লেনিনের শিক্ষার আলোকে নয়া-উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশ : চন্দন দত্ত
লেনিনের শিক্ষার আলোকে নয়া-উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশ
(ইংরেজি ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'Janashakti'-তে প্রকাশিত, কমরেড অলোক মুখার্জি দ্বারা লিখিত 'Colony - Neo colony - Semi colony' নামক নিবন্ধ অনুসরণে সংকলিত)
কমিউনিস্ট শিবিরে রাষ্ট্র-চরিত্র নির্ধারণকে কেন্দ্র করে নানান বাদানুবাদ প্রায়শই শোনা যায়। বিশেষ করে নয়া-উপনিবেশবাদ ও আধা-উপনিবেশবাদ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ও বিহ্বলতা বিদ্যমান রয়েছে। অথচ লেনিন, তাঁর 'সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়' নামক গ্রন্থে সমগ্র বিষয়টির ওপর অত্যন্ত বিস্তারিত ও বিশ্লেষণাত্মক ব্যাখ্যা প্রস্তুত করেছেন। সুতরাং এটা জরুরি হয়ে দাঁড়ায় যে লেনিনীয় শিক্ষার আলোকে বিষয়টির সম্যক পর্যালোচনা করা হোক, যাতে এই দুই ধরনের রাষ্ট্র চরিত্রের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা চিহ্ণিত করা যায়।
নয়া-উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশ, এই দুটি বিষয়ই যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী শোষণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত, সুতরাং প্রথমে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত একটি পরিস্কার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই সম্পর্কিত লেনিনের কিছু বিশ্লেষণাত্মক উদ্ধৃতির দিকে মনোনিবেশ করা যাক।
লেনিন লিখেছেন, -"সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিতন্ত্রের বিকাশধারার সেই স্তর, যে-স্তরে একচেটিয়া কারবার এবং মহাজনী মূলধনের আধিপত্য নিজেকে কায়েম করে নিয়েছে ; যে-স্তরে মূলধনের রপ্তানি প্রচন্ড গুরুত্ব অর্জন করেছে ; যে-স্তরে আন্তর্জাতিক ট্রাস্টগুলির মধ্যে পৃথিবীর ভাগবঁটোয়ারা শুরু হয়ে গিয়েছে ; যে-স্তরে বৃহত্তম পুঁজিতান্ত্রিক শক্তিবর্গের মধ্যে সমস্ত ভূখন্ডের ভাগ-বিভাগ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।" (সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়, পৃষ্ঠা- ৮৩)।
কিন্তু লেনিন এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি আরও লিখেছেন,-"পরে আমরা দেখতে পাবো যে, উল্লিখিত সংজ্ঞাটিতে আমরা নিজেদেরকে যে বনেদি ধারণাগুলির মধ্যে, বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক ধারণাগুলির মধ্যে নিবদ্ধ রেখেছিলাম, শুধুমাত্র সেগুলিকেই যদি আমরা মাথায় না রাখি, যদি সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিকভাবে পুঁজিতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিতন্ত্রের এই স্তরের ঐতিহাসিক ভূমিকা কি অথবা শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের প্রধান ধারা দুটির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক কি, সেটাও আমরা মাথায় রাখি, তাহলে সাম্রাজ্যবাদকে আমরা ভিন্ন একভাবে সংজ্ঞাবদ্ধ করতে পারি।" (ঐ - পৃষ্ঠা ৮৩)।
পরবর্তীতে লেনিন দেখিয়েছেন যে, সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু ও মরণোন্মুখ একটি স্তর।
তিনি এ কথাও বলেছেন যে, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলিকে তীব্রতর করে তোলার মাধ্যমে অগ্রসর হয় যুদ্ধের দিকে, এক প্রকৃত যুদ্ধের দিকে।
সাম্রাজ্যবাদী ক্রিয়াকলাপের অভিমুখ সম্পর্কিত বিষয়ে লেনিন বলেছেন, "মহাজনী পুঁজি, তার রাজনীতি আর তার মতাদর্শের ভিত্তিতে যে অর্থনৈতিক উপরিকাঠামো গড়ে ওঠে, উপনিবেশ অধিকারের প্রচেষ্টাকে তা উদ্দীপ্ত করে তোলে।" (ঐ - পৃষ্ঠা ৭৯)।
সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত উপরোক্ত এই সূত্রায়নে উপনীত হওয়ার আগে লেনিন, ফিনান্স ক্যাপিটালের সক্রিয় গতিবিধির ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, "মহাজনী পুঁজি এমন এক বিরাট, বলা যেতে পারে এমন এক নিয়ন্তা শক্তি যে, পূর্ণতম রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে এমন সব রাষ্ট্রকেও তা বশীভূত করতে পারে, আর বশীভূত করতে থাকে ; এই ধরনের উদাহরণ আমরা একটু পরেই আলোচনা করব। অবশ্য, যে ধরনের বশ্যতার ফলে বশবর্তী দেশ এবং জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর্যন্ত খোয়া যায়, তেমন ধরনের বশ্যতা থেকেই মহাজনী পুঁজি বৃহত্তম মুনাফা আদায় করে নিতে সবচাইতে 'সুবিধা পায়' এবং সক্ষম হয়। এই প্রসঙ্গে অর্ধ-ঔপনিবেশিক দেশগুলি 'মধ্যবর্তী পর্যায়ের' একটি প্রতিভূস্থানীয় দৃষ্টান্ত। মহাজনী পুঁজির যুগে বাকি জগতের ভাগাভাগি যখন সমাধা হয়ে গিয়েছে, তখন এই আধা-স্বাধীন দেশগুলির জন্য সংগ্রাম যে বিশেষ তিক্ত রূপ ধারণ করবে, তা স্বাভাবিক।" (ঐ, পৃষ্ঠা ৭৬)।
আমরা দেখেছি, বিশ্বকে পুনর্বিভাজিত করার লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয়, দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী শক্তিগুলি লুন্ঠন চালিয়েছে বিজিত শক্তিগুলির উপর, তাদের প্রতিযোগিতার বাইরে সরিয়ে দিতে। একই সাথে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র --- ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক (ইউএসএসআর)-এর উত্থানের মধ্য দিয়ে। তখনও পর্যন্ত উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশগুলির জাতীয় জনযুদ্ধগুলি ছিল দূর্বল অবস্থায়।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সেইসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি, যারা পূর্ববর্তী যুদ্ধে পরাজিত, বিজিত হয়েছিল, তারা 'অক্ষ-শক্তি'র নির্মাণ ক'রে এক আগ্রাসী রূপ ধারণ করে। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি প্রথমে এই যুদ্ধকে সোভিয়েতের দিকে পরিচালিত করতে সচেষ্ট হয়েছিল, কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা বিফলতায় পর্যবসিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে, সোভিয়েতের সঙ্গে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির জোট, 'মিত্র-শক্তি'র গঠণের মধ্য দিয়ে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিবর্তিত হয়েছিল একটি ফ্যাসিবাদ-বিরোধী যুদ্ধে এবং একইসঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন পদানত দেশগুলিতে শুরু হয়ে গেছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। পরিশেষে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছিল 'মিত্র শক্তি'র জয় এবং ফ্যাসিস্ট 'অক্ষ-শক্তি'র পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতিরেকে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়েছিল এবং একইসাথে তারা নিজ নিজ উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। উপরন্তু, চীন বিপ্লব ও পূর্ব ইউরোপীয় কিছু দেশগুলিতে বিপ্লবের সফলতাকে কেন্দ্র করে এক শক্তিশালী
সোস্যালিস্ট ক্যাম্প-এর উদ্ভাবন ঘটে। এইরকম একটি পরিস্থিতিতে, উপনিবেশগুলিকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সামনে দুটি মাত্র পথ খোলা ছিল, - প্রথমত, হয় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধগুলিকে দমন করার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন যথাপূর্ব বজায় রাখা (যা লগ্নি পুঁজির পক্ষে সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক হতে পারত), অথবা দ্বিতীয়ত, সেই সমস্ত দেশের আভ্যন্তরীণ এমন কোনো শক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, যারা লগ্নি পুঁজির স্বার্থের সেবা করার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করবে, আর এইভাবে উপনিবেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসনের পরিবর্তে অপ্রত্যক্ষ শাসন জারি থাকবে। সাম্রাজ্যবাদীরা দ্বিতীয় উপায়টিকেই শ্রেয় বিচার করে তা গ্রহণ করেছিল, কারণ প্রথম পথটি অবলম্বনের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে সশস্ত্র জনযুদ্ধের অভিঘাতে উপড়ে ছুঁড়ে ফেলার নিশ্চিত সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল।
নীতির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। এটি ছিল নতুন রূপে সেই একই ঔপনিবেশিক নীতি, দেশগুলিকে প্রত্যক্ষ ভাবে শাসন করার পরিবর্তে শাসনকার্য পরিচালিত করা হবে তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষিত দালালদের মাধ্যমে, স্বনিয়োজিত পুতুল (পাপেট) নিয়োগের মাধ্যমে, অপ্রত্যক্ষভাবে। নব রূপের এই উপনিবেশিক নীতিকেই বলা হয় নয়া-উপনিবেশিক নীতি ; আর এই শাসন পদ্ধতিকে বলা হয় নয়া-উপনিবেশিক শাসন। গ্রেট ডিবেটের সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি,"এপোলজিস্টস অফ নিও কলোনিয়ালইজম" নামক একটি রিপোর্টে বিষয়টিকে স্পষ্ট ভাবে বিবৃত করে। এতে বলা হয়, -"বিষয়বস্তু পরিষ্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদীরা নিশ্চিতভাবেই উপনিবেশবাদী শোষণ-নীতি পরিত্যাগ করেনি, বরং নিছক একটি নতুন রূপ (form) ধারণ করেছে, নয়া-উপনিবেশবাদ। এই নয়া-উপনিবেশবাদ-এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এই যে, সাম্রাজ্যবাদীরা বাধ্য হয়েছে কিছু কিছু অঞ্চলে তাদের প্রত্যক্ষ শাসন ও শোষণ চালানোর উপনিবেশবাদী পদ্ধতির পরিবর্তন করে সরাসরি তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য এজেন্ট নিয়োগ মারফত নতুন ধরনের এক ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে।"
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, সাম্রাজ্যবাদ তার উপনিবেশিক নীতির অন্তর্বস্তুর কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি, পরিবর্তন ঘটিয়েছিল শুধু তার বহিরাবরণের (form)। অন্তর্বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়নি এই কারণে যে, এমনকী অপ্রত্যক্ষ শাসন কালেও, সাম্রাজ্যবাদ চায় সামগ্রিক অধীনতা, এমন অধীনতা যে তার ফলে অধীনস্থ দেশটির স্বাধীনতাও ক্ষুন্ন হতে পারে। এই ধরনের সামগ্রিক অধীনতার নিদর্শন আমরা দেখেছি দক্ষিণ ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে। ফরাসীরা যখন সেই দেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মোটেই নিজেদের প্রত্যক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেনি, বরং প্রতিষ্ঠা করেছিল তার দালাল সরকারের (পাপেট) এবং শাসন-শোষণ চালিয়েছে তাদের মাধ্যমে, অপ্রত্যক্ষ ভাবে এবং নিজেদের অপ্রত্যক্ষ শাসনকে আড়াল করতে পুতুল সরকার (পাপেট) দ্বারা সময়ে সময়ে সংসদীয় নির্বাচন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত করিয়েছে। একই রকমের অপ্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের উদাহরণ দেখা গেছে কম্বোডিয়ায়, যখন প্রিন্স নরোদম সিহানুককে সহযোগিতা করার অছিলায় লোন নল-সিরিক মাটাক চক্রান্তের মধ্য দিয়ে সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পাপেট সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এইসবই ছিল সাম্রাজ্যবাদের নয়া-উপনিবেশবাদী নীতির সুস্পষ্ট নিদর্শন।
উপরোক্ত ঘটনাগুলি থেকে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক নীতির অন্তর্বস্তু ও বহিরাবরণের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক রয়েছে, সেটা অনুধাবন করা বিশেষ প্রয়োজন। কারণ, সাম্রাজ্যবাদীরা যখন উপনিবেশবাদী নীতির যুগে অবস্থান করছিল, এমনকি সেই যুগেও এমন কিছু দেশও ছিল, যাদের তখন লগ্নি পুঁজির জালে আবদ্ধ হয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয়েছিল, অথচ সেই সমস্ত দেশ কিন্তু উপনিবেশ ছিল না। অর্থাৎ উপনিবেশ হোক বা নয়া-উপনিবেশ, মূলত আর্থিক শোষণই সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক নীতির অন্তর্বস্তু, আর গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির আড়ম্বর হচ্ছে তার বহিরাবরণ।
অন্তর্বস্তু যথাপূর্ববৎ বজায় রেখে বহিরাবরণের এই যে পরিবর্তন, সাম্রাজ্যবাদীরা তার গালভরা নাম রেখেছে 'ডি-কলোনাইজেশন'। এখন দেখে নেওয়া যাক তৎকালীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি), সাম্রাজ্যবাদের এই তথাকথিত 'ডি-কলোনাইজেশন' সম্পর্কে কী বলেছে ---
"ঘটনাবলি নিরীক্ষণ করে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের পুরনো ঔপনিবেশিক নীতির পরিবর্তন করেছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা নিশ্চিতভাবেই উপনিবেশবাদ পরিত্যাগ করেনি, বরং নিছক একটি নতুন রূপ ধারণ করেছে,
নয়-উপনিবেশবাদ।"
এইভাবে উপনিবেশবাদের অন্তর্বস্তু থেকে গেছে একই, কেবল তার রূপ পরিবর্তন করা হয়েছে এবং আজও তা বলবৎ রয়েছে। বহিরাবরণের এই পরিবর্তিত রূপটিই হচ্ছে নয়া-উপনিবেশবাদ বা নয়া-উপনিবেশবাদী নীতি। এই পরিবর্তন কীভাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে ? ইতিপূর্বে লগ্নি পুঁজি সম্পর্কিত লেনিনের একটি উদ্ধৃতিতে আমরা দেখেছি, সেখানে তিনি বলেছেন যে -"অবশ্য, যে ধরনের বশ্যতার ফলে বশবর্তী দেশ এবং জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর্যন্ত খোয়া যায়, তেমন ধরনের বশ্যতা থেকেই মহাজনি পুঁজি বৃহত্তম মুনাফা আদায় করে নিতে সবচাইতে সুবিধা পায় এবং সক্ষম হয়", বর্তমান অবস্থায়ও একই কথা প্রযোজ্য, অন্তর্বস্তুর কোনো পরিবর্তন আদৌ হয়নি। পূর্বেকার উপনিবেশিক ব্যবস্থায় দেশ ও জাতির স্বাধীনতা হরণ করতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজে, আর নয়া-উপনিবেশ হওয়ার পর সেই স্বাধীনতা হরণ করা হয় পাপেট রিজিম-এর মাধ্যমে। এইসব পাপেট'রা আভ্যন্তরীণ কোনো শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং তারা সাম্রাজ্যবাদী প্রভূদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এই হচ্ছে নয়া-উপনিবেশবাদ ও তার রীতি-নীতী।
এইবার আলোচ্য বিষয় আধা- উপনিবেশ। এক্ষেত্রেও লেনিনের কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু করা যাক ---
"এই যুগটির স্বভাব-বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র এটাই নয় যে এই দু'ধরনের দেশসমষ্টিই এখানে বিদ্যমান --- উপনিবেশ দখলকারী দেশসমষ্টি আর ঔপনিবেশিক দেশসমষ্টি। এই দু'ধরনের দেশসমষ্টি ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের পরনির্ভর দেশ এখানে বর্তমান ; --- আনুষ্ঠানিক দিক থেকে এইসব দেশ রাজনৈতিক ভাবে আত্মনির্ভর কিন্তু আসলে অর্থগত এবং কূটনৈতিক পরনির্ভরতার জালে তারা আবদ্ধ। এক ধরনের পরনির্ভর দেশের কথা আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি --- আধা উপনিবেশের কথা।" (সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় নামক পর্যায়, পৃষ্ঠা-৭৯)
"প্রকৃতি এবং সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই যে ক্রান্তিকালীন রূপসমূহ (transitional forms) আমরা প্রত্যক্ষ করি, তেমনি ধারা ক্রান্তিকালীন রূপের উদাহরণ হলো 'অর্ধ-উপনিবেশিক' রাষ্ট্রগুলি।"(ঐ - পৃষ্ঠা ৭৬)।
"অর্ধ-ঔপনিবেশিক দেশগুলি 'মধ্যবর্তী পর্যায়ের' একটি প্রতিভূস্থানীয় দৃষ্টান্ত।" (ঐ-পৃষ্ঠা- ৭৬)।
লেনিনের উপরোল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলোর মধ্যে 'ক্রান্তিকালীন রূপ' ও 'মধ্যবর্তী পর্যায়ের' বলতে কী বোঝায় ? বোঝায় এটাই যে, প্রথমত এই ধরনের দেশগুলি রাজনৈতিক স্বাধীনতা-হীনতার সম্মুখীন হয়নি, কিন্তু সেই স্বাধীনতা-হীনতার সম্ভাবনা বিদ্যমান রয়েছে এবং সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তারা মধ্যবর্তী পর্যায়ে রয়েছে, কারণ তারা পুরোপুরি স্বাধীনও নয় আবার পুরোপুরি পরাধীনও নয়। ক্রান্তিকালীন রূপ ( transitional form) বলতে এটাও বোঝায় যে, সম্ভাব্য স্বাধীনতা-হীনতার প্রবণতা থাকার কারণে এইসব দেশ-এর, অন্যান্য বিভিন্ন দেশের ওপর বিভিন্ন সময়ে, কমবেশি মাত্রায় নির্ভরশীলতা থাকতে পারে। এ ছাড়াও, এই সমস্ত দেশগুলির ওপর সম্পূর্ণ আধিপত্য কায়েম করাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারে। এ কথা লেনিনও পরিষ্কার করে ব্যাক্ত করেছেন এই বলে যে, "মহাজনি পুঁজির যুগে, বাকি জগতের ভাগাভাগি যখন সমাধা হয়ে গিয়েছে, তখন এই আধা-স্বাধীন দেশগুলির জন্য সংগ্রাম যে তিক্ত রূপ ধারণ করবে, তা স্বাভাবিক।" (ঐ - পৃষ্ঠা-৭৬)।
বস্তুত, আধা-উপনিবেশগুলিকে প্রথমে নিজেদের বন্ধুত্বমূলক কর্তৃত্বের প্রভাবাধীনে নিয়ে আসা ও তারপর সেটিক উপনিবেশে পরিণত করার চেষ্টায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে।
এই ধরনের দেশগুলিতে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী মুৎসুদ্দি চরিত্র সম্পন্ন হয়। লগ্নি পুঁজির কঠিন বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসার মত শক্তি তাদের থাকে না এবং তারা সেটা করেও না, এইজন্য নয় যে তারা সেটা চায় না, বরং এইজন্য যে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির সাথে টক্কর দেওয়ার মত পুঁজির জোর তাদের থাকে না। উল্টে তাদেরকে নিজেদের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। এই লগ্নি পুঁজি, বৃহৎ বুর্জোয়াদের কাছে আসে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (FDI) বা ফরেন ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টমেন্ট (FII) বা ঋণ ( Loan) হিসেবে, যা বিভিন্ন ফরেন ব্যঙ্ক, যেমন Deutsche Bank, Morgan, Credit Suisse, Standard Chartered, Goldman Sachs প্রভৃতি মারফত। আধা-উপনিবেশিক দেশগুলোর লগ্নি পুঁজির ওপর নির্ভরশীলতা এই কারণে থাকে যে, দেশগুলি বিকাশ-উন্মুখ ও পরিবর্তনকালীন (transitional) স্তরে অবস্থান করে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে এই নির্ভরশীতলতার স্তরেরও আবার তারতম্য থাকে, যেমন পাকিস্তান আর্থিকভাবে ভারতের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল একটি দেশ।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে আধা-উপনিবেশিক দেশগুলির রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকা সত্বেও অর্থনৈতিক ভাবে তারা সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে ধীরে ধীরে সেগুলি ঔপনিবেশিক শোষণের জালে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং ফলস্বরূপ একটু একটু করে সেগুলি স্বাধীনতা-হীনতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন