আদিম কমিউন থেকে বুর্জোয়া রাষ্ট্র পর্যন্ত মানব সমাজের যাত্রার ধারা বেয়ে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের উৎস ও সমাধানের খোঁজে – একটি প্রস্তাবনা ;প্রয়াসে চঞ্চল মুন্সী এবং চারুদত্ত নীহারিকা রজত



আদিম কমিউন থেকে বুর্জোয়া রাষ্ট্র পর্যন্ত মানব সমাজের যাত্রার ধারা বেয়ে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের উৎস ও সমাধানের খোঁজে – একটি প্রস্তাবনা

 <প্রয়াসে চঞ্চল মুন্সী এবং চারুদত্ত নীহারিকা রজত> 

“ আরে আরে জগমোহনএস, এস,এস

বলতে পারো কোথায় থাকে আদ্যানাথের মেসো? “ 

– সুকুমার রায়

না, জগমোহন আদ্যানাথের মেসোর ঠিকানা বলেন নি। শুধু বলেন নি না, প্রচুর ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তাকে আবার আমড়াতলার মোরেই এনে ফেলেছিলেন। ভারত রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ধারণে, সময়ের সাথে সাথে জনগণ বোধহয় সেই আমড়াতলাতেই ফিরে ফিরে আসছে। ভারতের রাষ্ট্র চরিত্র কি বুর্জোয়া? নাকি সামন্ততান্ত্রিক? নাকি আধা ঔপনিবেশিক? নাকি নয়া ঔপনিবেশিক? নাকি সাম্রাজ্যবাদী? নাকি সম্প্রসারণবাদী? ভারতীয় বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রক কারা? জাতীয় বুর্জোয়া? মুতসুদ্দী বুর্জোয়া? নাকি সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা স্পনসরড বৃহৎ বুর্জোয়া, যারা জাতীয় বুর্জোয়া নয়, কিন্তু মুতসুদ্দী অবস্থা থেকে বিকশিত হয়ে গেছে? ভারতে বিপ্লবের স্তর কি? সমাজতান্ত্রিক? জনগণতান্ত্রিক? নাকি নয়া গণতান্ত্রিক? 

এই প্রশ্নে ভারতের কমিউনিস্ট দল এবং গোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার সম্পর্ক বেশ হোস্টাইল। এই প্রশ্নে তারা পরস্পরের প্রতি যে মন্তব্য ছুঁড়ে দেন, তা আর যাই হোক, অধিকাংশ সময়েই, শালীন বোধহয় নয়। তবে সেটার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, এরা প্রত্যেকেই ভারতে, তাদের প্রস্তাবিত রাষ্ট্র চরিত্র ধরে, বিপ্লবের অক্ষ নির্বাচন করেও বিপ্লবটা করতে পারেন নি; না, কেউই করতে পারেন নি। এবং অদূর ভবিষ্যতেও পারবেন, এরকম কোনও লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

তাই ১৯২০ থেকে ২০২০ – ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিচিত্র বিবর্তন ও শত  বিভাজনের পরেও, ১৯৪৮ সালে শিবদাস ঘোষের এস,ইউ,সি,আই,-এর প্রতিষ্ঠা থেকে ৭২ বছর কেটে গেলেও, নকশালবাড়ি আন্দোলনের অর্ধ শতকের বেশি সময় কেটে গেলেও, ভারতের বিপ্লব আমড়াতলার মোড়েই বারবার ফিরে এসেছে। O tempora, o mores! 


এইটিনথ ব্রুমেইর অব লুই বোনাপার্ট-এর তৃতীয় জার্মান সংস্করণের মুখবন্ধে এঙ্গেলস লিখেছিলেন,

মার্কস, যিনি প্রথম ইতিহাসের গতির নিয়মকে খুঁজে বের করেন, যে নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত ঐতিহাসিক সংগ্রামগুলি, তা সে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, দার্শনিক বা অন্য যেকোনো আদর্শগত ক্ষেত্রেই ঘটুক না কেন আদপে, সামাজিক শ্রেণিগুলির মধ্যেকার সংগ্রামের কমবেশি স্পষ্ট প্রকাশ, এবং সেই অস্তিত্ব (সামাজিক শ্রেণিগুলি – লেখক) এবং তার দরুন  উদ্ভূত এই শ্রেণিগুলির মধ্যেকার সংঘর্ষগুলি পরিপুষ্ট হয় তাদের স্ব স্ব অর্থনৈতিক অবস্থানের দ্বারা,  উৎপাদনের উপায়ের দ্বারা এবং সেটার দ্বারা নির্ধারিত বিনিময় পদ্ধতির দ্বারা।“ 

পাঠক একটু খেয়াল করুন – 

                        এক) সামাজিক শ্রেণিগুলির অর্থনৈতিক অবস্থান,

                        দুই) উৎপাদনের উপায়,

                        তিন) বিনিময় পদ্ধতি।

এই তিনটি পয়েন্টকে একটু মাথায় রাখবার অনুরোধ করছি। একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতর এই তিনটি উপাদানের বিশ্লেষণ-ই আমাদের সেই কাঠামোর আর্থ-সামাজিক স্তর বুঝতে সাহায্য করে; এবং এটিই, যেকোনো সমাজের মধ্যেকার শক্তিগুলির এবং সামগ্রিক ভাবে সেই সমাজের প্রধান বিরোধাত্মক মেরুকে চিনবার, মার্কসবাদী বিজ্ঞানের পথ।


অ্যান্টি ডুরিং-এ এঙ্গেলস বলেছেন,

“ব্যপক অর্থে, রাজনৈতিক অর্থনীতি হল, মানবসমাজের টিকে থাকার বস্তুগত উপায়ের উৎপাদন এবং বিনিময়ের নিয়মাবলীর বিজ্ঞান। উৎপাদন এবং বিনিময় দুটি আলাদা ক্রিয়াকলাপ। বিনিময় ছাড়াও উৎপাদন হতে পারে, কিন্তু বিনিময় (যা) আবশ্যিক ভাবেই, যা উৎপাদিত হয়েছে তার বিনিময় (তাই বিনিময়) উৎপাদন ছাড়া ঘটতে পারে না। এই দুটি সামাজিক ক্রিয়াকলাপের প্রত্যেকে, বহিঃ প্রভাবের অধীন যা, অনেকাংশেই সেটির নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিশেষ; এবং এই কারণে প্রতিটির ক্ষেত্রে, একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে, সেটির  নিজের জন্য বিশেষ নিয়মাবলী বর্তমান। কিন্তু অপরদিকে, তারা সমানতালে পরস্পরকে, এমন পর্যায় পর্যন্ত নির্মাণ এবং প্রভাবিত করে যে, তাদেরকে  অর্থনীতির কার্ভ-এর ভুজ ও কোটি বলে অভিহিত করা যেতে পারে।“

এবারে একটা গল্প শুনুন। গল্পটি কোথায় পরেছিলাম মনে নেই; আমি গল্পটি আমার মতন করে বলছি।


এক মহাপ্রতাপি ঋষি তার অনুগামীদের সাথে নিয়ে চলেছেন এক গহন অরণ্যের মধ্য দিয়ে। চতুর্দিকে সমস্ত “আদিম মহাদ্রুম”-গুলি দাঁড়িয়ে রয়েছে আর মাথার উপরে নির্মাণ করেছে এক সজীব চাঁদোয়ার, যা সূর্যের আলোর প্রবেশের পথকে করে তুলেছে সূক্ষ্ম, অতি সূক্ষ্ম। 

যেতে যেতে হটাৎ গতি রোধ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন ঋষি। অনুগামীরাও তাকে অনুসরণ করে স্থবির হলেন। ধীরে ধীরে অনুগামীদের দিকে ফিরলেন ঋষি। নির্মল, স্মিত হাসি ভরা মুখে উপস্থিত অনুগামীদের তিনি বললেন, “আমি এখন তোমাদের দর্শনের জ্ঞানের উপর একটি পরীক্ষা নেবো; তোমরা প্রস্তুত হও! তোমাদের মধ্যে কে এমন আছো, যে আমাকে এখুনি একটি বৃক্ষ দেখাতে পারে?” 

প্রশ্ন শুনে অনুগামীরা হয়ে উঠলেন চঞ্চল। এ কি প্রশ্ন? গহন অরণ্যের মধ্যে রয়েছেন তারা সকলে; চতুর্দিকে বিশাল বিশাল গগনচুম্বী বৃক্ষরাজি; আর গুরুদেব সেখানে দাঁড়িয়ে বলছেন তাঁকে একটি বৃক্ষ দেখাতে? গুরুদেব কি তাদের সঙ্গে পরিহাস করছেন? নাকি এর পিছনে রয়েছে কোনও গুঢ় ইঙ্গিত? 

গল্পটি এখানে শেষ! বা, গল্পটি এখান থেকেই শুরু! 

আচ্ছা, গাছ বলতে আমি, আপনি ঠিক কি বুঝি? বিশাল বিশাল বটগাছের মতন ঝুড়ি নামা কোনও আকৃতি? নাকি নারকেল, তাল, সুপুরির মতন লম্বা, লম্বা আকৃতি? নাকি বেল গাছের মতন আকৃতি? নাকি অন্যকিছু? বা, যদি বলা হয় ১, কি বুঝবো আমরা? বাংলা ১, ইংরেজি 1? নাকি একটি ছাগল? নাকি একটি বই? নাকি অন্যকিছু?

বিষয়টিকে নিয়ে একটু ভাবলেই দেখা যাবে, গাছ বলুন বা ১, আমি বা আপনি নির্দিষ্ট কিছুই বুঝি না; বুঝি সমমাত্রিক একটি সামগ্রিক ধারণাকে। কিন্তু যদি সেটিকে আমাদের নিদর্শন হিসাবে বাস্তবে দেখাতে হয় বা, তার সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়তে হয়, তাহলে আমাদের সেই সমমাত্রিক সাধারণ ধারণাকে বিনির্মাণ করতে হয় এবং অসংখ্য বিশেষের মধ্য থেকে এক বা একাধিক নিদর্শনকে বেছে নিতে হয়। তাই গাছ বা ১ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা করতে পারলেও, নিদর্শন হিসাবে আমাদের আম গাছ, বট গাছ বা একটি ছাগল, একটি বই দেখাতে হয়; গাছ বা ১ দেখাতে আমরা পারি না।  

কেন গল্পটি বললাম। সামাজিক শ্রেণি বলুন, উৎপাদনের উপায়ই বলুন বা বিনিময় পদ্ধতি-ই বলুন – এগুলি সবই সাধারণ সমমাত্রিক ধারণা প্রকাশক শব্দ; যেকোনো নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে বুঝতে গেলে এগুলিকে বোঝা জরুরী। কিন্তু এগুলি যেহেতু সাধারণ, তাই এগুলিকে বুঝতে পারা তখনই সম্ভব যখন, এই ধারণাগুলি যে সকল অসংখ্য সমমাত্রিক সাধারণ ধারণার বিমূর্ত রূপ, সেই সকল অসংখ্য সমমাত্রিক অস্তিত্বকে বিশেষে জানা হবে। অর্থাৎ আমরা গাছ – এই শব্দের সাধারণ অর্থ তখনই বুঝতে পারবো, যখন আমাদের বিভিন্ন প্রকার গাছ সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকবে। এই কথা যেকোনো সাধারণ বিমূর্ত ধারণার ক্ষেত্রেই সত্য।   

বিষয়টিকে এভাবে বোঝা যাক, আমি, আপনি বা যেকেউ, যখন বলি উৎপাদন সম্পর্ক, তখন আমরা একটি সাধারণ সমমাত্রিক বিমূর্ত ধারণার কথা বলি যেটি কিনা আমাদের আর্থ-সামাজিক উৎপাদন সম্পর্কগুলির মধ্যেকার সাধারণ বিশিষ্টতা। কিন্তু আপনি এই উৎপাদন সম্পর্ক ধরে যখন আন্দোলনে যুক্ত হবেন তখন, আপনাকে, তার সাধারণ বিশিষ্টতার সাথে সাথে, সেই বিশেষ ক্ষেত্রের উৎপাদনের বিশেষ   নিয়মাবলী সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সেই অনুযায়ী লক্ষ্যকে সামনে রেখে আন্দোলনকে গোছাতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, একটি পাট কলের উৎপাদন সম্পর্ক এবং ভারতীয় রেলের ওয়ার্কশপের উৎপাদন সম্পর্ক বিশেষ ভাবে আলাদা, যদিও নির্দিষ্ট আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার নিরিখে তাদের মধ্যে একটি সাধারণ বিশিষ্টতাও রয়েছে। অর্থাৎ, সাধারণ বিশিষ্টতা হল, বিশেষ বিশিষ্টতাগুলির সাধারণ গুণের একটি বিমূর্ত সমমাত্রিক ধারণা যা, সেই বিশেষ বিশেষ উৎপাদন সম্পর্ককে, একটি নির্দিষ্ট আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার সাধারণ গুণাবলির মাধ্যমে একসুত্রে গ্রথিত করে এবং সেই আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে, অন্য আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাগুলির সাথে সাধারণ প্রভেদের দ্বারা (কিছু সাধারণ মিল সহ) চিহ্নিত করে। একেই আমরা বলি সেই বিশেষ আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার শ্রেণি চরিত্র, বা রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র।


এঙ্গেলসের “অন অথরিটি” থেকে একটি অংশ উল্লেখ করছি, বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করবার অভিপ্রায়ে।

তুলা থেকে সুতায় পরিণত হবার জন্য তুলাকে কমপক্ষে ছয়টি ক্রমিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এবং এই প্রক্রিয়াগুলির অধিকাংশ-ই আলাদা আলাদা ঘরে সংঘটিত হয়। উপরন্তু, মেশিনগুলিকে চালু রাখবার জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ারের দরকার হয় স্টিম ইঞ্জিনটিকে দেখভাল করবার জন্য, একজন মেকানিকের প্রয়োজন হয় তখুনি হওয়া কোনও যান্ত্রিক ত্রুটিকে সারাবার জন্য, এবং অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয় যাদের কাজ হল উৎপাদিত বস্তুকে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে চালান করা ইত্যাদি। এই সমস্ত শ্রমিকরা, পুরুষ, মহিলা, শিশু নির্বিশেষে, প্রত্যকেই এই গোটা ব্যবস্থার অথরিটির দ্বারা নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু এবং শেষ করতে বাধ্য এবং এই ব্যবস্থা ব্যক্তিগত স্বায়ত্তশাসনের কোনও তোয়াক্কাই করে না। সুতরাং, শ্রমিকেরা সর্বপ্রথমে শ্রম ঘণ্টা সম্পর্কে একটি বোঝাপড়ায় আসবে এবং, তা একবার নির্ধারিত হয়ে গেলে, কোনও প্রকার ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে, প্রত্যেকের দ্বারা তা পালিত হতে হবে। এরপর আসবে প্রত্যেক ঘরে। এরপরে আসবে প্রত্যেক মুহূর্তের উৎপাদনের পদ্ধতি, মালের বণ্টন প্রভৃতি জনিত নির্দিষ্ট প্রশ্নগুলির কথা, যেগুলি আবার স্থির হবে  প্রত্যেক শ্রম বিভাগের শীর্ষের প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তের দ্বারা বা, যদি সম্ভব হয়, অধিকাংশের ভোটের দ্বারা; একক ব্যক্তির ইচ্ছাকে সর্বদাই অধীনতা স্বীকার করে নিতে হবে যার অর্থ হল এই যে, প্রশ্নগুলির সমাধান করা হয়েছে একটি কর্তৃত্বমূলক পথে।

পাঠক, এখানে সাধারণ এবং বিশেষ প্রক্রিয়াকে একটু খেয়াল করুন; খেয়াল করুন বিশেষের সাথে সাধারণের যোগসুত্রকে এবং বিশেষ থেকে সাধারণের গড়ে উঠবার প্রক্রিয়াকে। কর্তৃত্ব এখানে একটি সাধারণ ধারণা। সেই ধারণা গড়ে উঠেছে উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে সচল রাখবার জন্য; যে উৎপাদন প্রক্রিয়া আবার একাধিক উপ-প্রক্রিয়ার একটি সাধারণ ধারণা। রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রকে বুঝবার প্রক্রিয়াটা এরকম। একটি সাধারণ উৎপাদন ব্যবস্থা, তার বণ্টন, তজ্জনিত গড়ে ওঠা উৎপাদন সম্পর্ক; সেই উৎপাদন সম্পর্কগুলির মধ্যেকার সাধারণ বিশিষ্ট-ই হল একটি রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র। তাই রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র বোঝা মানে, অন্যান্য রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রের সাথে তার সাধারণ প্রভেদকে বোঝা, কেন সেই প্রভেদ সেটা বোঝা এবং সেই প্রভেদ কোন গতির এবং অভিমুখের জন্ম দিচ্ছে (ভেক্টর) তাকে বোঝা।

ভূমিকাটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা জরুরী। জরুরী এই কারণে যে, এযাবৎকালে যে ঝোঁক প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, মার্কসবাদের বেসিক সম্পর্কে একটা ব্যাপ্ত ভ্রান্তি এবং অর্বাচীন বোধ আমাদের সমাজে রয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলির বা গ্রুপগুলির সদস্যদের মধ্যে একটা পার্টি আইডেন্টিটি ছেয়ে রয়েছে যা, তার মধ্যে এই বোধের জন্ম দিচ্ছে, আমার পার্টি ঠিক এবং বাকি সবাই ভুল। মার্কসবাদ যে একটি বিজ্ঞান, এবং বিজ্ঞান যে কোনও গোষ্ঠীর কুক্ষিগত পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, বিজ্ঞান যে কোনও আপ্তবাক্য নয়, বিজ্ঞান যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে অর্জনের বিষয়, তর্ক-বিতর্ক মাত্রই যে কোনও হোস্টাইল বিষয় নয় – এই বোধগুলির ভীষণ অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে চারিদিকে। একজন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট হিসাবে গড়ে উঠবার পরিবর্তে, আমরা পরিণত হচ্ছি শুধুমাত্র একজন পার্টির সমর্থক, কর্মী, দরদীতে। ফলে আমাদের মধ্যে একদেশদর্শীতার প্রাবল্য ঘটছে। এবং মহান লেনিনের সেই অমোঘ শিক্ষা – ভাববাদের বিরোধিতা আমরা এই কারণে করি না যে তা কাল্পনিক; বরঞ্চ এই কারণে করি যে, তা একদেশদর্শী – অনুযায়ী আমরা নিজেরই অজান্তে পরিণত হচ্ছি ভাববাদীতে। বিশ্লেষণের পরিবর্তে পার্টির বক্তব্যকে তোতাপাখির মতন আউরে যাওয়া; অন্য সমস্ত পার্টির লড়াই সংগ্রামের অভিজ্ঞতাকে একজায়গায় আনবার উদ্যোগের বদলে তাদের অসম্মান করা এবং “তুমি যদি সঠিক হও, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো” মার্কা গুরুবাদি নিদান হাঁকা-কে আমরা বিপ্লব বলে মনে করে চলেছি। মার্কসবাদকে, বিপ্লবের বিজ্ঞানকে না জেনেই, নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে তাকে “স্ব-রচিত” মার্কসবাদ নাম দিচ্ছি; অন্যের সাধারণ প্রশ্ন, আমার না-পসন্দ হলেই, তাকে গালাগাল দিচ্ছি” – কিন্তু একবারও বিবেচনা করে দেখছি না, আমরা যদি প্রত্যেকেই এতোটাই সঠিক হবো, তাহলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে কেন পৌঁছতে পারছি না? প্রশ্ন করা, প্রশ্নের উত্তরকে বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে খোঁজা, ব্যক্তির একক ও বিচ্ছিন্ন চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করা – এগুলির প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধিটাই যেন আমরা হারিয়ে ফেলছি। তাই না পারছি অতীতের ভুলের কারণকে বুঝতে, না পারছি বর্তমানের কর্মসূচীকে নির্ধারণ করতে, না পারছি এ সব কিছুর সঙ্গে আমাদের যে লক্ষ্য, সেই সমাজতন্ত্রের বিজয়ের সাথে সম্পর্কিত করতে। এও বোধহয় এক অন্ধকার যুগ। এই সমালোচনা একটি সাধারণ সমালোচনা। এই সমালোচনার সাথে বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিগুলির নেতা কর্মীদের অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য ত্যাগ, তিতিক্ষা, যাপনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও এবং তাদের কাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার প্রতি সম্মান রেখেও এ কথা বলা উচিত যে, লাইন যদি সঠিক না হয়, বিজ্ঞান যদি চালিকা শক্তির আসনে না থাকে, তাহলে লাখ লাখ সৎ মানুষ জন্মাবে আর মরে যাবে – বিপ্লব আসবে না; স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে, তাহলে কথাটি বোধহয় শিবদাস ঘোষের।    

ভারত রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ধারণের প্রশ্নে যে মতপার্থক্য রয়েছে, তাকে বিদ্রুপ না করে, আমাদের সর্বাগ্রে উচিত, তাদের বিশ্লেষণগুলিকে জানা। আমিই ঠিক – এই বোধকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য সুইচ অব করে, তাদের বিশ্লেষণটিকে মার্কসবাদের আলোকে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোকে অনুধাবনের চেষ্টা করা – গ্রহণ করা বা বাতিল করবার প্রশ্ন তো তারপর আসবে। মাথায় রাখুন, আমরা একে অন্যকে বিদ্রুপ করতেই পারি, কিন্তু দিনের শেষে এ কথা সত্যই থেকে যাবে যে, আমরা কেউই আমাদের ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি নি, বা তার অতি দুর্বল সম্ভাবনাটুকুও সৃষ্টি  করতে পারি নি।

রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ধারণের প্রশ্নে আমাদের পথ কি হবে? এবং কেনই বা এই প্রশ্নে আমরা নিজেদের নিয়োজিত করবো? এবং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার জন্য আমাদের কোন কোন পূর্বশর্তগুলির সমাধান করতে হবে? অর্থাৎ কোন কোন বিষয়গুলি সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা সৃষ্টি করতে হবে?

আমরা আগেই এই বিষয়ে তিনটি পয়েন্টের উল্লেখ করেছি। এক) সামাজিক শ্রেনিগুলির অর্থনৈতিক অবস্থান, দুই) উৎপাদনের উপায়, তিন) বিনিময় পদ্ধতি।

এক) সামাজিক শ্রেনিগুলির অর্থনৈতিক অবস্থান 

আরেকটা গল্প শুনুন।


উবুন্টুঃ

দক্ষিণ আফ্রিকার শব্দ উবুন্টু। এই শব্দটি সেখানকার প্রচলিত শব্দ হলেও, আমাদের কাছে এই শব্দ এবং তার অর্থ পৌঁছানোর পিছনে একটি গল্প প্রচলিত আছে।

এক নৃ-বিজ্ঞানী একবার দক্ষিণ আফ্রিকার একটি উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করছিলেন। তিনি সেখানকার সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝবার জন্য, সেখানকার বাচ্চাদের নিয়ে একটি খেলার আয়োজন করেন।

খেলাটি একটি দৌড় প্রতিযোগিতা। শর্ত হল, যে সবার আগে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে, সে পাবে এক ঝুড়ি ফল।

দৌড় শুরু হল।

কিন্তু নৃ-বিজ্ঞানী আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলেন, যখনই কেউ বা কয়েকজন দৌড়ে বাকিদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনই তারা দাঁড়িয়ে পড়ছে পিছিয়ে পরা সাথীদের জন্য এবং তারা এসে পৌঁছলে আবার দৌড় শুরু করছে। মজা হল সবার শেষে। সকলে মিলে প্রতিযোগিতা শেষ করে, একসাথে ফলের ঝুড়িটি ঘিরে বসে খাওয়া শুরু করে দিল।

নৃ-বিজ্ঞানী যখন তাদের গিয়ে বললেন, - তোমরা তো একজনই এই পুরো ফলের ঝুড়িটা পেতে পারতে! এই বোকামি করে তো তার ক্ষতি হল!

এটি শুনেই তারা সমস্বরে বলে উঠলো, - উবুন্টু! উবুন্টু!

উবুন্টু শব্দের মোটামুটি বাংলা মানে হবে – ওরা আছে বলে আমরা আছি, বা ওরা দুখি হলে আমরা কি ভাবে সুখী হবো?

গল্পটা আমাদের পরবর্তী পর্বের একটি প্রিলিউড! ভুলে গেলে পাপ হবে না; মনে রাখলেও কেউ টাকা চাইবে না।   

মানব সমাজের শুরুটা হয়েছিল শ্রেণিহীন অবস্থাতে। মানব সমাজের সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত অবস্থাকে তিনটি পর্যায় দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। 

এক) বন্য বা Savage (মানব সমাজের শৈশব অবস্থা থেকে মাছ ধরা, আগুনের ব্যবহার করতে শেখা ও তীর ধনুকের অবিস্কার) 

দুই) বর্বর বা Barbaric (মৃৎ শিল্পের সূচনা থেকে পশুপালন, ইঁট নির্মাণ, কৃষি, ধাতুর ব্যবহার) এবং    

তিন) সভ্য বা Civilized (লিখতে শেখা থেকে শুরু)   

প্রথম দিকে মানব সমাজ ছিল শিকারি এবং সংগ্রাহক। শিকার করবার বা সংগ্রহ করবার অস্ত্র ছিল খুবই অনুন্নত, মূলত পাথরের বা হাড়ের তৈরি। সেই অস্ত্র দিয়ে শিকার করা বা সংগ্রহ করা ছিল অতি শ্রম সাধ্য এবং সেটিও একক প্রচেষ্টায় ছিল অসম্ভব। মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীব হিসাবেই তার সভ্যতার যাত্রা শুরু করেছিল। এই গোষ্ঠীগুলিকে বেঁচে থাকবার জন্য সবসময়ই সংগ্রাম করতে হতো। কিন্তু তবুও তারা যা জোগাড় করতে পারতো তা প্রায়শই হতো অপর্যাপ্ত। এই সময় যদি মানুষের দুটি গোষ্ঠী মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধতো (খাবার বা বাসস্থানের জন্য) তাহলে বিজয়ী গোষ্ঠী, পরাজিত গোষ্ঠীকে হত্যা করতো; কারণ তার যা উৎপাদন করবার ক্ষমতা এবং জ্ঞান, তা তাকে তার গোষ্ঠীর বোঝা বাড়াতে সক্ষম ছিল না।  

সময়ের সাথে সাথে তারা তাদের হাতিয়ারগুলিকে উন্নত করতে শিখতে থাকলো। উন্নততর হাতিয়ার (ভোঁতা পাথরের হাতিয়ারের বদলে তীক্ষ্ণ এবং ধারওয়ালা পাথরের হাতিয়ার ইত্যাদি) ব্যবহার করবার সাথে সাথে তাদের অস্ত্র পরিচালনার পদ্ধতিরও উন্নতি ঘটতে লাগলো। তারা এই সময়েই পশু পালন করতে শিখল, চাষাবাদ, মাছ ধরা প্রভৃতি শিখতে ও অনুশীলন করতে শুরু করেছিলো। এই সময়ে তাদের অস্ত্র কিছুটা উন্নত হয়েছে কিন্তু তাদের কাজও বেড়ে গেছে। অর্থাৎ এখন আর তারা শুধু পশু শিকার করে বেড়ায় না বা পশুর পালের সাথে সাথে ঘুরে ঘুরে যাযাবর জীবন যাপন করে না। এখন তারা পশু পালে। পশুর সংখ্যা এই পদ্ধতিতে বাড়তে থাকে। তারা চাষাবাদ করে কিছুটা। চাষাবাদের জন্য অনেক হাতের প্রয়োজন হয়। এছাড়া বন্য পশুর থেকে পশু এবং ক্ষেতকে বাঁচাতেও দরকার হাতের। এই সময় দেখা গেল, যুদ্ধে পরাজিত গোষ্ঠীকে, বিজয়ী গোষ্ঠী হত্যা না করে তাদের বন্দী করতে শুরু করলো। এই বন্দিরা গোষ্ঠীর মূল বাসিন্দাদের মতন অধিকার পেত না। এই বন্দীকে বিজয়ীরা তাদের মতন মানুষ বলেও মনে করতো না। এরা ছিল ক্রীতদাস। শুরু হল মানব সমাজের শ্রেণি বিভক্ত যুগের।

আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করবো উপজাতি সমাজ থেকে। যদিও উপজাতি সমাজ, তার একেবারে পূর্ণ বিকশিত রূপে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত কোনও প্রকার আর্থ-সামাজিক শ্রেণির জন্ম দেয় নি, কিন্তু আমরা শ্রেণি বিভক্ত সমাজকে বুঝবার জন্য এটিকে আলোচনা করবো। এবং অবশ্যই এর সাধারণ এবং বিশেষ বৈশিস্টকে খুঁটিয়ে দেখবার চেষ্টা করবো মার্কসবাদী বিজ্ঞানের গাইডলাইন মেনে।

উপজাতি সমাজ (Tribal Society):


মানব সমাজের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা দীর্ঘ কালব্যাপী সমাজ ব্যবস্থা হল উপজাতি সমাজ। মানুষের প্রথম সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সময় থেকে ৬০০ খৃস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত একটি বিস্তৃত সামাজিক বিন্যাসকে বলা হয় উপজাতি সমাজ।

আমার মতন যাদের নীরস প্রবন্ধ পাঠে আলস্য আছে, তারা রাহুল সাংকৃত্যায়নের “ভোলগা থেকে গঙ্গা”-র ‘দিবা” পড়ে নিন। পুরো “ভোলগা থেকে গঙ্গা” পড়তে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে। গল্পগুলি বেশ বড় বড়; নইলে এখানে দিতাম।

উপজাতি সমাজের সাধারণ বৈশিষ্টগুলিঃ 

·     প্রতিটি জনবসতি (জন) পরস্পর থেকে প্রাকৃতিক ভাবে ও ব্যপক ভাবে বিচ্ছিন্ন;

·        শ্রমের বিভাজন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে, অর্থাৎ শুধুমাত্র নারী এবং পুরুষের মধ্যে এই বিভাজন বর্তমান;

·     পুরুষেরা যুদ্ধ করে, শিকার করে, মাছ ধরে, খাবারের উপকরণ সংগ্রহ করে, অস্ত্র বানায় প্রভৃতি;

·      নারীরা গৃহস্থালি পরিচালনা করে, পোশাক বানায়, রাঁধে, বোনে, শেলাই করে প্রভৃতি;

·   নারী এবং পুরুষের স্ব স্ব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত (সামাজিক ভাবে);

·     নারী এবং পুরুষের শ্রমের ক্ষেত্রের হাতিয়ারের উপর তাদের নিজ নিজ অধিকার সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত;

·      সম্পত্তির অধিকার সাম্প্রদায়িক;

·     প্রতিটি উপজাতি সমাজ প্রাথমকিক ভাবে রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত;

·     সামাজিক চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের হাতিয়ার খুবই অনুন্নত;

·     উদ্বৃত্তের অস্তিত্ব নেই;

·     সাংস্কৃতিক চর্চা যৌথ;

·   ধর্মীয় বিশ্বাস মূলত জাদু এবং পূর্বপুরুষ ভিত্তিক; প্রকৃতি পুজাও পাওয়া যায়;

·     পরিবার শব্দটি খুবই দুর্বল

 

বিকাশের ধারা বেয়ে উপজাতি সমাজের বিবিধ গঠনঃ  

“স্বগোষ্ঠী পরিবার” ভিত্তিক উপজাতি সমাজ (Consanguine family):   

এই ধরণের পরিবার গড়ে উঠত ভাই, বোন এর যৌন সম্পর্কের ভিত্তিতে। এই ধরণের সমাজের সদস্যরা সকলেই রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত।

এই আলোচনা শুরুর আগে, আসুন, একটু বেদ-পাঠ করে নি। প্রথমে সংস্কৃতে লিখবো, তারপর তার অনুবাদ দেবো। কেউ যদি প্রশ্ন করেন কেন সংস্কৃত শ্লোকটি লিখছি, তার জন্য আমার আগাম উত্তর, যে কারণে মার্কস ল্যাটিন ভাষায় মজা করেছিলেন ক্যাপিটালে বা মর্গান হোরাসের ল্যাটিন কবিতা লিখেছিলেন তার প্রাচীন সমাজ-এ, সেই একই কারণে।   

এই সুক্তের ঋষি (রচনাকার?) যম এবং যমী; উদ্দিষ্ট দেবতাও তারাই। এবং ছন্দ হচ্ছে ত্রিস্টুপ (১১ মাত্রা) । এটি ঋক্ বেদের দশম মণ্ডলের ১০ নম্বর সুক্তের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঋক্।   


যমী যমকে বলছেন -

“ও চিৎসখায়াং সখ্যা ববৃত্যাং তিরঃ পুরূ চিদর্ণবং জগন্বান্ ।

পিতুর্ণপাতমা দধীত বেধা অধি প্রতরং দীধ্যানঃ ।।

অনুবাদঃ বিস্তীর্ণ সমুদ্রমধ্যবর্তী এ দ্বীপে এসে, এ নির্জন প্রদেশে তোমার সহবাসের জন্য আমি অভিলাষিণী, কারণ গর্ভাবস্থা অবধি তুমি আমার সহচর। বিধাতা মনে মনে চিন্তা করে রেখেছেন, তোমার ঔরসে, আমার গর্ভে, আমাদের পিতার এক নাতি জন্মিবে।

উত্তরে যম যমীকে বলছেন –

“ন তে সখ্যা সখ্যাং বষ্ট্যেতৎসলক্ষ্মা যন্বিষুরূপা ভবাতি ।

মহস্পুত্রাসো অসুরস্য বীরা দিবো ধর্তার উর্বিয়া পরি খ্যন্ ।।“

অনুবাদঃ তোমার গর্ভ-সহচর তোমার সাথে এপ্রকার সম্পর্ক কামনা করে না। যেহেতু তুমি সহোদরা ভগিনী; অগম্যা। আর এ স্থান নির্জন নহে, যেহেতু সে মহান অসুরের স্বর্গধারণকারী বীরপুত্রগণ পৃথিবীর সর্বভাগ দেখছেন।

যমী পাল্টা যুক্তি দিলেন –

"উশন্তি ঘা তে অমৃতাস এতদেকস্য চিত্ত্যজসং মর্তস্য ।

নি তে মনো মনসি ধাজ্যস্মে জন্যুঃ পতিস্তন্ব মা বিবিশ্যাঃ ।।“

অনুবাদঃ যদিও কেবল মানুষের পক্ষে এপ্রকার সংসর্গ নিষিদ্ধ, তথাপি দেবতারা এরুপ সংসর্গ ইচ্ছাপূর্বক করে থাকেন। অতএব আমার যেরূপ ইচ্ছা হচ্ছে, তুমিও তদ্রুপ ইচ্ছা করো। তুমি পুত্র জন্মদাতা পতির ন্যায় আমার ভিতরে প্রবেশ করো।

এবার চলুন একটু মিশরে যাওয়া যাক, ফারাও-এর দেশে।


১২৭৯ খ্রিঃপূঃ থেকে ১২১৩ খ্রিঃপূঃ পর্যন্ত, মিশরের রাজা রামসিস দ্বিতীয়-র ৫০ জনের মতন কন্যা সন্তান ছিল যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে তিনি বিবাহ করেছিলেন।


২৮৬-২৪৫ খৃস্টপূর্বাব্দে মিশরের ফারাও টলেমি দ্বিতীয়, তার নিজের বোন আসিনো দ্বিতীয়কে বিবাহ করেন। প্রকৃতপক্ষে আলেকজান্দ্রিয়াতে যে ৮জন টলেমি রাজত্ব করেছিলেন, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের বোনকে বিয়ে করেছিলেন। বালক রাজা টুট আনখ আমুন-এর (১৩৩৪ খ্রিঃপূঃ থেকে ১৩২৫ খ্রিঃপূঃ) বাবা এবং মা ছিলেন ভাই বোন।


মেসোপটেমিয়া সভ্যতাতেও যে স্বগোত্র বিবাহ ছিল, তার প্রমাণ হামুরাবির আইন।


সফোক্লিসের অয়েদিপাউস নাটকটি কে না জানে!   

“সাধারণ জোড় বাধা গোষ্ঠী পরিবার” ভিত্তিক উপজাতি সমাজ (Punaluan family):

এ ধরণের পরিবার গড়ে উঠত একটি গোষ্ঠীর ভাইদের সাথে অপর গোষ্ঠীর বোনেদের সাধারণ বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে। সাধারন স্ত্রী বা সাধারণ স্বামী, এই সমাজের আরেকটি বিশিষ্ট। এই ধরণের পরিবারে, একই মায়ের পুরুষ ও স্ত্রী সন্তানের মধ্যে (লিনিয়ার পারিবারিক সম্পর্ক) বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ।


রামায়নে,        রামচন্দ্র বিবাহ করেন জনক-এর কন্যা সীতাকে।

                     লক্ষ্মণ বিবাহ করেন সীতার বোন ঊর্মিলাকে।

                   ভরত বিবাহ করেন জনকের ছোট ভাই কুশধ্বজ-এর কন্যা মান্ডবিকে।

                     শত্রুঘ্ন বিবাহ করেন মান্ডবির বোন শ্রুতকৃতিকে।

তবে, এই মাহাকাব্যিক উপমাতে “সাধারণ জোড় বাধা গোষ্ঠী পরিবার”-এর নিদর্শন পাওয়া গেলেও, এরা একে অন্যের সাধারণ স্বামী-স্ত্রী ছিলেন, এরকম কোনও সুত্র পাওয়া যায় না।  

মহাভারতে, দ্রৌপদি চরিত্রের মধ্যে আবার এই বিশিষ্টতা পাওয়া যায় যেখানে তিনি পঞ্চ পাণ্ডবের সাধারণ স্ত্রী ছিলেন।

এখানে একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, আপনাদের জানা থাকলে বলবেন, শালী শব্দটি বাংলা ভাষায় বেশ অফেন্সিভ শব্দ, উপযুক্ত সম্পর্ক ব্যতিরেকে প্রয়োগে। শালী শব্দটির একটি গঠন এরকম – শালা (গৃহ) + ইন = শালী এবং অপরটি হল শাল্ (শ্লাঘা করা) + ইন = শালী। কিন্তু এই বুৎপত্তি থেকে কোনও অসম্মানজনক ঝোঁক কি শব্দটির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে? আমি তো সেরকম স্পষ্ট কিছু বুঝছি না। নাকি এই শব্দের কোনও আদি ব্যবহার এই ধারণাকে বহন করে চলেছে?

দক্ষিণ আমেরিকার কিছু পিছিয়ে থাকা আদিবাসীদের মধ্যে “সাধারণ জোড় বাধা গোষ্ঠী পরিবার”-এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ভেনিজুয়েলাতে পদার্পণ করা প্রথম নাবিকের বর্ণনা থেকেও এই ধরণের পরিবারের অস্তিত্বের সন্ধান মেলে।

…… চলবে


মন্তব্যসমূহ

  1. ভুমিকা প্রয়োজন বটে কিন্তু এক সাথে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করার মধ্যে আনলে বিষয় বস্তুর বাঁধুনি থাকে না।টিকা হিসেবে এগুলো দেখালে ভালো হতো। বিপ্লবী দল বা গোষ্ঠী গুলো বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারেনি বলে তাদের সামাজিক অবদান শূন্য এমন বোধ সঠিক নয়। বর্তমান কালে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চৈতন্য দেব থেকে ক্যমুনিষ্ট পার্টি গুলো বা কঙ্গরেস পার্টির রেডিক্যাল ফোর্সের ভূমিকা ছিল আর তার ফলে স্বাধীনতা আন্দোলন গতি পায়।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। বিষয়টি মাথায় রাখবার চেষ্টা করবো।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম - অনুবাদে রুমা নিয়োগী(প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)

রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>