কেন মার্ক্সবাদীরা অভিবাসনের (immigration) ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে
মূল রচনা
নিকোলাস আলবিন ভেনসন
অনুবাদ, অনুলিখন, সংক্ষেপণে
চারুদত্ত নীহারিকা রজত
২০০৮-এর সংকটের শুরু থেকেই, অভিবাসন বিরোধী দল এবং আন্দোলনগুলি, (তাদের নিজেদের) বিকাশ ঘটিয়েছে। তারা এমনকি, শ্রমিক শ্রেণীর কিছু অংশকে, তাদের প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রভাবিতও করেছে। এর পরিণতিতে শ্রমিক আন্দোলনের একটি অংশকে, কঠোরতর সীমানা নিয়ন্ত্রণ, মার্ক্সের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থানকে জাস্টিফাই করা - এই ধারণাগুলির সাথে আপোষ করতে হয়েছে। এই সব অদূরদর্শী নীতিগুলির সাথে মার্ক্স, বা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের ঐতিহ্যের কোনও সম্পর্ক নেই, যা আমরা দেখাবো।
বাণী চয়নের শিল্পঃ
২০১৬
সালের ২৪শে ডিসেম্বর, ম্যাক্লস্কি, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা, “Morning
Star”-এ, তার পুনঃনির্বাচনী প্রচারের অঙ্গ হিসাবে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন। এই আর্টিকেলটির
লক্ষ্য ছিল, স্পষ্টতই, তার বাম প্রতিপক্ষ আয়ান অ্যালিনসন, যিনি কয়েকদিন আগেই একটি আর্টিকেল
লিখেছিলেন শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে চলাচলের (সীমানা নির্বিশেষে) অধিকারের সমর্থনে।অন্যান্য
যুক্তিগুলির মধ্যে, অ্যালিনসন, একটি চমৎকার সাদৃশ্য দেখিয়ে, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের উদাহরণ দিয়েছিলেন। মহিলাদের
বাইরে বেরিয়ে কাজ না করার দাবি এবং ইউনিয়নগুলিকে
প্রতিক্রিয়াশীল বলে দেগে দেওয়া হল একটি বিভাজনমূলক দাবি, যা কর্তৃপক্ষকে পুরুষ এবং
মহিলাদের জন্য আলাদা মজুরির হার প্রস্তুত করতে সাহায্য করে এবং এর দ্বারা পুরুষ শ্রমিকদের
মজুরি এবং অবস্থাকে অবহেলা করতে মহিলাদের ব্যবহার করে (অর্থাৎ মহিলারা কাজ করছে বলে
পুরুষদের কাজ কমে যাচ্ছে, বা তারা কম মজুরি পাচ্ছে প্রভৃতি)। বর্তমানে পারিয়ারি শ্রমিকদের
উপস্থিতি সম্পর্কে যে যে আপত্তিগুলিকে তোলা হয়, সেগুলিই তোলা হতো অতীতে, মহিলা শ্রমিকদের
বিরুদ্ধে। পারিয়ারি শ্রমিকদের তাই আলাদা করে বিচার করবার কোনও কারণ নেই।
নিজের
অবস্থানের স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে, ম্যাক্লস্কি, প্রথম আন্তর্জাতিকের ল’জেন (Lausanne) সম্মেলনের প্রস্তুতিতে মার্কসের
বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে বললেনঃ
“ইংরেজ
শ্রমিক শ্রেণি যে লড়াই পরিচালনা করছেন তা স্পষ্ট করেছে যে, নিজেদের শ্রমিকদের বিরোধিতা
করতে গিয়ে, নিয়োগকর্তারা হয় বিদেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে আসে বা, উৎপাদনকে সেই সব দেশে চালান করে, যেখানে সস্তা শ্রম শক্তি বর্তমান রয়েছে।“
এই টুকরো
অংশ দিয়ে, ম্যাক্লস্কি এই সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছেন যে, মার্কস সীমানার নিয়ন্ত্রণকে
সমর্থন করেছেন। কিন্তু আমরা যদি পুরো প্যারাগ্রাফটি পড়ি, (তাহলে) আমরা একটি আলাদা ছবি-ই
পাবোঃ
“ব্যক্তি
মানুষের ক্ষমতা, পুঁজির ক্ষমতার সামনে হারিয়ে গিয়েছে, কারখানায় শ্রমিকেরা এখন যন্ত্রের চাকার দাঁত বই আর কিছু নয়। তার নিজস্বতাকে
উদ্ধার করতে হলে, শ্রমিকদের, অন্যান্যদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং নিজেদের জীবন ও
জীবিকাকে রক্ষা করবার জন্য সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান সময় পর্যন্ত, এই সংগঠনগুলি
ভীষণ ভাবে স্থানীয়, যেখানে, নতুন নতুন যন্ত্রের আবিস্কারের সাহায্যে, পুঁজির ক্ষমতা
দিন দিন বাড়ছে; উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রেই, জাতীয় সংগঠনগুলি শক্তিহীন হয়ে পড়েছেঃ একটি
স্টাডি দেখাচ্ছে যে, ইংরেজ শ্রমিক শ্রেণি যে লড়াই
পরিচালনা করছেন তা স্পষ্ট করেছে যে, নিজেদের শ্রমিকদের বিরোধিতা করতে গিয়ে, নিয়োগকর্তারা
হয় বিদেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে আসে বা উৎপাদনকে সেই সব দেশে চালান করে যেখানে সস্তা শ্রম
শক্তি বর্তমান রয়েছে। এমতাবস্থায়, যদি শ্রমিক শ্রেণি, সফল হবার সম্ভাবনাকে মাথায়
রেখে তাদের সংগ্রামকে চালিয়ে যেতে চায়, (তাহলে) জাতীয় সংগঠনগুলিকে অবশ্যই হয়ে উঠতে
হবে আন্তর্জাতিক।“ (ল’জেন
(Lausanne) সম্মেলন, মার্কস)
মার্কস
সমস্যাটি বুঝেছিলেন্ যে, নিয়োগকর্তারা জাতীয় এবং সীমানাকে ব্যবহার করছে শ্রমিক
শ্রেণিকে, একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে গাড্ডায় ফেলতে। যদিও, তাঁর সমাধান
“নিয়ন্ত্রিত অভিবাসন” নয়, তাঁর সমাধান ছিল আন্তর্জাতিক সংগঠন। মার্কস, সীমানা
ছাড়িয়ে শ্রমিক সংগ্রামের মধ্যে আরও বেশি বেশি করে সহযোগিতার ডাক দিলেন।
যেটি হওয়া
উচিত সঠিক দাবি, যা ম্যাক্লস্কি তার ১৯শে ডিসেম্বরের আর্টিকেলে উত্থাপিত
করেছিলেন, তা হল, নিয়োগকর্তাদের দ্বারা বিদেশি শ্রমিকদের, বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকদের
মজুরির তুলনায় কম মজুরিতে নিয়োগ করা বন্ধ করা। মার্কসের দ্বারা অনুমোদিত প্রোগ্রামের
এটি একটি অংশ ছিল।
এখানে
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, (মার্কসের সময়ে) ধর্মঘট ভাঙবার জন্য শ্রমিকদের আনা হত অন্য
দেশ থেকে। মার্কস যখন প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর প্রধান কাজ ছিল এই প্র্যাকটিসের
বিরুদ্ধে লড়াইকে পরিচালনা করা। (এবং) কিভাবে তিনি এটি করেছিলেন? পারিয়ারি শ্রমিকদেরকে ইউনিয়নের মধ্যে
অন্তর্ভুক্ত করে এবং বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের মধ্যে, আন্তর্জাতিকের মধ্য দিয়ে, সংযোগ
স্থাপন করে।
প্রথম
আন্তর্জাতিক শ্রমিকদের কাছে আন্তর্জাতিকতাবাদকে সফল ভাবে প্রমাণ করেছিল, বিশেষত ব্রিটেনে।
একই প্রক্রিয়া দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকও লাগু রাখে এবং তা আরও ব্যাপকতর সাফল্যের মধ্য দিয়ে।
ব্রিটেনের সমস্ত শ্রমিক কাজ করবে একই বেতন হারে – এই কথা বলা, আর বিদেশি শ্রমিকদের
নিষিদ্ধ করা বা সীমাবদ্ধ ভাবে ব্যবহার করা --- দুটি সম্পূর্ণ আলাদা কথা; যেখানে প্রথমটি
শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে আর দ্বিতীয়টি করে বিভাজিত।
মার্কস এবং আইরিশ জাতিগত প্রশ্নঃ
প্রথম
আন্তর্জাতিকের দু’জন মার্কিন সদস্যকে লেখা মার্কসের চিঠিতে মার্কস বললেনঃ
“……আয়ারল্যান্ড
সমানতালে তার উদ্বৃত্তকে ইংরেজ শ্রম বাজারে চালান করে চলেছে, এবং যা ইংরেজ শ্রমিক শ্রেনির
মজুরী ও তাদের বস্তুগত ও নীতিগত অবস্থানের বাধ্যতামূলক অবনমন ঘটাচ্ছে।
…… এবং
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বর্তমানে ইংল্যান্ডের সমস্ত শিল্প ও বানিজ্য কেন্দ্রগুলি দুটি
যুযুধান শ্রমিক শ্রেনিতে বিভাজিত হয়ে রয়েছে, ইংরাজ শ্রমিক শ্রেণি এবং আইরিশ শ্রমিক
শ্রেণি। একজন সাধারণ ইংরাজ শ্রমিক, একজন আইরিশ
শ্রমিককে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ঘৃণা
করে কারণ সে তার জীবন-জীবিকার মানের অবনমন ঘটিয়েছে। আইরিশ শ্রমিকের তুলনায়, সে (একজন
ইংরাজ শ্রমিক) নিজেকে শাসক দেশের একজন সদস্য হিসাবে ভাবে এবং ফলত সে পরিণত হয়ে পড়ে,
আয়ারল্যান্ড এর বিরুদ্ধে, ইংরাজ অভিজাত শ্রেণি
ও বুর্জোয়াদের ক্রীড়নকে এবং এর ফলে সে নিজের উপর তাদের (ইংরাজ অভিজাত শ্রেণি ও বুর্জোয়াদের ) প্রভাবকে আরও শক্তিশালী
করে ফেলে। সে একজন আইরিশ শ্রমিকের তুলনায় তার ধর্মীয়, সামাজিক এবং জাতিগত বিশেষ সুবিধা
ভোগ করতে থাকে। তাদের (আইরিশ শ্রমিক) প্রতি তার (ইংরেজ শ্রমিকের) আচরণ হয় সেরকম, যেরকম
আচরণ আগের মার্কিন দাস সমাজের সরল সাদা-দের
ছিল নিগ্রোদের প্রতি।
…… এই
বিরোধকে কৃত্রিম ভাবে জীবন্ত এবং তীব্র করতে থাকে সংবাদ পত্র, ধর্মীয় ইত্যাদি প্রচার,
মজার সংবাদগুলি; সংক্ষেপে, সবটাই করা হয় শাসক শ্রেণির স্বার্থে। এই বিরোধই হল, ইংরাজ
শ্রমিক শ্রেণির দুর্বলতার গোপন রহস্য, তাদের সংগঠন থাকা সত্ত্বেও। এটি হল সেই গোপন
রহস্য, যার দ্বারা বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের ক্ষমতাকে সুরক্ষিত করে।
… বর্তমান
বিশ্ব-বাজারকে শাসন করবার ক্ষমতার মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ড হয়ে উঠেছে সমস্ত রাজধানীগুলির
রাজধানী। ইংল্যান্ড বর্তমানে শ্রমিক বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং উপরন্তু
একমাত্র দেশ যেখানে এই বিপ্লবের বস্তুগত শর্তগুলি একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত বিকশিত
হয়ে উঠেছে। ফলত, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী জন সঙ্ঘ
(International Working Men’s Association) –এর সবচেয়ে গুরুতবপুর লক্ষ্য হল, অতি শীঘ্র
ইংল্যান্ডে একটি সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করা।
এই দ্রুততার একমাত্র অর্থ আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীন করা। তাই আন্তর্জাতিকের এটি কর্তব্য,
ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের এই দ্বন্দ্বকে সর্বত্র সামনে নিয়ে আসা এবং সর্বক্ষেত্রে
আয়ারল্যান্ডের পাশে প্রকাশ্যে দাঁড়ানো। লন্ডন কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের বিশেষ কাজ হল, ইংল্যান্ডের
শ্রমিক শ্রেণিকে এটা উপলব্ধি করানো যে তাদের জন্য আয়ারল্যান্ডের মুক্তি শুধুমাত্র একটি
বিমূর্ত ন্যায় বা মানবিক আবেগের প্রশ্ন নয়, এটি তাদের নিজেদের সামাজিক মুক্তির প্রথম
শর্ত।“
মার্কস
যুক্তি দিয়েছেন ইংরেজ শ্রমিকদের আইরিশ শ্রমিকদের স্বাধীনতার কারণকে সমর্থন করবার মধ্য
দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং প্রথম আন্তর্জাতিককে এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে ডাক দিয়েছেন।
এইভাবে, ইংরেজ এবং আইরিশ শ্রমিকরা, ইংরেজ বুর্জোয়া এবং ইংরাজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধের
সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হবে। এটি সীমানা নিয়ন্ত্রণের যুক্তির সাপেক্ষে সম্পূর্ণ পৃথক যুক্তি।
উদারবাদী বুর্জোয়াদের মিথঃ
নিজেদের
সুবিধাবাদকে আড়াল করবার জন্য, অনেক বামপন্থী অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সওয়াল করেন।
তাদের এই বিভাজনমূলক নীতিকে ন্যায্য প্রমাণ করবার জন্য “শ্রেণি সংঘর্ষ”-র একটি বুকনি
ব্যবহার করে।
হিলারি
ক্লিন্টন বললেন,
“আমি
অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের মতন নেতাদের নেওয়া সহৃদয় এবং সহানুভূতিসম্পন্ন পদক্ষেপগুলিকে
সম্মান করি। কিন্তু আমি মনে করি, এটা বলা ঠিক হবে যে, ইউরোপ তার কাজ ইতিমধ্যেই করেছে
এবং একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া দরকার যে, - আমরা আর (উদ্বাস্তুদের) আশ্রয় এবং সমর্থন
দিতে অপারগ – কারণ আমরা যদি অভিবাসন বিষয়টিকে না সামলাই, তাহলে তা আমাদের রাজনৈতিক
গঠনকে পচিয়ে দেবে।“।
টনি
ব্লেয়ার একই কথা বললেন কিন্তু তার স্বভাব সুলভ চালাকি মিশিয়ে,
“তোমাকে
তাদের আইনস্মমত ক্ষোভ কে সামলাতে হবে এবং সেগুলির উত্তর দিতে হবে, (এবং) এইজন্যই আজকে,
ইউরোপে তুমি নির্বাচনে দাঁড়াতেই পারবে না যদিনা তোমার, অভিবাসন সম্পর্কিত, একটি শক্ত
অবস্থান থাকে কারণ জনগণ এটি নিয়ে চিন্তিত …… তোমাকে এই সমস্যার উত্তর দিতে হবে। যদি
তুমি এগুলির উত্তর না দাও – তুমি একটি বিরাট খোলা অঞ্চল ছেড়ে দিচ্ছ যেখান দিয়ে জনপ্রিয়
রাজনীতি ঢুকে পড়বে।“
বুর্জোয়ারা
কোনও ভাবে অভিবাসী শ্রমিকদের বন্ধু হতে পারে, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে
সংঘটিত হওয়া জাতিবাদ এবং বিদেশীদের প্রতি ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে
– এই ভানের পিছনের আসল উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়াদেরই সেবা করা, তাদেরকে একটি বাম ও প্রগতিশীল আড়াল দেওয়া। মার্কসবাদী হিসাবে আমাদের ভূমিকা হল, বুর্জোয়াদের
উভয় গোষ্ঠীর এইসব প্রতিক্রিয়াশীল প্রেরণার মুখোশ ছিঁড়ে দেওয়া। এরা যে আসলে বুর্জোয়াদেরই
প্রতিনিধি এবং এদের আসল উদ্দেশ্য যে শ্রমিক শ্রেণিকে বিভাজিত করে তার উপর আরও নির্মম
শোষণ নামিয়ে এনে তাদের নিজেদের লাভের পাহাড়ের উচ্চতা বৃদ্ধি করা – এই সত্যকে শ্রমিক
শ্রেণির সামনে স্পষ্ট ভাবে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরা।
আমাদের প্রকৃত ঐতিহ্যঃ
১৯০৭
সালের স্টুটগার্ট সম্মেলন ছিল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন।
এই সম্মেলন আলোচনা করেছিল, উপনিবেশ, যুদ্ধ,
সাম্রাজ্যবাদ, নারী ভোটাধিকার, ট্রেড
ইউনিয়ন এবং অভিবাসন নিয়ে। (এবং) এটি কোনও কাকতালীয় বিষয় ছিল না; এই প্রশ্নগুলির মধ্য
দিয়েই তখন সুবিধাবাদ নিজেকে স্পষ্ট করছিল।
সম্মেলনের
দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীরা ছিল মূল ব্রিটেন, আমেরিকা এবং জার্মানি থেকে আগত। তারা তর্ক
দিয়েছিল উপনিবেশবাদের সমর্থনে এবং উপনিবেশবাদীদেরকে তারা বলেছিল “সভ্যতার শক্তি”, যুদ্ধের
সপক্ষে নিয়েছিল কঠোর অবস্থান, অভিবাসন বিরোধী অবস্থান, নিরপেক্ষ ট্রেড ইউনিয়নের সপক্ষে
অবস্থান এবং মহিলাদের ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে নিয়েছিল আপোষের নীতি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত
সম্মেলনের বামপন্থীরাই ভোটাভুটিতে জয়ী হয়েছিল।
এখানে,
আলোচ্য বিষয় যেহেতু অভিবাসন, তাই সেই প্রশ্নে এই সম্মেলনকে আলোচনা করা যেতে পারে। আমরা
দেখবো, সেই সময় যে যে বিতর্কগুলি তোলা হয়েছিল অভিবাসনের বিরুদ্ধে, আজও তাই-ই তোলা হচ্ছে।
ত্রোমির ছিলেন অস্ট্রেলীয় লেবার পার্টির প্রতিনিধি। তিনি বললেন,
“পুঁজিপতিরা
প্রয়াস করে আরও বেশি বেশি করে এশিয় শ্রমিক নিয়ে আসতে যাতে মজুরী কমানো যায়। অভিবাসী
সাদা চামড়ার শ্রমিকরা নিজেদেরকে দ্রুত সংগঠিত করে নেয় এবং এরা অস্ট্রেলীয়দের অবস্থার
ক্ষতি করে না। তাই অস্ট্রেলীয় লেবার পার্টি সেইসব শ্রমিকদের বাইরে রাখতে চায় যারা সাদা-দের
অবস্থার সাথে মানিয়ে নেবে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ এশিয়দের। অস্ট্রেলীয় লেবার পার্টির
এই নীতি সমাজতন্ত্রের সাথে বিরোধাত্মক নয়। অবশ্যই আমরা সবাই একটি জনগণের ভ্রাতৃত্ব
চাই, কিন্তু যতদিন না সেটা হচ্ছে, (ততদিন) আমরা অবশ্যই আমাদের নিজের দেশের শ্রমিকদের
স্বার্থ দেখবো, যাতে তারা প্রতিরোধ ছাড়া পুঁজিপতিদের সামনে আত্মসমর্পণ না করে।“
মার্কিন
প্রতিনিধি হিলকুইট প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি করেন,
“পুঁজিপতিরা
সেইসব শ্রমশক্তি আমদানি করে, যারা প্রকৃতিগত ভাবে সস্তা এবং সাধারণভাবে অবোধ স্ট্রাইক
ব্রেকার, যারা স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য বিপজ্জনক প্রতিযোগী। আজকালকার দিনে, এই শ্রমশক্তি
হল চীনা ও জাপানীরা; সাধারণভাবে পীত জাতি। আমাদের একেবারেই কোনও জাতিগত সঙ্কীর্ণতা নেই চীনাদের
প্রতি, কিন্তু এটা আমরা অবশ্যই বলবো যে, তারা সংগঠিত হবার একেবারেই অযোগ্য। একজন মানুষকে
একমাত্র তখনই শ্রেণি সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করা যায়, যখন তার যথেষ্ট বিকাশ হয়েছে, যেটি
(বিকাশ) ঘটেছে বেলজিয়াম এবং ইতালির শ্রমিকদের মধ্যে, যারা ফ্রান্সে প্রবেশ করেছে। চীনারা
এইদিক থেকে সংগঠিত হবার থেকে অনেক পিছিয়ে
আছে। সমাজতন্ত্র শুধুমাত্র একটি আবেগবাদ নয়। আমরা পুঁজি এবং শ্রমের লড়াইয়ের মাঝখানে
দাঁড়িয়ে আছি। যেকেউ-ই সংগঠিত শ্রমের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, সে আমাদের শত্রু। আমরা কি স্ট্রাইক
ব্রেকারদের জন্য সেরকম কোনও সুবিধা চাই, যার বিরুদ্ধে স্থানীয় শ্রমিকরা লড়াই করবে?
যদি না আমরা এই চীনা স্ট্রাইক ব্রেকারদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নই, তাহলে আমাদের
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসতে হবে।“
চীনাদের
স্থানে রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি মুসলমান বসিয়ে দেখুন তো পাঠক, কোনও মিল পাচ্ছেন?
কিন্তু
স্টুটগার্ট কংগ্রেস এইসব দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে নি। কমিউনিস্ট
প্রতিনিধিরা এদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন এবং এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক
শ্রেণি সংগ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে নির্দিষ্ট কর্মসূচিও উপস্থিত করেছিলেন।
ইতালির
প্রতিনিধি দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের মুখোশ খুলতে গিয়ে বললেন,
“… আমরা
অভিবাসনের নিয়ন্ত্রণের বিরোধী কারণ আমরা জানি যে, সরকারের তৈরি আইনের চেয়ে পারিয়ারি
শ্রমিকদের পিছনে থাকা ক্ষুধার চাবুকের দাগ অনেক বেশি শক্তিশালী।“
স্টুটগার্ট
সম্মেলন সিদ্ধান্ত করলো,
“১)
যে সমস্ত শ্রমিকেরা এমন চুক্তিতে রাজি হয়েছেন যাতে তাদের শ্রম এবং মজুরির অধিকার চলে
গেছে, তাদের আমদানি বা রপ্তানি নিষিদ্ধ করতে হবে।
২) শ্রম-দিবসকে
সংক্ষিপ্ত করা, ন্যূনতম বেতন হার প্রবর্তন, বিনে পয়সায় বা অতি-সস্তা ব্যবস্থা বাতিল (sweat
system) করবার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের বিধিস্মমত নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে।
৩) সেই
সমস্ত নিয়ন্ত্রণ বাতিল করতে হবে যা, কোনও নির্দিষ্ট জাতি বা জাতিগোষ্ঠীকে
একটি দেশে থাকা থেকে বিরত করে, বা তাদেরকে, স্থানিয়দের মতন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক
অধিকার লাভের ক্ষেত্রে দূরে রাখে, অথবা সেই সমস্ত অধিকার পালনের ক্ষেত্রে বাধা দেয়।
স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাবার জন্য নিবিড় পদক্ষেপ নিতে হবে।“
অধিকন্তু
এই সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, অভিবাসী শ্রমিকদের সদস্য হবার ক্ষেত্রে
সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে দূর করবে এবং সাধ্যমতো তাদের অংশগ্রহণকে সহজ করবে এবং পাশাপাশি,
একটি আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলবে ও অভিবাসীদের নিজেদের দেশের ট্রেড
ইউনিয়ন আন্দোলনকে শক্তিশালী করবার চেষ্টা চালাবে।
লেনিন এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিকঃ
স্বাভাবিক
ভাবে, স্টুটগার্ট সম্মেলনে লেনিন বামপন্থীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। শ্রমিক আন্দোলনে
সুবিধাবাদের শক্তিবৃদ্ধি নিয়ে তিনি বললেন,
“ঔপনিবেশিক
প্রশ্নের উপর এই ভোট অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এটি লক্ষণীয় ভাবে সমাজতান্ত্রিক সুবিধাবাদকে
প্রকাশ করে দিয়েছে যা, আত্মসমর্পণ করেছে বুর্জোয়াদের চাটুবাক্যের (blandishments) কাছে।
দ্বিতীয়ত, এটি ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের একটি নেগেটিভ বিশিষ্টতাকে প্রকাশ করেছেন, যা
প্রোলেতারিয়েতের স্বার্থের কম ক্ষতি করবে না এবং এই কারণেই (এই বিষয়ের উপর) অত্যন্ত
সিরিয়াস নজরদারি দরকার।“
লেনিন
আরও বললেন,
“বৈধ
এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে গুটিকয়েক কথা বলছি। এখানেও, এই কমিশনে, একটি সঙ্কীর্ণ, কায়েমি
স্বার্থকে রক্ষা করবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, পিছিয়ে পড়া দেশের (কুলি – চীন থেকে প্রভৃতি)
শ্রমিকদের অভিবাসনকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে। এটি হল সেই একই অভিজাতবাদ যা ‘সভ্য দেশগুলির’
শ্রমিকদের মধ্যে পাওয়া যায় যারা, তাদের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থান থেকে নির্দিষ্ট
সুবিধা পেয়ে থাকে এবং ফলত, তারা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির প্রয়োজনীয়তাকে বিস্মৃত হতে
চায়।“
১৯১৩
সালে লেনিন তাঁর “পুঁজিবাদ এবং শ্রমিক অভিবাসন”-এ
আবার বললেন,
“বুর্জোয়ারা
একদেশের শ্রমিককে অন্যদেশের শ্রমিকের বিরুদ্ধে খেপাতে চায় তাদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখবার
উদ্দেশ্যে। শ্রেণি সচেতন শ্রমিকেরা এটা উপলব্ধি করেন যে, পুঁজিবাদের সৃষ্ট দেশের সীমানার
বিলীন হয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী এবং প্রগতিশীল এবং তাদের পিছিয়ে পড়া দেশের সহযোদ্ধাদের
তারা এই উপলব্ধিতে আলোকপ্রাপ্ত করেন ও সংগঠিত করেন”
১৯১৫ সালে লেনিন আবার অভিবাসনের
বিষয়ে ফেরত এলেনঃ
“জিংগো
সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং প্রকৃত আন্ত্রজাতিকতাবাদের পক্ষে আমাদের এই সংগ্রামে, আমরা
আমাদের প্রকাশনায় সর্বদাই উল্লেখ করে থাকি আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টির সুবিধাবাদী
নেতাদের যারা, চীনা এবং জাপানি শ্রমিকদের অভিবাসনের উপর নিয়ন্ত্রণের পক্ষে (বিশেষত
১৯০৭ সালের স্টুটগার্ট সম্মেলনের পরে এবং স্টুটগার্ট-এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে)। আমরা
মনে করি যে, একজন একইসাথে আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং এই ধরণের নিয়ন্ত্রণের পক্ষে থাকতে
পারেন না। এবং আমরা আশ্বস্ত করি যে, আমেরিকার সোশ্যালিস্টরা, বিশেষত ইংরাজ সোশ্যালিস্টরা,
(যারা) শাসক এবং শোষক রাষ্ট্রের মানুষ, (যারা) অভিবাসনের উপর নিয়ন্ত্রণের বিরোধী নন, উপনিবেশের (হাওইয়াই) দখলদারির বিরোধী
নন এবং উপনিবেশগুলির সম্পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে নন, এই রকম সমাজতন্ত্রীরা, প্রকৃতপক্ষে
জিংগো।“
লেনিনের
অবস্থান জলের মতন স্পষ্ট। অভিবাসনের উপর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনও তর্কেরই অবকাশ নেই।
এই ধরণের অবস্থান (অভিবাসন এর উপর নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অবস্থান) আসলে জিংগো সমাজতন্ত্র
এবং এটি মূলগত ভাবে আন্তর্জাতিক নীতির বিরোধিতা করে। ১৯১৩ সালের একটি আর্টিকেলে, লেনিন
এ বিষয়ে আরও অগ্রসর হয়ে বললেন,
“এ বিষয়ে
কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই যে, চরম দারিদ্রই মানুষকে বাধ্য করে তার ভিটে-মাটি ছাড়তে এবং
পুঁজিপতিরা এই অভিবাসী শ্রমিকদের চরমতম নির্লজ্জতার সাথে শোষণ করে। কিন্তু একমাত্র
প্রতিক্রিয়াশীলরাই, দেশগুলির এই আধুনিক অভিবাসনের প্রগতিশীল গুরুত্ব সম্পর্কে অন্ধ হয়ে থাকতে পারে।
পুঁজির জোয়াল থেকে মুক্তি, পুঁজিবাদের আরও বিকাশ এবং তার ভিত্তি স্বরূপ শ্রেণি সংগ্রামের
আরও বিকাশ ব্যাতিত অসম্ভব। আর পুঁজিবাদ, স্থানীয় জীবন যাপনের
সেকেলে, পচা অভ্যাসকে ভেঙে দিয়ে, জাতীয় সীমা ও সংস্কারকে টুকরো করে দিয়ে জনগণকে এই
সংগ্রামে টেনে আনছে এবং সমস্ত দেশের শ্রমিকদেরকে, আমেরিকা, জার্মানি প্রভৃতি দেশের
বিশাল বিশাল কারখানা ও খনিতে, ঐক্যবদ্ধ করছে।“
অভিবাসনের
সমস্যাকে উত্থাপিত করতে হবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে। তৃতীয় আন্তর্জাতিক,
তার চতুর্থ সম্মেলনে, অভিবাসী শ্রমিকদের প্রশ্নে বললেন,
“ভয়ঙ্কর
বিপদের প্রেক্ষিতে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কমিউনিস্ট পার্টিগুলি, যথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,
জাপান, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা – নিজেদেরকে শুধুমাত্র যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারে
রত রাখতে পারে না। তাদের সমস্ত রকম প্রচেষ্টা নিতে হবে সেই সমস্ত ফ্যাক্টরগুলিকে দূর
করতে যা, সেই সমস্ত দেশের শ্রমিক আন্দোলনকে অসংগঠিত করে এবং যার মাধ্যমে পুঁজিপতিদের
পক্ষে দেশীয় ও জাতিগত শত্রুতাকে ব্যবহার করা সহজ হয়ে যায়।
অভিবাসনকে
নিয়ন্ত্রণকারী আইনের বিরুদ্ধে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ত্রেলিয়ার কমিউনিস্ট
পার্টিগুলি অবশ্যই একটি ব্যাপক প্রচার কাজ চালাবে এবং এই সমস্ত দেশের প্রোলেতারিয় জনগণের
কাছে ব্যাখ্যা করে বলবে যে, এই আইনগুলি যে জাতি ঘৃণাকে ঘৃতাহুতি দেবে, তার দ্বারা তারাও
আক্রান্ত হবে।“
পুঁজিপতিরা
চায় সস্তায় শ্রম আমদানি করতে এবং এটিকে একটি ভাবেই মোকাবিলা করা সম্ভব আর তা হল, অভিবাসী
শ্রমিকরা অবশ্যই শ্রমিক ইউনিয়নগুলিতে যুক্ত হবে। অভিবাসী শ্রমিকদের দেশীয় শ্রমিকদের
সম মর্যাদায় তুলে আনার দাবি পুঁজিপতিদের অভিসন্ধিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসবে এবং প্রতিষ্ঠা
করবে এই সত্যকে যে, আন্তর্জাতিক শ্রমিকের কোনও জাতিগত সংস্কার নেই।
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী?
অভিবাসন
নিয়ন্ত্রণের পক্ষের বামেরা, অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংহতিরও যুক্তি
দেয়। নিশ্চিত ভাবেই, যে দেশ থেকে অভিবাসন ঘটছে, সে দেশের জন্য অভিবাসন ভালো নয়, এবং
আমরা কি সে দেশের অবস্থার উন্নতির পক্ষে নই?
কথাগুলি
শুনতে খুব মধুর, কিন্তু প্রশ্ন হল, কিভাবে আমরা তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটাবো? উপরন্তু,
যেহেতু শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতায় নেই, আমাদের কোন দাবি, এক্ষেত্রে, তাদের স্বার্থপূরণ
করবে?
বিশ্বের
নেতাদের সমস্ত পবিত্র বাণী আসলে সর্বাগ্রে রাখে নিজেদের স্বার্থ। পণ্যের উপর চাপানো
প্রতিরক্ষামূলক বেড়াগুলি আসলে অন্য দেশে বেকারি চালান করবার কৌশল। অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও
একই কথা খাটে। অভিবাসীদেরকে বাইরে রেখে, বা বার করে দিয়ে, বুর্জোয়া রাষ্ট্র নিজের ঘরকে
শ্রেণি সংগ্রামের আঁচ থেকে রক্ষা করে।
আমাদের
বহুল প্রচারিত এবং জনপ্রিয় কল্পনায় আমরা ভাবি, অবৈতনিক প্রতিষ্ঠানগুলি এবং বৈদেশিক
সাহায্য বোধহয় বিশ্বের অপুষ্ট জনগণকে সহায়তা করে। প্রকৃতপক্ষে, এই সমস্ত কর্মকাণ্ড,
দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি আধিকারিক, নেতা এবং নিজেদের পকেটের সেবা করে। শ্রমিক এবং দরিদ্র
জনতাকে উচ্ছিষ্টেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর একটা কাজ এইসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে করা হয়;
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি এবং ব্যাঙ্কগুলি সেদেশের গরীবের বুকে যে গভীর ঘায়ের সৃষ্টি করে,
তাকে এইসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঢেকে রাখার চেষ্টা চালানো হয়।
এক নতুন যুগঃ
আজকের
যুগের সংকটের কারণ অভিবাসীরা নয়, আজকের যুগের সংকটের কারণ পুঁজিবাদ নিজে। এর নির্দিষ্ট
দ্যোতনা আছে। সংস্কারপন্থীরা এবং ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা এই ফাঁদে পড়ে যায় যে, পুঁজিবাদ
(কোন এক দেশের) ঠিক কতজন অভিবাসির দায়িত্ব নিতে পারে। কতজন অভিবাসী এলে মজুরী কমবে
না? কতজন অভিবাসীর জন্য আমরা স্কুলে জায়গা দিতে পারবো, বা হাসপাতালে জায়গা দিতে পারবো
বা তাদের বাসস্থান দিতে পারবো?
উত্তর
হল, অভিবাসী থাকুক, বা নাই থাকুক, আসুক, বা নাই আসুক; পুঁজিবাদ, তার এই ক্ষয়ের যুগে,
বর্তমান মজুরী বা শ্রমিকের বর্তমান অবস্থাকে বজায় রাখতে পারবে না। সীমানাকে সিল করে
দিয়ে বা, অভিবাসিদের বের করে দিয়েও পুঁজিবাদ এই সত্যকে বদলাতে পারবে না। এ যেন তৃষ্ণার্তের
পিপাসা মেটানোর জন্য নুন ভর্তি জলের গ্লাস এগিয়ে দেওয়া।
পুঁজিবাদের
আজকের দিনের বাস্তবতা হল, স্থানীয় এবং অভিবাসী সহ সমস্ত শ্রমজীবী এবং নিপীড়িত জনতার
জন্য বাসস্থান, স্কুল প্রভৃতি সরবরাহ করবার মতন টাকা আছে কিন্তু তা আছে গুটিকয়েক ব্যাক্তির
হাতে। পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসির জন্য একটি ভদ্রস্থ জীবন-মান সরবরাহের মজুত বর্তমান, কিন্তু
তা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে গুটিকয়েক কোটিপতি ও মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানির হাতে।
সমস্যা
অভিবাসন নয়, সমস্যা অভিবাসীরা নয় – সমস্যা হল পুঁজির কেন্দ্রিভবন, সমস্যা হল পুঁজিবাদ
নিজে। আমাদের সকল লড়াই তাই লড়তে হবে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নয়, অভিবাসনের নিয়ন্ত্রণের
জন্য নয়, দেশের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক জাতি ও ধর্মীও বৈরিতার মধ্যেও নয়; লড়তে হবে আন্তর্জাতিক
শ্রমিক সংহতির লক্ষ্যে, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে, শ্রেণিহীন সমাজের লক্ষ্যে।
@@@
সমাপ্ত @@@
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন