বলশেভিকবাদের সেরা দুশমন ট্রটস্কি (প্রথম পর্ব) - বোধায়ন রায়





(এই প্রবন্ধটি “Towards A New Dawn…the other voice of the people magazine”-এ ২০১২ সালের জানুয়ারি – ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটিকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন চারুদত্ত নীহারিকা রজত)


(প্রথম পর্ব)


সারা দুনিয়া জুড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণী এবং নিপীড়িত জনতার অন্যান্য অংশগুলির সংগ্রাম তীব্রতর হয়ে উঠবার সাথে সাথে, নানা রঙের স্ব-ঘোষিত কমিউনিস্ট গ্রুপগুলিও গজিয়ে উঠেছে ও ছড়িয়ে পড়ছে। এই গ্রুপগুলির মধ্যে কিছু গ্রুপ, তাদের বুকনিবাজির পাশাপাশি জনগণের লড়াইকে বিপথু করতে চেষ্টা করছে। সুতরাং, এই গ্রুপগুলির ইতিহাস ফিরে দেখা এবং তাদের ভ্রান্তিপূর্ণ কর্মধারাকে বিশ্লেষণ করা জরুরী। এই প্রবন্ধে আমরা, এই ছদ্ম-কমিউনিস্টদের দংগলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠীর পথপ্রদর্শক মতবাদের উৎসের উপর আমাদের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করবো তা হলো ট্রটস্কিবাদ। বিগত দশকগুলি ধরে, অন্যান্য ছদ্ম-কমিউনিস্ট তত্ত্বের মতই, ট্রটস্কিবাদ এমন স্তরে অধঃপতিত হয়েছে যে, এটি, এমনকি সবচেয়ে সৎ এবং বিপ্লবী মানসিকতার ট্রটস্কিপন্থীকেও, কোথাও শ্রেণী-যুদ্ধে প্রবেশ করতে প্রতিষেধ করে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে তার বর্তমান যে বিস্তার, তার মূল কারণ, শ্রমিক শ্রেণীর বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে সংশোধনবাদ এবং পাতি অর্থনীতিবাদের ফাঁদে ফেলবার ক্ষমতা। যে সমস্ত দেশে শ্রেণী-যুদ্ধ শ্রমিক শ্রেণীর অনুকূলে এমন স্তরে বিকশিত হয়েছে যে, সে তার নিজস্ব লাল-ফৌজ গঠন করতে সক্ষম, ট্রটস্কিপন্থীরা সেখানে ছোট ছোট গোষ্ঠী হিসাবে টিকে থাকে যা, বিপ্লবী শক্তির মধ্যেকার বিশেষ বুর্জোয়া-দানবায়নের প্রতি অনুগত থাকে এবং আদর্শগত ভাবে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রোলেতারিয়েতদের একটি অংশকে, নিও-কলোনিতে বসবাসকারী তাদের শ্রেণী-ভাইদের উপর সামরিক আক্রমণ নামিয়ে আনবার প্রস্তুতিতে সহায়তা করে। 

ট্রটস্কিপন্থীরা, তাদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি ঘৃণার জন্য পরিচিত, যার তারা নাম দিয়েছে স্তালিনবাদ। তারা স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি পতিত বা বিকৃত শ্রমিক রাষ্ট্র, এমনকি রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হিসাবেও মনে করে। তারা, সেই সময়ের সোভিয়েত রাষ্ট্রকে, সোভিয়েত শ্রমিক শ্রেণীর উপর আমলাতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র হিসাবে অভিযুক্ত করে। এরপর তারা আরও অগ্রসর হয়ে প্রতিটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী লাইনের কমিউনিস্ট বৈপ্লবিক আন্দোলনকে তথা যেকোনো সময়ের প্রতিটি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অভিযুক্ত করে অগণতান্ত্রিক এবং জনগণের  বিরোধী হিসাবে। মূল কথা হল, তারা বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের অভিযোগগুলিকেই তোতা পাখির মতন আউড়ে যায়; শুধু নিজেদেরকে আড়াল করে কিছু মার্কসীয় বুলির আড়ালে। এখন, ট্রটস্কির নিজের এবং তাদের তত্ত্ব এবং প্রয়োগের একটি নিবিড় অনুসন্ধান খুব সহজেই প্রকাশ করে দেয়, যে তারা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী লাইনকে যা বলে অভিযুক্ত করে, তারা নিজেরাই আসলে সেই দোষে দুষ্ট ও অপরাধে অভিযুক্ত এবং কিভাবে তারা প্রকাশ্যেই লেনিনের নীতিগুলির বিরোধিতা করেছিলো বা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের সাথ দিয়েছিল।

ট্রটস্কির জীবনের প্রথমার্ধ ঃ

১৮৭৯ সালের ৭-ই নভেম্বর, একটি বর্ধিষ্ণু, সচ্ছল কৃষক পরিবারে ট্রটস্কির জন্ম। তার পরিবার কাজের জন্য মুনিষ ভাড়া করতো এবং অন্যান্যদের মতনই তাদেরকে খুবই কম মজুরী দিত। মুনিষদের খাদ্যের অবস্থা এতই করুণ ছিল যে, এক গ্রীষ্মে তারা সকলেই অপুষ্টির কারণে রাতকানা-মহামারীতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গৃহযুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠলে, তার পরিবার এতই সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে যে, লালেরা তাদের কাছে ছিল উপদ্রবস্বরূপ। যদিও, তারা সোভিয়েত শক্তির বিরোধিতা করে নি এবং তার বাবা, মস্কোর কাছে এক বছরের মতন একটি রাষ্ট্রীয় মিল পরিচালনা করেছিলেন। ট্রটস্কি ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। স্কুলের পাঠ শেষ করে, তিনি ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবী চক্রে যোগদান করেন। এই চক্রগুলির কাজ সীমাবদ্ধ ছিল অন্তহীন আলোচনার মধ্যে। প্রথমদিকে, শ্রমিক শ্রেণিকে প্রকৃত ভাবে সংগঠিত করা এবং পীড়ক রাষ্ট্রকে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য একটি গুপ্ত সংগঠন গড়ে তুলবার কোনও উদ্যোগই ছিল না। এখানে এটা উল্লেখযোগ্য যে, আজকের ট্রটস্কিপন্থীদের কোনও গ্রুপ এই লাইনকে অতিক্রম করে না। প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক, ছাত্র এবং এমনকি ব্যঙ্ক ম্যানেজার ও অন্যান্য পেটি-বুর্জোয়া উপাদানে গঠিত ট্রটস্কিপন্থীদের অসংখ্য বাতেলাবাজির দোকান আছে; রিপোর্ট আছে শ্রমিকরা ট্রটস্কিদের মিছিলে পা মিলিয়েছে; কিন্তু কোথাও, ট্রটস্কিপন্থীরা প্রোলেতারিয়েতদের সেই স্তরে সংগঠিত করেছে যে স্তরে, তাদের একটি সামরিক কাজের সাথে যুক্ত গুপ্ত সংগঠন আছে, এরকম শোনা যায় নি। এটা এই কারণে যে, একটি বিপ্লবী সংগঠন ছাত্রদের আলোচনা চক্র থেকে শুরু হতে পারে এবং প্রকাশ্যে শ্রমিকদের মিছিল সংগঠিত করতে পারে কিন্তু এগুলি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করবার পক্ষে একেবারেই যথেষ্ট নয় এবং অতএব, সংশোধনবাদী উপাদানগুলির দ্বারা এইসবের নকল হতে পারে যারা, আসলে বুর্জোয়াদের জন্য কাজ করে শ্রমিক শ্রেণিকে প্রতারণা করবার মধ্য দিয়ে। ট্রটস্কিপন্থীদের সংগঠনগুলি, যেগুলি সেইসব দেশে দশকের পর দশক ধরে টিকে আছে, যেখানে প্রোলেতারিয়েতদের একটি উল্লেখযোগ্য ভাবে বিরাট অংশ চরম অত্যাচারের মুখোমুখি হচ্ছে যদিও, তারা গুপ্ত কাজকর্ম শুরু করে নি যা বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করবে; এরা আসলে পুঁজিবাদের সচেতন যন্ত্র বৈ কিছু নয়। সচরাচর তারা এই অজুহাত দেয় যে, ঐ সব দেশের পরিস্থিতি এখনও এই ধরণের কাজকর্মের জন্য পরিপক্ক হয় নি কিন্তু, বাস্তবে সেই সমস্ত দেশের পরিস্থিতি, ট্রটস্কি সহ রাশিয়ার কমিউনিস্টরা তাদের বিপ্লবী কাজকর্মের পথে যা মোকাবিলা করেছে, তার তুলনায় অনেক বেশি অনুকূল।  

নিকোলায়েভের বিপ্লবী চক্রগুলি, যেগুলির সাথে ট্রটস্কি যুক্ত ছিলেন, শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং প্রদর্শন থেকে শিক্ষা লাভ করে তৎক্ষণাৎ শ্রমিকদের প্রকৃত ভাবে সংগঠিত করবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই অঞ্চলের পুলিশের অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে, ১৮৯৮ সালে তাদের গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই, শ্রমিকদের মধ্যে তাদের সংগঠন এতটাই ব্যাপ্তি লাভ করেছিল যে, অন্যান্য কমিউনিস্টরা সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। পরবর্তীকালে ট্রটস্কি সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হলেন। ১৯০২ সালে তিনি মুক্তি পান এবং লন্ডনে লেনিনের সাথে তার প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়।

লেনিন এবং বলশেভিকদের সাথে প্রথম বিরোধগুলিঃ

নির্বাসনে থাকাকালীন, ট্রটস্কি R.S.D.L.P.-র মধ্যেকার মতপার্থক্যের ব্যাপারে জানতে পারেন। সেই সময়, লেনিন R.S.D.L.P.র একটি ঝোঁক, অর্থনীতিবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যস্ত ছিলেন। অর্থনীতিবাদীরা মনে করতো যে, শ্রমিকরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং স্বাধীন বুর্জোয়াদের সমর্থন করবে যারা, রাজনৈতিক লড়াইটা লড়বে। স্বাভাবিক ভাবেই, লেনিনের একটি কেন্দ্রীভূত প্রোলেতারিয় পার্টি গঠন করবার পরিকল্পনার তারা বিরোধী ছিলেন। এই ইস্যুতে, লেনিনের সমর্থকরা একটি সারা রাশিয়া ব্যাপী রাজনৈতিক সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন যা, অর্থনীতিবাদীদের প্রতিহত করবে। তারা পরিকল্পনা করলেন এটিকে বিদেশে ছাপানোর এবং গোপনে সারা রাশিয়ায় ছড়িয়ে দেবার। ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে এটি প্রথম সূর্যের আলো দেখলো। এর নাম রাখা হয়েছিল  ইস্ক্রা (স্ফুলিঙ্গ)। ট্রটস্কি অর্থনীতিবাদীদের বিরুদ্ধে ইস্ক্রাপন্থীদের পক্ষ নিয়েছিলেন।

১৯০৩ সালে, R.S.D.L.P.-র দ্বিতীয় সম্মেলনে, লেনিন এবং মারতভের অনুগামীদের মধ্যে, পার্টি সংগঠনকে কেন্দ্র করে একটি খাড়া বিভাজন পরিলক্ষিত হয়। এই সময়েই, ট্রটস্কি প্রথম লেনিনের বিরোধিতায় উঠে দাঁড়ান। লেনিন এবং মারতভ দুজনেই এই বিষয় সহমত হয়েছিলেন যে, একজন পার্টি সদস্যকে অবশ্যই পার্টির কর্মসূচীকে গ্রহণ করতে হবে এবং পার্টিকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করতে হবে। লেনিন জোর দিয়ে বললেন যে, একজন পার্টি সদস্যকে, পার্টির কোনও না কোনও সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকতে হবে। এর একটি সুদূরপ্রসারী অভিঘাত ছিল একটি ঠাস বুনটের প্রোলেতারিয় অগ্রবাহিনি গঠন করবার ক্ষেত্রে যেহেতু, এর দ্বারা সদস্যরা পার্টি শৃঙ্খলার সামনে নিজেদের সমর্পণ করবে। মারতভ এটিকে আবশ্যিক মানতে রাজি হলেন না কারণ, তিনি পার্টি সংগঠনের কোনও নির্দিষ্ট আকারের পক্ষে ছিলেন না। 

সম্মেলনে লেনিনের অনুগামীরা অধিকাংশের ভোট পেলেন এবং নাম পেলেন “বলশেভিক” (বলশিন্সতভো – সংখ্যাগুরু) এবং মারতভরা নাম পেলেন “মেনশেভিক (মেনশিন্সতভো – সংখ্যালঘু)। বর্তমানে মেনশেভিক ট্রটস্কি, সম্মেলনে তার রিপোর্টে, মারতভের পার্টি সংক্রান্ত সুত্রকে সমর্থন করলেন এবং লেনিনকে “পার্টির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী”, “পার্টির প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর” নেতা বলে অভিযুক্ত করলেন ও তাকে সংশোধনবাদী বার্নস্তাইনের সাথে  তুলনা করলেন! এটি ছিল লেনিন এবং লেনিনবাদের উপর ট্রটস্কির প্রথম আক্রমণ। 

পরবর্তী বছরগুলি প্রত্যক্ষ করলো রুশ-জাপান যুদ্ধ এবং ১৯০৫ সালের বিপ্লবের উত্থান এবং পতন যেটিকে, লেনিন আখ্যায়িত করেছিলেন অক্টোবর বিপ্লবের “পূর্ণ সজ্জিত মহলা” বলে। ইতিমধ্যে প্লেখানভ মেনশেভিকদের দিকে সরে এসেছেন এবং ফলে বলশেভিকরা ইস্ক্রার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। বলশেভিকরা, জাপানের হাতে রাশিয়ার পরাজয়কে বিপ্লব সংঘটিত করবার একটি সুযোগ বলে বিবেচনা করলো। একেই বলা হয় বৈপ্লবিক পরাজয়বাদ; নিজের দেশের শাসক শ্রেণীর, বিদেশীর হাতে পরাজয়কে স্বাগত জানানো, যাতে বিপ্লবের শক্তিগুলি দুর্বল শাসক শ্রেণীকে সহজেই পরাজিত করতে পারে। অপরদিকে মেনশেভিকরা, সামন্ত প্রভু এবং পুঁজিপতিদের পিতৃভূমিকে রক্ষার অবস্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বিপ্লবের সময় ট্রটস্কি, প্রথমবারের জন্য সেন্ট পিটারসবার্গের সোভিয়েতের, প্রথমে ভাইস চেয়ারম্যান এবং তারপর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

এই সময়েই, আলেকজান্ডার পারভাস এবং ট্রটস্কি একটি তত্ত্ব প্রস্তুত করেন যাকে তারা নাম দিলেন “চিরস্থায়ী বিপ্লব”-এর তত্ত্ব। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার পারভাস আন্তর্জাতিকতাবাদকে পরিত্যাগ করেন এবং শেষের দিকে একজন সমাজ-দেশপ্রেমিতে পরিণত হন। “চিরস্থায়ী বিপ্লব” কথাটি ১৮৫০ সালে “Address of the Central Committee to the Communist League” শিরোনামের একটি দলিলে, মার্কস এবং এঙ্গেলস প্রথম ব্যবহার করেন। “চিরস্থায়ী বিপ্লব” বলতে মার্কস এবং এঙ্গেলস আসলে যা বুঝিয়েছিলেন তা হল, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে বিপ্লবকে শেষ করবার বদলে শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লব চালিয়ে যাবে সমাজতান্ত্রিক স্তর পর্যন্ত। কিন্তু মার্কস এবং এঙ্গেলসের যুক্তিযুক্ত প্রোগ্রামের সাথে ট্রটস্কির তত্ত্বের দূর দূর পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক নেই।

পরবর্তীতে ট্রটস্কি, তার “চিরস্থায়ী বিপ্লব”-এর তত্ত্বে লেনিনবাদের কিছু উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং সেটিকে নিজের বলে দাবি করেন কিন্তু, শুরুতে তার তত্ত্ব কৃষকদের গুরুত্ব দেয় নি এবং রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণীকেই একমাত্র বিপ্লবী শক্তি হিসাবে দেখেছিলেন। এর সাথে রয়েছে তার এক ধাপে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব এবং একটি দেশে সমাজতন্ত্রের অসম্ভাব্যতার তত্ত্ব। প্রোলেতারিয়েতের কৃষকদের সাথে জোটের ধারনাটি লেনিনের। ট্রটস্কি এই জোটের উল্লেখ শুধুমাত্র তার শেষের দিকের কাজেই করেছেন। ১৯০৯ সালে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট প্রোলেতারিয়েত এবং কৃষকদের মধ্যে একটি অনিবার্য সংঘর্ষের পূর্বাভাস করেছিলেন। “এই সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটতে পারে হয় কৃষক পার্টির দ্বারা শ্রমিকদের দমনের মধ্যে দিয়ে অথবা, সেই পার্টিকে ক্ষমতা থেকে সরাবার মধ্য দিয়ে।“ এটি লেনিনের চিরস্থায়ী বিপ্লবের মার্কসবাদী তত্ত্বের বিকাশের বিরোধী। লেনিনীয় মডেল বলে যে, প্রোলেতারিয়েত এবং কৃষকের গণতান্ত্রিক-একনায়কতন্ত্র, বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরেও ক্ষমতা দখল করে এবং তাকে সমাজতান্ত্রিক স্তর পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যায় যেখানে, প্রধানত আধা-প্রোলেতারিয়েত বা দরিদ্র-কৃষকদের সমর্থনে প্রোলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯১৯ সালে লেনিনের R.C.P. (B)-র খসড়া প্রোগ্রাম বলছে, “১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবরের (৭-ই নভেম্বর) বিপ্লব রাশিয়াতে প্রোলেতারিয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে যেটি, দরিদ্র কৃষক বা আধা-প্রোলেতারিয়েতদের সমর্থনে কমিউনিস্ট সমাজের ভিত্তি প্রস্তর পত্তনের কাজ শুরু করেছে।“ ঐ বছরই লেনিন আরও বলেছিলেন, “প্রোলেতারিয় একনায়কতন্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের সমাপ্তি নয় বরঞ্চ, নতুন আঙ্গিকে তার চলমানতা। প্রোলেতারিয় একনায়কতন্ত্র হল সেই শ্রেণী সংগ্রাম যা, জারি করা হয়েছে সেই প্রোলেতারিয়েতদের দ্বারা, যারা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বিজয়ী  হয়েছে কিন্তু, তার মানে এই নয় যে, বুর্জোয়ারা উবে গেছে বা প্রতিরোধ দেবার জন্য তাদের আর অস্তিত্ব নেই; উল্টে সেই প্রতিরোধ আরও তীব্র হয়েছে। প্রোলেতারিয় একনায়কতন্ত্র হল, শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী এবং  শ্রমজীবী মানুষের অসংখ্য অ-প্রোলেতারিয়েত বর্গ (পেটি-বুর্জোয়া, ছোট মালিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি) বা এই বর্গের অধিকাংশের একটি জোট, যাদের লক্ষ্য হল, সমাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ও সংহতকরণের লক্ষ্যে পুঁজির সম্পূর্ণ উচ্ছেদ সাধন, বুর্জোয়াদের প্রতিরোধের সম্পূর্ণ দমন; সাথে সাথে বুর্জোয়াদের পুনর্বহালের প্রচেষ্টার সম্পূর্ণ দমন।“ লক্ষণীয় যে, এটি এটাও বলে যে, সমাজতন্ত্রে শ্রেণী সংগ্রাম চলতে থাকে। অতএব, মার্কসের চিরস্থায়ী বিপ্লবের লেনিনীয় বিকাশ এটি নির্দিষ্ট করে বলে যে, এক স্তর থেকে অন্য স্তরে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রোলেতারিয়েত অবশ্যই বৈপ্লবিক শ্রেণী-জোটে যাবে।

১৯০৬ সালে, ট্রটস্কি “Our Revolution”-এ লিখলেন, “ইউরোপীয় প্রোলেতারিয়েতদের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ব্যতিরেকে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণী নিজেকে ক্ষমতায় ধরে রাখতে পারবে না এবং তার অস্থায়ী শাসনকে একটি টেকসই সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রে উন্নীত করতে পারবে না। এই সত্যকে কোনও ভাবেই আমরা সন্দেহ করতে পারি না” এবং “বুর্জোয়া বিপ্লবের ঘটনার তালেগোলের ফলে যদি, রাশিয়ার প্রোলেতারিয়েত নিজেকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে পারে, সে সম্মুখীন হবে বিশ্ব প্রতিক্রিয়ার একটি সংগঠিত প্রতিরোধের এবং অপরদিকে বিশ্ব প্রোলেতারিয়েতের তরফ থেকে পাবে সংগঠিত সমর্থনের একটি স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ। শুধুমাত্র নিজের সম্পদের নিরিখে, যে মুহূর্তে কৃষকরা তার পাশ থেকে সরে যাবে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণী অনিবার্য ভাবে প্রতিক্রিয়ার বিপ্লবের দ্বারা চূর্ণ হয়ে যাবে। নিজের রাজনৈতিক শাসনের ভাগ্যকে, সমগ্র রাশিয়ার বিপ্লবের ভাগ্যকে, ইওরোপের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভাগ্যের সাথে জোড়া ছাড়া তার কাছে আর কোনও বিকল্প থাকবে না।“ এখানে  তার প্রচলিত পূর্বাভাস, প্রোলেতারিয়েত বিপ্লবে একা হয়ে যাওয়া, এর পাশাপাশি ট্রটস্কি আরও বললেন, ইওরোপের আরও অগ্রসর দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যতিত, রাশিয়াতে সমাজতন্ত্র টিকতে পারবে না। পরবর্তীতে তিনি তার এই দ্ব্যর্থবোধক দাবিকে বারবার ব্যবহার করেছেন, লেনিনের এক দেশে সমাজতন্ত্রের ধরানাকে আক্রমণ করবার উদ্দেশ্যে। 


......ক্রমশঃ 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রুশ বিপ্লবের বিকাশ পথ < মূল হিন্দি রচনা ডঃ রাম কবীন্দ্র; বাংলায় অনুবাদে - চন্দন দত্ত>

সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম - অনুবাদে রুমা নিয়োগী(প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)

ইস্ক্রার সম্পাদকীয় বোর্ডের ঘোষণা