চীনে আসলে হচ্ছেটা কি? (What’s Really Happening in China?) মুল রচনাঃ ফেলিক্স গ্রিন; অনুবাদেঃ অলকা বন্দ্যোপাধ্যায়


"মহাজনপদ" - এর তরফে কিছু কথাঃ   
(ডিসক্লেইমারঃ এটি মূল বুকলেটের অংশ নয় বা ফেলিক্স গ্রিন এর বক্তব্য নয়):

এই রচনার কিছু বক্তব্যের সাথে আমরা একমত নই, তথ্যের কারণেই নই যেমন, উদাহরণস্বরূপ স্তালিন সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হয়েছে মুখবন্ধে, তা আমরা নাকচ করছি
কিন্তু তাতে এই রচনার গুরুত্ব কিছু কমে না এই রচনা সেই সমস্ত দেং-পন্থীদের মাও-এর চীনের বিরুদ্ধে চালানো মিথ্যাচারের একটি অন্যতম জবাব, যা তাদের লজ্জিত করবে, অবশ্য সে বস্তু যদি তাদের থেকে থাকে তো! মাও-এর চীন, সমাজতান্ত্রিক চীন (১৯৪৯-১৯৭৭) কি করেছিল, সমাজতন্ত্রের ম্যাজিক মানে কি, কি ঘটেছিলগ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড-এর সময়, শিল্পে, কৃষিতে, চিকিৎসায়, কমিউন গঠনে? যদি এগুলিকে কেউ জানতে চায়, সমাজতান্ত্রিক   চীন (১৯৪৯ থেকে ১৯৭৬) এবং পুঁজিবাদী চীন (১৯৭৮ পরবর্তী চীন)-এর প্রভেদ বুঝতে চায়, তাহলে রচনা তার অবশ্য পাঠ্য
পরিশেষে, আমরা রক্তিম অভিবাদন জানাই অলকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই সম্পূর্ণ পিসটিকে ইংরাজি থেকে বাংলায় তর্জমা করে দেবার জন্য
অভিনন্দন সহ মহাজনপদ 

লেখক পরিচিতিঃ


ফেলিক্স গ্রিন (জন্ম ২১শে মে, ১৯০৯; মৃত্যু ১৫- জুন, ১৯৮৫)
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের মার্কিন ব্যুরোর প্রাক্তন প্রধান ফেলিক্স গ্রিন (জন্ম ২১শে মে, ১৯০৯; মৃত্যু ১৫-ই জুন, ১৯৮৫), ১৯৫৭ সালে নিজের উদ্যোগে চীনে যান এবং তার চাক্ষুষ করা প্রতিবেদন, চীন সম্পর্কিত পুরানো ধারণাকে নস্যাৎ করে যা আজও, মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের উপর নির্ভর করা অধিকাংশ মানুষের মনে বর্তমান রয়েছে।
একটি সাম্প্রতিক রেডিও প্রচারে ফেলিক্স গ্রিন বলেছিলেন,
“আমি চীনে গিয়েছিলাম বর্তমানের সমস্ত অনুমান এবং ধারণাকে  সঙ্গে করেই। আমি আশা করেছিলাম অপুস্টি, মারাত্মক নোংরা এবং রোগগ্রস্ত একটি দেশ দেখতে পাবো। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম দেখতে পাবো পুলিশ রাষ্ট্রের কঠোর জুলুমবাজির পরিণামস্বরূপ গোমড়া-মুখো ও অসংবেদনশীল  জনগণকে। এই ছিল আমার প্রত্যাশার চীন কিন্তু এটি সেই চীন নয়, যাকে আমি বাস্তবে পেয়েছিলাম। চীনে এক ঘণ্টা কাটালে এমন কেউ নেই যে অনুভব করবে না, একটি স্পষ্ট প্রানবন্ত প্রকাশ এবং শৃঙ্খলা বা দেখবে না সর্বদিকে বিপুল উৎসাহের প্রকাশ চিহ্ন যা এই অসাধারণ মানুশগুলিকে উদ্দিপিত করে চলেছে।
পশ্চিমী মানদণ্ডকে প্রয়োগ করে, আজকের চীনে কি ঘটছে, তা বুঝতে চাওয়া কোনও কাজের কথা নয় বা, এরকম কল্পনা করে নেওয়া যে, আমাদের বদ্ধমূল ধারণার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কি ঘটে চলেছে, তা আমরা বুঝতে পারবো। চীনে যা ঘটছে তাকে বুঝতে হলে বুঝতে হবে চীনের নিজের নিজস্ব ঐতিহাসিক বিকাশের প্রেক্ষাপটে। শুধু এইটুকু বলা যে, চীন একটি শিল্প এবং সামাজিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বিপুল সুযোগ ও গতিতে এগিয়ে চলেছে যা, মানব ইতিহাসে অতুলনীয়, মূল গল্পের অর্ধেক মাত্র। বাকি অর্ধেক হল, যা হয়তো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, চীনারা মানব সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং সমবায় উদ্যোগের ক্ষেত্রে যা আবিষ্কার করছে এবং প্রাপ্ত হচ্ছে……। একটি অনুপযুক্ত মাপনী দিয়ে চীনকে বুঝতে যাওয়া ভীষণ রকমের মূর্খতা কিন্তু facts বাদ দিয়ে তাকে বুঝতে চাওয়া পাগলামি।“
এই প্রতিবেদন, অবশ্য, একজন মানুষের মূল চীনা ভূখণ্ডে যাত্রার একটি বিবরণীর চেয়ে বেশি কিছু যেহেতু, এটি বিস্তৃত ভাবে নথিবদ্ধ করেছে বর্তমান চীনা কমিউনিস্টদের উন্নতিকে, বিখ্যাত বিদেশী authorities এবং পরিদর্শক দের প্রতিবেদনের দ্বারা, যেগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শোনাই যায় না।   

অলকা ব্যানার্জি (অনুবাদক):
অলকা বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৪৮ সাল)   

জন্ম উত্তর কোলকাতায়। পড়াশুনা গিরিবালা সরকার বালিকা বিদ্যাপীঠ, নরসিংহ দত্ত কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়; বিশেষজ্ঞ বিষয় - ইংরাজি। লবণ হ্রদ বিদ্যাপীঠের ইংরেজি ভাষার প্রাক্তন শিক্ষিকা। সহকারী শিক্ষিকা পদ থেকে অবসর গ্রহণও করেছেন। বিয়ের পর, বিবাহিত সঙ্গীর হাত ধরে বাম রাজনীতিতে  প্রবেশ; একটি সর্বভারতীয় মহিলা সমিতির সক্রিয় সদস্যা তিনি।  সঙ্গীর অকস্মাৎ প্রয়াণের পরও মনের জোর হারান নি; রাজনীতি থেকে অবসর নেন নি। ভালোবাসেন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে, সতত সক্রিয় থাকতে, নতুন জিনিস শিখতে এবং সামাজিক মানুষের কর্তব্য সম্পাদন করতে। ও হ্যাঁ! খুব ভালো রাঁধেন; খাওয়ানও। শরীরের কষ্টকে অতিক্রম করে তিনি এই অনুবাদের কাজটি করে দিয়েছেন। মহাজনপদ তাকে জানায় কুর্নিশ।

মুখবন্ধঃ


চীনের প্রতি আমেরিকার মনোভাব একটা কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে। এই অচল অবস্থার সৃষ্টির উৎস খুঁজতে চাইলে, চীনের গৃহযুদ্ধের সময় উদ্ভুত কতকগুলি ভুল ধারণার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যেগুলি যেন, এক গ্রীক ট্র্যাজেডির  ঘটনাবলীর মতো আমেরিকাকে অনিশ্চিত ও হতভম্ব অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এখন পরিস্থিতি, এমন অবস্থায় এসে গেছে যেখানে, প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবে চিনতে নিতে হবে; নয়তো সামনে বিপদ; অথচ সঠিক পদক্ষেপ না করলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। এই জট পাকানো পরিস্থিতিতে একটা জিনিস তো নিশ্চিত; এক্ষেত্রে একটি সুবুদ্ধি সম্পন্ন ও মানবিক পদ্ধতি ছাড়া এই অবস্থা থেকে মুক্তি নেই এবং এই সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটি, তথ্য নির্ভর ও সত্যতার উপর ভিত্তি করেই নিতে হবে। আর এতো দিন ধরে আমরা সেটাই করে  আসছি – এড়িয়ে যাওয়া!! আমেরিকার জনসাধারণ সম্পূর্ণ অন্ধকারে – কবে এক নতুন চীনের উদ্ভব হলো, কবে সে বিশ্বের দরবারে প্রথম সারিতে এসে উপস্থিত হলো!!! যদি আমাদের চীন দেশের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্কে আবদ্ধ হতে হয়, আমাদের তো চীনকে, তার নতুন অবতারে দেখতে হবে! আমাদের পুরনো, বস্তাপচা ধ্যান ধারণাকে বদলাতে হবে! আমাদের বুঝতে হবে যে, চীন আর বিশাল, বিস্তীর্ণ পশ্চাদপদ দেশ নেই; কুশাসন মুক্ত এক নতুন দেশরূপে দেখা দিয়েছে। সে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলি আহৃত হচ্ছে, তার জনসংখ্যা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানের আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে সক্ষম।
গৃহযুদ্ধ সবসময় মানুষের সমাজে সব থেকে নিষ্ঠুর ঘটনাবলীর মধ্যে পড়ে। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, গৃহযুদ্ধের সময় উভয়পক্ষ বেশ কিছু বর্বরতার ঘটনা ঘটিয়েছে। একথা কেউ দাবি করবে না যে, সমস্ত ঐতিহাসিক বিদ্রোহের ঘটনা, যা ঘটে থাকে অবর্ণনীয় অত্যাচার আর অবিচার এর বিরুদ্ধে, সবই চড়ুইভাতির মতো ছিল; যদিও আজকের দুনিয়া সেই রক্তপাতের ও হিংসা-হানাহানির থেকে পালাতে চায়, কিন্তু তাতো কদাচ  সম্ভব নয়। একথা ফরাসী বিপ্লব এবং আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। এখন, যখন সেই সব ঘটনা  অতীত হয়েছে এবং বলা যায়, পরিপ্রেক্ষিত পরিষ্কার হয়েছে, আমাদের চীনের বিপ্লব সম্বন্ধে নিজেদের ধারণাগুলিকে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে নিতে হবে; নাহলে, আমরা ঘটনাগুলিকে সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে পারবো না। ফলে, সঠিক মূল্যায়ন করাও সম্ভবপর হবে না।
যখন আমি পিকিং-এ ছিলাম, আমার সুযোগ হয়েছিল পাশ্চাত্য দেশগুলির রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলার; তদুপরি, সেই সব দূতাবাসগুলির বিভিন্ন কর্মনির্বাহীদের সঙ্গেও আমি একাধিকবার কথা বলেছি। আমি কথা বলেছি সেই সব পাশ্চাত্য দেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে, যারা দীর্ঘদিন চীনে বসবাস করছেন। তাঁদের বক্তব্য বর্তমান নেতৃত্ব সম্বন্ধে অত্যন্ত সম্ভ্রম উদ্রেককারী ও সদর্থক মনে হয়েছে আমার  কাছে। তাঁরা মনে করেন যে, চীন মোটেও একদল ক্ষমতালোভী বা ক্ষমতালিপ্সু নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না। এই সব নেতৃবৃন্দ চীনা জনসাধারণের উপর, জোর করে, নেতৃত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে বলে তাঁরা মনে করেন না। বরং এর বিপরীত চিত্রটাই সঠিক যেখানে, দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমান নেতৃবৃন্দ জনসাধারণের ভালো থাকার বিষয়ে যথেষ্ট যত্নবান ও সচেষ্ট। যদিও, নেতৃত্বের মধ্যে অনেক সময় পরিবর্তন আসে কিন্তু, সেটা কখনওই ক্রেমলিনের ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের পরস্পরের প্রতি প্রতিযোগিতার মনোভাব বা ক্ষমতা আঁকড়ানোর চেষ্টা নয়। মাও সেতুং কখনওই চাটুকার পরিবৃত হয়ে থাকেন না বা, তার বিরাগভাজন হবার ভয়ে,  তাঁকে ‘জল উঁচু – জল নিচু’ বলার মতো লোকজনেরা ঘিরে থাকে না। আমরা এভাবেও বলতে পারি যে, এখানে হিটলার, মুসোলিনি বা শেষের দিকের স্তালিন যিনি, নৈতিক বিচারবুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়েছিলেন এবং যার কার্যকলাপগুলি বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল খানিকটা প্যারানোইয়ার দ্বারা – এ ধরণের কোনও ঘটনায় চৈনিক নেতৃবৃন্দ দোষী নন। চীন এখন সেই সব নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যারা, ঐতিহাসিক চেতনাসম্পন্ন, সবল এবং প্রভুত ক্ষমতাশালী, যারা জনসাধারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের চাহিদাসমূহকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন এবং তদনুযায়ী তাদের চাহিদা পূরণের বিধিব্যবস্থা করতে পেরেছেন। তাঁরা এই বিপ্লবে জয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছেন কারণ তাঁরা শোষিত, নিপীড়িত জনগণের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরতে পেরেছেন – যে জনগণ শোষণের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁরা স্থির করেছিলেন যে, তাঁরা ক্ষুধা, ব্যাধি ও ভ্রষ্টাচার, যা তাদেরকে বেঁধে রেখেছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী, তাকে তাঁরা শেষ করবেন। যদি  ইতিহাসে জনগণের মুক্তির বিপ্লব ঘটে থাকে, তবে এই বিপ্লব-ই সেই বিপ্লব।
আমেরিকাবাসীরা হয়তো হতাশ হবেন এই ভেবে যে, তাঁরা যে রাজনৈতিক দর্শনকে অপচ্ছন্দ করেন, চীনে সেই দর্শনের রাজনীতি দ্বারা, বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রভুত উন্নতি সাধন হয়েছে। কিন্তু আমরা অপচ্ছন্দ করলেই তো সত্য মিথ্যা হয়ে যেতে পারে না! বর্তমানের যে পন্থা আমেরিকা নিয়েছে – সম্পূর্ণ ঋণাত্মক এবং সম্পূর্ণ অসহযোগিতা – সেটা আত্ম-প্রবঞ্চনামূলক। আমরা সেই আত্ম-প্রবঞ্চনাকে আরও বাড়িয়ে তুলছি আমাদের সাংবাদিকদের সে দেশে না যেতে দিয়ে; দিলে তারা নিজের চোখেই দেখতে পারতো, চীনে বর্তমানে কি ঘটছে এবং তাদের পাঠানো সংবাদের ভিত্তিতে সমস্ত ভুল ধারণার অবসান ঘটতো। তারা তাদের নিজস্ব ধারণা যে, চীনের নেতৃবৃন্দ একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছে বা, চীনের জনগণ দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে আছে, সেই প্রবঞ্চনা থেকে মুক্তি পেত।
যতক্ষণ না আমারা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বচ্ছ করছি – চীনের বিপ্লবকে বাস্তবসম্মত, ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করছি – ততক্ষণ আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত এবং পন্থাগুলিকে ভুল সিদ্ধান্তের ওপর খাড়া করবো এবং শেষ পর্যন্ত একটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো। দুঃখের বিষয় এইযে, আজ এই মুহূর্তে আমরা, চীনের প্রথম সফল সরকার – তাদের গৃহযুদ্ধের হিংসা সত্ত্বেও – তারা যে সাফল্য এনেছে – একতা, শৃঙ্খলা, সততা, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সব কিছুর উপরে, জনগণের মনের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে – এমন এক সরকারের সঙ্গে শত্রুতামূলক মনোভাব পোষণ করছি।

শিল্পায়নের দুরন্ত গতিঃ


চীন এবং আমেরিকার বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস কোরীয় যুদ্ধের আগে থেকে। দুই তিনটি ব্যাতিক্রম ছাড়া কোনও আমেরিকী সাংবাদিককে বা আমেরিকী নাগরিককে চীনে প্রবেশ করবার অনুমতি দেওয়া হতো না আমেরিকার রাষ্ট্র দপ্তর থেকে। এই সময়কালের মধ্যে, আমেরিকার জনগণের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে, ঘটে গেল চৈনিক বিপ্লব; সামাজিক এবং শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে যার আকার এবং গতি অতুলনীয়। সাধারণত, আমরা যে চীনকে জেনে এসেছি – দারিদ্র পীড়িত, পশ্চাদপদ, এক অনগ্রসর সমাজে বাসকারী – সে কোথায়? সে ছবি এখন আর বাস্তব নয়।
আমার যে কথোপকথন ও আলাপচারিতা হয়েছে বিভিন্ন পাশ্চাত্য দূতাবাসকর্মীদের সঙ্গে এবং শিল্পপতিদের সঙ্গে যখন আমি পিকিং-এ গেছি; বিভিন্ন তথ্যসন্ধানী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলেছি যারা পাশ্চাত্য দেশগুলি থেকে চীনে এসেছে – সেই সব অভিজ্ঞতা একত্রে আনলে কতোগুলি সুত্র বার হয় পরিষ্কার রূপেঃ

ক) চীনারা অতি দ্রুত শিল্পায়ন পদ্ধতিগুলি আয়ত্ত করছে;

খ) ১০ বছর সময়ের মধ্যে, রুশ এবং পূর্ব ইউরোপীয়দের সাহায্যে চীনারা বিশাল শিল্পকারখানা স্থাপন করেছে এবং প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ও স্থাপন করেছে ব্যাপক হারে, যেগুলির মধ্যে বেশি অংশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও, এখনও অনেক রুশ এবং পূর্ব ইউরোপীয় প্রযুক্তিবিদরা চীনে কাজ করছেন, কিন্তু দ্রুত হারেই সেই সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।

গ) প্রাথমিক প্রয়োজনীয় শিল্পগুলির (কয়লা, লোহা, ইস্পাত, তেল এবং বৈদ্যুতিক শক্তি) পাশাপাশি চীন তৈরি করছে তার নিজস্ব ব্যবহারের জন্য মেশিনের যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি যেগুলি বৃহৎশিল্পে ব্যবহৃত হয়। দশ বছর আগে চীন, এমনকি, এশিয় দেশগুলির মাপকাঠিতে ও পৃথিবীর মধ্যে অনগ্রসর দেশগুলির মধ্যে পড়তো; প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনগ্রসরতায় অন্যতম ছিল। আজ চীনের কাছে উন্নতমানের বইদ্যুতিন শিল্প আছে; ২৩০০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ জলে ভাসাচ্ছে; বিশালাকার ডিজেল-বিদ্যুৎ চালিত ইঞ্জিন চালাচ্ছে তার রেলপথের জন্য; জেট ফাইটার বিমান তৈরি করছে ক্রমাগত; বর্তমানে একটি সাইক্লোট্রন ও আনবিক চুল্লি নির্মাণের কাজ শেষ করেছে এবং এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে, চীন, যত শীঘ্র সম্ভব, আনবিক  বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির স্থানে পৌঁছে যাবে।

ঘ) চীন তার শিল্পগুলিকে বিকেন্দ্রিত ভাবে গড়ে তুলছে এবং এই পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে একদিকে যেমন তার বিপুল জনসংখ্যার সদ্ব্যবহার করতে পারছে, তেমনি অন্যদিকে বহিরাক্রমণের ক্ষেত্রেও সুরক্ষিত থাকতে পারছে। 

ঙ) প্রতি বছর চীন তার দেশে প্রযুক্তিবিদ তৈরি করছে আমেরিকার দ্বিগুণ হারে এবং এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। চীনারা জাতি হিসাবে অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষার্থী এবং সহজেই তারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে উঠছে। (আমাকে একজন পূর্ব জার্মানির বৈদ্যুতিন বিষয়ের প্রশিক্ষক বলেন যে, পিকিং-এ তাঁর চীনা ছাত্ররা, তাদের পাঠক্রম জার্মান ছাত্রদের থেকে দ্বিগুণ গতিতে সমাপ্ত করছে) ।

শ্রী J. Tuzo Wilson, একজন কানাডীয়, যিনি International Union of Geodesy and Geophysics-এর সভাপতি, তিনি, মধ্য চীনের লাং চাও শহরে, তাঁর সদ্য ঘুরে আসার একটি অভিজ্ঞতার একটি বিস্তারিত বর্ণনা করেন যেখানে বর্তমানে ১৫০০ বৈজ্ঞানিক কাজ করছেন এবং যেখানে, কয়েক বছরের মধ্যে, এর দশগুন কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।  Wilson সাহেব একটি প্রতিবেদনে বলেন, “এর মধ্যে বিজ্ঞান হল এই যে, …… এশিয়ার এই প্রান্তদেশ, যদিও জনসংখ্যার দ্বারা সীমিত কিন্তু প্রশ্নাতীত ভাবে উন্নত, প্রযুক্তি ও তত্ত্বগত দিক দিয়ে”। [সুত্রঃ Red China’s Hidden Capital of Science; J. Tuzo Wilson; Saturday Review; November 8th, 1959]

চ) বর্তমান ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে “আগামী ১৫ বছরের মধ্যে, ব্রিটিশ শিল্প উৎপাদনকে ডিঙিয়ে যাওয়া”। ব্রিটিশরাও বিশ্বাস করে যে, এই লক্ষ্যে পৌঁছানো হয়তো আরও শীঘ্র সম্ভব হবে। ব্রিটেনের কয়লা উৎপাদনকে চীন ছাপিয়ে গেছে ১৯৫৮ সালে এবং আশা করছে ইস্পাত উতপাদনেও চীন তাদের ছাপিয়ে যাবে ১৯৫৯ সালে। একটি ব্রিটিশ অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ

অগ্রসরতার গতি এক্ষণে এমন যে, এক দশকের মধ্যে চীন বিশ্বের তৃতীয় অগ্রসরতম দেশ হিসেবে এগিয়ে আসবে, আমেরিকা ও রাশিয়ার পরেই। [সুত্রঃ Chinese Trade and Economic News Letter, September 1958. This News Letter is a monthly report on China’s trade and industrial development published by the British Council for the Promotion of International Trade, 15, Hanover Square, London, W.1., England. The British Council is supported by British Industry.]

বিশাল ঝাঁপ (The Great Leap) ১৯৫৮:


যদিও, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে (১৯৫২ – ১৯৫৭) গড়ে ১৯.২% হারে শিল্পবিস্তার যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ছিল কিন্তু সেটা সোভিয়েত শিল্পবিস্তারের অগ্রগতিকে (১৯২৭ – ১৯৩২) ছাপিয়ে যেতে পারে নি। কিন্তু ১৯৫৮ সালে, চীনা শিল্প বিস্তারের গতিকে বিপুল পরিমাণে বাড়ানো হয়। এক বছরের মধ্যে চীনা ইস্পাত উৎপাদনকে, ১৯৩২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের উৎপাদনের থেকে পিছিয়ে থেকে আরম্ভ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন পৌঁছতে পারে নি – এমন স্তরে তুলে আনা হয়। নিচে একটি ব্রিটিশ অর্থনৈতিক প্রতিবেদন থেকে চৈনিক শিল্প বিস্তার ও উন্নতির বিবরণের (১৯৫৮) কিছু অংশ দেওয়া হলও।

“অর্থনীতির ইতিহাসে, ১৯৫৮ সালে চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের গতি ছিল অনন্যসাধারণ। ১৯৫৭ সালের তুলনায় Gross Industrial Output বেড়ে দাঁড়ায় তার প্রায় ৬৫%। ১৯৫৭ সালের তুলনায় মোট Government Capital Construction দাঁড়ায় সাড়ে নয় ট্রিলিয়ন বা ৮৭% বেশি। প্রায় ৭০০ বৃহৎ শিল্প প্রকল্প সম্পূর্ণ করা হয় – এদের মধ্যে ৫টি খোলা চুল্লি ছিল আনশানে যার মধ্যে আবার ২টি ছিল বিশ্বের বড় চুল্লিগুলির সমান…।  ১৯৫৯ সালে, Wuhan Heavy Machine Tool Plant –এর পরিকল্পিত আউটপুট, যুক্তরাজ্যের ভারি Heavy Machine Tool Plant-গুলির মোট  বার্ষিক আয়ের থেকে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না।
১৯৫৮ সালে সরকারি রাজস্ব বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৭ বিলিয়ন ডলারে। সমস্ত ক্ষেত্রে বিস্তারের গতি বৃদ্ধি এবং বিশেষত পরিবহনের ক্ষেত্রে মারাত্মক bottleneck পরিস্থিতির উদ্ভব সত্ত্বেও ২৯টি প্রধান শহরের খুচরা মুল্যের ০.৯% পতন ঘটে, বৈদেশিক বানিজ্য বৃদ্ধি পায় ১৪%। ১৪৩০ মাইল নতুন রেলপথ গড়ে ওঠে বা, বলা যায় ১৯৫৭ সালে যা ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি রেলপথ গড়ে ওঠে। ১৯৫৮ সালে, এক লক্ষ মাইলের বেশি দীর্ঘ মহা সড়ক গড়ে তোলা হয়।
স্থানীয় অসামরিক বিমান পরিবহন ব্যবস্থা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে ১৮টি স্থানীয় বিমান পথ চালু আছে। চীন দ্বারা প্রস্তুত “An-2” প্রকারের বিমানগুলি ৩৭০০০ মাইল ব্যাপৃত পথে পরিষেবা দিয়ে চলেছে। ১৯৫৯ সালের মধ্যে চীন, ব্রিটেনের পিগ আয়রন, ইস্পাত, তামা, এলুমিনিয়াম, যন্ত্রাংশ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উৎপাদনকে হয় ধরে ফেলবে বা কাছাকাছি চলে আসবে। ১৯৫৮ সালেই চীন, কয়লা এবং বস্ত্রশিল্পে, ব্রিটেনকে অতিক্রম করেছে। ১৯৫৮-১৯৫৯ – এই একবছরে, ব্রিটেন থেকে  চীনে রপ্তানির পরিমাণ ৩১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৭৫  মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।“ [সুত্রঃ Chinese Trade and. Economic News Letter, February, 1959] 
  
১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালে, ইকোল পারটিক দি এটুডস, সহবন, প্যারিস-এর প্রফেসর, চার্লস বেটেলহম একটি চীন সফরকারী ফরাসী অর্থনীতিবিদদের ডেলিগেশনের অংশ হিসাবে চীনে এসেছিলেন। প্রফেসর বেটেলহমের প্রতিবেদন, ব্রিটিশ অর্থনৈতিক সার্ভে রিপোর্টগুলিকে সম্পূর্ণ রূপে সমর্থন করে। অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাবে এবং সুগ্রথিত ও ধারাবাহিক ভাবে লিখিত প্রতিবেদনগুলির মধ্য দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, কিভাবে উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই অভূতপূর্ব বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে এবং কেন তিনি বিশ্বাস করেন যে, ভবিষ্যতেও একই ভাবে এই দর্শনিয় বৃদ্ধির হার বজায় থাকবে। তার সাধারণভাবে করা ধারনাগুলির একটা সংক্ষিপ্তসার করা যায় এই মন্তব্যগুলির মধ্য দিয়ে –

“অনুন্নত” – এই সামাজিক দাগের মুছে যাওয়া যে অনন্যসাধারণ অনুভূতি আমার মধ্যে সৃষ্টি করেছে, তাকে সম্পর্কিত না করে পারছি না। এশিয়াকে চিনে এবং এই মহাদেশের কিছু মানুষের দুর্দশাকে প্রত্যক্ষ করে … আমি শহরের সাথে সাথে গ্রামের উপযুক্ত পোষাকে শোভিত, আপাতভাবে ভালো খাদ্য প্রাপ্ত, স্বাস্থ্যবান এবং আনন্দিত জনতাকে দেখে আমি গভীর ভাবে মুগ্ধ হয়েছি। যদিও আমি বর্তমান চীন সম্পর্কে প্রচুত পড়াশুনা করেছিলাম, আমি এ ধরণের পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করি নি এবং আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, আমার অবস্থানকালের সম্পূর্ণ পর্যায় ধরে পরিবর্তনের এই যে অনুভূতি, ইতিহাসের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব এই মাত্রা এবং গতি, আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
আমাকে আরও যেটা মুগ্ধ করেছে তা হলও, দোকানে সাজানো বিভিন্ন পণ্যের সমাহার এবং এটি শুধু খাদ্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে নয়, একই সাথে তা চীনে প্রস্তুত পোশাকপরিচ্ছদ, কুটীর শিল্পজাত পণ্য এবং শিল্পজাত ভোগ্য পণ্যের সমাহার। যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার সময়ের কৃচ্ছসাধন প্রত্যক্ষ করেছেন, এটি তাদের কাছে এক মহাবিস্ময়।“ [সুত্রঃ "China's Economic Growth" by Professor Charles Bettelheim, of the Sorbonne, Paris. A report originally
published in four parts by The Economic Weekly, Bombay,
lndia, November, 22 and 29; December 6 and 13, 1958.  Reprinted in a somewhat abridged form by Monthly Review, March 1959.]

চীনের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহঃ


দীর্ঘ দিনের একটি ধারণার সংশোধন অবশ্যই দরকার – তা হলও, চীনের বৃহৎ শিল্পের উন্নতির জন্য যা যা খনিজ সম্পদ দরকার তার অভাব রয়েছে। চলমান নিবিড় ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় নিম্নলিখিত মজুতগুলির কথা জানা গেছেঃ

কয়লা -    মোট জানা মজুত কয়েক শতাব্দীর জন্য যথেষ্ট। সারা দেশে সুন্দর ভাবে এই মজুত বন্টিত হয়ে আছে।

লোহা -     পৃথিবীর জানা মজুতগুলির মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম

তামা, টিন, টাংস্টেন, মলিবডিনাম, পারদ –
          পৃথিবীর সমস্ত দেশের মধ্যে বৃহত্তম মজুত ভান্ডার

অ্যালুমিনিইয়াম, নিকেল, অ্যাসবেসটস, হীরা –
          রাশিয়ার পরেই

পেট্রোলিয়াম – একমাত্র সম্পদ যা, বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কম সরবরাহ রয়েছে। দুটি বড় তৈলক্ষেত্র সাম্প্রতিক সময়েই আবিষ্কৃত হয়েছে। চীনারা দাবি করছে যে, তাদের জানা তেলের মজুত এখন ইরানের থেকে বেশি। এটি হয়তো অতিশয়োক্তি। পেট্রোলিয়ামের সাথে সাথে, ৬ হাজার মিলিয়ন টনের জানা এবং সম্ভাব্য তৈল শেডগুলি একটি তুলনামূলক কম অর্থনৈতিক গুরুত্বের মজুত হিসাবে কাজে লাগছে।

মোটের উপর চীনের নিজেকে একটি প্রধান শিল্প ও সামরিক শক্তি
হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবার মতন আবশ্যিক খনিজ মজুতের পূর্বশর্তগুলি মজুত রয়েছে।

কৃষিঃ


শিল্পের বিকাশের মতনই, কৃষির বিকাশ সমান চমকপ্রদ; এবং শিপ্লের মতনই, ১৯৫৮ সালে কৃষির বিকাশ সমস্ত আগের রেকর্ড ভেঙে দেয়। ১৯৫২-১৯৫৭ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদনের গড় বৃদ্ধি ছিল বাৎসরিক ৬% হারে। [সুত্রঃ Article on Chinese Agriculture by Chou Pei-yann, Bulletin of the Atomic Scientists, October 1958.]। ১৯৫৭-১৯৫৮ সালের শীতের সময় নতুন নতুন অঞ্চলকে সেচের আওতায় আনবার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক কোটি মরসুমি কৃষক যাদের অন্য সময় কাজ থাকে না এবং চার মাস ব্যাপী এই শীতের মধ্যে ৭ কোটি ৪০ লক্ষ একর জমিকে সেচের আওতায় আনা হয়। ১৯৫৮ সালের অন্যান্য আরও উদ্যোগ নেওয়া হয় মোট খাদ্য উৎপাদনকে বৃদ্ধি করবার জন্য। জমিকে গভীর লাঙ্গল দেওয়া, ঘন বপন পদ্ধতি, সার এবং কীটনাশক প ট্র্যাক্টরের ব্যবহারে ব্যপক বৃদ্ধি ঘটানো হয় মোট খাদ্য  উৎপাদন  বৃদ্ধির লক্ষ্যে। কৃষকদের বৈজ্ঞানিক উপদেশ দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু নিজেদের পরীক্ষা করবার ব্যাপারেও উৎসাহ দেওয়া হয় এবং কখনও কখনও উল্লেখযোগ্য সাফল্যের সঙ্গে সমস্ত প্রকারের আদর্শ  ও অব্যবহৃত পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো নয়। একটি ব্রিটিশ রিপোর্ট অনুমান করে যে, ১৯৫৮ সালে, কম করে ৬৪ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী পুরুষের তরুণদল গ্রামীণ অঞ্চলে গিয়েছিল স্থানীয় উৎপাদনের গোষ্ঠীকে সহায়তা করতে এবং কৃষি ও স্থানীয় শিল্পের জন্য আধুনিক প্রাযুক্তিক জ্ঞানকে পৌছিয়ে দিতে।
ফলাফল সমস্ত প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেলো। একটি ব্রিটিশ রিপোর্ট বিবৃত করলোঃ

“মোট কৃষি উৎপাদন ৭০%-র বেশি বৃদ্ধি পায় ১৯৫৭ তে। শুধু চীন কেন, পৃথিবীর অন্য কোনও স্থানেও, কৃষিতে এই ব্যপক বৃদ্ধির কোনও উদাহরণ পাওয়া যাবে না এবং এই লক্ষ্যমাত্রা অতীব চমৎকারী বলা যায় কারন গত বছরে আবহাওয়ার অবস্থা খুব সুবিধার ছিল না। এছাড়া এতো বড় একটি মহাদেশীয় দেশে, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার জন্য কৃষি উৎপাদন ৬%-র বেশি বৃদ্ধি পেতে দেখা যায় না। [সুত্রঃ Chinese Trade and, Economic News Letter, February 1959.]

চীনের এই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সংক্রান্ত, বিদেশ থেকে আসা, সবচেয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন যা এসেছে তা, এসেছে M. Rene Dumont, Professor of Comparative Agriculture at the Agronomic Institute, Paris থেকে। তিনি চীনে এসেছিলেন ১৯৫৫ সালের শেষের দিকে এবং আবার এসেছিলেন ১৯৫৮ সালের শরৎকালে। তার প্রতিবেদন থেকে কিছু অংশ এখানে তুলে দেওয়া হচ্ছেঃ

“চীনের মতন বিশাল এক দেশে, এক বছরের উৎপাদনে, ৬০% থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি, বিশ্বের কৃষি উৎপাদনের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
কিভাবে এই ৬০% থেকে ৯০% বৃদ্ধি সম্ভব হলও? ১৯৫৫ – ১৯৫৬ সাল অবধি সেচ সেবিত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৬৬ মিলিয়ন একর হয়ে যাওয়া এবং তারপর, একবছরের মধ্যে ১৯.৭ মিলিয়ন একর এক লাফে বেড়ে যাওয়া, এটিও অভূতপূর্ব একটি ঘটনা। শুধুমাত্র ১৯৪৫৭ – ১৯৫৮ সালের প্রচারে, সেচ সেবিত অঞ্চল আরও প্রসারিত হয়ে ৭৪.১ মিলিয়ন একরে পৌঁছিয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এইভাবে, ১৫ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে, বিগত দু হাজার বছরে যা অর্জিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি অর্জন সম্ভব হয়েছে। প্রশ্নাতীতভাবে সেচ-ই হল সেই নির্ধারক ফ্যাক্টর যাকে ছাড়া উৎপাদনের এই অতি-গতি ব্যখ্যা করা অসম্ভব।
অবশ্য, আমি নিজে এই সমস্ত ফিগারের সঠিক হবার দায়িত্ব ব্যক্তিগত ভাবে নিতে অক্ষম, যদিও সেগুলি সরকারি। একই সাথে, যে পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তার যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণতা আমার নিজের এই দাবিকে সমর্থন করতে যথেষ্ট যে, চীনে যা ঘটছে তা হলও কৃষি বিকাশের বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক।“[সুত্রঃ "Chinese Agriculture", by Rene Dumont, Professor of Comparative Agriculture at the Agronomic Institure, Paris. This article first appeared in Le Monde, Paris, October 12th, 1958. It was translated and printed in Monthly Review, December 1958.]

১৯৫৮ সালে মোট শস্য উৎপাদিত হয়েছিল ৩৫০ মিলিয়ন টন; চীনের গম উৎপাদন, এই প্রথম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে গেছে এবং রাশিয়ার মোট উৎপাদনকে ধরে ফেলবার দিকে এগোচ্ছে। বর্তমানে চীন বছরে মাথা পিছু হাফ টনের বেশি শস্য বরাদ্দ করতে পারে। এখনের আহ্বান হলও ১৯৫৯ সালে, কৃষিতে আরও ৪০% উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেখানে জোর দেওয়া হয়েছে প্রানিজ উৎপাদনে। ঘটনা হলও, চীন তার ইতিহাসে, এই প্রথমবার খাদ্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে এবং হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে, অন্যান্য এশিয় দেশগুলির মুখ্য খাদ্য সরবরাহকারীতে পরিণত হবে যা তার রাজনৈতিক প্রভাবকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে তুলবে।
কৃষিজ উৎপাদনের বিকাশের ফলস্বরূপ (আমার দেখা ভারত এবং অন্যান্য এশিয় দেশগুলির সাথে বৈপরীত্যে) আমি চীনে, কোথাও একটি শিশুকেও দেখি নি যার মধ্যে অপুষ্টির কোনও চিহ্ন রয়েছে। এটিকে নিশ্চিত ভাবে চীনের কৃষি উৎপাদনের অগ্রগতির ফসল বলতে পারি।

জনসংখ্যা

“Introducing a cooperative”; RMRB, ২৭শে মে, ১৯৫৮

চীনের বর্তমান (এই গ্রন্থের রচনার সময়কালকে বোঝানো হচ্ছে- মহাজনপদ) জনসংখ্যা প্রায় ৬৬৩ মিলিয়ন এবং বছরে ২.২% হারে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি বর্তমানে কানাডার জনসংখ্যার বার্ষিক বৃদ্ধির সমান এবং আমেরিকার ১২ বছরের বৃদ্ধির হারের সমান। হিসেব করলে চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘণ্টায় গড়ে ১৭০০ জন। ১৯৫৬ সালে চীন সরকার, জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্লিনিক বা জনশিক্ষার  মাধ্যমে, জন্মনিয়ন্ত্রণ করবার সীমিত চেষ্টা চালায় কিন্তু এ পর্যন্ত, এই প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত করা যায় নি বা, চীনা কৃষকদের  মধ্যে এই প্রচেষ্টাকে নিয়ে যাওয়া হয় নি। প্রসঙ্গত বলা উচিত চীনা জনসংখ্যার ৮৫%-ই কৃষক। চীনের বাইরে এ ব্যাপারে অনেক কিছুই বলা হয়েছে বা লেখা হয়েছে কিন্তু, চীনের জনসংখ্যার সমস্যা সম্বন্ধে পিকিং-এর কর্মধারা কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করে নি বা বাইরের উদ্বেগকে স্বীকার করে নি। ১৯৫৮ সালের আগেও, চীনের খাদ্যের এবং কৃষির উৎপাদনের এই অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি, জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি ছিল। ১৯৫৮ সাল থেকে এই হার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেচ ব্যবস্থা, এপর্যন্ত উষর হয়ে পড়ে থাকা, জমিকে উৎপাদনশীল কোরে তুলেছে। চীনা সংবাদ মাধ্যমে তো মাঝে মাঝেই একথা বলা হয় যে, কিছু কিছু স্থানে ম্যান-পাওয়ারের অভাব আছে।

শিক্ষা ব্যবস্থা


বর্তমান সরকারের ব্যবস্থাপনায় হাজার হাজার ছোট ছোট গ্রামীণ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষকরা সংখ্যায় পর্যাপ্ত নন এবং আমি এমন গ্রাম দেখেছি যেখানে, শিক্ষকরা দিনে, একটি বিদ্যালয়ে ২/৩ ঘণ্টা সময় দিতে পারছেন কারণ, তাদেরকে আশপাশের বিদ্যালয়গুলিতে পড়াতে হচ্ছে। চমৎকৃত করার মতো সংখ্যায় শিক্ষক শিক্ষণ কলেজগুলি তৈরি হয়ে গেছে বা হচ্ছে এবং চীনে ১৯৫৮-তে স্নাতকের সংখ্যা আমেরিকার সংখ্যার তিনগুণ হয়েছে। অশিক্ষার বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে তা একমাত্র তুলনীয় হতে পারে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সঙ্গে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানগুলিই নির্দেশিত করে অশিক্ষার হার, জনসংখ্যার অনুপাতে ২০%-এ নেমে এসেছে যদিও, এটা প্রত্যায়িত করা যায় নি, কিন্তু যদি তা সত্য হয় তবে, তা হবে বিস্ময়কর। চীনে, এই দৃশ্যের সাথে সবাই পরিচিত কারণ, এটা বহুলদৃষ্ট – শিশুরা তাদের পিতামাতাকে প্রাথমিক লেখাপড়া করার জ্ঞানটুকু দিচ্ছে; এবং কলেজ-স্নাতকরা নির্দেশিত হচ্ছে তাদের নিজ নিজ গ্রামে, ১/২ বছরের জন্য ফিরে গিয়ে, নিজেদের অর্জিত বিদ্যার কিছুটা হলেও, বিশেষ করে বয়স্ক কৃষকদের মধ্যে, বিতরণ করতে কারণ, তারা, তখনও পর্যন্ত, কোনও শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত ছিল না। রাশিয়াতে যারা বেড়াতে গেছেন তারা যেটা বলেন যে, সেখানে শিক্ষালাভ করবার জন্য যে, ব্যগ্রতা তারা লক্ষ্য করেছেন, সেই একই ব্যগ্রতা চীনের জনসাধারণের মধ্যেও লক্ষিত হচ্ছে। লন্ডনের রয়টার্স নিউজ এজেন্সির প্রধান সম্পাদক, চীনের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি, তার ঘুরে আসা পর, এই মন্তব্য করেছেনঃ

“শিক্ষা এখন আর মুষ্টিমেয়দের কুক্ষিগত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সম্পূর্ণরূপে তাদের ক্ষমতার সীমায় পৌঁছে গেছে। তারা উদ্যমী ছেলেমেয়েদের, পাশ করবার পর, বাইরের পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে যাতে, তারা তাদের জ্বলন্ত আগ্রহ নিয়ে নিজের দেশকে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে, পাশ্চাত্য দেশগুলির সমান স্থানে পৌঁছে দিতে পারে।“ [সুত্রঃ Article by the Editor of Reuters, New York Times; February 27th,1958.]

সহবন, প্যারিস-এর প্রফেসর, চার্লস বেটেলহম, যার মন্তব্য আমরা আগেই উদ্ধৃত করেছি, প্রযুক্তিগত উন্নতির বিষয়ে, আমাদের, ওই একই প্রতিবেদনে বলেন যে,

প্রাথমিক বিদ্যাল্যের ছাত্র সংখ্যা ১৯৪৯ সালের তুলনায় ৩০০% বৃদ্ধি পেয়েছে; ৭০ মিলিয়ন বয়স্ক মানুষ লিখতে ও পড়তে শিখছেন; ১৯৪৯ সাল থেকে, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রাপ্ত ছাত্রের সংখ্যা ৬৯০% বেড়েছে এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪০০%। [সুত্রঃ "China's Economic Growth" by Professor Charles Bettelheim, of the Sorbonne, Paris. A report originally published in four parts by The Economic Weekly, Bombay, lndia, November, 22 and 29; December 6 and 13, 1958.  Reprinted in a somewhat abridged form by Monthly Review, March 1959.]  
      
বর্তমানে চীনে, ব্যপক শিক্ষাগত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। ছাত্ররা সর্বস্তরে অংশগ্রহণ করছে, কখনও সেই সব ছোটখাটো শিল্পগুলিতে, যেগুলি সর্বত্র গজিয়ে উঠছে; কখনও শহর ছেড়ে যাচ্ছে অনেক দিনের জন্য; যাচ্ছে গ্রামে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে কৃষকদের কৃষিকাজে সহায়তা করবার জন্য। এই ব্যবস্থাকে কটাক্ষ করে পাশ্চাত্য দেশগুলি বেশ সমালোচনা করেছে; এইযে শিক্ষার সঙ্গে কায়িক শ্রমকে জুড়ে দেওয়া, তাতে কোথাও কোথাও হয়তো, অতিরিক্ত জোর প্রয়োগ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, হংকং-এ, ABC-র প্রতিবেদক Stanley Rich “New Republic”-এ আতঙ্কের সাথে লিখছেন, তার মতে ভয়াবহ ব্যবস্থার কথা যেখানে মানসিক শ্রম এবং কায়িক শ্রমকে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে; কৃষক এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কোনও তফাত রাখা হচ্ছে না। Rich বাবু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছেন যে,

“শ্রমিক …… তাকে তার প্রযুক্তিগত পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে! সে হয়তো এক দিন শিক্ষক; পরের দিন কৃষক; তার পরের দিন সে হয়তো ইস্পাত গলাচ্ছে।“ [সুত্রঃ The New Republic,  January 5th,1959.] 

কিন্তু এই জিনিসটি, নিশ্চিতভাবেই সেইটা, যেটি পাশ্চাত্য সমাজবিদরা প্রায়শই চেয়ে এসেছেন – আমাদের জীবনশৈলীর মধ্যেকার এই ক্রমবর্ধমান এবং ধ্বংসাত্মক স্পেশালাইজেশন যা, মানুষকে ক্রমে আরও বেশি বেশি করে একটি সঙ্কীর্ণ অভিজ্ঞতার গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে – তার বিরুদ্ধে। 
সম্ভবত, পশ্চিমের সেরা চীন বিশেষজ্ঞ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের Dr, Joseph Needham যা বলেছেন, তা খুবই চিত্তাকর্ষক। তিনি, তার সাম্প্রতিকতম চীন ভ্রমণের পর, লিখেছেন,

“এটা সন্দেহাতীত যে, বর্তমান চীনে এক বিস্ময়কর কায়িক পরিশ্রমের রূপ দেখা যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস যে, এটি, পার্টি নেতৃত্বের দ্বারা, সঠিক ভাবে প্রবাহিত করা জনসাধারণের গভীর অভিব্যক্তি; কিন্তু কোনোভাবেই তা উপর থেকে আরোপিত নয়। আগেকার দিনের চীনের, বিদ্বান ব্যক্তিদের কায়িক পরিশ্রমের থেকে, একটা প্রথাগত বিচ্ছিন্নতা ছিল যেটা পৃথিবীর আর কোথাও এতটা পরিলক্ষিত হয় নি। এখন চীনের জনগণ এই ব্যবস্থাকে অতিক্রম করতে দৃঢ় সংকল্প। হয়তো কোথাও, কোনও সময়ে, অতিরিক্ত উৎসাহের কারণে, এর অতিলক্ষণ দেখা গেছে কিন্তু, এই আন্দোলন, মূলগত দিক দিয়ে অভ্রান্ত।
সব সংস্কৃতি এবং সভ্যতা, তত্ত্ব এবং আচরণের এই ব্যবধান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, প্রয়োগকারী এবং শিল্পীরা অনুভব ক্রেছেন এবং প্রত্যক্ষ ক্রেছেন যে, যখন কায়িক এবং বৌদ্ধিক শ্রমের সংমিশ্রণ ঘটেছে তখনই, একজন মানুষের অভিজ্ঞতার ফসলকে, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে, সর্বোচ্চ স্থানে উন্নিত করা গেছে। এই সম্মিলন যে শুধুমাত্র প্রকৃতির  সম্বন্ধে জ্ঞান বৃদ্ধি করে তাই নয়, সমাজের সেই অংশের প্রতি গভীরতর মমত্ববোধ এর প্রকাশ ঘটায়, যাদের অবদান, এখনও কিছুকাল ধরে মূলত কায়িক আছে ও থাকবে। …… কায়িক শ্রমকে একটি অবমাননাকর শাস্তি হিসাবে ভাবনাই, চীনারা যা করছে, তাকে ভুল বোঝাচ্ছে। [সুত্রঃ Letter to New Statesman, London, January 3lst, 1959]।

চিকিৎসাবিদ্যা




বর্তমান চীনে ভ্রমণরত যে কেউ এই বাস্তবতার মুখোমুখি যে, গোটা দেশের চতুর্দিকে, অভূতপূর্ব শৃঙ্খলা এবং পরিচ্ছন্নতা বিরাজ  করছে। যারা এশীয় দেশগুলির নোংরা পরিবেশ এবং আবর্জনা যুক্ত অবস্থার সাথে পরিচিত, তারা এক বিরাট বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন। রাস্তা, ট্রেন, হোটেল, বিদ্যালয়, বাড়ি আমাদের দেশের মতোই (লেখক এখানে তার নিজের দেশ অর্থাৎ ইংল্যান্ডের কথা বলছেন – মহাজনপদ) পরিষ্কার এবং ঝকঝকে। এমনকি বস্তিগুলি, যদিও কুটীরগুলি অত্যন্ত দারিদ্রের সাক্ষ্য বহন করছে এবং এর মধ্যেকার রাস্তাগুলি মাটির, সেগুলিও (যেমন একটি ব্রিটিশ মেডিকাল রিপোর্ট বর্ণনা করেছে) “under hygienic control”। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকাল ফ্যাকাল্টির পূর্বতন ডিন এবং ব্রিটিশ মেডিকাল রিসার্চ কাউন্সিলের সদস্য, প্রফেসর Brian Maegraith, ১৯৫৭ সালে, নয় জন উচ্চ স্তরীয় ব্রিটিশ ডাক্তার দলের একজন হিসাবে চীন পরিদর্শন করেন এটা দেখতে যে, বিপ্লবোত্তর চীনে চিকিৎসার বাস্তব পরিস্থিতিটি ঠিক কি।  এখানে প্রফেসর Maegraith-এর প্রতিবেদনের কিছু অংশ দেওয়া হলওঃ


“জনবহুল কিছু অংশে, পেটের অসুখ জনিত ক্ষেত্রে যেমন, টাইফয়েড, জীবাণুঘটিত এবং আমাশয় জনিত পেট খারাপ, সাথে সাধারণ কৃমিজাত সংক্রমণে, অনেক পরিমাণে সাফল্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এই সাফল্য অর্জনের জন্য, সংক্রমিত অঞ্চলে, যে বিপুল পরিমাণে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হয়েছে তা, শুরুতে, রীতিমত হতাশাজনক মনে হয়ে থাকতে পারে।  
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান, এখনও পর্যন্ত যে স্থানে পৌঁছিয়েছে, তা এক কথায় অকল্পনীয়। উদাহরণস্বরূপ, বড় বড় শহর এবং তার পরের পর্যায়ের ছোট শহরগুলিতেও মাছি এবং ময়লার অনুপস্থিতি চোখে পড়ে। মাছির উপরে নিয়ন্ত্রণ, আবর্জনাহীন পথঘাট এবং গৃহস্থ বাড়িগুলির নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা, পেটের অসুখের ওপর নিয়ন্ত্রণকে সাফল্যমণ্ডিত করেছে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে তো বটেই।
এটা কিভাবে সম্ভব হল? কি করে একটি কুখ্যাতিগ্রস্ত, নোংরা শহর হটাৎ-ই পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল? এর উত্তর পাওয়া যাবে সেই সব জনগণের সদিচ্ছার মধ্যে, যাদের বোঝানো হয়েছে যে, তাদের ঘর-গৃহস্থালি পরিচ্ছন্ন রাখলে কি সুফল পাওয়া যাবে। এই রূপ জনকল্যাণে জনসাধারণের সহযোগিতা জরুরী এবং এক্ষেত্রে, সরকার অবশ্যই কৃতকার্য হয়েছে তাদের সহযোগিতা আদায় করতে। এই কাজ হয়তো সহজ হতো কোনও একনায়কতন্ত্রী দেশের পক্ষে এবং এর খানিকটা বাধ্যতামূলক অবস্থান নিতে হতো জনসাধারণকে বাধ্য করতে, সহস্র সহস্র টন বর্জ্যবস্তু ও ময়লা আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে, মাছি মারতে এবং কীটপতঙ্গ মুক্ত করতে। যাইহোক না কেন, চীনা লোকজন অত্যন্ত বাস্তববাদী এবং কোনও ধরণের ভুজুং-ভাজুং দিয়ে তাদের এটা করাতে পারা যেত না, যদিনা, তাদের মধ্যে সাধারণ বুদ্ধির চর্চা করানো হতো এবং সামাজিক সচেতনতার পাঠ না পড়ানো হতো। এর ফলেই, তার মধ্যে গড়ে উঠেছে বর্তমানের স্বাস্থ্যসচেতনতার মনোভাব।“ [সুত্রঃ "The Chinese are 'liquidating' their disease problems", by Dr. Brian Maegraith, The New Scientist, London, December 5th, 1957]

এই টিমের আরেকজন সদস্য ছিলেন, লন্ডনের সেন্ট্রাল মিডলসেক্স হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো-এন্টারোলজিকাল ইউনিটের ডাইরেক্টর Dr. F. Avery Jones. নিচে ব্রিটিশ মেডিকাল জার্নালে প্রকাশিত তার প্রতিবেদনের কিছু অংশ দেওয়া হলঃ

“পরিচ্ছন্নতা অতুলনীয়, তার সঙ্গে আবর্জনা ও মাছির অনুপস্থিতি অবাক করবার মতো। বহু স্থানে, আবর্জনা ফেলবার পাত্র দেখা যায়, বিশেষত পার্কগুলিতে। এমনকি, খচ্চরগুলির ল্যাজের তলায় থলি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় যাতে, তারা যত্রতত্র, মল-মুত্রের দ্বারা, রাস্তাঘাট নোংরা না করতে পারে। এই যে মাছি জাতীয় পতঙ্গদের উৎখাত করতে পারা গেছে, এটা সম্ভব হয়েছে দেশব্যাপী প্রচার আন্দোলনের সাফল্য হিসাবে এবং এটা জনস্বাস্থ্যের উন্নতির ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখে……।
চীনের নীতি হচ্ছে, যত সম্ভব দ্রুত হারে, পাশ্চাত্য রীতির চিকিৎসক তৈরি করা এবং বিগত বছরে ৮০০০-এর ওপর ছাত্র, পাঁচ বছরের চিকিৎসাবিদ্যার কোর্সে ভর্তি হয়েছে …… পাঁচ বছরের শিক্ষাকালের সব বিষয়গুলি, প্রায়গিক দিকগুলি, পাশ্চাত্য মেডিকাল স্কুলগুলির মতন হুবহু এক। সব ছাত্ররাই হয় ইংরাজী শেখে অথবা, শেখে রাশিয়ান ভাষা। [সুত্রঃ "Visit to China" by F. Avery Jones, M.D., F.R.C.P. British Medical Journal, November 9th, 1957.]

“Lancet”-এর সম্পাদক, ডঃ T.F. Fox-এর সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক কিছু সংক্ষিপ্ত কোটেশন এবার দিচ্ছিঃ

“দ্রুত হারে হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে; চীনের প্রতিটি জেলায় একটি করে হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। (চীন দাবি করেছে যে, শেষ ৮ বছরে ৮৬০টির মতন হাসপাতাল তৈরি হয়েছে) অবশ্য এগুলি সংখ্যায় নগণ্য বলতে হবে …… আমাদের যে কথা বলা হয়েছে যে, ফলাফল অত্যন্ত সন্তোষজনক …… পিকিং জেলা, যেটিতে আমরা গিয়েছিলা, সেখানে ১৯৫৪ সাল থেকে, একটিও প্রাণঘাতী fatal puerperal sepsis-এর ঘটনা ঘটে নি।
প্রসবকালীন মৃত্যুর হার ১৯৫৬ সালে, ওই জেলায় প্রতি হাজার জীবন্ত শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে ০.৩ এবং সাংহাইতে তা ০.২৮ …… ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস-এর ক্ষেত্রে এই হার, ১৯৫৫ সালে ছিল, ০.৫৪। শহরে টীকাকরণের প্রক্রিয়াগুলি বিস্তৃত। পিকিং শহরে, ৯০-৯৭ শতাংশ শিশুরা BCG টীকা পায় ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে …… ২ থেক ৬ মাসের মধ্যে শিশুদের স্মল পক্স-এর টীকা দেওয়া হয় …… পরে শিশুদের হুপিং কাশি, ডিপথেরিয়া এবং এনসেফেলাইটিস-এর টীকা দেওয়া হয় …… এই সমস্ত প্রচেষ্টা তার সুফল পাচ্ছে।“

ডঃ ফক্স, এই বিস্তৃত মেডিকাল প্রতিবেদনে, চীনাবাসীদের জন্য   এইরূপ একটি ট্রিবিউট দিয়ে শেষ করেছেন –

“আমি এখানে এসেছিলাম এইটি অনুভব করবার জন্য যে, মেজাজ, চাতুর্য, সদাশয়তা এবং বীরত্বপূর্ণ সহিষ্ণুতা – এই মানবিক গুণগুলি এখানে রক্ষিত হচ্ছে কিনা। কিন্তু দেখলাম যে, এ বিষয়ে চিন্তিত হবার কোনও প্রয়োজন নেই যে, আমাদের বাদ দিয়ে ভবিষ্যতে, চীনারা পৃথিবীকে কব্জা করে নেবে। [সুত্রঃ "The New China-Some Medical Impressions", by T. F. Fox, M.A., M.D., F.R.C.P. The Lancet, London, November,
9, 16, and 23, 1957.]

ব্রিটিশ ডাক্তারদের দ্বারা, এই প্রতিবেদনগুলি কিন্তু লিখিত হয়েছে পিপলস কমিউনগুলি গড়ে উঠবার আগে। এখানে আরও সাম্প্রতিককালের প্রতিবেদন দেওয়া আছে। লিখেছেন ইংল্যান্ডের Birmingham Accident Hospital-এর প্রাক্তন শল্যবিদ এবং বর্তমানে পিকিং মেডিকাল কলেজ ও হাসপাতালের কন্সাল্টিং শল্যবিদ হিসাবে কর্মরত ডঃ J. S. Horn, F.R.C.S।


“পিপলস কমিউন তৈরি হবার পর, সেগুলি, জেলা স্তরে হাসপাতাল স্থাপন করছে অথবা, প্রতিটি গ্রামে চিকিৎসাকেন্দ্র বা ‘ওয়ার্কিং ব্রিগেড’ তৈরি করছে যা দিয়ে, অত্যন্ত প্রাথমিক স্তর থেকে জাতীয় স্তর অবধি মেডিকাল সার্ভিস তৈরি করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, হুপেহ প্রদেশের একটি জেলাতে তারা ৬৮৫টি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেছে। এগুলি এখনও খুবই সাধারণ মানের, কয়েকটি মাত্র কক্ষ এবং জরুরী ওষুধ সম্বলিত …… এবং পিপলস কমিউন এখানে মেডিকাল ট্রেনিং ক্লাস চালু করেছে। সত্যই মন ভালো হয়ে যায় যখন দেখি, কৃষকরা ছোট ছোট উপহার নিয়ে আসছে – মশারী,  থারমোস-ফ্লাস্কস, গামলা, কেটলি প্রভৃতি …… কখনও টাকা-পয়সা সাহায্য করবার জন্য কারণ, তারা বুঝতে পারছে পরবর্তীকালে, এই হাসপাতালগুলি,  ধীরে ধীরে, তাদের নিজেদের ‘কটেজ হাসপাতাল’ হয়ে উঠবে। [সুত্রঃ "A Letter from Peking", by Dr. Joshua Horn, F.R.C.S., published by Britain-China Friendship Association, London, 1959.]


......ক্রমশঃ 







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম - অনুবাদে রুমা নিয়োগী(প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)

আদিম কমিউন থেকে বুর্জোয়া রাষ্ট্র পর্যন্ত মানব সমাজের যাত্রার ধারা বেয়ে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের উৎস ও সমাধানের খোঁজে – একটি প্রস্তাবনা ;প্রয়াসে চঞ্চল মুন্সী এবং চারুদত্ত নীহারিকা রজত

রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>