতন্ত্রের শক্তির পুরোভাগে এসে দাঁড়াবে, স্বৈরতন্ত্রকে ধ্বংস করবে এবং রুশ সর্বহারাকে (সমস্ত দেশের সর্বহারাদের সঙ্গে) কমিউনিস্ট বিপ্লবের বিজয়ের লক্ষ্যে প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংগ্রামের সিধে রাস্তায় নেতৃত্ব দেবে।

এই বৈপ্লবিক রণনীতিগত কর্মসূচী লেনিন স্পষ্ট ভাষায় উপস্থিত করেছিলেন রুশ সর্বহারা এবং মার্কসবাদীদের সামনে, এবং তার রূপায়ণের জন্য সমস্ত মার্কসবাদ-বিরোধী প্রবণতার বিরুদ্ধে এক তিক্ত লড়াই চালিয়েছিলেন।

তখন মার্কসবাদের প্রসার ঘটানো এবং মার্কসবাদী শ্রমিক পার্টি গঠনের পক্ষে প্রধান বাধা ছিল নারদিজম। নারদনিকরা রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশের অনিবার্যতাকে অস্বীকার করত, সর্বহারাকে সবচেয়ে অগ্রণী এবং বিপ্লবী শ্রেণি হিসাবে স্বীকার করত না এবং জনগণের বিপুল শক্তিকে অবজ্ঞা করে তারা ব্যক্তি-সন্ত্রাসের প্রচার করত। প্লেখানভ এবং তাঁর শ্রমিকমুক্তি গোষ্ঠী এই নারদনিকদের দারুণ আঘাত হেনেছিলেন, কিন্তু তাতেও মতাদর্শগত ক্ষেত্রে নারদিজমকে ধংস করার কাজটা বাকি ছিল। কাজটা লেনিনের ঘাড়ে পড়ল। তাঁর “ ‘জনগণের বন্ধু’ কারা এবং তারা কিভাবে সমাজ-গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে” রচনায় লেনিন নারদনিকদের যাবতীয় তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক কর্মসূচীকে চূড়ান্তভাবে খন্ডন করলেন এবং সর্বহারারাই যে সমাজের সবচেয়ে অগ্রণী এবং বিপ্লবী শ্রেণি, সেই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করলেন। সেইসঙ্গে তিনি এই প্রথমবার জারতন্ত্র, ভূস্বামী এবং পুঁজিপতিদের উৎখাতের মূল উপায় হিসেবে রুশ শ্রমিক এবং কৃষকের মধ্যে মৈত্রীর ধারণা উপস্থিত করলেন। একই সঙ্গে তিনি নির্দিষ্টভাবে দেখালেন যে, নব্বইয়ের দশকের নারদনিকরা জারের সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সংগ্রামকে পরিত্যাগ করেছে এবং আপসের পথে হাঁটছে, এবং এইভাবে ‘জনগণের বন্ধু’ থেকে তারা কার্যত কুলাকদের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে।

লেনিন নারদীয় মতাদর্শকে চূর্ণ করেছিলেন। তিনি ‘আইনি মার্কসবাদে’রও পুঙ্খানুপুঙ্খ সমালোচনা করেছিলেন। ‘আইনি মার্কসবাদী’রা নারদিজমের বিরুদ্ধে লড়াইকে ব্যবহার করে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনকে বুর্জোয়া স্বার্থের অধীন করতে চেষ্টা করেছিল। প্রখ্যাত ‘আইনি মার্কসবাদী’ পিটার স্ত্রুভ পুঁজিবাদের ওকালতি করতেন, পুঁজিবাদের ঢালাও প্রশংসা করতেন। তিনি বলতেন, ‘আমরা আমাদের সংস্কৃতির অভাব অনুভব করি এবং পুঁজিবাদের কাছে যাই শেখার জন্য’। লেনিন নির্দিষ্ট করে দেখালেন যে, এইসব ‘আইনি মার্কসবাদী’রা আসলে বুর্জোয়া উদারনীতিবাদী এবং তারা মার্কসবাদকে বুর্জোয়া সংস্কারবাদে পরিবর্তিত করার চেষ্টায় আছে। এরা শ্রেণিদ্বন্দ্বকে উপেক্ষা করে এবং সর্বহারা বিপ্লব ও সর্বহারা একনায়কত্বের তত্ত্বকে অস্বীকার করে।

স্বতঃস্ফূর্ততার উপাসক এবং অর্থনৈতিক সংগ্রামের সংস্কারগ্রস্ত

অর্থনীতিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

‘আইনি মার্কসবাদে’র উত্তরসূরী হিসেবে অর্থনীতিবাদ এরপর বাজার দখল করে। ১৮৯৭ সালে জার সরকার লেনিনকে সাইবেরিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে নির্বাসন দেয়। তিনি সেখানে ‘অর্থনীতিবাদী’দের কাজকর্ম ভালোভাবে নিরীক্ষণ করেন। ১৮৯৯ সালে ‘অর্থনীতিবাদী’দের একটি গোষ্ঠী এক ইস্তাহারে বলে যে, শ্রমিকদের উচিত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংগ্রাম করা এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যাপারটা বুর্জোয়া উদারনীতিবাদীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। তারা সর্বহারাশ্রেণির কোন রাজনৈতিক পার্টি গঠনেরও বিরোধিতা করে। এই ইস্তাহারটি পড়বার পর লেনিন কাছাকাছি যেসব মার্কসবাদীরা নির্বাসনে ছিলেন, তাঁদের একটা মিটিং ডাকেন এবং সেই মিটিং-এ লেনিনের লেখা ‘রুশ সমাজ-গণতন্ত্রীদের প্রতিবাদ’ গৃহীত হয়। এরপর তিনি ‘আমাদের কর্মসূচী’ ও ‘রুশ সমাজ-গণতন্ত্রে পশ্চাৎগতির এক প্রবণতা’ সহ বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন। নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হলে লেনিন বিদেশে চলে যান এবং ১৯০২ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘কি করিতে হইবে’ গ্রন্থটি শেষ করেন। এই সমস্ত লেখাতে লেনিন মার্কসবাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ‘অর্থনীতিবাদী’দের তীব্র ধিক্কার দেন এবং এদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদীদের এক দৃঢ়চিত্ত সংগ্রামের মাধ্যমে সর্বহারাশ্রেণির একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনার ডাক দেন।

‘অর্থনীতিবাদী’দের মৌলিক ভুলটা ছিল শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততার লেজুড়বৃত্তি করায়। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মধ্য থেকেই একটি স্বাধীন মতাদর্শ জন্ম নিতে পারে। মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল যে তারা ‘বিকাশের স্বতঃস্ফূর্ততার উপাদানের অথবা বাস্তব অবস্থার তাৎপর্যকে খাটো করছে’, ‘মতাদর্শের গুরুত্বকে বেশি বাড়িয়ে দেখছে’ এবং ‘সচেতনতার ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করছে’। লেনিনের যুক্তি ছিল যে শ্রমজীবী জনগণের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ সূত্রবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় তারা বড়জোর ট্রেড ইউনিয়ন সচেতনতা গড়ে তুলতে পারে, অর্থাৎ এই বিশ্বাসে পৌঁছতে পারে যে ট্রেড ইউনিয়নে সংঘবদ্ধ হওয়া, মালিকের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সরকারকে প্রয়োজনীয় আইন করতে বাধ্য করা দরকার। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ গড়ে তুলতে প্রয়োজন গভীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং সেটা শ্রমিকদের কাছে বাইরে থেকেই পৌঁছতে হয়। শ্রমিকরা নিজস্ব সামাজিক অবস্থানের কারণেই সমাজতন্ত্রকে দ্রুত গ্রহণ করে। তবে বুর্জোয়া মতাদর্শ সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের চেয়ে অনেক পুরোনো, অনেক বেশি বিকশিত এবং তা প্রচারের জন্য বহুগুণ বেশি উপায় তাঁর আয়ত্তে আছে। তাই, শ্রমিকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের চেতনা সঞ্চারের বিষয়টির বিরোধিতা করে ‘অর্থনীতিবাদী’রা আসলে বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রভাব বাড়াতেই সাহায্য করছে। লেনিন লিখলেনঃ

যেহেতু আন্দোলনের প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে শ্রমজীবী মানুষ নিজেরাই কোন স্বাধীন মতাদর্শ গড়ে তুলতে পারে না, তাই তাদের কোন একটি মতাদর্শই বেছে নিতে হয় – হয় বুর্জোয়া মতাদর্শ নয়তো সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ। এর মাঝামাঝি কোন পথ নেই। ......... অতএব কোনভাবে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে খাটো করা বা এর থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হওয়ার মানেই হল বুর্জোয়া মতাদর্শকে শক্তিশালী করা। 

তিনি আরও বললেনঃ

শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততার সমস্ত বন্দনা, সচেতনতার বা সমাজ-গণতন্ত্রের ভূমিকাকে যেকোনভাবে খাটো করার মানে হল, যিনি এই খাটো করার কাজটা করছেন তিনি চান বা না চান, আসলে তিনি শ্রমিকদের ওপর বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রভাব বাড়ানোর কাজ করছেন।

লেনিন নির্দিষ্টভাবে দেখালেন যে, বিপ্লবী তত্ত্ব এবং বিপ্লবী পার্টির ভূমিকাকে খাটো করলে তার ফল দাঁড়াবে বিপ্লবী আন্দোলনকে কবর দেওয়া, কারণ ‘বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কোন শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক পার্টি হয় না’, এবং ‘বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কোন বিপ্লবী আন্দোলনও হয় না’।

‘অর্থনীতিবাদী’দের জোরালো মত ছিল যে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের প্রধান ধ্বনি হল ‘অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য লড়াই’। তাদের মতে এক রুবলের সঙ্গে এক কোপেক যোগ করা হল সমাজতন্ত্র বা রাজনীতির থেকে অনেক মূল্যবান এবং ‘তারা কোন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নয়, বরং লড়াই করছে নিজেদের জন্য’। নিজেদের মতের সপক্ষে ‘অর্থনীতিবাদী’দের যুক্তি ছিল যে, ‘মার্কস ও এঙ্গেলসের তত্ত্ব অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থই ইতিহাসে চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করে। ফলত, .... বিশেষ করে সর্বহারাশ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য সংগ্রাম হল তার বিকাশের এবং মুক্তির জন্য সংগ্রামের পক্ষে চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ’। এইসব যুক্তি খন্ডন করে লেনিন বললেনঃ

অর্থনৈতিক স্বার্থ চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করে মানে কিছুতেই এই নয় যে, অর্থনৈতিক (অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়ন) সংগ্রামই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; সবচেয়ে সার কথাটা হল, শ্রেণিসমূহের ‘চূড়ান্ত’ স্বার্থ পূরণ হয় কেবলমাত্র মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। নির্দিষ্টভাবে সর্বহারাশ্রেণির মৌলিক অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণ হতে পারে কেবলমাত্র এমন একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, যে বিপ্লব বুর্জোয়া একনায়কত্বের পরিবর্তে সর্বহারার একনায়কত্বকে প্রতিষ্ঠা করবে।

সর্বহারাশ্রেণির কর্মসূচীকে অর্থনৈতিক সংগ্রামে আবদ্ধ করার মানে হল শ্রমিকদের চিরদাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখা, যাতে তারা জারের স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্ত হতে এবং পুঁজিবাদকে কবর দিতে না পারে।  এর মানে অবশ্যই এই নয় যে মার্কসবাদীরা অর্থনৈতিক সংগ্রামের তাৎপর্যকে ছোট করে দেখবে। লেনিন বললেন যে, সমাজ-গণতন্ত্রীরা অবশ্যই শ্রমিকশ্রেণির অর্থনৈতিক সংগ্রামকে সংগঠিত করবে। ‘কিন্তু অর্থনৈতিক সংগ্রামের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামকে ভুলে যাওয়ার অর্থ হল আন্তর্জাতিক সমাজ-গণতন্ত্রের মূল নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া, শ্রমিক আন্দোলনের এযাবৎ কালের ইতিহাস আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে, তাকে ভুলে যাওয়া’। অর্থনৈতিক সংগ্রামে আটকে যাওয়া হল সমাজ-গণতন্ত্রের পক্ষে রাজনৈতিক আত্মহত্যা। ‘রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নেই, এমন সমাজ-গণতন্ত্র পৃথিবীতে কোথাও নেই, কখনও ছিলনা। রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া সমাজ-গণতন্ত্র হল জলহীন নদী’।

এটা সত্য যে ‘অর্থনীতিবাদী’রা রাজনীতিকে পুরোপুরি বাদ দেয়নি। তারা এমনকি ‘অর্থনৈতিক সংগ্রামকেই রাজনৈতিক চরিত্র দেওয়া’র কথা বলত। কিন্তু লেনিন দেখালেনঃ

.....’অর্থনৈতিক সংগ্রামকে রাজনৈতিক চরিত্র দেওয়া’র গ্রাম্ভারি কথা, যা ভীষণরকম জ্ঞানগর্ভ এবং বৈপ্লবিক শোনায়, তা হল আসলে সমাজ-গণতন্ত্রকে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতিতে নামিয়ে আনার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টাকে আড়াল করার পর্দা।

ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে স্পর্শমাত্র না করে ‘আইনি ও প্রশাসনিক উপায়ে’ শ্রমিকদের অবস্থাকে উন্নত করার কাজ করে। লেনিন যেমন বলেছিলেন, এ হল শ্রমিকশ্রেণির বুর্জোয়া রাজনীতি, যা সমাজতন্ত্র থেকে বহু বহু দূরে। বিপ্লবী সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টি তার কার্যক্রমে সর্বদাই সংস্কারের কর্মসূচী অন্তর্ভুক্ত করে, কিন্তু শ্রমিকশ্রেণি তো ‘অর্থনৈতিক রাজনীতির পাতলা ঝোল খাওয়াবার শিশু নয়’। শ্রমিকরা অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে প্রাথমিক রাজনৈতিক চেতনা অর্জন করে, তাকে সর্বদাই সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনায় উন্নীত করা দরকার, যেমন দরকার আংশিক সংস্কারের জন্য আংশিক সংগ্রামকে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের অধীন করা।

সংগঠনের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততার পূজার প্রকাশ ঘটেছিল সেসময়কার সাংগঠনিক অনৈক্যকে ‘অর্থনীতিবাদী’দের প্রশংসার মধ্য দিয়ে, এবং মার্কসবাদী চক্রগুলির গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ও শৌখিন মনোভাবের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ‘অর্থনীতিবাদী’রা মনে করত যে, সর্বহারাশ্রেণির কাজ হল শুধু মালিক এবং সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সংগ্রাম করা, কাজেই কোন জাতীয়, কেন্দ্রীভূত, বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার কোন প্রয়োজনই তাদের ছিলনা। কেন একটি কেন্দ্রীভূত, ঐক্যবদ্ধ, বিপ্লবী পার্টি সর্বহারাশ্রেণির গড়ে তোলা দরকার, সে বিষয়ে গভীর ব্যাখ্যা দেন লেনিন। তিনি বলেন, ‘সর্বহারাশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম প্রকৃত ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ হয়ে উঠবে না, যদি না বিপ্লবীদের একটি শক্তিশালী সংগঠন এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়’। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘ আমাদের একটি বিপ্লবী সংগঠন দাও, আমরা রাশিয়াকে উল্টে দেবো’।

‘অর্থনীতিবাদী’দের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লেনিন যুক্তিসিদ্ধভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্যেকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন এবং সর্বহারাশ্রেণির মুক্তির জন্য সংগ্রামে রাজনৈতিক সংগ্রামের নির্ধারক ভূমিকা নির্দেশ করেন। তিনি তত্ত্ব এবং পার্টির ভূমিকাকে যথাযথ গুরুত্বে তুলে ধরেন এবং এই মৌলিক সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করেন যে পার্টি হল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মিলনের ফসল।

সব দেশের সুবিধাবাদীরা একে অপরের পিঠ চাপড়ায়

আর মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে

অর্থনীতিবাদ ছিল বার্নস্টাইনবাদের রুশি সংস্করণ। র্থনীতিবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে লেনিন তাই বার্নস্টাইনবাদেরও সমালোচনা করেছেন। 

জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী বার্নস্টাইনই প্রথম মার্কসবাদের মৌলিক তত্ত্বগুলির ‘সংশোধনে’র একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সংহত রূপ দেন। ১৮৯৬ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত তিনি ‘সমাজতন্ত্রের সমস্যা’ শিরোনামে একগুচ্ছ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৮৯৯ সালে প্রবন্ধগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়, যার নাম ‘সমাজতন্ত্রের সূত্রাবলি এবং সমাজ-গণতন্ত্রের কর্তব্যসমূহ’। এই প্রবন্ধগুলিতে বার্নস্টাইন সর্বহারাশ্রেণির বিপ্লব এবং সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্বের বিরোধিতা করেন। বাস্তবে বার্নস্টাইনবাদের একটি ‘চমৎকার উদাহরণ’ হয়ে ওঠেন ফরাসি সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতা মিলেরা, কারণ তিনি এমন একটি প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, যার সদস্য ছিলেন কমিউনার্ডদের হত্যাকারী জেনারেল গ্যালিফেট। আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে সর্বত্র বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সুবিধাবাদীরা মাথা তুলল। লেনিন এই সুবিধাবাদী এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি বিপ্লবের জ্যাকেবিন এবং গিরোন্ডপন্থীদের। তিনি বলেছিলেনঃ

.....সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যেকার বিভিন্ন প্রবণতার মধ্যে সংঘর্ষ এখন জাতীয় সীমানা ছেড়ে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে ..... ইংরেজ ফ্যাবিয়ান, ফরাসি মিনিস্টেরিয়ালিস্ট, জার্মান বার্নস্টাইনপন্থী এবং রুশ সমালোচক --- সবাই একই পরিবারের সদস্য, সবাই একে অপরের পিঠ চাপড়ায়, একে অপরের থেকে শেখে এবং সবাই মিলে ‘গোঁড়া’ মার্কসবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে।

তিনি আরও বলেনঃ

এযাবৎ মার্কস এবং এঙ্গেলসের মতবাদকে বিপ্লবী তত্ত্বের দৃঢ় ভিত্তি হিসেবে সবাই জানত, কিন্তু এখন সর্বত্র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যে এই মতবাদ নাকি যথেষ্ট নয়, এগুলি বাতিল হয়ে গেছে।

বার্নস্টাইনপন্থীরা দাবি করল যে, মার্কসবাদকে ‘পুনর্গঠিত’ করতে হবে। কিভাবে এটা করল তারা? ‘সমাজতন্ত্রের সূত্রাবলি এবং সমাজ-গণতন্ত্রের কর্তব্যসমূহ’ গ্রন্থে বার্নস্টাইন এই মতগুলি তুলে ধরলেনঃ

১। “..... আমি ..... সমাজতন্ত্রের বিজয়কে ‘আশু অর্থনৈতিক প্রয়োজনে’র ওপর নির্ভরশীল ভাবি না, বরং বিপরীতপক্ষে আমার মনে হয় এর পক্ষে কোন বিশুদ্ধ বস্তুগত যুক্তি দেওয়া সম্ভবও নয়, প্রয়োজনীয়ও নয়”।

২। “ হয় পুঁজিবাদীদের  সংখ্যা ক্রমশ বেশি বেশি হারে কমে যাবে এবং সর্বহারাশ্রেণির সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকবে, অথবা মধ্যশ্রেণির সংখ্যাধিক্য ঘটবে --- উৎপাদনের ক্রমাগত বৃদ্ধি এই বিকল্পই হাজির করে’।

৩। “...... ইউরোপিয় রাষ্ট্রগুলির বিপুল সম্পদবৃদ্ধি, আধুনিক ঋণব্যবস্থার নমনীয়তা এবং শিল্পগত কার্টেলের উত্থানের সঙ্গে একযোগে ব্যক্তিগত বা স্থানীয় প্রতিক্রিয়াজনিত বিশৃঙ্খলার শক্তি এমন সীমাবদ্ধ করেছে যে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও, আগেকার মত সাধারণ বাণিজ্যসঙ্কট আর সম্ভব বলে মনে হয়না”। ....”এরকম সঙ্কট কেবলমাত্র অর্থনৈতিক কারণে উদ্ভুত হবে এমন কোন সিদ্ধান্তে আসার বিশেষ কোন আশু কারণ নেই”।

৪। “...... আধুনিক রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক সংগঠনগুলি যতই গণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে, রাজনৈতিক মহা বিপর্যয় ঘটার সুযোগ এবং প্রয়োজন ততই কমবে.....”। “..... বেআইনি পথে বা সশস্ত্র বিপ্লবের চেয়ে বরং আইনি পথেই সমাজ-গণতন্ত্র অনেক ভালোভাবে বিকশিত হবে”।

৫। “......আমার কাছে আন্দোলনই হল সব আর ঐ যাকে বলা হয় ‘সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য’ --- তার কোন মূল্যই আমার কাছে নেই”।

বার্নস্টাইনের গ্রন্থটি পড়ামাত্রই লেনিন ক্রুদ্ধ হয়ে লিখলেনঃ

.....এর বিষয়বস্তু আমাদের ক্রমাগত বিস্মিত করছে। তাত্ত্বিক দিক থেকে --- অবিস্বাস্যরকমের দুর্বল, অন্য লোকের মতামতের পুনরাবৃত্তি। সমালোচনার নামে টুকরো বাক্যবন্ধ, সত্যিকারের স্বাধীন সমালোচনার চেষ্টামাত্র নেই। বাস্তব ক্ষেত্রে এ হল – সুবিধাবাদ – সীমাহীন সুবিধাবাদ এবং সম্ভববাদ, তাও কাপুরুষের মত সুবিধাবাদ --- এ যে একটা প্রহসন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বার্নস্টাইনের ‘নতুন’ যুক্তি এবং যুক্তিবিন্যাসের ওপর লেনিন মন্তব্য করলেনঃ

ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা এবং তার প্রয়োজন ও অনিবার্যতা প্রদর্শন করার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা হল। ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, সর্বহারাকরণের প্রক্রিয়া এবং পুঁজিবাদী দ্বন্দ্বসমূহের তীব্রতাবৃদ্ধি --- সব অস্বীকার করা হল। ‘চূড়ান্ত লক্ষ্যে’র ধারণাটাকেই বাজে বলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল এবং সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্বের ধারণাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা হল। উদারতাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যেকার বিরোধকে অস্বীকার করা হল। শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বকেও অস্বীকার করা হল এই অজুহাতে যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাক্রমে পরিচালিত কঠোরভাবে গণতান্ত্রিক সমাজে এটা প্রয়োগ করা চলে না, ইত্যাদি।

বার্নস্টাইনবাদের সার কথা হল মার্কসবাদকে বিকৃত করা, তাকে টেনে নামানো, বিপ্লবী সংগ্রামের জায়গায় সংস্কারকে বসানো আর শ্রমিকদের বিপ্লবী পার্টিকে সংস্কারবাদী পার্টিতে পরিণত করা।

লেনিন সংস্কার এবং বিপ্লবের মধ্যেকার সম্পর্কের এক অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি বলেনঃ

বিপ্লবীরা কখনই সংস্কারের জন্যন সংগ্রামকে বাতিল করবেনা, শত্রুর ছোটখাট গুরুত্বহীন জায়গাকেও দখল করার সংগ্রাম করবে, যদি তা তাদের আক্রমণকে শক্তিশালী করে এবং পূর্ণ বিজয় অর্জনে সাহায্য করে।  কিন্তু তারা কখনও ভুলবে না যে, কোন কোন সময় শ্ত্রু নিজেই কিছু কিছু জায়গা ছেড়ে দেয় আক্রমণকারীদের ঐক্য ভেঙে সহজে তাদের হারিয়ে দিতে। তারা কখনও ভুলবে না যে, কেবলমাত্র ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’কে প্রতিনিয়ত সামনে রেখে, সাধারণ বিপ্লবী আন্দোলনের দৃষ্টিকোণ থেকে আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপের এবং সংস্কারের মূল্যায়ন করেই শুধু ভুল পদক্ষেপ এবং লজ্জাকর ভ্রান্তি থেকে আন্দোলনকে রক্ষা করা যাবে।

‘আমাদের কর্মসূচী’ প্রবন্ধে লেনিন ঘোষণা করেনঃ

আমরা সম্পূর্ণভাবে মার্কসবাদী তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে আমাদের অবস্থান নির্ণয় করি.... এতে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী পার্টির সত্যিকারের কর্তব্য স্পষ্টভাবে বলা আছেঃ সমাজকে অন্য ছাঁদে গড়বার জন্য পরিকল্পনা করা নয়, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য পুঁজিপতি বা তাদের দালালদের উপদেশ দেওয়া নয়, ষড়যন্ত্র করা নয়, বরং সর্বহারাশ্রেণির শ্রেণিসংগ্রামকে সংগঠিত করা এবং তাতে নেতৃত্ব দেওয়া, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সর্বহারাশ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজকে গড়ে তোলা।

বার্নস্টাইনপন্থীদের মার্কসবাদের তথাকথিত ‘পুনর্গঠন’ এবং ‘সমালোচনার স্বাধীনতা’র সপক্ষে যাবতীয় যুক্তির স্বরূপ প্রকাশ করেন লেনিন। তাদের মার্কসবাদের ‘পুনর্গঠন’ যে আসলে বুর্জোয়া প্রেসের কাছ থেকে ধার করা কিছু পুরোনো তত্ত্বের অংশ ছাড়া কিছুই নয়, যা হল ‘ছাড়ের তত্ত্ব’ --- সর্বহারাশ্রেণির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রুকে ছাড়, সরকার এবং বুর্জোয়া পার্টিকে ছাড়, যারা সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নতুন নতুন পন্থা খোঁজে ক্লান্তিহীনভাবে। মার্কসবাদের যে ‘সমালোচনার স্বাধীনতা’ তারা দাবি করে, তা আসলে সমস্ত সুচিন্তিত, সংহত তত্ত্ব থেকে স্বাধীনতা, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে বুর্জোয়া মতাদর্শ আমদানির স্বাধীনতা। তাদের ‘গোঁড়ামি’ এবং ‘চিন্তার অনড়ত্বে’র বিরোধিতা হল তাদের তাত্ত্বিক অক্ষমতা ঢাকার চেষ্টা, যেটা আদতে মার্কসবাদবিরোধী কৌশল। লেনিন বলেনঃ

কি সহজ ছোট্ট শব্দ এই ‘গোঁড়ামি’! বিরোধী কোন তত্ত্বকে একটু উল্টোপাল্টা করে দাও আর ‘গোঁড়ামি’র ধুয়ো তুলে সেটাকে চাপা দিয়ে দাও --- ব্যস, আর কি চাই!

তিনি আরও বলেনঃ

ওরা চিৎকার করবে যে আমরা সমাজতন্ত্রী পার্টিকে ‘প্রকৃত বিশ্বাসী’দের একটি প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করতে চাই, যারা ‘গোঁড়ামি’ থেকে একটু সরলে, স্বাধীন মতপ্রকাশ করলে অবিশ্বাসীদের শাস্তি দেয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কেতাদুরস্ত ধারালো শব্দবন্ধ আমরা জানি। এও জানি যে এদের মধ্যে বোধের বা সত্যের একটি কণাও পাওয়া যাবে না।

লেনিন নির্মমভাবে সংশোধনবাদের বিরোধিতা করেন এবং মার্কসবাদের বিশুদ্ধতার সপক্ষে লড়াই করেন। একইসঙ্গে তিনি বলেন যে মার্কসবাদকে অধ্যয়ন করতে হবে এবং বিপ্লবী সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে তাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেনঃ

আমরা মার্কসের তত্ত্বকে কোন সম্পূর্ণ বা অলঙ্ঘনীয় তত্ত্ব বলে মনে করিনা। বরং আমাদের বিশ্বাস যে এটি হল সেই বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর যা সমাজতন্ত্রীদের সমস্ত দিক দিয়ে বিকশিত করতে হবে, যদি তারা জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়।

মার্কসের তত্ত্বের স্বাধীন ব্যাখ্যার ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন, কারণ ‘এই তত্ত্ব শুধু সাধারণ দিশাপ্রদর্শনের নীতিগুলি আমাদের দেয়, যেগুলি ইংলন্ডে যেভাবে প্রয়োগ হয়েছে, তা ফ্রান্সের থেকে আলাদা, ফ্রান্সের প্রয়োগ জার্মানির থেকে আলাদা, এবং জার্মানিতে রাশিয়ার থেকে আলাদা’।

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

 বিপ্লবী সর্বহারাশ্রেণির নতুন ধরনের পার্টি গঠনের জন্য সংগ্রাম

পার্টি গঠনের বিষয়ে দুই সম্পূর্ণ বিরোধী লাইন

মতাদর্শগত বাধা দূর করার সঙ্গে সঙ্গে লেনিন সর্বহারাশ্রেণির একটি পার্টি গঠনের জন্য বিপুল পরিমাণ সাংগঠনিক কাজ করেন। 

১৮৯৫ সালের হেমন্তে সেন্ট পিটার্সবুর্গে লেনিনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ‘লিগ অব স্ট্রাগল ফর এমানসিপেশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস’। সংগঠনটি শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সংযোগ ঘটাবার কাজ শুরু করেছিল। রুশ সর্বহারাশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির একটি প্রাথমিক রূপ ছিল এটি। ১৮৯৮ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গ, মস্কো এবং কিয়েভের লিগগুলি অন্যান্য এলাকার লিগগুলির সঙ্গে মিলে রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টির প্রথম কংগ্রেসের ডাক দিল। এই কংগ্রেস অবশ্য মার্কসবাদী চক্রগুলির সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীপরতা আর আনাড়িপনাকে কাটিয়ে উঠতে পারল না। ফলে পার্টিও গড়ে উঠল না।

নির্বাসনে থাকার সময়েই লেনিন একটি নতুন ধরনের জঙ্গী বিপ্লবী সর্বহারাশ্রেণির পার্টি গড়ে তোলার সমস্যা নিয়ে বিচার-বিবেচনা করছিলেন এবং এই লক্ষ্যে তিনি একটি বিস্তারিত পরিকল্পনাও রচনা করেন। তাঁর মতে, ঐক্যবদ্ধ মার্কসবাদী পার্টি গড়ে তুলতে হলে, ‘অর্থনীতিবাদী’দের থেকে মতাদর্শগতভাবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে হবে এবং পার্টিকে গড়ে তুলতে হবে মার্কসবাদের দৃঢ় ভিত্তির ওপর। তিনি বললেনঃ

ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আগেই এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আমাদের প্রথমেই নির্দিষ্ট এবং দৃঢ় পার্থক্যরেখা টানতে হবে।

অতএব পার্টিগঠনের কাজ শুরু করতে হবে পার্টির মতপ্রকাশের একটি মাধ্যম তৈরি করার মধ্য দিয়ে, যা বিপ্লবী মার্কসবাদী ধারণার প্রচার করবে। এই মাধ্যমটিকে তার প্রতিনিধিদের মারফত স্থানীয় সংগঠনগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। তিনি বললেনঃ

এরকম একটি মাধ্যম ছাড়া, স্থানীয় কাজকর্ম সবই সঙ্কীর্ণ ‘আনাড়িপনা’ হয়ে থাকবে। কোন সংবাদপত্রের মাধ্যমে পার্টিকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারলে, পার্টিগঠনের ব্যাপারটা কথার কথা হয়েই থাকবে।

লেনিনের কষ্টসাধ্য কাজের ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইসক্রা’ সংবাদপত্র প্রকাশিত হল। ইসক্রা মার্কসবাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালাল; সর্বহারাশ্রেণির অগ্রণীদের মধ্যে গড়ে তুলল বিপ্লবী তত্ত্বের প্রতি আনুগত্য এবং সুবিধাবাদের প্রতি আপসহীন মনোভাব। এই কারণেই ইসক্রা ‘রুশ এবং পশ্চিম ইউরোপের সুবিধাবাদীদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠার সম্মান অর্জন করল’। এছাড়াও এটি বিক্ষিপ্ত মার্কসবাদী চক্রগুলিকে একজোট করে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস ডাকার পথ প্রশস্ত করল।

মার্কসবাদী পার্টি গঠনের প্রক্রিয়ায় লেনিন মেনশেভিকদের (যারা ছিল মতাদর্শ এবং সংগঠন --- উভয়তই ‘অর্থনীতিবাদী’দের উত্তরসূরী) এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম চালান।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অধিকাংশ পার্টিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পুঁজিবাদের এক অপেক্ষাকৃত ‘শান্তিপূর্ণ’ বিকাশের সময়। এইসব পার্টিগুলির কোনটিরই কর্মসূচীতে সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্ব নিয়ে একটি অনুচ্ছেদও ছিল না। তাদের সাংগঠনিক নীতিগুলি ‘আইনি’ কার্যকলাপ এবং সংসদীয় সংগ্রাম চালানোর প্রয়োজন মেটাত এবং পার্টিগুলিতে কোন কঠোর শৃঙ্খলাও ছিল না। পার্টির সংসদীয় গোষ্ঠী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য ছিল না এবং পার্টির কেন্দ্রীয় মাধ্যমগুলি কেন্দ্রীয় কমিটির থেকে পৃথক লাইনে চলতে পারত। পার্টিকে সর্বহারাশ্রেণির সমস্ত সংগঠনের মধ্যে সর্বোচ্চ সংগঠন হিসাবে দেখা হত না। বস্তুতপক্ষে, পার্টি সংগঠন ছিল সংসদীয় গোষ্ঠীর লেজুড়। এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পার্টিগুলিতে শ্রমিকদের মধ্যেকার দোদুল্যমান অংশ, শ্রমিক-অভিজাত, পেটি বুর্জোয়া এবং বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা বেনোজলের মত ঢুকেছিল, যার ফলে সুবিধাবাদ দিব্যি বেড়ে উঠছিল। এই ধরনের পার্টিগুলির পক্ষে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব ছিল না।

রাশিয়ায় কি ধরনের সর্বহারাশ্রেণির পার্টি গড়ে তোলা উচিত? প্রথমে পার্টি কর্মসূচী নিয়ে লেনিন আর প্লেখানভের মধ্যে, আর তারপর পার্টির নিয়মবিধি নিয়ে মার্তভ ও তাঁর অনুগামীদের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য দেখা দিল।

প্লেখানভ পার্টির কর্মসূচীর যে খসড়া তৈরি করেছিলেন, তাতে না ছিল সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্বের কোন উল্লেখ, না শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট কোন বক্তব্য। লেনিন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এইসব সুবিধাবাদী ভ্রান্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তাঁর পীড়াপীড়িতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ --- সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্ব সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি পার্টি কর্মসূচীর খসড়ায় যুক্ত করা হয় এবং বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বদায়ী ভূমিকার কথাটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। পরে তিনি বলেছিলেন যে, বার্নস্টাইনপন্থীদের বিরোধিতা করার জন্যও সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্বের বিষয়টি স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার ছিল। শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যে দৃঢ় মৈত্রী গড়ে তোলার সপক্ষে তাঁর অভিমত অনুযায়ী তিনি কৃষকদের জমির জন্য দাবিকে সমর্থন করার কথা বলেছিলেন। পার্টি কর্মসূচীর খসড়ায় জমি সংক্রান্ত সব কটি অনুচ্ছেদের প্রস্তাবক ছিলেন লেনিন।

পার্টি সংগঠনের নীতির প্রশ্নে মার্তভ কোম্পানি পশ্চিমি সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টিগুলির নীতির নকল করার চেষ্টা করে। বিপরীতপক্ষে, লেনিন বলেছিলেন যে, পশ্চিম ইওরোপের পার্টিগুলির অভিজ্ঞতাকে খুঁটিয়ে বিচার করে দেখা উচিত। ১৮৯৯ সালে তিনি নির্দিষ্টভাবে বললেনঃ

আমাদের পার্টির জন্য একটি উদ্দেশ্যসাধক সংগঠন এবং উদ্দেশ্যসাধক রণকৌশল তৈরি করার জন্য আমাদের যে যে বিষয়গুলি আয়ত্ত করতে হবে, সেগুলি হলঃ পশ্চিম  ইওরোপের সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ইতিহাস, রুশ বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাস এবং আমাদের শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের অভিজ্ঞতা। এইসব বিষয়ের ‘বিশ্লেষণ’ অবশ্যই করতে হবে স্বাধীনভাবে, কারণ এ ব্যাপারে কোন পূর্বনির্দিষ্ট মডেল কোথাও পাওয়া যাবে না।

১৯০১ সালে লেনিন একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত পার্টিগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন, যা “প্রস্তুতির সংগ্রামে, অপ্রত্যাশিত হামলার বিরুদ্ধে এবং নির্ধারক আক্রমণে নেতৃত্ব দিতে পারবে”।

১৯০৩ সালে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে পার্টির নিয়মাবলি আলোচনার সময় পার্টিগঠনের লাইন নিয়ে মতপার্থক্য তীব্র  হয়ে উঠল। লেনিন নিয়মাবলির প্রথম পরিচ্ছেদ তৈরি করেছিলেন এইভাবেঃ

রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির সেই সদস্য হবে, যে তার কর্মসূচী গ্রহণ করবে, পার্টিকে আর্থিকভাবে সাহায্য করবে এবং কোন-না-কোন পার্টি সংগঠনে ব্যক্তিগতভাবে যোগদান করবে।

মার্তভের মত ছিল যে, সদস্য হতে গেলে পার্টি কর্মসূচী গ্রহণ এবং পার্টিকে অর্থ সাহায্য করা অবশ্যশর্ত, কিন্তু কোন-না-কোন পার্টি সংগঠনে যোগদান আবশ্যিক নয়। মার্তভ এবং তাঁর অনুগামীরা কেন্দ্রীভূত, ঐক্যবদ্ধ  নেতৃত্বের বদলে ‘স্বশাসনবাদ’ও দাবি করলেন এবং বললেন যে স্থানীয় সংগঠনগুলিকে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে না। তাদের চাহিদা ছিল এক নিরবয়ব, পাঁচমিশালি, শিথিল সংগঠনের। লেনিন মার্তভপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালালেন। তিনি বললেন, একটি সংগঠিত, শৃংখলাবদ্ধ, কেন্দ্রীভূত এবং ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তুলতে হলে, পার্টি সদস্যদের অবশ্যই কোন একটি পার্টি সংগঠনে থাকতেই হবে, এবং এই সাংগঠনিক নীতিও মেনে চলতে হবে যে, স্থানীয় সংগঠনগুলি কেন্দ্রের, নিচের সংগঠনগুলি ওপরের সংগঠনের এবং সংখ্যালঘু অংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের অধীনে থাকবে। পার্টির কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি নির্বাচনের সময়, দ্বিতীয় কংগ্রেস দুটি পরস্পরবিরুদ্ধ গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গেল --- বলশেভিক আর মেনশেভিক। লেনিন পরে লিখেছিলেন, “রাজনৈতিক চিন্তার ধারা হিসাবে এবং রাজনৈতিক পার্টি হিসাবে, বলশেভিকবাদ সেই ১৯০৩ সাল থেকেই আছে”।

পার্টির নিয়মাবলি আলোভনার সময় প্লেখানভ লেনিনকে সমর্থন করেন। কংগ্রেসের পর মেনশেভিকরা কংগ্রেসের সিদ্ধান্তগুলিকে ব্যর্থ করার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা শুরু করল এবং বলশেভিকদের বিরুদ্ধে কাজকর্মও চালিয়ে যেতে লাগল। প্লেখানভ মেনশেভিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার কথা বললেন এবং দ্রুত নিজেই মেনশেভিক বনে গেলেন। তাঁর সাহায্যে মেনশেভিকরা ইসক্রা-র সম্পাদকমন্ডলীর নেতৃত্ব দখল করে নিল এবং একে লেনিনসহ বলশেভিকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা ঘাঁটিতে পরিণত করল। নতুন ইসক্রায় মেনশেভিকরা পার্টিসদস্যদের মধ্যে ‘স্বাধীন গোষ্ঠী ও ব্যক্তি’র অনুমোদনের পক্ষে প্রচার চালালো, যাদের পার্টি সংগঠনের সিদ্ধান্ত মেনে চলার কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না, আর সেই সঙ্গে তারা “প্রতিটি ধর্মঘটী” এবং পার্টির সহমর্মী প্রতিটি বুদ্ধিজীবীর নিজেদের পার্টি সদস্য হিসাবে ঘোষণা করার পক্ষেও প্রচার করল। লেনিনের নামে তারা ‘আমলাতান্ত্রিকতা’ ও ‘আনুষ্ঠানিকতা’র অভিযোগ এনে বলল যে তিনি পার্টিতে ‘ভূমিদাসপ্রথা’ চালু করতে চাইছেন। সর্বহারাশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির সাংগঠনিক নীতিসমূহের পক্ষে লেনিন ‘এক পা আগে, দু’পা পিছে’ গ্রন্থটি রচনা করলেন, যেখানে তিনি মেনশেভিক এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক --- উভয়েরই সাংগঠনিক নীতির প্রশ্নে সুবিধাবাদী অবস্থানের সমালোচনা করলেন।

লেনিনের মতে, সংগঠনের ক্ষেত্রে সুবিধাবাদ “চায় সর্বহারাশ্রেণির পার্টির প্রতি ব্যক্তি-বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব কমাতে, কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাব কমাতে, পার্টির সবচেয়ে দোদুল্যমান লোকগুলির স্বশাসন বাড়াতে,   এবং সাংগঠনিক সম্পর্ককে নামাতে চায় বিশুদ্ধ প্লেটনিক এবং মৌখিক অনুমোদনে”। তিনি আরও বললেন, এই সুবিধাবাদী প্রবণতা ইওরোপিয় দেশগুলির সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টিগুলিতে সর্বত্রই দেখা গেছে এবং এর ফলে পার্টি সংগঠনগুলি ভেঙে গেছে। পার্টির সুবিধাবাদী এবং বিপ্লবী অংশের মধ্যেকার লড়াই হল “সংগঠন ও শৃঙ্খলাকে শিথিল করা ও আঁটসাঁট করার মধ্যেকার লড়াই, দোদুল্যমান বুদ্ধিজীবী ও দৃঢ় সংকল্প সর্বহারার মানসিকতার মধ্যেকার লড়াই, বুদ্ধিজীবীবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ও সর্বহারা সংহতির মধ্যেকার লড়াই-এর প্রতিফলন”। সাংগঠনিক দিক থেকে, মেনশেভিকদের সুবিধাবাদ নিহিত ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্বের জন্য সংগ্রামে সংগঠনের বিরাট ভূমিকা অস্বীকার করার মধ্যে, এবং তাদের এই সুবিধাবাদী লাইন তাদের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক লাইনকেই শক্তি জোগায়।

‘এক পা আগে, দু’পা পিছে’ গ্রন্থটিতে লেনিন একটি জঙ্গি, কেন্দ্রীভূত, শৃঙ্খলাবদ্ধ, বিপ্লবী পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য মৌলিক সাংগঠনিক নীতিমালার রূপরেখা দেন এবং সামগ্রিকভাবে পার্টির তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি দেখান যে, পার্টি হল সর্বহারাশ্রেণির অগ্রণী বাহিনী (ডিট্যাচমেন্ট) এবং শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে, পার্টিকে মার্কসবাদী তত্ত্ব, সমাজবিকাশ ও শ্রেণিসংগ্রামের নিয়মাবলির জ্ঞানের অস্ত্রে সুসজ্জিত হতে হবে। সংগঠিত বাহিনী হিসাবে, পার্টি সর্বহারাশ্রেণির সব ধরনের সংগঠনের মধ্যে সর্বোচ্চ। পার্টি সর্বহারাশ্রেণির অন্য সংগঠনগুলিকে দিশা দেখাতে সমর্থ এবং দিশা দেখানো তার উচিত। পার্টিকে ব্যাপক জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রাখতে হবে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। পার্টির সংগঠন হবে একশৈলিক, যার ইচ্ছার ঐক্য, কর্মের ঐক্য এবং শৃঙ্খলার ঐক্য থাকবে, এবং কেন্দ্রীভবনের নীতিতে একে সংগঠিত হতে হবে। লেনিনের মতে, এরকম একটি পার্টি থাকলে, সর্বহারাশ্রেণি লক্ষ্যের জন্য সংগ্রাম এবং লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ এক অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত হবে। তিনি লিখলেনঃ

ক্ষমতার জন্য সংগ্রামে সর্বহারাশ্রেণির সংগঠন ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই। ..... মার্কসবাদী নীতির ভিত্তিতে মতাদর্শগত ঐক্যের  মাধ্যমে সর্বহারাশ্রেণি এক অপরাজেয় শক্তি হয়ে উঠতে পারে এবং অবধারিতভাবে তা হবে, যে মতাদর্শগত ঐক্য, বস্তুগতভাবে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবীকে শ্রমিকশ্রেণির এক বাহিনীতে পরিণত করা সাংগঠনিক ঐক্যের দ্বারা, আরও শক্তিশালী হবে। এইভাবে জরাগ্রস্ত রুশ জারতন্ত্র বা প্রায়বৃদ্ধ আন্তর্জাতিক পুঁজি --- কেউই এই বাহিনীর সঙ্গে যুঝে উঠতে পারবে না।

বলশেভিক পার্টি গড়ে উঠেছিল লেনিনের এই পার্টির তত্ত্বকে ভিত্তি করে এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সংস্কারবাদী পার্টিগুলির থেকে তাই এই পার্টি ছিল আলাদা। মার্কসবাদের দৃঢ় ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছিল এই পার্টি। সমস্ত ধরনের সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে অবিচল লড়াই করে এই পার্টি সর্বহারাশ্রেণির বিপ্লব এবং সর্বহারাশ্রেণির একনায়কত্বের জন্য সংগ্রাম করেছিল। লেনিনের এই পার্টি বিশ্বজোড়া সমস্ত সর্বহারাশ্রেণির পার্টির কাছে হয়ে উঠেছিল এক উজ্জ্বল উদাহরণ এবং আন্তর্জাতিক সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী  প্রাচীর।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের স্থূল হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করে

বলশেভিক পার্টির স্বাধীনতা ও বিশুদ্ধতা রক্ষা

বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মধ্যেকার প্রচন্ড সংগ্রামে, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীরা, তাদের রুশ সঙ্গী মেনশেভিকদের সমর্থনে দৌড়ে এল লেনিন এবং বলশেভিকদের বিরোধিতা করতে।

১৯০৪ সালের মে মাসে একটি মেনশেভিক পত্রিকায় কাউটস্কি মেনশেভিকদের প্রতি তাঁর সমর্থন এবং লেনিনের বিরোধিতা ঘোষণা করলেন। তিনি তথ্য বিকৃত করে রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ইসক্রা-র সম্পাদকমন্ডলী থেকে মেনশেভিকদের “বিতাড়িত” করার জন্য লেনিনকে তিরস্কার করলেন (আসলে মেনশেভিকরা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল)। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রায় সমস্ত পত্রিকাই মেনশেভিকদের পক্ষ নিয়ে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যেকার লড়াইয়ের বিকৃত প্রতিবেদন ছাপতে লাগল। এর ফলে আন্তর্জাতিক সর্বহারাশ্রেণির কাছে রুশ পার্টির অভ্যন্তরের প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা এবং সুবিধাবাদীদের প্রতারণামূলক প্রচারের স্বরূপ প্রকাশ করা লেনিনের কাছে এক অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। ১৯০৪ সালের আগস্ট মাসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের আমস্টার্ডাম কংগ্রেসে, বলশেভিকরা ‘রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির সঙ্কট অনুধাবনের জন্য তথ্যাবলি’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট পেশ করে, যার সঙ্কলন এবং সম্পাদনা করেছিলেন লেনিন। এই রিপোর্টে ব্যাখ্যা করা হয় যে, লেনিনের খসড়ায় পার্টি সদস্যদের কোন-না-কোন পার্টি সংগঠনে যোগদানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রীদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, কারণ জার্মান পার্টির নিয়মাবলির প্রথম ধারায় এটির অনুপস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ১৯০৫ সালের জুনে লেনিন লিপজাইগার ফকজাইটুং পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর উদ্দেশে একটি খোলা চিঠিতে লিখলেন, কাউটস্কি “রুশ সমাজ-গণতন্ত্রীদের মধ্যেকার সম্পর্ক সম্বন্ধে অত্যন্ত বিকৃত একটি চিত্র উপস্থিত করেছেন” এবং “নিরপেক্ষতা বিষয়ে কাউটস্কির কোন কথা বলার অধিকার নেই। রুশ সমাজ-গণতন্ত্রীদের মধ্যে বর্তমান সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি সর্বদাই পক্ষ নিয়েছেন। এটি অবশ্যই তাঁর অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু পক্ষ যিনি নেন, তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো, নাহলে আবার তিনি ভন্ডামির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন”। এরপর তিনি সমস্ত জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেনঃ

কমরেড! যদি আপনারা রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টিকে সত্যিই ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টি হিসেবে বিবেচনা করেন, তাহলে আমাদের মধ্যেকার ভাঙন সম্বন্ধে তথাকথিত নিরপেক্ষ জার্মানদের একটি কথাও বিশ্বাস করবেন না। আপনারা দলিল দেখার ওপর জোর দিন, প্রামাণ্য দলিল।

লেনিন বিদেশে শ্রমিকদের সমস্ত পাঠচক্র এবং বিদেশি সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টিগুলির সদস্যদের কাছে বলশেভিক পার্টির সঠিক অবস্থানের বিষয়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে আহ্বান জানান বলশেভিকদের।

প্রচার ছাড়াও, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মেনশেভিকদের সমর্থনে একগুচ্ছ সাংগঠনিক পদক্ষেপও নেয়। ঐক্যবদ্ধ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য আমস্টার্ডাম কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেই ঐক্য কিসের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে, তা পরিষ্কার করে বলে না। কংগ্রেসের পরে ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ব্যুরো ( আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরো) বেবেলের নেতৃত্বে একটি মধ্যস্থতাকারী কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যে কমিটি বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মধ্যে মধ্যস্থতা করে “ঐক্য” প্রতিষ্ঠা করবে। এই ‘মধ্যস্থতা’ মেনে নেওয়ার অর্থ ছিল কার্যত এটা মেনে নেওয়া যে রুশ পার্টির আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অধিকার দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের (বাস্তবিকপক্ষে জার্মান পার্টির) আছে।  এই কমিটি শর্ত দিয়েছিল যে বলশেভিক এবং মেনশেভিকরা ‘বিতর্ক থামাক’। এর মানে হল, বলশেভিকরা মেনশেভিকদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা এবং সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা বন্ধ করে দেবে। লেনিন এই ‘মধ্যস্থতা’ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে প্রস্তাব দিলেন যে, একটি কংগ্রেস ডেকে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের বিরোধের নিষ্পত্তি করা হোক। ১৯০৫ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরো আবারও ‘মধ্যস্থতা’র প্রশ্ন তুলল।  লেনিন জবাব দিলেন যে যতক্ষণ না দুই অংশের মধ্যেকার আলোচনায় কোন ফল হচ্ছে, ততক্ষণ আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরো ‘মধ্যস্থতা’ শুরু করতে পারে না।

লেনিনের এই দৃঢ় নীতিনিষ্ঠ অবস্থান এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের স্থূল হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কারণেই, বলশেভিক পার্টি তার স্বাধীনতা এবং বিশুদ্ধতা রক্ষা করে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে নিজেদের প্রভাব ক্রমাগত বিস্তার করতে পেরেছিল।

১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবে সুবিধাবাদী রণকৌশলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

বিপ্লবের শুরু এবং রণকৌশল নিয়ে মতপার্থক্য

১৯০২ সালে লেনিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেনঃ

ইতিহাস আমাদের এমন এক আশু কর্তব্যের মুখোমুখি করিয়ে দিয়েছে, যা কোন দেশের সর্বহারাশ্রেণির সমস্ত আশু কর্তব্যের মধ্যে সবচেয়ে বিপ্লবী। এই কর্তব্যের পালন শুধু ইওরোপের নয়, বরং (এখন যা বলা যায়) এশিয়ার প্রতিক্রিয়াশীলদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধকে ধ্বংস করবে এবং রুশ সর্বহারাশ্রেণিকে পরিণত করবে আন্তর্জাতিক বিপ্লবী সর্বহারাশ্রেণির অগ্রণী বাহিনীতে।

বাস্তবিকপক্ষেই, জারের স্বৈরতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার প্রথম মহান বিপ্লবী যুদ্ধ রুশ সর্বহারাশ্রেণি শুরু করেছিল ১৯০৫ সালে।

জারের রাশিয়া এবং জাপানের মধ্যে চিন ও কোরিয়া দখলের জন্য দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ ১৯০৪ সালে শুরু হওয়া রুশ-জাপান যুদ্ধ এই বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। এই যুদ্ধ সম্পর্কে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মনোভাব ছিল ভিন্ন ভিন্ন। মেনশেভিকরা ‘প্রতিরক্ষাবাদে’ নেমে গিয়েছিল এবং ‘পিতৃভূমি’ রক্ষার পক্ষে সওয়াল করছিল, যে পিতৃভূমি ছিল আসলে জার, জমিদার আর পুঁজিপতিদের। অপরপক্ষে বলশেভিকরা জার সরকারের এই আগ্রাসী যুদ্ধের সমালোচনা করেছিল। লেনিন ঘোষণা করেছিলেন যে, জারের সরকার ‘নির্বোধ ও অপরাধমূলক ঔপনিবেশিক অভিযানে’র নীতি নিয়ে চলছে এবং ‘রুশ স্বৈরতন্ত্রই ..... এই ঔপনিবেশিক যুদ্ধ শুরু করেছিল’। লেনিনের মত ছিল যে, এই যুদ্ধে জারের পরাজয় ঘটাতে সাহায্য করলে তা জারতন্ত্রকে দুর্বল করবে এবং বিপ্লবী ঝড়ের সূচনাকে ত্বরান্বিত করবে। তিনি বলেছিলেন, ‘সামরিক বিপর্যয় অবশ্যই গভীর একটি রাজনৈতিক সঙ্কট ডেকে আনবে’।

ঠিক সেইরকম ঘটনাই ঘটল। এই যুদ্ধ রাশিয়ার আভ্যন্তরীণ শ্রেণিদ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করলএই বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল এবং জনগণের লড়াকু মেজাজকে চাগিয়ে তুলল। ১৯০৫ সালের এই বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি জারের পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী যখন সেন্ট পিটার্সবুর্গে শ্রমিকদের একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হত্যালীলা চালিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে আহত ও নিহত করল, তখন সেই রক্তস্নানের বিরুদ্ধে ধিক্কারে শ্রমজীবী জনতা জেগে উঠল এবং বিরাট বিরাট ধর্মঘট ও সমাবেশ শুরু হয়ে গেল। অক্টোবর মাসে গোটা রাশিয়া জুড়ে রাজনৈতিক ধর্মঘট হল। শ্রমিকরা লড়াই করতে করতে গড়ে তুললেন শ্রমিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত। ডিসেম্বর মাসে মস্কোর শ্রমিকরা একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটালেন। তাঁরা রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে জারের পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ে নেমে পড়লেন। এই বছরে রাশিয়ায় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি উয়েজদে (জেলায়) কৃষকরা জার এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উঠে দাঁড়ালেন। জুন আর নভেম্বরে ওডেসায় পোটেমকিন রণতরীতে এবং অন্যত্র নাবিকরা বিদ্রোহে ফেটে পড়লেন। বেশ কয়েকটি শহরে সৈন্যদের মধ্যেও অস্থিরতা দেখা দিল। সারা দেশে তখন বিপ্লবের জোয়ার বইছে। এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য লেনিন বিদেশ থেকে সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরলেন।

এই বিপ্লবী অভ্যুত্থান প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তাদের মনোভাব পরিষ্কার করে জানাতে এবং কাজের লাইন ঠিক করতে বাধ্য করল। ৯ জানুয়ারির ঘটনার পরে পরেই লেনিন বললেন যে এই সময়ের মৌলিক কাজ হল সর্বহারা শ্রেণি এবং কৃষকদের সশস্ত্র করা এবং জার সরকারকে উচ্ছেদ করে শ্রমিক এবং কৃষকের বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। ১৯০৫ সালের এপ্রিলে রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস বসল লন্ডনে, লেনিনের নেতৃত্বে। কংগ্রেসে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল এবং একটি মার্কসবাদী রণকৌশলগত লাইনও গ্রহণ করা হল। বলশেভিক রণকৌশল তৈরি হয়েছিল বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং তার মেজাজ ছিল লড়াই করার ও বিজয় ছিনিয়ে আনার সাহসে পূর্ণ। মেনশেভিকরা এই কংগ্রেসে যোগ দিতে অস্বীকার করে এবং কংগ্রেস চলাকালীন জেনেভায় তাদের নিজেদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত করে। এই সম্মেলনে তারাও   নানা সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটি সুবিধাবাদী রণকৌশল প্রণয়ন করে। তাদের সিদ্ধান্তগুলি থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে লড়াই করার ও বিজয় ছিনিয়ে আনার সাহস তাদের ছিলনা, বরং তারা চেয়েছিল সর্বহারাশ্রেণিকে উদারতাবাদী বুর্জোয়াদের অধীনে আনতে এবং এইভাবে বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে।

বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি রণকৌশলগত লাইনের প্রশ্নে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যেকার মতপার্থক্যকে সামনে আনল। রুশ বিপ্লবকে বিজয়ের পথে চালিত করার জন্য মেনশেভিকদের রণকৌশলকে আগাপাশতলা খন্ডিত করে বলশেভিক রণকৌশলের সামগ্রিক একটি ব্যাখ্যা অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। ১৯০৫-এর জুলাইয়ে, অতএব, প্রকাশিত হল লেনিনের বিখ্যাত গ্রন্থ --- ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সমাজ-গণতন্ত্রের দুটি রণকৌশল’। এই গ্রন্থে তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারাশ্রেণির নেতৃত্বের তত্ত্ব, শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে শেমিক-কৃষক মৈত্রীর তত্ত্ব এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তীর্ণ হওয়ার তত্ত্ব দ্বারা মার্কসবাদকে আরও বিকশিত করলেন।

সর্বহারাশ্রেণির কি গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা উচিত?

মেনশেভিকদের বক্তব্য ছিল যে বুর্জোয়া বিপ্লব কেবলমাত্র বুর্জোয়াদেরই উপকার করে এবং শুধু বুর্জোয়ারাই এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে। তাদের মতে, সর্বহারাশ্রেণি শুধুমাত্র বুর্জোয়াদের সহযোগীর ভূমিকা নিতে পারে এবং তাদের কখনই গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া বা তার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটানো উচিত হবে না, কারণ তাতে বুর্জোয়ারা ভয় পেয়ে সরে যেতে পারে।

লেনিন মেনশেভিকদের এই উদ্ভট তত্ত্বের সমালোচনা করেন। তিনি নির্দিষ্টভাবে দেখালেন যে রুশ বুর্জোয়া শ্রেণি একটি সামন্ততান্ত্রিক, সমরবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশে অবস্থান করে এবং তাদের শ্রেণি-অবস্থানই গণতান্ত্রিক বিপ্লবে দোদুল্যমানতার জন্ম দেয়। তিনি দেখালেন যে শ্রেণি হিসাবে সর্বহারাশ্রেণির নিজস্ব অবস্থানই তাকে দৃঢ়ভাবে গণতান্ত্রিক করে তোলে এবং কেবলমাত্র সর্বহারাশ্রেণির নেতৃত্বই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে তার পরিণতিতে পৌঁছে দিতে পারে। তিনি আরও দেখালেন যে, বুর্জোয়ারা কখনই মনেপ্রাণে চায় না যে বুর্জোয়া বিপ্লব অতীতের সমস্ত আবর্জনা ঝেটিয়ে বিদায় করুক আর সর্বহারাশ্রেণির হাতে সেই অস্ত্র তুলে দিক যা তারা শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করবে। বুর্জোয়াদের তুলনায় বরং সর্বহারাশ্রেণিই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় কামনা করে। অতএব, এক অর্থে, বুর্জোয়া বিপ্লব বুর্জোয়াদের চেয়ে বরং সর্বহারাশ্রেণির পক্ষেই বেশি সুবিধাজনক। লেনিন বললেনঃ

মার্কসবাদ সর্বহারাশ্রেণিকে শিক্ষা দেয় বুর্জোয়া বিপ্লব থেকে কখনও দূরে না থাকতে, এর প্রতি নির্লিপ্ত না থাকতে, বুর্জোয়াদের এই বিপ্লবের নেতৃত্বে যেতে না দিতে; বরং উল্টোদিকে শিক্ষা দেয় বুর্জোয়া বিপ্লবে সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সর্বহারা গণতন্ত্রের জন্য দৃঢ়ভাবে লড়াই করতে, বিপ্লবকে তার চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে।

একাজ করতে ব্যর্থ হওয়ার মানে আমাদের নীতির মূল্যে, বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সর্বহারাশ্রেণির বিপ্লবী মঞ্চ থেকে “বুর্জোয়াদের সঙ্গে দর-কষাকষি করার, বুর্জোয়াশ্রেণির স্বেচ্ছা-সম্মতি কেনার (যাতে তারা গুটিয়ে না যায়)” মঞ্চে গিয়ে ওঠা। লেনিন বললেনঃ

বিপ্লবের পরিণতি নির্ভর করবে সর্বহারাশ্রেণি,স্বৈরতন্ত্রকে ঘায়েল করার মত যথেষ্ট শক্তি থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ভাবে অক্ষম, বুর্জোয়াদের এমন এক সহযোগী হিসাবে কাজ করবে, না নিজেই বিপ্লবে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করবে --- তার ওপর।

বিপ্লবে নেতৃত্বের ভূমিকা নিশ্চিত করতে, সর্বহারাশ্রেণিকে কৃষকদের নির্ভরযোগ্য মিত্রে পরিণত করতে হবে। লেনিন দেখালেন যে, গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষক সর্বহারাশ্রেণির মিত্র হতে পারে, সর্বান্তকরণে এই বিপ্লবের সবচেয়ে র‍্যাডিক্যাল অনুগামী হতে পারে, কারণ কেবলমাত্র একটি সামগ্রিক গণতান্ত্রিক বিপ্লবই তাদের জমির চাহিদা পূরণ করতে পারে। তিনি বললেনঃ

যে বিপ্লবী ঘটনাবলির ধারায় কৃষকরা ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠবে, তা যদি বুর্জোয়াদের বিশ্বাসঘাতকতায় এবং সর্বহারাশ্রেণির পরাজয়ে অকালে না নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কৃষকরা অবধারিতভাবে এইরকম ভূমিকাই পালন করবে।

অপরপক্ষে, “সর্বহারাশ্রেণি তখনই শুধু গণত্নত্রের জন্য বিজয়ী সংগ্রাম করতে পারবে, যখন কৃষক জনতা এই বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেবে”। সর্বহারাশ্রেণির শক্তিতে যদি তা না কুলোয়, তাহলে বুর্জোয়ারাই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা বনে যাবে এবং বিপ্লবে নিয়ে আসবে এক দোদুল্যমান, আত্মলোভী চরিত্র। সর্বহারাশ্রেণি এবং কৃষকের এক বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব ছাড়া আর কিছু একে ঠেকাতে পারবে না। কৃষকদের বিদ্রোহ বুর্জোয়া শ্রেণিকে বিপ্লব পরিত্যাগের উৎসাহ দেবে এবং তার ফলে বিপ্লবের ব্যাপকতা কমে যাবে, মেনশেভিকদের এই মত লেনিন খন্ডন করেন। তিনি বলেনঃ

যারা একটি বিজয়ী রুশ বিপ্লবে কৃষকদের ভূমিকা সত্যিই বোঝেন, তাঁরা স্বপ্নেও ভাববেন না যে, বুর্জোয়ারা সরে গেলে বিপ্লবের ব্যাপকতা কমে যাবে। কারণ, রুশ বিপ্লব তার সত্যিকারের ব্যাপকতা শুধু তখনই অর্জন করতে শুরু করবে, এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যাপকতম বিস্তার লাভ করবে, যখন বুর্জোয়ারা এর থেকে সরে যাবে এবং কৃষক জনতা সর্বহারাশ্রেণির সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সক্রিয় বিপ্লবীহিসাবে বেরিয়ে আসবে।

কৃষকদের সঙ্গে দৃঢ় মৈত্রী প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বহারাশ্রেণিকে অবশ্যই সামন্ততন্ত্রকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে একটি কৃষি-কর্মসূচী উপস্থিত করতে হবে এবং তাকে কার্যকর করতে হবে।

জনগণের বিপ্লবী হিংসা সম্বন্ধে আমাদের মনোভাব কি হওয়া উচিত?

মেনশেভিকরা সংগ্রামের পদ্ধতি সম্পর্কে দোলাচলে  ছিল। তারা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল এবং তাদের মত ছিল যে জেমস্কিসবর বা স্টেট ডুমার মত কোন প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের সংস্থা আহ্বানের জন্য চেষ্টা করাই ভালো। লেনিনের মত ছিল এর বিপরীত।  তাঁর মতে গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিজয়লাভের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল সশস্ত্র অভ্যুত্থান এবং তখনকার বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ইতোমধ্যেই  সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয়টি সামনে এনে ফেলেছে। সর্বহারাশ্রেণির রাজনৈতিক দলের উচিত সর্বহারাশ্রেণিকে সশস্ত্র করার জন্য সোৎসাহে উদ্যোগ নেওয়া এবং এই অভ্যুত্থানে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা। একটি বিপ্লবী সেনাবাহিনী গঠন করার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে লেনিন বললেনঃ

একটি বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী প্রয়োজন, কারণ বিরাট সব ঐতিহাসিক সমস্যা কেবলমাত্র বলপ্রয়োগেই সমাধান করা যায়, আর, আধুনিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে, বলপ্রয়োগের সংগঠন মানে সামরিক বাহিনী।

তিনি আহ্বান জানালেন, “সর্বত্র লড়াকু স্কোয়াড গড়ে তোলার, ছাত্রদের মধ্যে, বিশেষত শ্রমিকদের মধ্যে ইত্যাদি। এখনই তিনজন, দশজন,তিরিশজনের স্কোয়াড গড়ে উঠুক। যতটা সাধ্য সেভাবে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিক, তা রিভলভার হতে পারে, অথবা হতে পারে ছুরি কিংবা আগুন জ্বালাবার জন্য কেরোসিন-ভেজা ন্যাতা ইত্যাদি”।

অভ্যুত্থানের অভিমুখে জনতাকে দিশা দেখাতে, লেনিন এমন সব বিপ্লবী শ্লোগান তুললেন, যা জনগণের বিপ্লবী উদ্যোগের উৎসমুখ খুলে দেয় এবং জারের রাষ্ট্রযন্ত্রকে এলোমেলো করে দেয়। শ্লোগানগুলিতে আহ্বান ছিল সাধারণ রাজনৈতিক ধর্মঘটের বিপ্লবী পথে আটঘন্টার শ্রমদিবস আশু অর্জনের জন্য; জমিদারি বাজেয়াপ্ত সহ বিপ্লবী পথে সমস্ত গণতান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে অবিলম্বে বিপ্লবী কৃষক কমিটি গঠনের জন্য ইত্যাদি। শ্লোগানগুলি ছিল কর্তৃপক্ষকে এবং চালু আইনকানুনকে উপেক্ষা করে, এবং জারের কর্তৃপক্ষের চাপানো সব বিধিনিষেধ ও আইনকে অস্বীকার করে তৈরি, যাতে অননুমোদিত কার্যকলাপের মাধ্যমে জনগণ এক নতুন বিপ্লবী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

জনগণকে বিদ্রোহ করার ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেনিন তাদের নিয়মতান্ত্রিক সরকার সম্বন্ধে কোন মোহ পোষণ না করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। ১৯০৫ সালে আগস্টে, বিপ্লবের চাপে এবং সাধারণ মানুষের বিপ্লবী সংকল্পকে ভোঁতা করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে, জারের সরকার বুলিগিন ডুমা স্থাপন করার ঘোষণা করে। লেনিন দেখালেন যে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে, বুলিগিন ডুমায় যোগদানের অর্থ জনগণকে প্রতারণা করা এবং তাদের বিপ্লবের পথ থেকে সরিয়ে আনার জন্য জারের সরকারের চেষ্টাকে সাহায্য করা। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা বুলিগিন ডুমাকে বয়কট করার রণকৌশল নিল। এই রণকৌশলই সঠিক বলে প্রমাণিত হল এবং বিপ্লবের ক্রমবর্ধমান জোয়ারে বুলিগিন ডুমা ব্যর্থ হল। এরপর ডিসেম্বর মাসে বলশেভিকরা সশস্ত্র জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিল।

লেনিনের মতে, জনগণের বিজয়ী অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসাবে একটি অস্থায়ী সরকার গড়ে তোলা দরকার। তিনি বললেন যে, এই সরকার হবে শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী একনায়কত্বের সরকার, যা শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী একনায়কত্বকে প্রয়োগ করবে। এর কর্তব্য হবে বিপ্লবের অর্জনগুলিকে সংহত করা, প্রতিবিপ্লবীদের প্রতিরোধ চূর্ণ করা, বিপ্লবকে পেছনে টেনে ধরার জন্য বুর্জোয়াদের চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির ন্যূনতম কর্মসূচীকে কার্যকর করা।

অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারে যোগদানের প্রশ্নে মেনশেভিকদের মত ছিল যে রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির নীতিগতভাবে এই সরকারে যোগ দেওয়া উচিত নয়, বরং বুর্জোয়াদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে এটিকে বুর্জোয়া একনায়কত্ব হতে দেওয়া উচিত। এই মতের বিরোধিতা করে লেনিন বললেন যে, জনগণের বিপ্লব যখন বিজয় অর্জন করছে, তখন নীতিগতভাবেই সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টি অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারে যোগ দিতে পারে এবং সেটাই উচিত। এই সরকার রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির ন্যূনতম কর্মসূচী, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী কার্যকর করবে এবং সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের শর্তগুলি তৈরি করার দিকে অগ্রসর হবে। অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারে যোগ দিয়ে রুশ সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টি প্রতিটি প্রতিবিপ্লবী প্রচেষ্টাকে চূর্ণ করবে এবং শ্রমিকশ্রেণির স্বাধীন স্বার্থকে রক্ষা করবে। এরকম সরকারে যোগদানের দুটি প্রধান শর্তঃ প্রথমটি হল, পার্টি তার প্রতিনিধিদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখবে এবং দ্বিতীয়টি হল, এক মুহূর্তের জন্যও পার্টি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য থেকে নজর সরাবে না।

বিপ্লব চলতে থাকবে না মাঝপথে থেমে যাবে?

লেনিন অনুমান করেছিলেন যে, সেসময়ে রাশিয়ার যা অবস্থা, তাতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত হওয়ার পর সর্বহারাশ্রেণি বিপ্লবের সময় যা কিছু জয় অর্জন করেছে, তা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে বুর্জোয়ারা মরিয়া চেষ্টা করবে এবং এর ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য বুর্জোয়া এবং সর্বহারাশ্রেণির মধ্যে মরণপণ লড়াই হবে। তিনি বললেনঃ

তাই, সর্বহারাশ্রেণি, যারা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে সামিল এবং যারা এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়, তাদের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অন্তর্গত নতুন নতুন দ্বন্দ্বকে বা নতুন ধরনের সংগ্রামকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুললে চলবে না।  

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে কি? এই সূত্রে লেনিন নিরবচ্ছিন্ন বিপ্লবের তত্ত্বকে এবং সর্বহারা বিপ্লবের মহান মিত্র হিসাবে কৃষক সংগ্রামের তত্ত্বকে বিকশিত করেন, যে তত্ত্বগুলিকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীরা বর্জন করেছিল। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণের তত্ত্ব উপস্থিত করেন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীরা, এবং তাদের সঙ্গী রুশ মেনশেভিকরা মতপ্রকাশ করল যে, গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে একটি দীর্ঘ ব্যবধান থাকবে --- যেটি বুর্জোয়া একনায়কত্বের কালপর্ব। লেনিন একে খন্ডন করেন। তিনি বিলেন যে, গণতান্ত্রিক বিপ্লব পুঁজিবাদের ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারে না এবং “বুর্জোয়া বিপ্লব বুর্জোয়াদের কাঠামো, অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজ-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সরে আসেনা”। তিনি এ-ও যোগ করলেন যে, সর্বহারাশ্রেণিকে গোটা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ওপর অবশ্যই “সর্বহারাদের বা বরং সর্বহারা-কৃষকদের ছাপ” রাখতে হবে। তিনি ঘোষণা করলেনঃ

...... আমরা সমস্ত কৃষককে এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্ণ ফল পেতে সমস্ত ধরনের সাহায্য করব, যাতে আমরা, সর্বহারাশ্রেণির পার্টি, তুলনায় সহজে এবং যথাসম্ভব দ্রুত পরবর্তী উচ্চতর উত্তরণ সম্পন্ন করতে পারি --- সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

লেনিন গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে তুলনা করেন এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে তুলনা করেন দ্বিতীয় পদক্ষেপের সঙ্গে। তিনি বলেনঃ

...... যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই প্রথম পদক্ষেপ আমরা নেবো, যত তাড়াযাড়ি সম্ভব একে আমরা পেরিয়ে যাবো, একটি প্রজাতন্ত্র অর্জন করব, প্রতিবিপ্লবকে চূর্ণ করব এবং দ্বিতীয় পদক্ষেপের প্রস্তুতি নেবো।

তাঁর ‘কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি সমাজ-গণতন্ত্রের মনোভাব’ প্রবন্ধে, লেনিন বলেনঃ

..... গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে তৎক্ষণাৎ এবং আমাদের শক্তির হিসাব করে, যে শক্তি হল শ্রেণিসচেতন ও সংগঠিত সর্বহারাশ্রেণির শক্তি, আমরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হব। আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিপ্লবের পক্ষে। আমরা মাঝপথে থামব না।

১৯০৫ সালের বিপ্লবের দুটি মূল্যায়ন

ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর বিপ্লবের জোয়ারে ভাঁটার টান এল। সেই থেকে ১৯০৫ সালের বিপ্লবের মূল্যায়ন, এর থেকে পাওয়া শিক্ষা, এরকম আরও অনেক কিছু নিয়ে বলশেভিক আর মেনশেভিকদের মধ্যে মৌলিক মতপার্থক্য দেখা দিল।

মেনশেভিকদের প্রতিনিধি প্লেখানভ অভিযোগ করলেন যে, রাজনৈতিক ধর্মঘট করা হয়েছিল ‘অসময়ে’, কারণ এর ফলে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটেছিল, যে অভ্যুত্থানের পরাজয় ছিল ‘অপ্রত্যাশিত’ এবং শ্রমিকদের ‘অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া উচিত হয়নি’, ইত্যাদি। এর প্রত্যুত্তরে লেনিন ঘোষণা করলেনঃ

বিপরীতপক্ষে, আমাদের উচিত ছিল আরও দৃঢ়ভাবে, সোৎসাহে এবং আক্রমণাত্মকভাবে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া; আমাদের উচিত ছিল সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা যে শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটে ঘটনা আটকে থাকবে না এবং যা দরকার তা হচ্ছে এক নির্ভীক এবং দুর্বার সশস্ত্র সংগ্রাম।

প্লেখানভ নিজেকে মার্কসের সঙ্গে তুলনা করার স্পর্ধা দেখিয়ে বলেছিলেন যে মার্কসও ১৮৭০ সালে প্যারিসের শ্রমিক অভ্যুত্থানে বাধা দিয়েছিলেন। লেনিন দেখালেন যে, প্যারি কমিউনের ছ’মাস আগে, ১৮৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, মার্কস সময়ের আগেই অভ্যুত্থান করার ব্যাপারে ফরাসি শ্রমিকদের সতর্ক করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন জনসাধারণের ঐতিহাসিক উদ্যোগকে। লেনিন বললেন যে, “জনগণের উত্থান যখন ঘটল, মার্কস তাদের সঙ্গে পা মেলাতে চেয়েছিলেন সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় তাদের সঙ্গে একযোগে শিক্ষা নিতে। তিনি তাদের আমলাসুলভ তিরস্কার করেন নি”। সর্বহারাশ্রেণির এই স্বর্গ অভিযানের প্রতি মার্কসের মনোভাব ছিল এক বস্তুনিষ্ঠ উপদেশকের, গণসংগ্রামে একজন যোগদানকারীর। প্যারি কমিউন পরাজিত হওয়ার পর মার্কস এই সংগ্রামের অর্জনগুলির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেনঃ

শ্রমজীবী মানুষের প্যারিস আর তার কমিউন এক নতুন সমাজের উদ্বোধক হিসাবে চিরদিন অভিনন্দিত হবে। এর শহিদেরা শ্রমিকশ্রেণির বিশাল হৃদয়ে আসীন থাকবেন।

কিন্তু প্লেখানভের মনোভাব কি ছিল? লেনিন মনে করালেন যে, রুশ শ্রমিকদের ডিসেম্বরের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রাক্কালে প্লেখানভ শ্রমিকদের কোনভাবেই সতর্ক করেন নি, অথচ অভ্যুত্থান পরাজিত হওয়ার পর তিনি বিপ্লবী জনগণকে খোঁচা দিয়ে বললেন, “তাদের অস্ত্র হাতেব তুলে নেওয়া ঠিক হয়নি”। প্লেখানভের মত একজন সুবিধাবাদী কি করে সর্বহারাশ্রেণির বিপ্লবী শিক্ষক মার্কসের সঙ্গে নিজের তুলনা করেন? এদের মধ্যেকার পার্থক্য রাত আর দিনের পার্থক্য!

১৯০৫ সালের বিপ্লবের পরাজয়ের পর মেনশেভিকরা বুর্জোয়া উদারতাবাদীদের সঙ্গে মিলে অবাধে কাদা ছুঁড়েছিল। এই প্রসঙ্গে লেনিন বলেনঃ

আমাদের বিপ্লবের মূল্যায়নের প্রশ্নটি কোনভাবেই শুধুমাত্র তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রত্যক্ষভাবে, বাস্তবক্ষেত্রে এবং দৈনন্দিন বিচারেও এর গুরুত্ব আছে। সবাইকে শোনানোর জন্য, দোদুল্যমান এবং দুর্বলমনাদের উপকারের জন্য এবং যারা দলত্যাগী ও সমাজতন্ত্রকে পরিত্যাগ করছে, তাদের লজ্জা দেওয়ার জন্য, আমরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করব যে, শ্রমিকদের পার্টি ১৯০৫ সালের অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে জনগণের প্রত্যক্ষ বিপ্লবী সংগ্রামকে প্যারি কমিউনের পর সর্বহারাশ্রেণির সর্বোত্তম সংগ্রাম বলে মনে করে। বিপ্লবের পরবর্তী সাফল্যের বীজ এই ধরনের সংগ্রামেই নিহিত থাকে। এবং সংগ্রামের এই নজিরগুলিই পরবর্তী প্রজন্মের যোদ্ধাদের শিক্ষার এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।

১৯০৫ সালের বিপ্লবের শিক্ষার এক গভীর সারসঙ্কলন করেছিলেন লেনিন। তিনি দেখালেন যে, কেবলমাত্র জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে; যে, জারের ক্ষমতাকে তুচ্ছ করে দেওয়া বা সীমাবদ্ধ করাই যথেষ্ট নয়, একে ধ্বংস করে ফেলতে হবে; যে, কেবলমাত্র সর্বহারাশ্রেণিই পারে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না সর্বহারাশ্রেণি বুর্জোয়া শ্রেণিকে কোণ্ঠাসা করছে এবং কৃষকদের সঙ্গে দৃঢ় মৈত্রী স্থাপন করছে, ততক্ষণ বিপ্লব বিজয়ী হবে না।

১৯০৫ সালের বিপ্লবের আগুনে বলশেভিকরা এবং রুশ সর্বহারাশ্রেণি পোড় খেয়েছিল। সংগ্রামের এক সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা হল তাদের এবং শ্রমিক-প্রতিনিধিদের সোভিয়েত – সর্বহারাশ্রেণির ক্ষমতার ভ্রূণ – বিপ্লবী জনগণের দ্বারা সৃষ্ট হল। পরে লেনিন বলেছিলেন যে, ১৯০৫ সালের বিপ্লব ছিল ১৯১৭ সালেরবিপ্লবের ড্রেস রিহার্সাল। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের সময় লেনিনের লেখা ‘সমাজ-গণতন্ত্রের দুই রণকৌশল’ বলশেভিকদের রণকৌশলের ভিত্তিস্থাপন করেছিল এবং পার্টি ও শ্রমিকশ্রেণিকে বিপ্লবী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার জুগিয়েছিল।

চতুর্থ অধ্যায়

স্টুটগার্ট কংগ্রেসে সংগ্রাম

রাশিয়ায় ১৯০৫ সালের বিপ্লবের পর, পুঁজিবাদী দেশগুলিতে শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার এল। জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি,ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, হল্যান্ড এবং বেলজিয়ামে প্রায়ই বিরাট বিরাট ধর্মঘট হতে লাগল এবং তার ঘটনাক্রমে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র লড়াইও বাধল। প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম জেগে উঠল। এই পর্যায়ে একের পর এক আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু হল, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভীষণ টানাপোড়েন দেখা দিল এবং অভূতপুর্ব অস্ত্রসজ্জা শুরু হল। এই প্রেক্ষাপটে ১৯০৭ সালের আগস্টে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের স্টুটগার্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হল। লেনিন এই প্রথম কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করলেন এবং সম্মেলনে তিনি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদীদের সঙ্গে সংগ্রামে নামলেন।

জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টি নিজের মর্যাদা ব্যবহার করে কংগ্রেসে কলকাঠি নাড়ল এবং ভ্রান্ত ধারণা ছড়ালো

জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির নেতৃত্বের সুবিধাবাদী অংশ কংগ্রেসে অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলল। জার্মানি হল মার্কস-এঙ্গেলসের জন্মভূমি এবং জার্মান পার্টি তখন সর্বহারাশ্রেণির সবচেয়ে প্রাচীন এবং সর্ববৃহৎ পার্টি হিসাবে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন। এর সুযোগ নিয়ে জার্মান পার্টির সুবিধাবাদী নেতারা অন্যান্য পার্টিতে তাঁদের ভ্রান্ত ধারণা ছড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। এইসব পার্টির অনেক নেতাই জার্মান পার্টির সুবিধাবাদী লাইনকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করতেন। ‘আমাদের বিপ্লব’ প্রবন্ধে লেনিন পরে দেখিয়েছেন যে, এইসব নেতার অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল যে তারা ছিল ‘অতিরিক্ত রকমের দুর্বলচিত্ত’ এবং “জার্মান মডেল থেকে ন্যূনতম চ্যুতিতেও ..... (তারা) নানা আপত্তি তুলে নিজেদের সুরক্ষিত রাখত”।

কংগ্রেসে কলকাঠি নাড়ার জন্য জার্মান পার্টি কিছু সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। কংগ্রেসের শুরুতেই, তারা আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরোকে দিয়ে একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত করিয়ে নিল যে, প্লেনারি সেসনগুলিতে সভাপতিত্ব করবেন জার্মান পার্টির প্রতিনিধিরা এবং কংগ্রেসের প্রধান প্রধান কমিশনগুলিতেও নেতৃত্ব দেবেন ওই পার্টিরই বিশিষ্ট সদস্যরা। উদাহরণস্বরূপ, সমরবাদ-বিরোধী কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন সুডেকুম এবং সমাজতান্ত্রিক পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের সম্পর্ক সংক্রান্ত কমিশনের সম্পাদক ছিলেন কাউটস্কি। কংগ্রেস প্রত্যেক দেশের জন্য ভোটও নির্দিষ্ট করে দিল --- বড় বড় দেশগুলির কুড়িটা করে এবং ছোট ছোট দেশগুলির দুটো করে ভোট। উপরন্তু, জার্মান পার্টি বার্নস্টাইন, ডেভিড, লেজিয়ে, শাইডেমান এবং ভলমারের মত চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীদের ডেলিগেট করেছিল, আর বামপন্থীদের, বিশেষ করে রোজা লুক্সেমবার্গের কংগ্রেসে উপস্থিতি আটকাতে প্রচুর চেষ্টা করেছিল। রোজা লুক্সেমবার্গ অবশ্য শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসে যোগদান করেছিলেন, কিন্তু জার্মান পার্টির বদলে পোলিশ পার্টির ডেলিগেট হিসাবে।

রুশ ডেলিগেশনটি ছিল খুবই মিশ্র প্রকৃতির। অন্যান্যদের সঙ্গে এতে ছিল সমাজ-গণতন্ত্রীরা, সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীরা এবং ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা। সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির ডেলিগেটদের মধ্যে বলশেভিক ও মেনশেভিক দুই-ই ছিল।

কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল দক্ষিণপন্থী এবং মধ্যপন্থীরা। লেনিনসহ বলশেভিকদের ভরসা ছিল কেবলমাত্র রোজা লুক্সেমবার্গ ও জুলিয়ান মার্শলেউস্কির নেতৃত্বে পোলিশ বামপন্থী সমাজ-গণতন্ত্রীরা আর ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে জার্মান বামপন্থী সমাজ-গণতন্ত্রীরা।

স্টুটগার্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন আন্তর্জাতিক বিপ্লবীরা ছিল সংখ্যালঘু।

সংগ্রামের ফলে সঠিক সমরবাদ-বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ

কংগ্রেসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে উত্তপ্ত বিতর্কের বিষয়টি ছিল সমরবাদ-বিরোধিতা। লেনিন নিজে ছিলেন সমরবাদ-বিরোধী কমিশনের একজন সদস্য।

কংগ্রেসে আলোচনার জন্য চারটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল, যার একটি দিয়েছিলেন বেবেল জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির পক্ষ থেকে, আর অন্যগুলি দিয়েছিলেন হার্ভে, গুয়েসদে, জরেস এবং ভাইল্যান্ট, ফরাসি সমাজতান্ত্রিক পার্টির তরফে। সবকটি খসড়াতেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি এবং ভ্রান্তি। লেনিন হার্ভে এবং বেবেলের খসড়াদুটিকেই বিশেষ ভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য বেছে নিলেন।

হার্ভের খসড়া প্রস্তাবে বলা ছিল যে, সর্বহারা শ্রেণির কোন পিতৃভূমি নেই, সমস্ত যুদ্ধই হয় পুঁজিবাদীদের স্বার্থে এবং তাই সর্বহারা শ্রেণিকে ধর্মঘট ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিটি যুদ্ধের বিরোধিতা করতে হবে। লেনিন দেখালেন যে, হার্ভে আধা-নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত করেছেন। প্রথমত, তিনি বুঝছেন না যে, ‘যুদ্ধ হল পুঁজিবাদের আবশ্যিক ফল এবং সর্বহারা শ্রেণি বিপ্লবী যুদ্ধে যোগদান করতে অস্বীকার করতে পারেনা’। দ্বিতীয়ত, তিনি এ-ও বুঝছেন না যে, ধর্মঘট এবং অভ্যুত্থান দ্বারা কোন যুদ্ধের বিরোধিতা করা হবে কিনা, তা “নির্ভর করে সেই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সঙ্কটটির যুদ্ধজনিত বস্তুগত অবস্থার ওপর, বিপ্লবীরা কবে কি সিদ্ধান্ত করেছেন, তার ওপর নয়”।  এবং তৃতীয়ত, তার্ভে এবং তাঁর অনুগামীরা “সমরবাদ বিরোধিতা দিয়ে সমাজতন্ত্র ভুলিয়ে দিতে সমর্থ’। লেনিন বলেন যে, সংগ্রাম করতে হবে শুধু যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির জন্য নয়, বরং পুঁজিবাদের পরিবর্তে সমাজতন্ত্রের জন্য। আসল কথাটা শুধু যুদ্ধ-নিবারণ নয়, বরং যুদ্ধজনিত সঙ্কটকে বুর্জোয়াদের উৎখাতের জন্য ব্যবহার করা।

লেনিনের মার্কসবাদী সমালোচনার বিপরীতে, ভলমার এবং অন্যান্যরা হার্ভের ভুলের সমালোচনায় সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এলেন। তাঁরা বললেন যে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপ হচ্ছে সংসদীয় সংগ্রাম এবং ধর্মঘট দিয়ে যুদ্ধের বিরোধিতার বদলে জনমতকে প্রভাবিত করে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা দরকার, যাতে সশস্ত্র সংঘর্ষ বন্ধ হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেনিন দেখালেন যে, হার্ভেকে খন্ডনের জন্য যেসব তাত্ত্বিক সত্যের অবতারণা করা হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য “সংসদীয় নির্বুদ্ধিতার সাফাই গাওয়া, বা কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ উপায়ের অনুমোদন, বা এখনকার অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ ও শান্ত অবস্থার পুজো করা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হল রাশিয়ার বিপ্লবের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করে সংগ্রামের সবরকম উপায় অবলম্বন করা”। তিনি বললেন যে, হার্ভের দৃষ্টিভঙ্গির সুবিধাবাদী সমালোচনা হার্ভেপন্থার মধ্যেকার স্ফুলিঙ্গকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করছে। সত্যিকারের কথাটা হল হার্ভে গণ বিপ্লবী কার্যকলাপের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। লেনিনের ঘোষণায়, যদি সামগ্রিক বিচারে হার্ভে এক “বীরোচিত ভুল” করে থাকেন, ভলমার ও অন্যান্যদের অবস্থান হল “সুবিধাবাদী কাপুরুষতা”র।

জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির পক্ষ থেকে বেবেলের পেশ করা খসড়ায় বলা হয়েছিল যে, সমরবাদ হল পুঁজিবাদের ফল এবং কেবলমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ করলে তবেই যুদ্ধের অবলুপ্তি সম্ভব। এতে অবশ্য সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বদলে ‘আক্রমণমূলক’ এবং ‘আত্মরক্ষামূলক’ যুদ্ধের কথা বলা হয়েছিল, ফলে ‘আত্মরক্ষাবাদী’দের ব্যবহারের উপযুক্ত ফাঁক তাতে রয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পদ্ধতির প্রশ্নে খসড়ায়, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের আগেকার কংগ্রেসগুলিতে পাস হওয়া সিদ্ধান্তের মতই, প্রকৃত প্রস্তাবে সংসদীয় সংগ্রামকেই সংগ্রামের একমাত্র রূপ হিসাবে হাজির করেছিল।

লেনিন রোজা লুক্সেমবার্গ, ক্লারা জেটকিন এবং অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন এবং রোজা লুক্সেমবার্গের সঙ্গে মিলে জার্মান পার্টির প্রস্তাবিত খসড়ায় সংশোধনী তৈরি করলেন। সংশোধনীতে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের কথা তুলে দিয়ে খসড়ার শেষ দুটি অনুচ্ছেদের নীতিগত পরিবর্তনের কথা বলা হল। শেষ দুটি অনুচ্ছেদের সংশোধিত রূপ ছিল এই রকমঃ

যদি কোন যুদ্ধ শুরুর হুমকি শোনা যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরোর সমন্বয়কারী কাজ দ্বারা সমর্থিত সংশ্লিষ্ট দেশগুলির শ্রমিকশ্রেণি এবং তাদের সংসদীয় প্রতিনিধিদের কর্তব্য হবে, যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তাদের কাছে সবচেয়ে কার্যকর উপায় বলে যা মনে হবে, তা দিয়ে সর্বতোভাবে চেষ্টা করা। স্বভাবতই এটি নির্ভর করবে শ্রেণিসংগ্রাম কতটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে এবং সাধারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা তীব্র, তার ওপর।

তাসত্ত্বেও যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাদের কর্তব্য হবে যুদ্ধ বন্ধ করার সপক্ষে হস্তক্ষেপ করা এবং যুদ্ধের ফলে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট উদ্ভুত হবে, তাকে সাধ্যমত ব্যবহার করে পুঁজিবাদী শ্রেণিশাসনের উচ্ছেদ ত্বরান্বিত করা।

খসড়ার এইসব পরিবর্তন বেবেলের খসড়াকে একেবারে আলাদা একটা খসড়ায় পরিণত করল। লেনিনের মতে, এই খসড়া ছিল ‘চিন্তাসমৃদ্ধ এবং সর্বহারাশ্রেণির কর্তব্য এতে স্পষ্টভাবে সূত্রায়িত ছিল’। এতে দৃঢ় বিশ্বাসীদের কঠোরতা সমণ্বিত হয়েছে --- অর্থাৎ শ্রমিকদের পার্টির দৃঢ়তম বিপ্লবী কার্যকলাপের সুপারিশসহ একমাত্র বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদী বিশ্লেষণ। ভলমারদের দিয়ে এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা হবে না, বা আনকোরা হার্ভেবাদের সঙ্কীর্ণ কাঠামোতেও এটি ধরবে না। লেনিনকৃত এই খসড়া প্রস্তাব কংগ্রেসে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

‘সমাজতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক নীতি’ এবং ট্রেড ইউনিয়নের নিরপেক্ষতা তত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই

ঔপনিবেশিক নীতির প্রশ্নটি ছিল আর একটি উত্তপ্ত বিতর্কের বিষয়।

হল্যান্ডের সুবিধাবাদী ভ্যান কল যে খসড়া প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন, তাতে ঔপনিবেশিক নীতির বিরুদ্ধে সর্বহারাশ্রেণির রাজনৈতিক পার্টিগুলির সংগ্রামের বা উপনিবেশের নিপীড়িত জনগণের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে উত্থান ও প্রতিরোধ সংগ্রামে উজ্জীবিত করার কোন উল্লেখ ছিলনা। তার বদলে এতে কিছু ‘সংস্কারে’র কথা বলা ছিল, যেগুলি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনে উপনিবেশগুলিতে কার্যকর করা যাবে। ভ্যান কল এবং তাঁর মত লোকেদের মত ছিল যে সমাজতন্ত্রীরা নিজের নিজের দেশের সরকারকে এমন সব আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সই করার পরামর্শ দিক, যেখানে উপনিবেশের অধিবাসীদের কিছু কিছু অধিকার নির্দিষ্ট করা থাকবে। প্রস্তাবে একথা খোলাখুলিই বলা ছিল যে, “কংগ্রেস সমস্ত ধরনের ঔপনিবেশিক নীতিকে ধিক্কার জানায় না, কারণ সমাজতন্ত্রের অধীনে ঔপনিবেশিক নীতি সভ্যতার বিস্তার ঘটাতে পারে”। কমিশনে প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনার সময়ে বেশির ভাগ সুবিধাবাদীই একে সমর্থন করে, কিন্তু বামপন্থীরা এর তীব্র বিরোধিতা করে। কংগ্রেসে, সুবিধাবাদী বার্নস্টাইন এবং ডেভিড, জার্মান প্রতিনিধিদলের সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি হিসাবে, ‘সমাজতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক নীতি’ গ্রহণ করার জন্য চাপাচাপি করেন এবং কংগ্রেসের ওপর ভ্যান কলের দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বামপন্থীরা সংস্কারের গুরুত্ব বুঝতে পারছে না এবং তাদের বস্তুনিষ্ঠ ঔপনিবেশিক কর্মসূচী নেই --- এই বলে তাঁরা চেঁচামেচি জুড়ে দেন।

লেনিন মত রাখেন যে, ভ্যান কলের বক্তব্য বাস্তবে বুর্জোয়া নীতি এবং বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর দিকে সরাসরি পশ্চাদপসরণ, যে নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি ঔপনিবেশিক যুদ্ধ ও উপনিবেশগুলির নিপীড়নকে সমর্থন করে। তিনি ঘোষণা করেন যে, “সমাজতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক নীতি”র ধারণাটাই একটা যাচ্ছেতাই তালপাকানো ব্যাপার এবং সমাজতন্ত্রীদের একমাত্র সঠিক অবস্থান হল “ঔপনিবেশিক নীতি নিপাত যাক, পুঁজিবাদীদের অন্য দেশে নাক গলানোর নীতি এবং নতুন নতুন সুবিধা, নতুন নতুন বাজার, প্রণালীগুলির নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি উদ্দেশ্যে বিদেশের ভূমি এবং মানুষজনকে পদানত করার জন্য পুঁজিবাদী যুদ্ধ নিপাত যাক”।

এবিষয়ে তীব্র লড়াই চালানোর ফলে, লেনিনসহ বিপ্লবীরা ছোট ছোট দেশ থেকে যে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন, তাঁদের জোটবদ্ধ করতে সমর্থ হলেন, কারণ হয় তাঁদের কোন ঔপনিবেশিক নীতি ছিলনা, নয়তো তাঁরা নিজেরাই এই নীতির ফলে দুর্দশায় পড়েছিলেন। এইভাবে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পেয়ে একটি অপেক্ষাকৃত সঠিক প্রস্তাব কংগ্রেসে পাস করালেন।

কংগ্রেসে পার্টি এবং ট্রেড ইউনিয়নের সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা হয়।

সুবিধাবাদীরা ট্রেড ইউনিয়নে পার্টির নেতৃত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল। কংগ্রেসে ফরাসি সমাজতান্ত্রিক পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছিল, তাতে স্বাধীন ভিত্তিতে পার্টি এবং ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে খোলা সহযোগিতার কথা বলা ছিল। এই প্রস্তাব ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সকলের সমর্থন পায়, এবং তারা ছিল জার্মান প্রতিনিধিদলের অর্ধেক। প্লেখানভ ট্রেড ইউনিয়নের নিরপেক্ষতার বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে বলেন যে, “রাশিয়ার ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের সূচনা হলে তা ক্ষতিই করবে”।

লেনিন ট্রেড ইউনিয়নের নিরপেক্ষতার তত্ত্বকে পুরোপুরি খারিজ করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, বুর্জোয়াশ্রেণির শ্রেণিস্বার্থই ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে সঙ্কীর্ণ এবং ছোটখাট কার্যকলাপে আবদ্ধ রাখে এবং সমাজতন্ত্রের সঙ্গে কোনরকম সংস্পর্শ হতে দিতে চায়না। ট্রেড ইউনিয়নের নিরপেক্ষতার তত্ত্ব আসলে বুর্জোয়াদের এই প্রচেষ্টাকেই আড়াল করে মাত্র। এটা এমন একটা তত্ত্ব, যা সর্বহারাশ্রেণির ওপর বুর্জোয়াদের প্রভাবকেই শক্তিশালী করে। অকাট্য সমস্ত তথ্য উদ্ধৃত করে লেনিন দেখান যে নিরপেক্ষতার পক্ষে এই সওয়াল জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির সুবিধাবাদীদের হাত শক্ত করেছে এবং এর ফলে জার্মানির ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা স্পষ্টত সুবিধাবাদের দিকে ঢলেছেন। রুশ বলশেভিক পার্টির প্রতিনিধিরা, অন্যান্য পার্টির বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলে লেনিনের নেতৃত্বে কংগ্রেসে ট্রেড ইউনিয়নের নিরপেক্ষতার তত্ত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। কংগ্রেসে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাতে নীতিগতভাবে এই নিরপেক্ষতার তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করা হয়।

জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টির সবচেয়ে খারাপ দিকগুলি অনুসরণীয় মডেল হিসেবে তুলে ধরা উচিত হবেনা

উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে স্টুটগার্ট কংগ্রেসে যে আলোচনা হয়েছিল, তার থেকে মার্কসবাদ ও সুবিধাবাদের মধ্যেকার, এবং সর্বহারাশ্রেণি ও বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যেকার বিরোধ স্পষ্টভাবে সামনে এল। লেনিন লিখলেনঃ

.... স্টুটগার্ট কংগ্রেস অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সুবিধাবাদী এবং বিপ্লবী পক্ষের মধ্যেকার বিরোধকে তীক্ষ্ণভাবে সামনে আনল এবং বিপ্লবী মার্কসবাদের ভিত্তিতেই প্রশ্নগুলির সমাধান করল।

স্টুটগার্ট কংগ্রেসে পাস হওয়া সিদ্ধান্তগুলি বিভিন্ন দেশের বামপন্থী সমাজ-গণতন্ত্রীদের কাছে সুবিধাবাদ, সামাজিক উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ‘আত্মরক্ষাবাদে’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠল। কংগ্রেসে যদিও দক্ষিণপন্থী এবং ‘মধ্যপন্থী’রাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, লেনিন কিন্তু মার্কসবাদী সত্যকে তুলে ধরেছিলেন এবং বামপন্থীদের সঙ্গে ঐক্য এবং অন্যান্য নানা কাজের মাধ্যমে তিনি সুবিধাবাদকে শেষ পর্যন্ত পরাস্ত করেছিলেন।

কংগ্রেসের পরে, লেনিন জার্মান পার্টির সুবিধাবাদী নীতির বিরুদ্ধে কি মনোভাব নিতে হবে, তা নির্ধারণ করলেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন যে, “জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলিকে অনুসরণীয় মডেল হিসেবে উপস্থিত করা” উচিত হবেনা। তিনি বললেন,

আমরা যদি মার্কসের চিন্তার প্রতি সৎ থাকতে চাই এবং রুশ সমাজতন্ত্রীদের শ্রমিক আন্দোলনের বর্তমান কর্তব্য সম্পাদনের উপযুক্ত করে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের খোলাখুলিভাবে নির্ভয়ে  জার্মান নেতাদের ভুলগুলির সমালোচনা করতে হবে ...... আমরা এই ভুলগুলি গোপন করব না, বরং রুশ সমাজতন্ত্রীদের সামনে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরব, যাতে তারা এগুলি এড়িয়ে চলতে শেখে এবং বিপ্লবী মার্কসবাদের অনেক বেশি কষ্টসাধ্য প্রয়োজন মেটানোর উপযুক্ত হয়ে ওঠে।

লেনিনের মতে, ১৮৮৬ সালে এঙ্গেলস জার্মান শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণ রেখেছিলেন, স্টুটগার্ট কংগ্রেসে সেটাই প্রমাণিত হয়েছেঃ “জার্মানিতে শান্ত সময়ে সবাই ফিলিস্তাইন হয়ে যায়। এই সময়ে তাই ফরাসি প্রতিযোগিতার হুল ফোটানো খুব প্রয়োজন। আর সেটার অভাবও হবে না”।  

….ক্রমশঃ 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আদিম কমিউন থেকে বুর্জোয়া রাষ্ট্র পর্যন্ত মানব সমাজের যাত্রার ধারা বেয়ে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের উৎস ও সমাধানের খোঁজে – একটি প্রস্তাবনা ;প্রয়াসে চঞ্চল মুন্সী এবং চারুদত্ত নীহারিকা রজত

রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>