কেন মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান?
কেন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারা)একটি বিজ্ঞান?
চারুদত্ত নীহারিকা রজত দ্বারা সংগৃহীত এবং অনুদিত এবং মুল রচনাকার এইচ।স্কট-এর অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।
এক) আপনি বলেন যে
মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান। কিন্তু অধিকাংশ অ-মার্ক্সবাদীদের কাছে এটি একটি বিজ্ঞান
নয়, এটি একটি আপ্তবাক্য (dogma)। তাহলে আপনি কেন বলেন যে এটি একটি বিজ্ঞান?
উত্তর) বিজ্ঞানের সংজ্ঞা
দেওয়াটা কোনও মামুলি ব্যাপার নয়। পদার্থবিদ্যা
কেন বিজ্ঞান? বা জীববিদ্যা কেন বিজ্ঞান? কেন জ্যোতির্বিদ্যা একটি বিজ্ঞান কিন্তু
জ্যোতিষবিদ্যা নয়?
অভিধান বিজ্ঞানকে এই মর্মে সংজ্ঞায়িত করে,অধ্যায়নের বিষয় হিসাবে সুসংবদ্ধ
জ্ঞানের একটি বিভাগ এবং জ্ঞান বা জ্ঞানের একটি পদ্ধতি যা, সাধারণ সত্যকে ব্যাপ্ত করে, অথবা সাধারণ নিয়মাবলীর গবেষণা করে,
বিশেষত সেইসব সাধারণ নিয়মাবলী যা
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আহিত হয়েছে। [সুত্রঃ Merriam-Webster's Collegiate
Dictionary, 10th ed. (1993)]
এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে আবার এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, জ্ঞানান্বেষণের নিয়মানুগ
প্রক্রিয়ার নীতিগুলি এবং প্রক্রিয়াগুলি, যা সমস্যার স্বীকৃতি এবং সুত্রায়নে রত হয়, পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে তথ্য
সংগ্রহ করে এবং প্রকল্পগুলিকে (Hypothesis) পরীক্ষা ও সুত্রায়িত করে। [সুত্রঃ Merriam-Webster's Collegiate
Dictionary, 10th ed. (1993)]
অর্থাৎ বিজ্ঞানের সংজ্ঞা পরোক্ষভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দ্বারা নির্ধারিত হয়। আমার
বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বাস্তবতার নিরিখে গৃহীত সত্যের পরীক্ষা এবং তার থেকে গড়ে ওঠা
তত্ত্ব, অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কেন্দ্রীয় উপাদানগুলির উপর নিবদ্ধ।
মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান কারণ, এটি সামাজিক প্রপঞ্চের(phenomena) একটি বিস্তৃত
ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে, সেই সমস্ত
সামাজিক প্রপঞ্চগুলিকে, যত্ন সহকারে গড়ে তোলা তত্ত্বের সাহায্যে সুসংবদ্ধ করে, ঐ তত্ত্ব থেকে
বহুবিধ ঘটনাকে সূত্রবদ্ধ করে এবং সেই সমস্ত তত্ত্বগুলিকে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে,
বাস্তবের মাটিতে সমাজ এবং ব্যক্তি মানুষকে বদলানোর লড়াইয়ের মাধ্যমে যাচাই করে। যেকোনো
বিজ্ঞানের মতনই এটি দুনিয়াকে বদলানোর শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছে;
যদিও অন্যান্য সকল বিজ্ঞানের মতনই তার নিজস্ব ক্ষেত্র সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের
উত্তর দেবার জন্য তাকে এখনও দীর্ঘ পথ পেরোতে হবে। আর পাঁচটা বিজ্ঞানের মতনই এটি, বাস্তবতার নিরিখে, পরীক্ষার
মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিবর্তিত ও বিকশিত
করেছে। ১৮৪০ সাল থেকে শুরু করে...
· এটি, প্রধান এবং অপ্রধান বিভিন্ন নতুন তত্ত্বের মাধ্যমে নিজেকে বিপুল ভাবে
বিস্তৃত ও বিকশিত করেছে এবং নতুন বহু বাস্তব বিষয় সেই সকল তত্ত্বের আলোকে স্পষ্টতর
হয়েছে;
· এটি কিছু ভ্রান্ত তত্ত্ব এবং বিভ্রান্তিমূলক বিষয়কে বাতিল করেছে এবং অন্যান্য
বহু বিষয়কে, ভ্রান্তির উপাদানগুলিকে বাতিল করে ও সত্যের উপাদানগুলিকে রক্ষা করবার মধ্য দিয়ে, পরিবর্তিত হয়েছে;
· যথেষ্ট সফলতার সাথে এটিকে, বিবিধ সামাজিক অবস্থার নিরিখে, বিশেষত রাশিয়া এবং চীনে দুনিয়া
কাঁপানো বিপ্লবের ক্ষেত্রে, প্রয়োগ করা গেছে এবং এক্ষেত্রে এটি, অপরাপর বিকল্প তত্ত্বগুলির তুলনায় বহুগুণে সফল থেকেছে;
· এটি চিহ্নিত করেছে যে, এখনও কিছু সমস্যা আছে
যার সম্পূর্ণ সমাধান সে করতে পারে নি এবং সে, সেই সমাধানের লক্ষ্যে, আন্তরিকতার সাথে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে;
যার সম্পূর্ণ সমাধান সে করতে পারে নি এবং সে, সেই সমাধানের লক্ষ্যে, আন্তরিকতার সাথে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে;
· এটি সেই সমস্ত প্রবণতার বিরুদ্ধে কষ্টকর সংগ্রাম চালাচ্ছে যেগুলি মার্ক্সবাদকে একটি আপ্তবাক্যে পরিণত করতে চায় এবং মার্ক্সবাদের বৈজ্ঞানিক ভাবে
পরিক্ষিত মূলগত সারৎসার থেকে মার্ক্সবাদকে বিচ্যুত করতে চায়; এবং
· এটি তার নিজের নীতিসমূহ এবং পদ্ধতির উপর বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনাকে প্রয়োগ করেছে
এবং এটি সে করেছে পরম আন্তরিকতার সাথে। প্রকৃতপক্ষে, এইক্ষেত্রকে,
এটি যেকোনো বিজ্ঞানের তুলনায় অধিক গুরুত্ব
দিয়েছে এবং এতে করে এটি সাধারণভাবে বিজ্ঞানের বিজ্ঞান বা অন্যভাবে বললে বৈজ্ঞানিক
দর্শনকে, মার্ক্সবাদের একটি উপাদানে
পরিণত করেছে।
দুই) অতএব আপনি বলছেন
মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান কারণ এর সাথে ভৌত বিজ্ঞানের কিছু মিল আছে?
উত্তর) বিজ্ঞান হিসাবে
বিবেচিত হতে হলে, যেকোনও শৃঙ্খলাকে, প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রগুলিতে, যথেষ্ট পরিমাণে
অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির মতন হতে হয়। যেভাবে পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা
বিজ্ঞান, সেই একই ভাবে মার্ক্সবাদও বিজ্ঞান। অন্যান্য বিজ্ঞানের সাথে বহু প্রাসঙ্গিক
মিলের দ্বারা এটিকে দেখানো যেতে পারে এবং এটিও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে কেন কিছু
আপাত অমিল অপ্রাসঙ্গিক।
অবশ্যই কোন দুটি আলাদা শৃঙ্খলার বিজ্ঞান হুবহু একরকম নয়, এমনকি তাদের বিকাশের
পদ্ধতিগুলিও সম্পূর্ণ একরকম নয়। বিজ্ঞানের শৃঙ্খলা ভেদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও বিভিন্ন
হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আপনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে “অন্ধত্ব নিবারণ” সংক্রান্ত কিছু শুনতে পাবেন
না যদিও এটি খুবই সাধারণ একটি সমস্যা এবং জীববিদ্যা সংক্রান্ত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
সমাজবিজ্ঞান এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভেদ রয়েছে, ঠিক যেরকম প্রভেদ রয়েছে ভৌত-বিজ্ঞান এবং
জীবন-বিজ্ঞানের মধ্যে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে প্রাসঙ্গিক মিলও,
যা তাদের সকলকেই বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। মার্ক্সবাদের
ক্ষেত্রেও এটি সত্য।
তিন) আপনি কি এরকম বলতে চাইছেন যে, মার্ক্সবাদ এবং
সমাজবিজ্ঞান একই এবং সকল প্রকৃত সমাজ বিজ্ঞানগুলি প্রকৃতপক্ষে মার্ক্সবাদের অংশ?
উত্তর) মোটামুটি সঠিকই ধরেছেন। যদিও মার্ক্সবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল
দর্শন, যাকে বলে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, যা সমাজবিজ্ঞানকে ছাপিয়ে আরও বহু ব্যাপ্ত।
প্রকৃতপক্ষে এই দর্শন নিজেই একটি সবচেয়ে সাধারণীকৃত এবং বিমূর্ত বিজ্ঞান, যা
সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত বিজ্ঞানের সাধারণ, বিমূর্ত সত্যের
একীকরণের মধ্য দিয়ে।
এটা বলাও পাশাপাশি বোধহয় উচিত হবে যে, সমাজের এবং সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কিছু বিশেষজ্ঞ
দিক রয়েছে যা মার্ক্সবাদের অংশ নয়, যেমন সমাজ-মনোবিদ্যা বা সমাজ-ভাষাতত্ত্ব
প্রভৃতি। যদিও, আমাদের মতে, সমাজবিজ্ঞানের প্রধান অংশগুলির অধিকাংশই মার্ক্সবাদের
সাথে সমবিস্তৃত (coextensive)। প্রকৃত সমাজবিজ্ঞানের গুপ্ত ক্ষেত্রগুলি, যা সরাসরি
ভাবে মার্ক্সবাদের অংশ নয়, সেটিও মার্ক্সবাদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত এবং
শিক্ষিত।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সমসাময়িক বুর্জোয়া সমাজ-মনোবিদ্যার দ্বারা উত্থাপিত বহু
বিষয়ের যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্লেষণ মার্ক্সবাদের মধ্যেই সম্ভব হয়। যেমন, মানুষের
সামাজিক কাজের প্রাথমিক চালিকা শক্তি কি? মার্ক্সবাদের উত্তর হচ্ছে, এটি হল
মানুষের নিজের গোষ্ঠীর বিকাশের তাগিদ, যা কিনা শ্রেণী বিভক্ত সমাজের ক্ষেত্রে তার
শ্রেণী স্বার্থ। এটি মার্ক্সবাদের একটি একেবারে মূলগত উপাদান। এইজন্যই আমি বলি যে, যদি
সমাজ-মনোবিদ্যার এমন কোনও অংশ থেকে থাকে যা মার্ক্সবাদের অংশ নয়, বা অন্তত সরাসরি
ভাবে মার্ক্সবাদের উপর নির্ভরশীল নয়, তাহলে তা অবশ্যই একটি গুপ্ত অংশ। এই একই কথা
সমাজ-ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতির ক্ষেত্রেও সত্য।
চার) সমাজবিদ্যা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যা
পড়ানো হয়?
উত্তর) বর্তমানে সমাজবিদ্যা যে ভাবে আমরা পাই তা বাস্তবে একটি তামাশা এবং
এইভাবেই বিজ্ঞানের অন্য শাখার মানুষেরা একে দেখে থাকে। একজন একবার মন্তব্য
করেছিলেন যে, সমাজবিদ্যার মূলগত পদ্ধতি হল, “সুস্পষ্টকে অস্পষ্ট ভাবে উপস্থাপিত
করা”। [সুত্রঃ Samuel
T. Williamson, "How to Write Like a Social Scientist", Rule 4,
Saturday Review [date unknown]. Quoted in R. John Brockmann & William
Horton, The Writer's Pocket Almanack (Santa Monica, CA: InfoBooks, 1988), p. 8] এখন প্রশ্ন হল, সমাজবিজ্ঞানীরা কেন এই ধরণের
দুর্বোধ্য বা রহস্যময় ভাষার ব্যবহার করেন? কারণ তারা বিষয়ের স্পষ্টীকরণের বদলে তাকে রহস্যে ঢেকে রাখতে চেষ্টা
করেন। যখন তারা অস্পষ্টকে
ঘোষণা করেন, তারা সর্বদাই গালভরা শব্দ ব্যবহার করেন, যাতে করে তাদের
মন্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি ভুল ধারণাকে
ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এবং প্রায়শই যখন তারা প্রকৃত সত্যকে লুকাতে চান তাদের স্বাভাবিক
ভাবেই ব্যবহার করতে হয় বেশি বেশি করে দুর্বোধ্য ভাষা এবং দোমড়ানো মোচড়ানো যুক্তি-মালা।
যেমন, উদাহরণ স্বরূপ, যখন তাদের উত্তর দিতে হয়,
কিভাবে সুবিধা প্রাপ্ত শ্রেণীগুলি,
নিজের দেশে এবং বিদেশে, অধিকাংশ জনগণকে শোষণ করে, তখন তারা প্রশ্নগুলিকে সম্বোধন না করে তাকে জটিল ও অবান্তর শব্দ দিয়ে
আড়াল করেন। ফলে বুর্জোয়া সমাজবিদ্যা একটি মূল্যহীন বিষয় এবং এই
শৃঙ্খলাটি গড়ে উঠেছে মার্ক্সবাদের বিরোধিতায় এবং মার্ক্সবাদের প্রতি ভীতিকে
কেন্দ্র করে। এর টিকে থাকার কারণ হল, মার্ক্সবাদকে আক্রমণ করা এবং শাসক শ্রেণীর মনপসন্দ একটি মনগড়া বিকল্প তৈরি করা।
সমাজের প্রকৃত বিজ্ঞান, প্রকৃত সমাজবিদ্যা হল মার্ক্সবাদ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত
সমাজবিদ্যা নামটি বুর্জোয়া ছদ্ম বিজ্ঞানের দ্বারা দখল হয়ে গেছে।
পাঁচ) অর্থনীতির বিষয়ে কি বলবেন? প্রায় সমস্ত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা মার্ক্সীয়
অর্থনীতিকে দেখামাত্র বাতিল করেছেন।
উত্তর) তারা এটাই করেন! এভাবেই তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয় এবং এই কারণেই তাদের
পারিশ্রমিক দেওয়া হয় অর্থাৎ শাসক পুঁজিবাদী শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা
এবং কেন শ্রমের শোষণ চিরকাল জরুরি – এটা বোঝানো। তারা প্রকৃতপক্ষে নিষিদ্ধ
শব্দবন্ধগুলি, যেমন শ্রমের শোষণ প্রভৃতি ব্যবহার করেন না; পরিবর্তে তারা কিছু কোড
ব্যবহার করেন। এমনকি পুঁজিবাদকেও তারা নরম করে বলেন “মুক্ত
উদ্যোগ ব্যবস্থা” (Free Enterprise System) বা “গণতন্ত্র” নামক আরও উদ্ভট শব্দে।
বুর্জোয়া সমাজবিজ্ঞানের কাজই হল সত্যকে
প্রকাশ করবার বদলে লুকিয়ে রাখা।
আমি দুটি কারণে, বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে শাসকরা যে গণতন্ত্র বলে থাকে, তাকে উদ্ভট বলেছিঃ প্রথমত, পুঁজিবাদের
ইতিহাসে মাত্র কিছু পুঁজিবাদী দেশ
গণতান্ত্রিক; ফ্যাসিবাদী বা অন্যান্য স্বৈরাচারী দেশগুলিও পুঁজিবাদী
(যদিও, প্রায়শই তারা সেটিকে লুকিয়ে রাখতে
চায়)। দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, সাধারণ মানুষের সাপেক্ষে বুর্জোয়া গণতন্ত্র, সর্বদাই একটি প্রতারণা, এটি শুধুই
একটি শব্দ। প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে বোঝায়,
জনগণের নিজের জীবন-জীবিকার উপর নিয়ন্ত্রন যেটি কিনা, সব দেশের উচ্চ শ্রেণীর নাগরিকদের বাদ দিলে, কোথাও নেই।
সমাজবিদ্যার মতনই বুর্জোয়া অর্থনীতিও প্রকৃতপক্ষে একটি ছদ্ম বিজ্ঞান। আজ
পর্যন্ত এটি একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সংজ্ঞা দিতে পারলো না যে, কেন পুঁজিবাদের মধ্যে বানিজ্য
চক্র (business cycle) পরিচালিত হয়? কেন বাজারে চড়া এবং পতন
আসে? কেন মন্দা আসে? প্রকৃতপক্ষে, প্রতিবার বাজার চড়লেই
বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা বলতে শুরু করেন যে,
বানিজ্য চক্র একটি অতীতের বিষয় – কিন্তু তাদের এই দাবি ঠিক তার পরের মন্দাতেই ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়।
এটা সবাই জানে যে, তাদের অর্থনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন জনের
ব্যাখ্যা, একে অন্যের সাথে প্রায়শই মেলে
না। তাই এটিকে একটি বিজ্ঞান বলবার থেকে, একটি অনুমানধর্মী কাজ বলাটাই উচিত। এনারা আসলে প্রাচীনকালের রাজ-জ্যোতিষীদের আধুনিক প্রতিনিধি!
বুর্জোয়া অর্থনীতির প্রকৃত সারবত্তা হল, শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে, বেকারদের
বিরুদ্ধে এবং গরীবদের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী শ্রেণীকে রক্ষা করা, তাকে তুলে ধরা এবং
তার অধিকার এবং স্বার্থকে মজবুত করা। অপরদিকে মার্ক্সীয় অর্থনীতি, যাকে আমরা
রাজনৈতিক অর্থনীতি বলে থাকি, তার রাজনৈতিক চরিত্রকে সোচ্চারে ঘোষণা করে। মার্ক্সীয়
রাজনৈতিক অর্থনীতি দৃঢ় ভাবে শ্রমিক শ্রেণী এবং তার মিত্র শ্রেণীগুলির স্বার্থের
পক্ষে অবস্থান নেয়। আমরা আমাদের পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে প্রকাশ্যে এবং সততার সাথে
অবস্থান গ্রহণ করি কারণ আমরা বৃহত্তর জনগণের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু বুর্জোয়া অর্থনীতি এই বিষয়টিকে লুকিয়ে
রাখতে চায় যে, তারা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাই তারা
তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে মিথ্যাচার করেই থাকে।
ছয়) বিজ্ঞান পূর্বাভাস দেয়। আমাদের মনে হয় মার্ক্সবাদের করা পূর্বাভাসগুলির
কিছুই প্রায় মেলে নি!
উত্তর) কে বলে? মুলত মার্ক্সবাদের বুর্জোয়া শত্রুরা বা যারা এইসকল মানুষদের
থেকে শিক্ষা পেয়েছেন তারা, তাইতো? আচ্ছা,
একটা উক্তিকে কোট করছি উদাহরণস্বরূপ, দেখুনঃ
“যেহেতু মার্ক্সের করা পূর্বাভাসগুলির একটিও মেলে নি (ব্যাতিক্রম The German Ideology-তে উক্ত, অনুন্নত দেশগুলিতে
সমাজতন্ত্রকে আরোপ করলে সেই সকল দেশের বিকাশ ঘটে), তাই মার্ক্সবাদ যে একটি বিজ্ঞান –
এরকম ভানও আর কেউ করেন না। এটি তার অনুগামীদের কাছে একটি অভিজ্ঞতাবাদী বাস্তবতার
বদলে একটি গুপ্ত ব্যবস্থায় (মধ্যযুগীয় কাবালার মতন) পরিণত হয়েছে যা আমাদের মতন
বাদবাকিদের চিন্তার বিষয় নয় – অন্তত এখন
পর্যন্ত নয়।“ [সুত্রঃ George Sim Johnson, "Everything Goes, Nothing Matters",
Image magazine supplement, San Francisco Examiner, Feb. 3, 1991]
এটি একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে, জর্জ
সিম জনসন বলে একজনের করা মন্তব্য। এখন
প্রশ্ন হল, কে এই জর্জ সিম জনসন? তিনি কি
মার্ক্সবাদের কোনও বিশেষজ্ঞ? আসলে, তিনি হলেন একটি প্রধান বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্কের
প্রক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং National Review-এর মতন একাধিক দক্ষিণপন্থী সাময়িক পত্রিকার লেখক। এবং উপরে উল্লেখিত তার বক্তব্যের
প্রতিটি মন্তব্যই ভুল – এমনকি শাসক শ্রেণী মার্ক্সবাদকে নিয়ে আর চিন্তিত নয় বা
চিন্তিত হবার কোনও কারণ নেই – এই বাক্যটিও ভুল। (আসল ঘটনা হল, তার ঐ লাইনটি লেখাই,
তার কথাটি যে ভুল, তা প্রমাণ করে)। আমরা
মার্ক্সবাদীরা, মার্ক্সবাদ যে একটি বিজ্ঞান, এই বিষয়ে কোনও ভনিতা করি না; আমরা
দৃঢ়তার বলি যে, মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান হিসাবেই এর বিকাশকে
এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এমনকি তিনি যখন অনুন্নত দেশে (রাশিয়া, চীন) সমাজতন্ত্রের
প্রভাব নিয়ে বলেন, সেটিও ভুল; এই দেশগুলিতে, অধিকাংশ জনগণের কল্যাণ, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রভুত উন্নতি করলেও
(যা অধিকাংশ অ-মার্ক্সবাদী অথরিটিরাও স্বীকার করেন) তারা কোনও ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী
দেশগুলির জীবনধারণের মানকে (living standards) স্পর্শ করতে পারে নি।
এবং মার্ক্স এবং অন্যান্য অনেক মার্ক্সবাদীদের (অবশ্যই সকলে নন) করা পূর্বাভাস
সম্পর্কে বলা যায় যে, তাদের পূর্বাভাস প্রায়োগিক ভাবেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এই
ক্ষেত্রে আমাদের রেকর্ড, মার্ক্সবাদকে যারা বাতিল করেছে,
তাদের তুলনায় বহুগুণে ভালো।
একজন আমেরিকান সাংবাদিক, কার্ল মার্ক্স-এর বৃদ্ধ বয়সে, তাঁর কাছে যান এবং
জানতে চান, তিনি (মার্ক্স) ভবিষ্যৎ সম্পর্কে
কি পূর্বাভাস করছেন। “গভীর এবং আত্মস্থ কণ্ঠে” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “সংগ্রাম”; [সুত্রঃ John Swinton, reporting on an interview with
Karl Marx for the New York Sun, Sept. 6, 1880] এর বিপরীতে,
ভিক্টোরিয়া যুগের শিক্ষিত বুর্জোয়াদের সেই সর্বজনীন আচরণ, যেখানে অগ্রগামী ইউরোপীয়
সভ্যতা এতটাই আশ্বস্ত ছিল যে, তারা এই বিষয়টিকে (সংগ্রাম) নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন
পর্যন্ত অনুভব করেন নি। সেইসময়, বুর্জোয়া
প্রত্যাশার প্রায় কাছাকাছি ছিল
শান্তিপূর্ণ প্রগতি, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রবল অভিঘাতই সেই প্রত্যাশার
পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল। একবার ফিরে দেখো ১২০ বছর আগে মার্ক্সের করা পূর্বাভাসগুলি;
বিশ্বযুদ্ধ, আক্রমণ/বহিরাক্রমণ, গণহত্যা, হিংস্র শ্রেণী সংগ্রাম, বিপ্লব,
জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, ধর্মীয় সংগ্রাম এবং এইরকম আরও অনেক কিছু। কে ঠিক ছিল?
মার্ক্স? নাকি ভিক্টোরীয় যুগের বুর্জোয়াদের সামাজিক শান্তির দৃশ্য?
মার্ক্সের এই পূর্বাভাসগুলিকে, যেগুলি সম্পর্কে ভিক্টোরীয়দের কোনও ধারণাই ছিল না, সেগুলিকে কি খুব অসার মনে
হচ্ছে তোমার? বেশ, তাহলে লেনিনের করা একটি ভীষণ নির্দিষ্ট পূর্বাভাসকে দেখা যাক
(লেনিন ১৯২৪ সালে মারা গিয়েছিলেন), যা মার্কিন লিবারেল সাংবাদিক জর্জ সেলডেস এর ১৯১৯ সালের রিপোর্ট থেকে জানা যায়।
“আরেকটি ক্ষেত্রে তিনি (লেনিন) সেই একই জেদি ধারণা প্রকাশ করেছিলেন, যে জেদি
আচরণ সমস্ত বিপ্লবী নেতাদের সাধারণ চরিত্র
ছিল।“
“জাপান এবং আমেরিকার মধ্যেকার যুদ্ধ কবে নাগাদ আসন্ন”, তিনি জিজ্ঞাসা
করেছিলেন। তাঁকে (লেনিন) আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, কোনও যুদ্ধ হবে না কারণ যুদ্ধের কোন কারণ নেই। “কিন্তু যুদ্ধ অবশ্যই হবে”, তিনি জোর
দিয়ে বলেছিলেন, “কারণ বুর্জোয়া দেশগুলি যুদ্ধ ছাড়া টিকে থাকতে পারে না”। [সুত্রঃ George Seldes, You Can't Print
That! (Garden City, NY: Garden City Publishing Co., 1929), p. 221.]
অবশ্যই এটার মজা এইটা নয় যে, মার্ক্সবাদী লেনিন জাপান এবং আমেরিকার মধ্যেকার
ভবিষ্যৎ যুদ্ধের কথা আগাম বলে দিয়েছিলেন (যখন গুটিকয়েক মানুষ, যদি অবশ্য কেউ থেকে থাকেন, এটি ঘটতে চলেছে বুঝেছিলেন), মজা হল বুর্জোয়া সাংবাদিক সেলডেস দৃঢ় নিশ্চিত ছিলেন যে,
লেনিন এই ক্ষেত্রে, অবশ্যই ভুল প্রমাণিত হবেন।
শুধুমাত্র লেনিন নন, সাধারণ ভাবে মার্ক্সবাদীরা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময় পূর্বাভাস করেছিলেন, যখন
বহু বুর্জোয়া আদর্শবাদীরা প্রথম
বিশ্বযুদ্ধকে “সেই যুদ্ধ যা সমস্ত যুদ্ধকে সমাপ্ত করেছে” বলে দাবি করতেন। বহু
ক্ষেত্রে আমরা মার্ক্সবাদীরা পূর্বাভাস করেছি এবং এখনও করি ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্যবাদী
যুদ্ধের, যখন অনেক লিবারেলরা শান্তির যুগের পূর্বাভাস দেন। বহু ক্ষেত্রে আমরা
পূর্বাভাস করেছি এবং এখনও করি, সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের শ্রমিক এবং পুঁজিবাদীদের
মধ্যেকার শ্রেণী সংগ্রামের যখন পুঁজিবাদী ভাবাদর্শের মানুষেরা, এই ব্যবস্থায়
সামাজিক শান্তির কল্পনা করেন।
সাত) বেশ, হয়তো মার্ক্সবাদীরা বিগত শতাব্দীতে,
চলমান সংগ্রামের যুগ, যুদ্ধ এবং বিপ্লবের ক্ষেত্রে সঠিক
পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, কিন্তু আর কিকি সফল
পূর্বাভাসের উদাহরণ আপনি দিতে পারেন?
উত্তর) বড় ছোট মিলিয়ে মার্ক্সের করা বহু পূর্বাভাস, সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই মুহূর্তে তাদের
মধ্যে কয়েকটা, যা মনে আসছে সেগুলি, হলঃ
· একচেটিয়া পুঁজির ঝোঁক ক্রমশ বাড়বে এবং তীব্র হবে;
· পুঁজিবাদের চড়া-মন্দার চাকা চলতেই থাকবে এবং পুঁজিবাদ কোনদিনই এটিকে নির্মূল
করতে পারবে না (যার কারণ মার্ক্স গভীর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন);
· কৃষক নির্ভর চাষ (আধা-সামন্ততান্ত্রিক) ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী কৃষি ব্যবস্থাকে পথ ছেড়ে দেবে;
· পুঁজিবাদ আরও বেশি বেশি করে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা হয়ে উঠবে;
· শ্রেণী সংগ্রাম চলবে এবং গড়ে উঠবে;
· মার্কিন গৃহ যুদ্ধে ইউনিয়ন জিতবে (কারণ উত্তরের অতি অগ্রসর পুঁজিবাদী
ব্যবস্থা);
· প্যারি কমিউনের ক্ষমতা, শ্রমিকরা ধরে রাখতে পারবে না (১৮৭১-এর প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লব);
· শ্রমিক শ্রেণী ক্ষমতা দখল করবার পর, পরাজিত বুর্জোয়াদের উপর, প্রোলেতারিয় একনায়কতন্ত্র কায়েমের মধ্য দিয়েই একমাত্র ক্ষমতা ধরে রাখতে
পারে (যে শিক্ষা মার্ক্স প্যারি কমিউনের পর সাম- আপ করেছিলেন এবং যা পরবর্তী
ইতিহাসের দ্বারা সত্য প্রমাণিত হয়েছে);
· প্রথম সফল প্রোলেতারিয় বিপ্লব হয়তো ঘটবে রাশিয়াতে।
আট) কিন্তু মার্ক্সবাদীরা কি ভুল পূর্বাভাসও করেন নি? উদাহরণস্বরূপ মার্ক্স কি
শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান দুর্দশার কথার
পূর্বাভাস করেন নি যেখানে বাস্তবে
শ্রমিকরা, এই সময়কাল ধরে, তাদের জীবন মানের অনেক উন্নতি ঘটিয়েছেন?
উত্তর) এটা সত্যি যে, মার্ক্সবাদীরা ভ্রান্ত পূর্বাভাসও করেছেন। কিন্তু এটা বলা সঠিক হবে না যে, যেহেতু
মার্ক্সবাদীরা মাঝে মধ্যে, অংশত বা সম্পূর্ণত, ভ্রান্ত পূর্বাভাস করেছেন, তাই এটি বিজ্ঞান নয়। কারণ এরকম
ভাবে দেখলে, পদার্থবিজ্ঞানকেও বিজ্ঞান বলা যাবে না কারণ প্রখ্যাত পদার্থবিদরাও মাঝে মধ্যে
ভ্রান্ত পূর্বাভাস দিয়েছেন! লর্ড কেলভিনের দুটি এরকম উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক। লর্ড
কেলভিন ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর একজন মহান বিজ্ঞানী এবং রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি।
তিনি বলেছিলেন, “বাতাসের থেকে ভারি বিমানযান অসম্ভব” এবং “বেতারের কোনও ভবিষ্যৎ
নেই”। এই ধরণের এতো মন্তব্য পাওয়া যায় যে, আরথার সি। ক্লার্ক একটি সাধারণী
বানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “যখন একজন খ্যাতনামা এবং বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী বলেন যে,
কোনও কিছু সম্ভব, তখন তিনি নিশ্চিত ভাবেই
সঠিক; কিন্তু যখন তিনি বলেন, কোনও কিছু
অসম্ভব, তখন তিনি খুব সম্ভবত ভুল”। [সুত্রঃ Arthur C. Clarke, Profiles of the Future (1973)]।
কোনও বিজ্ঞান সম্পূর্ণ নয় এবং কোনও বিজ্ঞানীর, কোনওকালেই, তার বিশেষ ক্ষেত্রের উপর সম্পূর্ণ দখল থাকে না। তাই প্রতিটি বিজ্ঞানে, সর্বদাই,
কিছু ভ্রান্ত প্রত্যাশা, পূর্বাভাস এবং
সাধারণীকরণ থাকবেই। তথাপি, যাদের, নিজ নিজ বিজ্ঞানের উপর, যত ভালো দখল থাকবে,
ততই তাদের প্রত্যাশা এবং পূর্বাভাস অন্যদের তুলনায় সঠিক হবে। উপরন্তু, যদি সেই শৃঙ্খলাটি
প্রকৃত বিজ্ঞান হয়, তাহলে সেই সমস্ত
ভ্রান্ত প্রত্যাশা এবং পূর্বাভাসগুলি সেই সেই তত্ত্বের পুনঃমুল্যায়নের দিকে নিয়ে যাবে, যাতে করে সেই সেই ক্ষেত্রে সফল পূর্বাভাস
দেওয়া যায়।
আজ হতে বহু আগে মার্ক্স, ইউরোপে সমাজ বিপ্লবের প্রত্যাশা করেছিলেন। এটি ছিল তার একটি
সন্দেহাতীত পূর্বাভাস যদিও, আমি মনে করি না যে, তিনি অমুক তিথিতে
অমুক সময়ে বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছিলেন। একইরকম ভাবে তিনি তিনি ভেবেছিলেন যে, ইউরোপের
শ্রমিক শ্রেণীর দুর্দশা অনেক বেশি ধারাক্রমে (systemetically) এবং অনেক ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পাবে যা ছিল বাস্তবে যা হয়েছে তার থেকে বেশি। এই
ভুল প্রত্যাশার বা ভুল পূর্বাভাসের পিছনে একটি মাত্র ভ্রান্তি ছিল আর তা ছিল তিনি,
পুঁজিবাদের আন্তর্জাতিকরণ এর বিশিষ্টতার বহু দিককে, পুরোপুরি বিবেচনার মধ্যে আনেন নি। (এটি পরবর্তীতে লেনিন করেছিলেন;
মার্ক্সবাদ যে তার চলার পথের ভ্রান্তিগুলিকে সংশোধন করে, এটি তার একটি উদাহরণ)।
এইজন্য, পূর্বাভাসের মুলগত নির্যাস সঠিক থাকলেও, প্রধান বিপ্লবগুলি প্রকৃতপক্ষে ঘটলো ইউরোপের
দূরতম পরিধিতে (রাশিয়া) বা তথাকথিত তৃতীয়
বিশ্বে, যে দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা
সবচেয়ে হিংস্র শোষণ ও নিপীড়নের শিকার ছিল (চায়না, ভিয়েতনাম প্রভৃতি)।
একইভাবে, আ-বিশ্ব প্রেক্ষাপটে, শ্রমিক শ্রেণীর দুর্দশার যে অনুমান/পূর্বাভাস, তাও যথেষ্ট সত্য বলে প্রমাণিত
হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষের মধ্যে, ৫০০ কোটি মানুষ জীবনধারণ করেন
দৈনিক ১৩৬ টাকারও ($2) কম টাকায়। [সুত্রঃ Mentioned by the prominent bourgeois economist, Jeffrey
Garten, in an "Economic Viewpoint" column in Business Week, Sept. 6,
2004, p. 28. Garten is dean of the Yale School of Management.]। এই কথা সত্য যে, জীবন
যাপনের খরচ পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন, কিন্তু যেখানেই তুমি থাকো না কেন, এটা সূর্যের
আলোর মতন স্পষ্ট যে, তোমার আয় যদি দৈনিক ১৩৬ টাকা বা তার কম হয়, তাহলে তুমি
চূড়ান্ত দারিদ্রের মধ্যেই অবস্থান করছো।
যেকোনো প্রকারেই হোক, চরমতম দারিদ্র অবশ্যই রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা শোষিত
ও নিষ্পেষিত দেশগুলিতে; প্রধানত এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকায়। বুর্জোয়ারা,
তাদের নিজেদের দেশে তুলনামূলক শান্তি এবং শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে কিছু পদক্ষেপকে
অনুমোদন দেয় (যদিও তা তারা দেয় ভীষণ
অনিচ্ছা সত্ত্বে এবং প্রবল চাপের কারণে) যেমন
মজুরি বাড়ানো, এবং তলার শ্রেণীর কাছে পৌঁছায় এমন সুবিধাগুলি; এটিই হল “New Deal” এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রের আসল কথা। শাসক শ্রেণী, জোসেফ কেনেডির সেই অবস্থানকে
গ্রহণ করেছিলেন যেখানে তিনি বলেছিলেন যে,
তিনি তার “সৌভাগ্যের” একটি অংশ ছেড়ে দিতে
প্রস্তুত বাকিদের মুখ বন্ধ করবার জন্য। কিন্তু তাদের চোখে এই ছাড় একটি অস্থায়ী
প্রয়োজন ছাড়া কিছু নয়। এবং বর্তমানে, পুঁজিবাদী শ্রেণী এবং তাদের রাজনীতিবিদরা
কল্যাণকামী রাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ও শ্রমিক শ্রেণী ও মধ্যবিত্ত বর্গের
উপর আবার আক্রমণ শানাচ্ছে। তারা এটিকে এখন সম্ভব ভাবছে কারণ সমাজতন্ত্র, এই
মুহূর্তে অন্তত, একটি বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসাবে শ্রমিকদের সামনে উপস্থিত নেই এবং
পুঁজিবাদ আরও বেশি বেশি করে যেহেতু আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছে তাই তাদের নিজেদের মধ্যে
“প্রতিযোগিতার” জন্য শ্রমিকদের মজুরিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিচে নামিয়ে আনাটা
জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই যদিও এটি সত্য যে, প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে আগের
থেকে ভালো অবস্থায় যাচ্ছিল কিন্তু বিগত ২৫/৩০ বছর ধরে তা আবার ধারাবাহিক ভাবে নিম্নমুখী এবং ধিরে ধিরে তাদের
দেওয়া সমস্ত ছাড় আবার ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এবং শ্রমিকদের দুর্দশা সারা পৃথিবী জুড়ে
আবার দ্রুত বাড়ছে।
মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান এবং সেই কারণেই আমরা তার পরিবর্তন এনেছি এবং এই
কারণেই মার্ক্সের কিছু ধারণা এবং প্রত্যাশা যে সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে সত্য
প্রতিপন্ন হয় নি, সেই বিষয়কে আমরা পাত্তাই
দিই না। গ্যালিলিও, নিউটন বা ডারউইনের কিছু ধারনাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু তার
জন্য এই ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এতটুকুও কমে না; না এতে এটা প্রতিষ্ঠিত
হয় যে, পদার্থবিদ্যা বা জীববিদ্যা বিজ্ঞান নয়। আসলে ঘটনাটি ঠিক এর বিপরীত।
নয়) অধিকাংশ বিকশিত বিজ্ঞানেরই একটি কেন্দ্রীয় সংগঠক ধারণা রয়েছে; উদাহরণস্বরূপ, রসায়নের
ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স, প্রাকৃতিক ইতিহাসের রয়েছে বিবর্তনবাদের
তত্ত্ব এবং ভু-পদার্থবিদ্যার রয়েছে টেক্টোনিক প্লেট। মার্ক্সবাদের কি এরকম কোনও কেন্দ্রীয় সংগঠক ধারণা রয়েছে? এবং থাকলে তা ঠিক কি?
উত্তর) সাধারণভাবে (অর্থাৎ দার্শনিকভাবে),
মার্ক্সবাদ – লেনিনবাদ – মাও চিন্তাধারার কেন্দ্রীয় সংগঠক তত্ত্বটি হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। সমাজের নিরিখে
নির্দিষ্ট করে বললে, মার্ক্সবাদ – লেনিনবাদ – মাও চিন্তাধারার কেন্দ্রীয় সংগঠক
তত্ত্বটি হল, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যা কিনা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সমাজ, অর্থনীতি এবং
রাজনীতিতে প্রয়োগের ফল। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কয়েকটি প্রধান প্রধান বিষয় হলঃ
1. মানব সমাজকে এবং ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক ভাবে বোঝা
সম্ভব;
2. যেকোনো বস্তুগত উৎপাদনই হল সামাজিক জীবনের ভীত এবং সামাজিক চেতনা হল সমাজবদ্ধ জীবের পরিণাম;
3. সমাজ এবং ইতিহাসের নির্মাতা হল মানব সমাজের অন্তর্গত মানুষেরা;
4. সমাজের বর্তমান উৎপাদক শর্ত তার পরিবর্তনের সীমাকে
নির্ধারণ করে, যা সমাজের মধ্যে সংঘটিত করা
যায়;
5. উৎপাদন সম্পর্কের সাথে মানুষের বিভিন্ন সম্পর্কের
কারণেই সামাজিক শ্রেণীগুলি টিকে থাকে (উদাহরণ স্বরূপ তারা কারখানা এবং যন্ত্রপাতির
মালিকানাকে ধারণ করে কি না);
6. মানব সমাজের ইতিহসাস, যবে থেকে শ্রেণী বিভক্ত সমাজ
হয়েছে, হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস;
7. বিকাশের একটি পর্যায়ে সমাজের বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তি, উৎপাদন সম্পর্কের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে; [সুত্রঃ Karl Marx, Preface to a
Contribution to the Critique of Political Economy, (Peking: 1976), pp. 3-4.]
8. সেই সময় থেকেই সমাজ বিপ্লবের যুগ শুরু হয়; [সুত্রঃ Karl Marx, Preface to a
Contribution to the Critique of Political Economy, (Peking: 1976), pp. 3-4.]
9. মানব সমাজ নিশ্চিত এবং অবধারিত ভাবেই কমিউনিজমে
পৌঁছবে, যেখানে শ্রেণীর বিলোপ ঘটেছে;
10.পুঁজিবাদ এবং কমিউনিজমের মধ্যে একটি অবশ্যম্ভাবী উত্তরণ পর্ব (সমাজতন্ত্র)
থাকবে যেটি কেবলমাত্র হবে বুর্জোয়াদের উপর প্রোলেতারিয় একনায়কতন্ত্র।
দশ) যদি মার্ক্সবাদ একটি বিজ্ঞান হয়, তাহলে তার এতো
সমালোচনা কেন হবে? আমার অনুমান, আপনি বলবেন, এই দেশের শাসকেরা এটিকে তাদের নিজেদের
জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করেন এবং হাজার হাজার “বেশ্যা” বুদ্ধিজীবীদের আর্থিক মদত
দেয় একে আক্রমণ করবার জন্য। কিন্তু আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন যে, এতো এতো
সমালোচকের সকলকেই অর্থের বিনিময়ে এগুলি করেন?
উত্তর) কিনে ফেলার মতন এত সহজ নয় বিষয়টি যদিও এরকমটিও হয়। কোনও যুগের
কর্তৃত্বপূর্ণ ধারনাটি হল শাসকের ধারণা এবং এটি শুধু এই কারণে নয় যে, তারা
অন্যান্য সমস্ত ধারণাকে কড়া হাতে দমন করতে
চায় বা তারা প্রচুর লোককে অর্থের বিনিময়ে এটিকে প্রচার করতে বলে। মুল কারণ হল,
অধিকাংশ মানুষ, এমনকি তাদের পয়সার বিনিময়ে নিয়োগ করা প্রচারকরাও শাসকের পক্ষের
মতবাদকে বা চিন্তাকে প্রচার করে এই জন্য যে, তারা তাদের শাসকের দর্শনকে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিবেশের মধ্যেই
কোনও না কোনও ভাবে বেড়ে ওঠে। তারা তাদের মায়ের কোল থেকেই ধনী মানুষের আচরণের ছড়িয়ে
থাকা ধারণা, বিকৃত তথ্য, অবৈজ্ঞানিক সামাজিক
তত্ত্ব, সাথে আগাপাশতলা মিথ্যার মধ্যে বেড়ে ওঠে। কচি বাচ্চার টিভি-র কার্টুন থেকে সমাজবিদ্যার
জার্নাল, কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়, খেলার মাঠ, সংবাদপত্র,
ম্যাগাজিন্স – বুর্জোয়া দর্শনকে মানুষের
ভিতরে পুরে দেওয়া হয়। কোনও খেলা পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহ হয়ে যায়, যদি না তা শাসকের
প্রশস্তি ব্যতিরেকে আরম্ভ হয় (The Pledge of Allegiance)।
সর্বোপরি, আমরা মার্ক্সবাদীরা মনে করি যে, মানুষ তাই বিশ্বাস করবার দিকে এগিয়ে
যায়, যা তাদের নিজেদের স্বার্থের অনুকুল
(যদিনা তাকে প্রবলভাবে বিপরীত চিন্তার দ্বারা শিক্ষা দেওয়া হয়)। তুমি যদি এটিকে
সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, প্রফেসরদের কাছে স্পষ্ট করে দাও যে, তাদের নিজেদের
ক্যারিয়ারের বিকাশ নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার ঘোষণার উপর, তাহলে
আশ্চর্যজনক ভাবে সেই চিন্তাধারা তাদের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হবে।
এগারো) কিন্তু আপনি একথা অস্বীকার করতে পারবেন না
যে মার্ক্সবাদ, অন্যান্য বিজ্ঞানের তুলনায় অনেক বেশি বিতর্কিত।
উত্তর) আমরা এটিকে একেবারেই অস্বীকার করি না; তবে
এটিকে ব্যাখ্যা করা খুবই সোজা, লেনি উলফ, তার অসাধারন বই The Science of Revolution বলেন, “কেউ কেউ মার্ক্সবাদের বৈজ্ঞানিক চরিত্রকে অস্বীকার
করতে উদ্যত হয়েছেন এই কারণে যে, এটিকে
কেন্দ্র করে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র বিতর্ক, একটি তত্ত্বকে অবৈজ্ঞানিক বলে নিদান
হাঁকতে পারে না। ডারউইন-এর বিবর্তনবাদের তত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক মহলে একটি প্রলয়
এনেছিল; ঠিক যেভাবে আইনস্টাইন-এর আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব এনেছিল। অবশিষ্ট সমাজ তথা বৈজ্ঞানিকেরা দুটি যুযুধান
শিবিরে ভেঙে গিয়েছিল এই তত্ত্বগুলিকে নিয়ে; দুটি ক্ষেত্রেই আনকোরা নতুন তত্ত্বের,
যে তত্ত্বগুলি গভীরভাবে সমাজে শিকড় গেড়েছিল, প্রচারকরা জয়ী হয়েছিলেন সংগ্রামের পর......(মার্ক্সবাদ) সমাজকে
গভীর ভাবে বিভাজিত করেছে – এবং একে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে – এই কারণে এটি
অবৈজ্ঞানিক হতে পারে না। একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যা বুর্জোয়া সমাজের সবচেয়ে নরম
তন্তুতে সরাসরি আঘাত হেনেছে – এর শোষণমূলক শ্রেণী সম্পর্ক এবং এর প্রোলেতেরিয়
বিপ্লবের প্রতি ঝোঁককে প্রকাশ করেছে – সে যে
বহু বিস্তৃত বিতর্কের জন্ম দেবে, তাতে
আশ্চর্যের কিছু নেই।“ [সুত্রঃ Lenny Wolff, The Science of
Revolution: An Introduction (Chicago: RCP Publications, 1983), pp. 12-13]প্রথম প্রবর্তিত হবার সময়, শুধুমাত্র বিবর্তন বা
আপেক্ষিকতাবাদই বিতর্কিত ছিল, বিষয়টি এরকম
নয়। কিন্তু কার্যত, সেই সমস্ত মহান বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলি, যেগুলি একটি বিস্তৃত প্রপঞ্চকে (Phenomena) ব্যাপ্ত করেছে, সেটাই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কোপারনিকাসের তত্ত্ব, যে পৃথিবী সূর্যের
চারদিকে পরিভ্রমণ করে (সূর্য পৃথিবীর চারদিকে পাক খায় এর বিপরীত) একটি দীর্ঘ সময়
ধরে অবশ্যই বিতর্কিত ছিল। এই কারণেই জিওরদানো ব্রুনো কে চার্চের নির্দেশে পুড়িয়ে
মারা হয়েছিল এবং গ্যালিলিও-র কপালেও প্রায় সমগোত্রীয় শাস্তি জুটেছিল। বেশ কিছু
শতাব্দী ধরে কিছু অঞ্চলে এই তত্ত্বকে বেআইনি করে রাখা হয়েছিল! ভু-পদার্থবিদ্যায় যখন আলফ্রেড ওয়েগনার, মহাদেশীয় প্লেটের সঞ্চালনের উপর দারুন দারুন যুক্তি ও প্রমাণ হাজির করেছিলেন বিংশ
শতাব্দীর শুরুতে, তখন থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত, প্রায় সমস্ত ভু-পদার্থবিদরা, তার তত্ত্বকে বাতিল করেছিলেন, যারা এটি বিশ্বাসই করতে পারেন নি যে, মহাদেশের মতন এত বিশাল কিছু নড়েচড়ে বেড়াতে পারে। বর্তমানে, টেকটোনিক প্লেটের তত্ত্ব
সর্বজনীন ভাবে গৃহীত। অতএব, বিতর্ক এবং বাতিল করা, বিজ্ঞানের গোঁড়াপন্থীদের কাছে খুবই স্বাভাবিক
এবং এটা বরাবরই স্বাভাবিক।
অধিকাংশ মানুষের, বিজ্ঞানের সাথে প্রত্যক্ষ
অভিজ্ঞতা বা ধারাবাহিক বিতর্কের সাথে,
পরিচয় নেই। আমরা বিজ্ঞানের যা কিছু শিখি,
তা মুলত শিখি স্কুল পাঠ্য বই থেকে, যেখানে
বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলিকে একটি মিটমাট হয়ে
যাওয়া বিষয় হিসাবে পড়ানো হয় এবং শুধুমাত্র সর্বশেষ সহমতিকে চিত্রিত করা যেটি, একসময় খুবই বিতর্কিত ছিল কিন্তু বর্তমানে আর তা
নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।
বারো) কিন্তু এটা তো নিশ্চিত যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং
সমস্ত কমিউনিস্ট জমানার পতনের পর মার্ক্সবাদ আর বিজ্ঞান নেই, বরঞ্চ তা একটি
সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ, মহান কাল্পনিক পরীক্ষা মাত্র?
উত্তর) আমি সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে পরে কোথাও বিস্তারে আলোচনা করবো, কিন্তু এখনের জন্য আমি
এইটুকুই বলবো যে, ১৯৯১ সালে যার পতন হয়েছে তা কোনভাবেই মার্ক্সীয় ছিল না বা সমাজতান্ত্রিক ছিল না; কমিউনিস্ট দেশের তো প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল ১৯৫৩-১৯৫৭ সালে, খ্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে। এবং সেই সময়
সমাজতন্ত্রের পতন হয় নি – সেটি ছিল কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে ক্ষমতাসীন হওয়া একটি
নতুন গোষ্ঠীর দ্বারা সমাজতন্ত্রের উৎপাটন।
এটা সত্যি যে, পার্টির ভিতরে এই নব্য উত্থিত
রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদীদের দ্বারা একটি
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল সম্ভব ছিল না যদিনা, সোভিয়েত সমাজের ভিতরে কিছু মারাত্মক দুর্বলতা থাকতো। কিন্তু এই দুর্বলতাগুলি অর্থনীতির নয় – যেরকমটা তোমাদের
বিশ্বাস করানো হয়েছে। (অর্থনৈতিক দুর্বলতা, অর্থনৈতিক বন্ধা দশা, এমনকি গোপন
মন্দা, সবই গড়ে উঠেছিল সংশোধনবাদী যুগে, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ প্রবর্তনের সাথে
সাথে)। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৫৫ সালে সোভিয়েতের শিল্প উৎপাদন ছিল ১৯১৩ সালে রাশিয়ার শিল্প উৎপাদনের পঁচিশ গুণ। [সুত্রঃ Emile Burns, An
Introduction to Marxism (NY: International Publishers, 1966), p. 78. The author
was a British revisionist, and you may dismiss him as biased—though other books
I've read, both by friends of the Soviet Union and by enemies, suggest that
this figure is in the right ball park. Even most rabid anti-communist
authorities admit that Soviet industrial production increased at a very rapid
overall pace during its first three decades (what we, the followers of Mao –
TseTung thoughts, count as the socialist
period)] এবং
এটি ঘটেছিল নিজের মাটিতে, দু-দুটি বিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধ সত্ত্বেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও,
বিপ্লবের দরুন প্রবল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও, বিপ্লবের ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও প্রবল
ক্ষতিকারক গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও এবং ১৩ টি পুঁজিবাদী দেশের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ)
উপদ্রব সত্ত্বেও। এতো কিছু বিরূপতা সত্ত্বেও , ১৯১৩ সালের ভীষণ ভাবে পিছিয়ে পড়া
দেশটি ১৯৫০ সাল নাগাদ একটি শক্তিশালী
শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা যাই বলুক
না কেন, সোভিয়েতের শ্রমিক শ্রেণী স্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করেছেন যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি
কাজ করে এবং এটি পুঁজিবাদের থেকে অনেক
ভালো ভাবে কাজ করে।
তাহলে কোথায় ছিল সেই ভয়ঙ্কর দুর্বলতা যার পরিণতিতে
ঘটলো সংশোধনবাদী ক্ষমতা দখল? এর একাধিক প্রকারের সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণ রয়েছে,
কিন্তু আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল যেভাবে স্তালিন এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট
পার্টি, শ্রমিক শ্রেণীর বকলমে শাসন করতে চেয়েছিল
শ্রমিক শ্রেণীকে সরাসরি সমাজকে শাসন করতে
দেবার বদলে এবং তাদেরকে, তাদের যৌথ স্বার্থকে রক্ষা না করতে শিখিয়ে। এই পিতার ন্যায় আচরণ, জনগণকে নিরস্ত্র করেছে এবং যখন ক্ষমতা দখল হয়েছে সংশোধনবাদীদের দ্বারা,
তখন তারা প্রথমে তা বুঝতেই পারে নি। এবং
যখন, অবশেষে, তারা তা বুঝতে পেরেছে, তারা দখলদারদের উচ্ছেদ করেছে; তবে তা ঘটেছে ৩৫ বছর পর, যার অনেক আগেই সমাজতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এই মুহূর্তের যেটা বক্তব্য সেটা হল, ১৯৯১
সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কোনভাবেই এটা প্রমাণ করে না যে, মার্ক্সবাদ ব্যর্থ
হয়েছে। বরঞ্চ এটা আরও ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র
পরিচালনার প্রয়োজনীয়তাকেই প্রমাণ করে। সমাজতন্ত্র একটি সমানতালে পরিবর্তনশীল এবং
উদ্বর্তনমূলক ব্যবস্থা যা জন্মগত ভাবেই ভীষণ অস্থির; হয় এটি অধঃপতিত হয়ে পুঁজিবাদে
ফিরে যাবে আর নয়তো, সেটি কমিউনিস্ট সমাজের
দৃঢ় স্থায়িত্বের দিকে এগিয়ে যাবে।
তেরো) এটি যদি বিজ্ঞান হয় তাহলে মার্ক্সবাদ বা
মার্ক্সবাদ - লেনিনবাদ- মাও চিন্তাধারা গোছের এরকম অদ্ভুত নাম কেন? আর কোনও
বিজ্ঞান তো কোনও ব্যক্তির নামে নেই!
উত্তর) এটা পুরোপুরি সত্য নয়; উদাহরণস্বরূপ বিবর্তনবাদকে অনেকসময়ই ডারউইনবাদ বলেও ডাকা হয়। কোনও বিজ্ঞানের উপর যত বেশি বিতর্ক হবে ততই
ব্যক্তির নাম, তার সাথে উল্লেখযোগ্য ভাবে যুক্ত হবে বা সেই বিজ্ঞানের নাম, সেই ব্যক্তির নাম অনুযায়ী হবে। এবং অবশ্যই এটি সমাজবিজ্ঞানের
ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে সত্য যেখানে, সামাজিক তত্ত্বের দ্বারা একটি গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব বা
বিরোধিতা করা হয়।
মার্ক্স এবং এঙ্গেলস তাদের তত্ত্বকে বলেছেন
“বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”, যাতে করে, এটিকে
বিভিন্ন পূর্ববর্তী প্রাক- বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের (কাল্পনিক সমাজতন্ত্র) থেকে
আলাদা করা যায়। যেকোনো ভাবেই হোক, আজকের দিনে এই বিজ্ঞানের একটি ভালো নাম নেই,
এমনকি আমাদের অর্থাৎ মার্ক্সবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকেও নেই। এর কারণ হল, বিগত
শতাব্দীতে সমাজতন্ত্র বলতে মার্ক্স বুঝিয়েছিলেন “সমাজতন্ত্রের প্রথম ধাপ” যার
অন্তিম লক্ষ্য হল, (যাকে মার্ক্স “সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয় স্তর” বলে উল্লেখ করেছেন) যাকে আমরা এখন বলি
‘কমিউনিজম”। উপরন্তু “সমাজতন্ত্র” নামটি, শ্রমিক
শ্রেণী বিরোধী যারা নিজেদের ‘সমাজতন্ত্রী’ বলতেন, তাদের আচরণের ও
কর্মকাণ্ডের দ্বারা, কিছুটা নিন্দিত
হয়েছে।
যদি পৃথিবীটা আরও একটু র্যাশানাল হত, তাহলে
মার্ক্সবাদ – লেনিনবাদ – মাও চিন্তাধারার স্পষ্ট নাম হতে পারতো ‘সমাজবিজ্ঞান’ বা
‘সমাজবিদ্যা’। কিন্তু, আমি আগেই যেরকমটি বলেছি, ইতিমধ্যেই শাসক
শ্রেণীর পক্ষে, সমাজবিদ্যা নামক ছদ্ম বিজ্ঞানের দ্বারা, এই
নাম নেওয়া হয়ে গেছে। যেহেতু, শাসক শ্রেণী, তার মিডিয়ার উপর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রনের মধ্য দিয়ে,
ভাষার উপর প্রভুত্ব করে, তাই আমাদেরকে
‘মার্ক্সবাদ – লেনিনবাদ – মাও চিন্তাধারা’ বা আরও সংক্ষেপে শুধু ‘মার্ক্সবাদ’ এই
নামেই ফিরে যেতে হয়েছে। এতে আমরা অন্তত এইটুকু নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, শাসক
শ্রেণী, তাদের ঘৃণিত তিন মহান বিপ্লবীর নামাঙ্কিত বিজ্ঞানকে অন্তত, তাদের নিজেদের
মধ্যে ঢুকিয়ে নেবে না!
@@@ সমাপ্ত @@@
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন